(২) ডায়-ডামা-নিকা
মোবাইলটা টুপ করে প্যানের মধ্যে পড়ে গেল, আর আমিও সোজা হাত চালালাম তার উদ্দেশে। রান্নার প্যান নয়। কমোডের ভারতীয় বেরাদর। তাও আবার পাবলিক টয়লেটের।
আজ্ঞে, ঠিক শুনেছেন। এক শীতের মনোরম সকালে, মানুষ যখন সামান্য ফিলোসফিকাল হয়ে, টুথব্রাশটা গালে গুঁজে বা না গুঁজে, চোখ পুরোপুরি খুলে বা না খুলে, নানাবিধ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার প্রতি নেহাত বাধ্য হয়েই সুবিচার করতে চেষ্টা করে - সে’রকম এক স্বপ্নিল প্রহরে, আমি দু’চোখের তলায় পুরনো-অ্যালুমিনিয়াম-কড়াইয়ের-কানা-জুড়ে-লেগে-থাকা একপোঁচ কালি নিয়ে, এক পাবলিক ইন্ডিয়ান ল্যাভেটরির সেরামিক প্যানের কৃষ্ণগহ্বর-সদৃশ গর্তের ভেতরে হাত চালালাম।
কেউ কখনও এ-সবের জন্যে মেডেল-ফেডেল দিল না বলে সামান্য আক্ষেপ রয়ে গেছে। এ জিনিস করতে কতটা সাহস লাগে জানেন? দাঁড়ান, আপনাদের তো পরিবেশটাই বলা হয়নি! ওই যে টয়লেটটি, যাতে এই বঙ্গতনয় সবে প্রাতঃকৃত্যের তোড়জোড় শুরু করেছে, সেটা আসলে এক বিশা-আ-আ-ল হোস্টেলের একতলার কোণের একটি টয়লেট, আর তার পাশেই – ফুটবল মাঠের মত সাইজের – হোস্টেল ক্যান্টিন। অন্তত ১৫-২০ জন মানুষ সেখানে কাজ করেন, যাঁরা সকলেই ওই টয়লেটটি ব্যবহার করেন। আর ব্যবহার করে - প্রায় জনাচল্লিশ ফার্স্ট-ইয়ার বি-টেক-এর ছাত্র।
অভিজ্ঞ-জনে এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন – টয়লেটটির অবস্থা ঠিক কি হতে পারে। যাঁরা বোঝেননি, তাঁদের জন্যে ব্যাখ্যা দিই – সদ্য বারো-ক্লাস পাশ করে আসা, জীবনে ঘরের কুটোটি ভেঙে দু’টো না করা, শরীরে হরমোনের আগ্নেয়গিরি, মাথার ওপর সিলেবাসের চাপ আর জীবনে হঠাৎ-করে-পাওয়া কো-এডুকেশনের সুযোগ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ওই অনূর্ধ্ব-কুড়ি ছোকরাগুলির আর যা-ই থাক, নিজের এবং অন্যের হাইজিন নিয়ে মাথা-ঘামানোর সময় নেই। তাদের উদ্বায়ী মগজ একইসাথে ভেক্টর-ক্যালকুলাস আর সামাজিক-সৌজন্য কম্পিউট করতে পারে না।
--
এ প্রসঙ্গে আর একটা গল্প মনে পড়ে গেল – আমারই এক অনুজপ্রতিম, ধরে নিন নাম তার ‘স’ – যে নিজে তখন ডক্টরেট করছে – বি-টেক ফার্স্ট-ইয়ারের টিউটোরিয়াল ক্লাস নিতে গিয়েছিল। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সকাল ৮টা থেকে ক্লাস। কাঁড়ি কাঁড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র-ছাত্রী দিয়ে ভরা কম্পিউটার ল্যাব। সেদিন স নাকি, ঘরে ঢোকার পর, মাত্র ১০ মিনিট পরে ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে আসে। ঘন্টাখানেক পরে, আমরা যখন আয়েস করে শীতের সকালের রোদ-পিঠে চায়ের দোকানে গল্পটা শুনছি – তখনও স-এর মুখের অবস্থা পুরো স্বাভাবিক নয়।
“বিশ্বাস করো – আমি অভ্যেস করে ফেলেছি। সোমবার সকালে, ওরা গোটা উইক-এন্ডের স্নান-না-করা গায়ের গন্ধ, দাঁত-না-মাজা মুখের গন্ধ –এসব নিয়ে হাজির হবে, আর আমায় সোনামুখে সকাল সকাল সেই বিষাক্ত গ্যাস হজম করে অঙ্ক কষাতে হবে। মেনেও নিয়েছিলাম। কিন্তু, মাইরি বলছি – যখন খাতা-দেখার নাম করে ওই অতগুলো ছেলে টেবিলের চারপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়লো না...”
আক্ষরিক অর্থেই, স-এর মুখের দিকে চেয়েই সেদিন আর আমরা ওকে কিছু বলতে জোর করিনি। এ অভিজ্ঞতা তো আমাদেরও কম না!
--
যাক গে, যা বলছিলাম। বেশ কিছু কুচ্ছিত-নোংরা-হাইজিনের-ছাত্র আর শিফটে কাজ করা বেশ কিছু কিচেন-কর্মীর (যাদের ওই অঞ্চলে থাকতে হয় না) কৃপায়, বাথরুমগুলির দশা নরক-সমান। এবার, মনে যদি প্রশ্ন জাগে – “এতকিছু জেনে-বুঝেও, তুমি বাপ কি-কুক্ষণে মরতে ওখানে গেচিলে?” – তবে মোক্ষম ধরেছেন! সুস্থ অবস্থায় ও ভুল কেউ করে? তাও তো সেই ‘হাত’ যখন বের করে নিয়ে এলাম, তাতে মোবাইল ছিল কি না – থাকলেও, সাথে আর কি কি ছিল – সে গল্প তো এখনও করিইনি।
কিন্তু তার আগে জানা দরকার, কোন বিশেষ গ্রহ-সংযোগে, কি কি ঘটনা-পরম্পরার ফলে, চোখে কয়েক-পোঁচ কালি নিয়ে, আমি ওই টয়লেটের দরজা খুলে ঢোকার দুঃসাহস করেছিলাম। মাক্কালি! আমার কোনও দোষ নেই!
যত দোষ, আমার এক বন্ধুর। নাম? ধরুন, ‘গ’।
টয়লেট-কাণ্ডের প্রায় বছর দুয়েক আগে, এক ঝিমিয়ে পড়া ইন্সটিটিউটের, দমবন্ধ-করা কিউবিকল-অফিসে দেখা হয়েছিল আমাদের। ওই অফিসটি আমরা শেয়ার করব – এমনটা ঠিক করেছিলাম দু’জনে। ব্যাপার হল এই – ঐ কিউবিকলটা ছিল বাকিদের থেকে বড়, আর সে’কারণে তাতে একজন মাত্র (প্রচলিত নিয়ম) বসবে না – এমনই ছিল উপরতলার নির্দেশ। আমরা দু’জন ছাড়া আর সকলেই নিজেদের ‘প্রাইভেসি’ নিয়ে সচেতন হওয়ায়, অফিস ভাগ করার দায় আমাদের কপালেই জোটে।
দেখা হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারি – একে অন্যকে অনেককিছু দেখানোর-শেখানোর আছে আমাদের (মেনে নিতে ক্ষতি নেই, গ-ই অনেক বেশি কিছু শিখিয়েছিল আমায়)। তার মধ্যে একটি হল – তার পাঠাভ্যাস। কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারলাম – সে মোটেই আমার চেনা-ছকের বইপত্র পড়ে না। কি সব উদ্ভট নামের বইয়ের কথা বলে, আর ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখতে পাই – সেগুলোর জনপ্রিয়তা যথেষ্ট! তার সঙ্গেই কোনও এক আড্ডায় গ আমায় বোঝাচ্ছিল, ফ্যান্টাসি-সায়েন্স ফিকশন নিয়ে তার ভালোলাগার কথা। গ কোনওকালেই বেশি কথা বলার লোক নয় (নেশাভাঙ না করলে; মদালস অবস্থায়, বাচালতায় সকলকেই টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে আমাদের পেশার মানুষজন)। আসিমভ, হ্যারি পটার, ওই আগের পোস্টে উল্লিখিত ইনহেরিটেন্স-সাইকল – এসব পড়েছি শুনে গ একটু হাসল (সামান্য condescending-ই হবে[১] )। বলল, ‘পড়েই দেখো অন্য একটা বই’।
পড়ে দেখলাম। এখন জানি, ভেবেচিন্তেই – এই জঁরায় অনভ্যস্ত মানুষের পক্ষে হজম করা সহজ ভেবেই ঐ বইয়ের নাম বলেছিল গ আমায়।
ভারতের সমুদ্রতীরে একশ্রেণীর মানুষ পাওয়া যায়, যাঁরা আপাদমস্তক সেজেগুজে, কখনো প্যান্ট - কখনো শাড়ি গুটিয়ে, জলের সাথে অনেকক্ষণ ছোঁওয়া-ছুঁয়ি খেলেন, আর জল গোড়ালির উপরে উঠলেই মনে করেন – সমুদ্র-স্নান শেষ। আমার অবস্থাও যে সে’সময় ঐরূপ ছিল, সেটা বুঝলাম প্রায় দু’বছর ধরে। ঐ টয়লেট-কাণ্ডের সমসময়ে, আমি প্রায় লাইফগার্ড-সদৃশ সাঁতার-পটু হয়ে উঠেছি ফ্যান্টাসি-সমুদ্রে। সে গল্প পরে।
তার আগে বলি, গ আমায় কি পড়তে দিয়েছিল। বইটার শুরু এভাবে –
একটু বেশিই তুলে দিলাম কি? হোক গে। কিন্তু বলুন তো, যে চিত্রকল্পটা তৈরি হল মাত্র ৩ প্যারাগ্রাফে, তারপর বইটা হাত থেকে নামানো যায়? বইয়ের নাম, ‘The Final Empire’। একটি বই-ত্রয়ীর প্রথম বই এটি। পুরো সিরিজের নাম ‘The Mistborn Series’। ছোট করে বললে, কি নিয়ে এই বই? বইয়ের লেখককে এ প্রশ্ন প্রায় নিয়মিত করা হয়, আর উত্তরটাও সম্ভবত তাঁর গাঁত হয়ে গেছে:
[১] এ কথাটার বাঙলা জানা নেই।
1 এর বাংলা প্রতিশব্দ 'ক্ষমাসুন্দর' হতে পারে
@Ramit, সত্যিই কি তাই?
"Having or showing an attitude of patronizing superiority"-র বাংলা কি ক্ষমাসুন্দর করা যায়?