"আয়নার জল যেন দেখে আকাশের মুখ-কস্তুরীগন্ধ চুল যেন আশশ্যাওড়ার ডাল,
ঝুঁকে দেখে কেমনতরো দিয়েছে উড়াল
বালিহাঁসেরা; চইচই ডাক আর ধুকপুকে বুক-
সেখানে জমেছে বরফের স্বাদ লোনা?হবেও বা।"
পারু চুল আঁচড়াচ্ছিল, ঝাড়া চুলে জল লেগে আছে কিন্তু কিছু করার নেই-রোদ্দুরে বেরোলেই শুকিয়ে যাবে।
আপনমনেই একবার গজগজ করলো-"ইস, কত্তো দেরি হয়ে গেল, বাজারে ভিড় হয়ে যাবে, রাস্তাটা জ্যাম হবে..."
পেছনে পেপারটা একবার খসখস আওয়াজ তুলে চুপ হয়ে গেল, মানে পাতা উল্টোনো হচ্ছে বিবিজানের।
চোখের তলাটায় এখনো একটু ফোলা আছে, লালচে হয়ে আছে, পাত্তা দেবার দরকার নেই, খালি কাজলটা একটু সরু করে আজ পরা দরকার।
মৌরিদি ডাকল- " পারু, ব্রেকফাস্ট খেয়ে অফিস বেরোবি কিন্ত, আর বৌমাকে বল চা টা নিয়ে যেতে তোদের দুজনের, তোর টিফিনটাও প্যাক করে রেখে দিইচি টেবিলের উপর, নিয়ে যায় যেন, ব্যাগে ভরতে ভুলবি না-আমি আসি এখন, চৌধুরিদের ফেলাটে যেতে হবে---"
পেছনে চেয়ার ঠেলে মেঘা উঠেছে, পারু দেখতে পাচ্ছে ওর গায়ের চাদরটা জড়ানো, চুলটা এলোমেলো, মুখচোখ ধুয়েছে, আজ বোধহয় চান-টান করবে না, যা ঠান্ডা!
মেঘা টেবিলে খাবারগুলো এনে রাখলো, দরজা টেনে দিল মৌরিদি বেরোনোর পর, হাতা,বাসন-থালার টুংটাং সবই শুনতে পাচ্ছে পারু, কিন্তু মেঘার মুখে টুঁ শব্দটি নাই, ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
পাশের বাড়ির রেডিওতে গান বাজছে-"এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিলো দ্বার-"। আয়না দিয়ে দেখতে পাচ্ছে পারু, বোসেদের বাড়ির ছাদে আলসের উপর গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, অ্যাডেনিয়ামের মেলা বসেছে, জানান দিচ্ছে সরস্বতী পুজো আসছে, জানলার কোণে পাশের পুরোনো বাড়িটার গায়ে শ্যাওলাগুলো খসখসে বাদামি-সবুজ, ভাঙা ড্রেনপাইপটার গায়েও ছ্যাতলা পড়েছে।আর বারান্দাটাও একটু দেখা যায় আয়নার কোণ দিয়ে, সেখানে মেঘার হাতের পরিচর্যায় মৌসুমি গাছগুলো মাথা দোলাচ্ছে হাওয়ায়, মাথায় মাথায় ফুল ফুটেছে মহারানির মুকুটের মতো, তারি মধ্যে একটু জায়গা করে বিল্লু চারপা-ল্যাজ গুটিয়ে গোল হয়ে পাপোশের ওপর শুয়ে আছে একটু রোদ্দুর হয় কি নয় হয়ে এসে পড়েছে যেখানে।
আটটার খবর শুরু হলো রেডিয়োতে, এবার খেতে বসে পড়তেই হবে। পারু জলদি জলদি হাত চালায়।
শাড়িতে পিনটা লাগাচ্ছে, এমন সময় মেঘা আসে থমথমে মুখে, হাতে মোটা শালটা আগের বছর কাশ্মীর থেকে আনা, স্বগতোক্তির মতো করেই বলে-"আজ খুব ঠান্ডা পড়েছে, ওই পাতলা স্টোলটাতে আটকাবে না-"।
পারু নিয়ে নেয় বাধ্য মেয়ের মতো শালটা, অন্যদিন হলে একটু গাঁইগুঁই করতো হয়তো-এই তো কার্ডিগানটা পড়েছি, এতো ঠান্ডা ও পড়েনি, শালটা পুরো বস্তার মতো-সাত-পাঁচ, আজ তা করা সমীচীন বোধ হচ্ছে না, হাওয়া খারাপ।
ইস, কাল রাতে কেন যে অতো খেল, বিয়ারটা ভালো ছিলো বেশ পার্টিতে, সুমন্ত্রদাটা বা তোর্সা জোর না করলে-নিজের মাথাটা নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করে পারু র। একেই মাথাটা হ্যাংওভারের জন্য ভার হয়ে আছে, চোখ-মুখে ঘুমের পাতলা চাদর জড়ানো যেন, চোখের তলায় কালি আর ফোলা, যতোই লেবু-জল খাক না কেন। তবু ভাগ্যিস ওরা দুজনে মিলেই তাড়াতাড়ি পারুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছিলো রাত্তিরে, নইলে মেঘা আরো দুশ্চিন্তা রাগারাগি করতো।
রাগারাগি করলে করুক ক্ষতি নেই, ওই মুখভারি, চোখ ছলছল, মেঘজমা মুখকে ভারি ভয় করে পারু, ভয় করে এই অতল নৈঃশব্দ্যকে, যখন তার শান্ত-শান্ত হাসিখুশি কৃষ্ণকলি দিদিমণি বৌটা গম্ভীর হয়ে যায়, নিঃশব্দে চোখ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে মুক্তোর মতো নিটোল সব দুঃখ, মায়া হয় একটা কেমন তিরতিরে কষ্ট বুকের ভেতরে।
এসবই এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে কাজল লাগাচ্ছিল পারু, ডান চোখের কাজলপাটিতে পেন্সিলটা একটু ঘন করে বোলাতে গিয়ে আয়নায় চোখে পড়লো পেপারের আড়ালে দুজোড়া চোখ চকচক করছে, থুড়ি চশমার কাঁচে সূর্যের আলো এসে ঠোকর মারছে, আর তার পেছনে দুটো চোখে কেমন যেন সূর্যের সাতরঙা আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। চোখাচুখি হতেই পেপারের আড়ালে মুখ ঢাকলো আবার।
পারুর মনে মনে হাসি পেলো।
নাহঃ, এ পাগলিকে নিয়ে আর পারা গেল না।
খুব মন দিয়ে চোখে চশমা এঁটে পেপার পড়ছে, জগৎ-সংসারের পানে ভ্রূক্ষেপ নেই, পেপারটা উল্টো করে ধরা যদিও, তাড়াহুড়োয় হুঁশ নেই-পারু গুঁড়ি মেরে পুরো বাঘের মতো এগোল, অফিস আজ ডকে, সুমন্ত্রদারা সামলে নেবে'খন।
হুড়মুড় করে একটা শব্দ হল, চেয়ার দুজনের চাপ নিতে পারেনি ফলে দুজনেই পেপার এবং যাবতীয় ধড়াচুড়ো শুদ্ধু পপাত ধরণীতল।
অস্পষ্ট একটা ফোঁপানির আওয়াজ, তার মধ্যে জড়িয়ে জড়িয়ে যে কটা কথা ভেসে এলো সেগুলো এর'ম-"কাল....অত গিলে এলি কেন??...দাঁড়াতে পারছিলি না সোজা হয়ে, আমার খারাপ লাগে না বুঝি? কতোবার বলেছি ওসব ছাইপাঁশ খেলে বুঝেশুনে খাবি, আমার চিন্তা....হয়...কাল টলছিলি, ওই অবস্থায় বাইক চেপে এসেছিস, তোর্সা তোর গায়ে কিভাবে খালি ঢলছিল...যাঃ, আমার ভালো লাগে না, আবার নাটক করছে! আহহহ...!"
আর কিছু বলার সুযোগ পেল না মেঘা, পারু ততক্ষণে ঠোঁট দুটো চেপে বন্ধ করে দিয়েছে....।
তারপর?তারপর আর কী, ঝড় উঠলো ঘরে, উথালপাথাল বাসন্তী বাতাসে। লুটোপুটি গেল শাড়ি, চাদর, নাইটি, পেপার-হু হু করে দামাল দস্যুর মতো দখিনা হাওয়া এতোলবেতোল বইতে থাকল।
কিন্ত্ত শেষেরও তো একটা শেষ থাকে।
তাই পারু এখন বলছে-" সরি বাবু, ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না-কাল আসলে অনেকদিন পর অফিসে পার্টি আর এই প্রজেক্টটাও চাপের ছিল; তুই তো জানিসই-আজ লাঞ্চ বাইরে?উঁউউউ?"
মেঘা বললো-"যা, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম, কিন্ত্ত বাইরে খাব?... মৌরিদি যে রান্না করে রেখে গেল--।"
"গুলি মার, ইয়ে মানে, রাতের বেলা খেয়ে নেব সব, এখন চ'।"
"ঠিক আছে, চল তাহলে রেডি হই, তোর ও তো সব সাজ ঘেঁটে গেছে, নতুন করে সাজতে হবে আবার, আর....হিহিহিহিহি...তোর কাজলটা ঘেঁটে গিয়ে তোকে না...তোকে না পুরো পান্ডার মতো লাগছে একটা...হেহেহে"।
পুরো ঘর কলকলানিতে ভরে উঠলো, বাইরে বসন্তের প্রথম কোকিল ডেকেই যাচ্ছে ঘোড়ানিম গাছটা থেকে, আর বেশি দেরি নেই আসার।
Amazing Illustration credit:-@opudraws(follow on insta!!!)
P.s:- এটা ছবি দেখে গল্প( wlw/gl romance fiction) :))
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।