ডিয়ার মাস্টারমশাই ,
কেন প্ল্যান বি নেই আপনাদের?
সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েক হাজার শিক্ষক গ্রুপ। তাতে আমার দেখা প্রায় সারাদিন ধরে কয়েকশ পোস্ট। বেশিরভাগটাই দুয়ারে আসার তাড়া তাও ব্যকলগে। দুয়ারে সরকার নিয়ে খিল্লি করা মাস্টাররা আজকাল মায়ের,মাসির, পিসির, নিজের কষ্ট দুর্দশার দুখ ভরা কাহিনি লিখে হেই বিকাশভবনে লম্বা লাইন। এই করোনার মার্কেটেও। কেউ বাদ নাই। কোচবিহার টু কলকাতা সব্বাই লাইনে। হাজারে হাজারে। কোন রকমে ফর্ম গলিয়ে রাজ্য জয় করার পর পরই মুখে নেভি কাট লাগিয়ে উক্তি করেন= একবার চেঞ্জ দরকার। সেন্ট্রাল আর স্টেট সেম হওয়া উচিত। শিক্ষা নিয়ে কিছু শুনেছেন?
এরপরেই আসে ক্রিয়েটিভিটি। শিক্ষার প্রথম সারিতে থাকা মানুষজন ক্রিয়েটিভ হবেন এটা স্বাভাবিক। আমার আপত্তি নেই। আমার আপত্তি অন্য জায়গায়। আমার এক পরিচিত মাস্টারমশাই সোশ্যাল গ্রুপে জ্বালাময়ী কবিতা আবৃত্তি করে ফাটিয়ে দিচ্ছেন। সাধু সাধু। গল্পটা হচ্ছে ব্লক লেবেল বা পাড়া লেবেল এও ওনার স্কুলের কোন ছাত্র বা ছাত্রীকে দেখেনি কোন আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়। ওনার স্কুলের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম ওরা জানেই না অমুক মাস্টারমশাই এত ক্রিয়েটিভ বলে। তা মশাই এই সোশ্যাল গ্রুপ ক্রিয়েটিভিটি সমাজের কি লাভ দিলো। মানে ধরুন আপনি হাসপাতালের ডাক্তার, কিন্তু আপনার হাসপাতালের লোকজন জানেনই না আপনি চিকিৎসা করেন। তা এতে কি সম্মান বাড়ে?
কী জানি? আমি মূর্খ লোক।
কয়েকবছর আগে পর্যন্ত্ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার মোটামুটি দুটো ভাগ ছিল। প্রায় ৯০ ভাগ সরকারি শিক্ষায় আর ১০ ভাগের মত বেসরকারি, তার বেশিরভাগটাই শহর কেন্দ্রিক। মোটামোটি একটু উচ্চবিত্ত বা অবাঙালি মানুষজন CBSE বা ICSE বোর্ডগুলোকে প্রাধান্য দিলেও আমবাঙালি কিন্তু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপরই অগাধ বিশ্বাস রাখতেন। কারণ যাই হোক না কেন এখন পরিসংখ্যান ঠিক উল্টো। নিম্নআয় থেকে আমলা সবার একটাই লক্ষ্য – ‘ইংলিশ মিডিয়াম’। যারা পড়ছেন বা যারা পড়াচ্ছেন তারা নিজেরাও জানেন এগুলো একপ্রকার ট্যাবু। না হলে যে অভিভাবক গতকাল পর্যন্ত্ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দোরে হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন একটা সিটের জন্য, তিনিই কিন্তু আজ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফিস কমানোর আন্দোলনের প্রধান মুখ। যে শিক্ষক শিক্ষিকারা কর্পোরেট ব্যাচ গলায় ঝুলিয়ে ব্র্যান্ডেড স্কুলগুলোতে ঝাঁ চকচকে ক্লাসরুমে পড়াচ্ছেন তাদের অনেককে সরকারি প্রাইমারি বা SSC এর টেট এর পেছনে ছুটতে দেখেছি। তার মানে শিক্ষার কোয়ালিটি বেসরকারিতে ভালো, এটা একশ ভাগ সত্যি নয়। এতগুলো কথা বললাম কারণ খোঁজ নিয়ে দেখবেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু প্রতিনিয়ত অনলাইন ব্যবস্থায় পাঠক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আগামী কয়েক বছর পর ওনারাই আবার বিজ্ঞাপনের জন্য এইসব ব্যবহার করবেন।
কিন্তু সরকারি শিক্ষা?
বললেই বলবেন কেন হোয়াটস আপ-এ তো চলছে, বললেই বলবেন গ্রামের ছেলে আলাদা ফোন নেই তো, বললেই বলবেন ধুর নেট ওয়ার্ক তো নেই ইন্টিরিয়রে, বললেই বলবেন সরকার কী করছে? বললেই বলবেন আমরা সামান্য চাকুরিজীবি। সত্যিটা কী আপনি নিজেও জানেন।
ইদানীং সব ব্যাপারে চোখেআঙুলদাদা হয়ে সব্বাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন, শিক্ষকরাও পিছনে নেই। সে পান দোকানির মুখে মাস্ক নেই কেন হোক আর প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর খুঁত ধরা হোক। সব জায়গায় হিট শুধু শিক্ষা কিভাবে এগোবে ওটা ছাড়া। প্রায় ১৬ মাসের ওপর স্কুল বন্ধ... তিনটে জেনারেশন পুরো অন্ধকারে। কিভাবে এই অপূরণীয় ক্ষতি মেকআপ করা যাবে তার কোন সুরাহা দেখেছেন? দেখেছেন কোন আলাপ আলোচনা করেছেন এ নিয়ে? খুউউউব কম। সারা বছর শিক্ষামন্ত্রীর সব মতের সঙ্গে মাস্টারদের বিরোধ থাকলেও ১৬ মাস ছুটি কিন্তু কোন প্ল্যান বি নেই; এই মতের সঙ্গে ওনাদের কোন বিরোধ নেই। বললেই বলবে কেন চাল ডাল দিতে স্কুলে তো যাই। তা মশাই একবারও প্রতিবাদ করেছেন কেন মাস্টাররা চাল আলু বিলি করবে? কেনই বা কেন এক বছর ধরে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা গেল না? আপনি বলবেন কেন অনলাইন ক্লাস করছি তো হোয়াটস আপ-এ... হাটে হাঁড়ি আর ভাঙলাম না, রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ যে সেটা পারে না এটা কি আপনার থেকে আর বেশি কেউ জানেন। তাও আপনি চুপ। কোভিড ভয় সব্বার আছে। আমারও। একবারও ভেবেছেন ঠিক একই অজুহাতে যদি ব্যাংক,হাসপাতাল আর পুলিশবাহিনী কাজ বন্ধ করে দেন তা হলে কি হবে।
আমি একবারও বলছি না স্কুল খুলে দিন। আমি একবারও বলছি না আমি ঠিক। আমি শুধু এটাই বলছি যে গত এক বছর ধরে পশ্চিম বঙ্গে সব পরিষেবা (মদ দোকান থেকে সোনাগাছি পর্যন্ত্) প্রায় ৮০ শতাংশ সচল আছে।
ব্যতিক্রম শুধু শিক্ষা।
বুনিয়াদি শিক্ষা।
মাস্টার মশাই মনে রাখবেন আপনাকে ছাড়া কিন্তু শিক্ষা চলছে।
এক বছর ধরে।
আপনাকে ছাড়া।
একদিন আপনাকে বাদেও শিক্ষা চলতে পারে।
অবাস্তব ভাববেন না, যেমনটি মাস্টারডিগ্রি করে চাল আলু দেবেন ভাবেননি, এটাও ঠিক সেরকম।
চলুন প্ল্যান বি ভাবি।
সুপার্ব।..
একমত। আমার বৃত্তি শিক্ষকতা। আমার অধিকাংশ সহকর্মী মনে করছেন যা চলছে ভালো চলছে। গতবছর প্রথম আড়াই মাস ও পরের চাল ডাল বিতরণ মিলিয়ে কাজের দিন 87। আমরা নীরব। ভাবছি ভালো আছি। জনতা বিদ্যালয় নামে একটা প্রস্তাব রেখেছিলাম একবার। নিজে যেখানে বাস করি সেখানকার ছাত্র ছাত্রীদের কোনো ক্লাব ঘরে একত্রিত করে পড়ানো শুরু হোক। কেউ পাত্তা দেয় নি।
আজ্ঞে,.. প্রায় মরা আমরা।আগে গাছ তলায় পড়াতুম।এখন ফোনে ফোনে, কানে কানে পড়াতে চাই। কিন্তু আমায় বেঁধে রেখেছে,চাল আলুর গুদমে।
আমার what's app নম্বর টুক যদি পৌঁছে যেত ঘরে ঘরে, বেশ গ্রুপ খুলে ওয়ার্ক শিট আর অডিও করেও কিছু পাঠ দিতাম।কিন্তু।..
ওই যে।... অর্ডার এর অপেক্ষা।.. আমরা পেরাইমারি।.. বড্ড ভয়..
ভালো লাগলো।
এপারেও শিক্ষার একই হাল। লুডু খেলতে খেলতে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া সব ভুলতে বসেছে।
বেসরকারি স্কুলের বেতন বন্ধ প্রায় দেড় বছর। এক শিক্ষক আপা বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না, শেষে বাসা ছেড়ে স্বপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন স্কুলে, আরেকাংশে খুলেছেন বিষমুক্ত আমের দোকান!
শুধু শিক্ষকদের দোষ দেওয়া যায় না, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন কেও দায় নিতে হবে সঠিক নীতি নিতে না পারার জন্য, কেউ একবার ভাবছে না ভবিষ্যতে এই ব্যাচের ছাত্র ছাত্রীদের কাজের বাজারে কোন বিরম্বনায় পরতে হবে।