“বেশরম” চেঁচিয়ে উঠলেন বাদশা। সহবত ভুলেছ শাহজাদি? বাবার সামনে কীভাবে দাঁড়াতে হয় জান না? বে-আব্রু? পোশাক ছাড়াই চলে এসেছ?
—পোশাক ছাড়া? এ কী বলছেন আপনি জাঁহাপনা? এই কাপড়টি আমার শরীরে সাত পাক ঘুরেছে।
—এ তাহলে কী পোশাক? সাত স্তর ফুটে দেহ দেখা যায়?
আহা! জেব উন্নিসার কপালটাই খারাপ। জীবনটাই কেটে গেল বন্দিদশায়, সেলিমগড় দুর্গে। লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখত, একটা নমুনা এরকম—
“শিল্পী আমার প্রতিকৃতি আঁকতে চাইছে কেন?
দীর্ঘশ্বাসকে কি আঁকা যায়?”
নিজে তিনি যেনএকটি দীর্ঘশ্বাস। পরে আছেন এমন পোশাক যা আবার দেখাই যায় না। এমন কাপড় কোথায় বোনে? এ যেন বাতাস কাপড়ে সেলাই, এ যেন নির্মল বহতা জল, এ যেন ভোরের শিশির। নরম, ফুরফুরে, স্বচ্ছ।
এর নাম আভরণ।
একখানা আভরণের দাম ছিল চারশো টাকা। আজ থেকে তিনশো বছর আগে। ওজন ছিল পাঁচ ভরি। আংটি দিয়ে গলে যেত হাওয়ার মতো স্বচ্ছ ফুরফুরে মসলিন।
এই আশ্চর্য সব আভরণ বোনা হত দেশের পুব দিকে। তাদের উৎস ঢাকা মুরশিদাবাদ, আরও বিশেষ করে বললে কাশিমবাজার। এই আভরণের মোহিনী মায়ায় কত বিদেশি বণিকেরা মধুলোভী মৌমাছির মতো এখানে এসে চাক বেঁধেছিল।
কবিদের কলম লিখেছিল বহতা জল, ভোরের শিশির আর বাতাসে সেলাই করা পরিধেয়র কথা। স্বপ্নের মতো!
এমন একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন আরও একজন। তবে সে স্বপ্ন অনেক দুরন্ত ছিল, ঝড় ছিল অনেক বেশি। কী স্বপ্ন দেখেছিল মহম্মদ হাদি?
ইরানের ইস্ফাহানে তার মালিক হাজি সাফির কাছেই বড়ো হয়েছে সে। সে ছিল আদতে হিন্দু ব্রাহ্মণ। সূর্যনারায়ণ মিশ্র এক দক্ষিণি গরিব বিকিয়ে গেল পারসিক বণিকের হাতে। ইস্ফাহানে সেই ছেলে জমকালো শহর কাকে বলে তা নিজের চোখে দেখল। দেখল সাঁঝের বেলা চেহেল সুতুনের আলোর তরঙ্গ। কুড়িটি স্তম্ভ দিয়ে ঘেরা এক প্রমোদ সরোবর। সরোবরের জলে কুড়িটি স্তম্ভের সন্ধ্যাবাতির কুড়িটি ছায়া। মনে হচ্ছে যেন চল্লিশটি আলোকিত স্তম্ভ বাগ এ আতশ বানিয়েছে কী অপূর্ব খেলায়। এই উদ্ধত রোশনাই সেই ছেলেটার মাথার এককোণে বসে গেল।
মনিব তাকে হিন্দোস্তানে ফিরে যেতে বলল। দেওয়ানির কাজে ছেলেটির মাথা খুব সাফ। রাজস্ব হিসেবনিকেশ পয়সাকড়ি সংক্রান্ত কাজে তুখোড়। হায়দ্রাবাদের দেওয়ান হয়ে খোদ আওরেংজেবকে খুশি করে দিল সে। অতএব ধীরে ধীরে সম্রাটের নজরে আসা এবং বাংলা সুবার দেওয়ানির দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় তার আগমন। এখানে একটা মজার গল্প আছে। দক্ষিণের বুরহানপুরে আওরংজেবের মাসির বাড়ি। সেখানে হারেমের জাইনা বাদির প্রেমে পড়েছিলেন আওরংজেব। আজ্ঞে হ্যাঁ, তার জীবনেও প্রেম এসেছিল। কিন্তু তার মেসো সইফ খান ছিল খুব খিটখিটে লোক, সুবিধের নয়। তখন এই মহম্মদ হাদিকেই আওরংজেব পাঠিয়েছিলেন দূতিয়ালি করতে তার মেসোর কাছে। তা সে দূতিয়ালি সফল হয়েছিল বটে। ইতিহাসে এমন কত আসল মজার গল্প গোপনে হারিয়ে যায়!
বাংলা সুবার রাজস্ব তখন রমরমা। মধু আছে ওখানে মধু। বিদেশিরা ভিড় জমাতে পারে আর দেশের সম্রাটের তো পাক্কা হক সেখানে।
নথিপত্র সব চমৎকার। রাজস্ব আদায় পরম সন্তোষের। এর মধ্যে মহম্মদ হাদি চলে এসেছে ঢাকা থেকে মুখসুদাবাদে।
বিশ্বাসী কর্মচারীকে পুরস্কার দিতে হয়। অতএব এই নাও খিলাত, এই নাও তোমার নতুন নাম মুরশিদ কুলি খান।
আচ্ছা বেশ, জাঁহাপনা। তাহলে শহরের নাম বদলে দিলাম। এই শহরের নাম আজ থেকে হোক মুরশিদাবাদ। আধিপত্যের তকমা এসে পড়ল নতুন শহরের গায়ে। নতুন মুদ্রা ‘জুরবে মুরশিদাবাদ’।
কেল্লা নিজামতের মধ্যে নতুন টাঁকশাল। রাজস্ব আদায়, রাজস্বের হিসেব, রাজস্বের আঁটসাঁট বাঁধন অর্থাৎ একটি তাগড়াই সাপ্লাই চেন এক্কেবারে খোদ দিল্লি পর্যন্ত। তাই করলেন মুরশিদ কুলি। খুব দক্ষতার সঙ্গেই করলেন। নিজেও দেওয়ানির কাজকর্মে বিশেষ পারঙ্গম ছিলেন কিনা।
রাজস্বের কাজে বাঙালি হিন্দুদের তিনি বেশি কাজে লাগিয়েছিলেন।
আগনা প্রাসাদের একটা পুরোনো ছবি দেখা যায়। সে প্রাসাদ এখন আর নেই। আগনা প্রাসাদ, আতশবাজির রোশনাইতে ঝলমল করে উঠছে, এমন একটা ছবি।
ভাগীরথীর মৃদু মন্দ হাওয়ায় ভেসে চলত ময়ূরপঙ্খি নাও। অতি মিহি বাঁশফুল চাল, গাওয়া ঘি আর ইলিশের সুবাসে আকাশ বাতাসে সুখ উড়ে বেড়াত। মিহিন সুখ। ওই স্বচ্ছ আভরণের মতো জড়িয়ে থাকত মুরশিদাবাদকে। পাঁচ মণ চাল পাওয়া যেত একটাকায়। সাধারণ গরিবের মানুষেরর পাতেও দু-বেলা ভাত জুটত। ভাগ্য ভালো হলে পোলাউ কালিয়াও।
না, দেওয়ান থেকে তিনি সুবেদার হলেও ইস্ফাহানের স্বপ্ন মুরশিদ কুলি ভুলে জাননি।
চেহেল সুতুন, হ্যাঁ সেই চল্লিশ স্তম্ভের জৌলুস। জলের মধ্যে কুড়িটি স্তম্ভের উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব, যা তিনি তাঁর প্রথম জীবনে সুদূর ইস্ফাহানে প্রাণ ভরে দেখতেন মুরশিদাবাদের মাটিতে এবারে সেই বিলাস খেলা শুরু করলেন। মোঘল সাম্রাজ্য তখন অস্তমিত।
বাংলা সুবা তখন জাঁকিয়ে বসেছে। স্বাধীনভাবেই কাজ করতেন মুরশিদ কুলি, বিচক্ষণ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, শান্ত।
এই শান্ত মানুষটির একটিই বিবি। নাসিরি বানু বেগম। এরকম আমরা দেখেছিলাম আর-এক মোঘল আমলাকে, আকবরের আমলে আবদুল রহিম খান এ খানান। তাঁরও ছিল একটিই পত্নী। মুরশিদ কুলি সেনাসামন্ত বা প্রতিরক্ষা খাতে খরচ কমিয়ে কোশাগারকে শক্তিশালী করতেই বেশি মন দিয়েছিলেন। বাংলার অর্থনীতির ইতিহাসে এই সময়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ধর্ম অর্থ রাজনীতি বিনুনির মতো একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে জুড়ে খেলা করে। ‘আজানুলম্বিত বাহু’ তুর্ক আফঘানদের ভয়ে বাংলার রাজা লক্ষণসেন পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সুলতানি আমলের পর যে নাসিরি বংশের শাসন শুরু হল তার উৎসে রয়েছেন মুরশিদ কুলি জাফর খাঁ নাসিরি, একদা দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান। আর অর্থনীতি? মরুসন্তানেরা কবজা করে নিল বাংলার অর্থনীতি আজ থেকে তিনশো বছর আগেই। রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে নিন মুখসুদাবাদে। মুরশিদ কুলিকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন খোদ মানিকচাঁদ। মহাজন ও অর্থউপদেষ্টা। মুরশিদাবাদ ও কাশিমবাজারের রমরমা বাণিজ্যিক অবস্থান এক নজরেই বুঝে গিয়েছিলেন দেওয়ানের চতুর খাজাঞ্চি মানিকচাঁদ। ভাগীরথী পদ্মা ও জলঙ্গী নদী দিয়ে ঘেরা কাশিমবাজারে ইতিমধ্যে বিদেশি কুঠিয়ালদের আস্তানা শুরু হয়ে গেছে কিন্তু।
মুসলমান শাসন, ধনভাণ্ডার হিন্দুদের হাতে আর মৌমাছির গুঞ্জনের মতো মধুর চাকের বাইরে বিদেশিদের আনাগোনা। ১৭১৭ সনে দিল্লির সম্রাট ফারুকশিয়ার বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব মেনে নিলেন মুরশিদ কুলিকে। সেই বছরেই ইংরেজরা কলকাতায় বাণিজ্যের অধিকার ও দুর্গ বানাবার অনুমতি পেল। কলকাতা তখন একটা হদ্দ গ্রাম। অসুখবিসুখে নাজেহাল। আর মুরশিদাবাদ নজরকাড়া এক রাজধানী। বিশেষ উপলক্ষে ভগীরথীর তীর বরাবর আলোয় আলোয় সেজে ওঠে সন্ধেবেলা। সন্ধের সময় একবার তোপধ্বনি হবার সঙ্গে সঙ্গেই সব আলো একসঙ্গে জ্বলে উঠত। হাঁ করে দেখত সবাই।
আরও আলো জ্বালিয়েছিলেন মুরশিদ, তাঁর সাধের রাজধানীতে। তখন বাংলার বাণিজ্যে বসত লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর কি জাতধর্ম থাকে ? তখন লক্ষ্মী আসত জলপথে।
ভাগীরথীর জলে কলাগাছ দিয়ে বড়ো বড়ো ভেলা বানিয়ে আলোর মালা সাজিয়ে সে এক বিশাল দীপাবলি শুরু হত ভাদ্র মাসে। বেড়া উৎসব। আজও হয়। ধর্মের ভূমিকা সেখানে কোথায়? এত আলো জ্বালাতে ভালোবাসতেন মুরশিদ?
ইস্ফাহানি আলো তার মাথায় মধ্যে জ্বলে উঠত বোধহয়!
দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ আর চক মিলানো অট্টালিকায় তখন নতুন সাজ মুরশিদাবাদের। আজ যেখানে চক মসজিদ, সেখানেই ছিল চেহেল সুতুন। আর এদিকে নতুন নতুন আলিশান হাভেলিতে গদ্দি বিছিয়ে বসল মানিকচাঁদ সমেত অনেক মরুসন্তান। বণিকের মানদণ্ড সরাসরি না হলেও রাজদণ্ডকে পরোক্ষভাবে চালনা করত।
কাশিমবাজার এক জবরদস্ত ব্যস্ত জায়গা। বাজারে বাজারে উপচে পড়া ভিড়, মহল্লায় পালকি পর্যন্ত ঠিকমতো চলতে পারত না। গৃহস্থের বাড়ির চারদিকে দেখা যেত তুঁত গাছের চাষ। উর্বর নদী মৃত্তিকা। কাশিমবাজারের রেশম হলুদরঙা। কলাগাছের ক্ষার দিয়ে সেই রেশমকে প্যালেস্টাইনের রেশমের মতো সাদা করে দেওয়া হত।
সমৃদ্ধি উছলে পড়েছিল। মুরশিদাবাদকে তুলনা করা হত রানির শহর লন্ডনের সঙ্গে! শুধু আকারে আয়তনে আর জনসংখ্যার ঘনত্বে নয়, বলা হত মুরশিদাবাদে ধনাঢ্য মানুষের সংখ্যা নিঃসন্দেহে লন্ডনের থেকে বেশি।
মুরশিদের পছন্দের বিষয় ছিল গণিত, হিসাব, রাশি রাশি সংখ্যা আর আয়ব্যয়ের খতিয়ান। রাজস্ব আসত কৃষি থেকে জমি থেকে পণ্য থেকে। দুর্ভিক্ষ যাতে না হয়, কেউ যেন পণ্য মজুত না করে, বেশি দামে জিনিস বিক্রি না করে, ইওরোপীয়দের ডেরায় বেআইনি মজুত যাতে না থাকে, এ সব তাঁকে দেখতে হত বইকি! আর এর মধ্যেই লেখা হয়ে চলছিল বাংলার ইতিহাস। সে ইতিহাস লুটেরার ইতিহাস, সে ইতিহাসে থাকে দুর্ভিক্ষের হাহাকার, কৃষক ও জমিদারদের ফুঁসে ওঠা, রাজস্ব আদায়ের ভয়াবহ অত্যাচার। রাজস্ব না দিতে পারলে জমিদারদের হাতের নীচ দিয়ে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে আসা হত। তারপর ঠেলে ফেলা হত বৈকুণ্ঠে। সেটা কী? সে হল নরকের নামান্তর। দুর্গন্ধ আর আবর্জনায় ভরা একটা পুকুর।
তাতে কী এসে গেল? প্রদীপের আলোর তলাতেই তো জমাট কালির চিরস্থায়ী আস্তানা!
ভাগ্যলক্ষ্মীকে বেঁধে কে আর কবে রাখতে পেরেছে? সে যে ওই বহতা জল। ক্ষণিকের শিশিরবিন্দু। বাতাস বুনন। এই আছে এই নেই।
মুরশিদ কুলি শায়িত আছেন কাটরা মসজিদে। কাটরা কথার অর্থ বাজার বা ক্যারাভান সরাই। একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে ব্যাবসাবাণিজ্য দোকানবাজার। এর সঙ্গে সার বাঁধা কুঠরিতে রাত্রিবাসের ব্যাবস্থা। সরাইখানা।
এমন জায়গায় নবাব সমাধিস্থ যার ওপরে বাঁধানো অঙ্গনে এসে পড়ে হাজার হাজার মানুষের পায়ের ধুলো। মানুষের পায়ের ধুলো এসে লাগুক আমার সমাধিতে।
আজিমুন্নিসা, মুরশিদের বড়ো মেয়ের মৃত্যু ঘিরে নানান গল্প উড়ে বেড়ায়। তাকে নাকি জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। দুধের শিশুর কলিজা খেতেন বলে তার নাম কলজেখাকি বেগম। এর স্বামীই মুরশিদের পর তাঁর উত্তরাধিকারী হন। উড়ো কথার খই এমনিই উড়ে বেড়ায়। তবে তিনি অসুস্থ ছিলেন বলে শোনা যায়।
ওয়াসিফ মঞ্জিলে তখন শেষ বিকেলের আলো। ভাগীরথীর হাওয়ার সঙ্গে বিলাসী বিষণ্ণতা। পাখিকে জড়িয়ে থাকা এক নারীর মর্মর মূর্তি। বড়ো সুন্দর প্রাসাদ এই ওয়াসিফ মঞ্জিল। স্যার সৈয়দ নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জা বানিয়ে ছিলেন। মঞ্জিলকে সন্ধের মুখে ছেড়ে এসে আমরা ঢুকে যাই ভগ্নস্তূপের মধ্যে! ভাগ্যিস সঙ্গে ফারুক ছিল। কলেজে ইতিহাস পড়ায়। হাতের তালুর মতো করে চেনে ওর মুখসুদাবাদকে। এসে পড়লাম বলাখানা মানে উঁচুমহলে। এর নাম এক কালে ছিল আমিরমহল। আমিরমহলের জঙ্গল সরিয়ে পায়ে হাঁটা পথে পরিমহল বা বেগমমহলের খন্ডহর।
ফারুখ সাবধান করে দেয়, প্রচুর সাপ আছে কিন্তু! জঙ্গলে থেঁতলে পড়ে আছে বসন্তের শিমুল ফুল। কাঁটাগাছে আটকে আছে লাল শিমুল। যেন কার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়। জঙ্গলের মধ্যে দূর দূর প্রান্তে কেল্লার ধসে যাওয়া প্রাচীর। সব মহলগুলো প্রাচীর ঢাকা জায়গাতেই ছিল এককালে। সাফাভিদ সাম্রাজ্যের চেহেল সুতুন আজও ইরানের ইস্ফাহানে সগৌরবে বেঁচে আছে অথচ মুরশিদ কুলি খানের সাধের চেহেল সুতুন খুঁজে পাওয়া যাবে না মুরশিদাবাদে। প্রাচীন নিদর্শনটি কিন্তু ইরানে দিব্যি হেরিটেজ সাইটের তকমা এঁটে বহাল তবিয়তে আছে! পোড়া কপাল শুধু আমাদের। বড়ো বড়ো মহল, আয়নামহল, নহবতখানা কিছুই আজ বেঁচে নেই।
আমিরমহলের ওপরে চলুন। চলুন না! ফারুকের তাড়া খেয়েই এই বড়ো বড়ো ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে আমিরমহলের ওপরে উঠে পড়ি। ওপর থেকে আন্দাজ হয় কী বিশাল কেল্লার পরিসর। প্রায় সবটাই জঙ্গল। সরকার বাহাদুর আর নবাব বাহাদুরের মামলা মোকদ্দমায় জীর্ণ থেকে জীর্ণতর মহলের হাল। বড়ো বড়ো ঘর। করিন্থিয়ান খিলান। একটি ঘরে মস্ত বড়ো গোল ফাঁকা জায়গাটায় লাগানো ছিল আয়না। সোনামহল, রুপামহল এমন নানা নাম ছিল মহলগুলোর। মেয়েরা, বেগমরা থাকতেন এখানে। রঙিন শিশার ভেতর দিয়ে আলো এসে এক একটা ঘরকে এক এক রকম রঙে রাঙিয়ে দিত। বৈঠকখানায় সোনালি হলুদ। প্রার্থনার ঘরে হালকা সবুজ। শোবার ঘরে নীল। নবাব হাতিতে চেপে বসবেন, তাঁর জন্য উঁচু সিঁড়ি দেওয়া প্ল্যাটফর্ম।
একটি ঘর আচমকা অলৌকিক। গা ছমছমে! কারও অনুভূতির অ্যান্টেনায় ধরা পরে গেল কিছু অর্থহীন শিরশিরানি। বুনো জঙ্গলের ভারী বাতাস।
বেগমদের একটা করে ছোট্ট নাম থাকে, জান্নি, মুন্নি, বুব্বু। এখানে হাল্লু বেগম থাকতে দিয়েছেন এক অদ্ভুত মানুষকে। ভট্টাচার্য মশাই। এই নৈঃশব্দ্য তার ভালোলাগে বোধহয়। সঙ্গে আছে একরাশ বই, পুরোনো স্মৃতি আর পুত্রশোকবিধুর জীবনসঙ্গিনী। হাল্লু বেগমের আসল নাম সাহাবজাদি হাসমত উন্নিসা বেগম। চোখ ধাঁধানো রূপসী ছিলেন নাকি! টমটম চড়ে ঘুরতে বেরুতেন। হাতে থাকত চুরুট। আর ওই যে পরিমহল বা বেগমমহল দেখছেন ওখানে বড়ো বড়ো মেহফিল বসত। কে আসেননি গানবাজনা করতে? জদ্দান বাই (নার্গিসের মা) জানকী বাই ছপ্পন ছুরি, বেগম আখতার।
সবাই আসতেন। ভট্টাচার্য মশাই ভেতর থেকে একটা তলোয়ার নিয়ে আসেন। খুব ধারালো। খুব পুরোনো। তাতে প্রার্থনা খোদাই করা আছে। মিরকাশিমের তলোয়ার নাকি? কে জানে! এই ভাঙা মহল, ওই তীব্র বুনো গন্ধ, নেতিয়ে পড়া শিমুল, এলিয়ে থাকা সাপের খোলস, তার মধ্যেই উনি এনে দেখান এক সুন্দর বৌদ্ধ তারা মূর্তি। সন্ধে ঘন হচ্ছে জঙ্গলের মাথায়। হাতের কবজিতে তখনও লেগে আছে সকালের আতরের মৃদু গন্ধ। পথে ছোটে নবাবের সঙ্গে দেখা। বর্তমান নবারের ভাই। দুর্গা পুজো কমিটির সভাপতি। ভাগীরথীর ভরসন্ধ্যার বাতাস, পুরোনো হাভেলির সামনে চওড়া মাঠ।
এই সন্ধ্যা এই ক্ষণ এই স্তব্ধ অনির্বচনীয় সময়ের চূর্ণ চিত্রের কী নাম দেব জানি না।
খন্ডহর সে খজানা মিলতা হ্যায়
শিকস্ত দিল সে মিলতা হ্যায় সুকুন।
সত্যিই গতবার মুর্শিদাবাদে গিয়ে চারদিকের খন্ডহর খুব বিষণ্ণ করে তুলেছিল। এ লেখায় সেই আলোকোজ্জ্বল দিনগুলোর আনাগোনা। খুব ভাল লাগল।
কাটরা মসজিদে ঢুকতে পারিনি। মহিলারা নাকি পারেন না। কে জানে মুর্শিদকুলি খাঁ বেঁচে থাকলে কী নিদান দিতেন।
ভুল বললাম কাটরা নয়, কাটোয়াতে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের প্রতিষ্ঠিত মসজিদে আমরা ঢুকতে পারিনি। এই কাটোয়াতেই নবাবের প্রথম চৌকি।
বড় ভাল লাগে এই লেখিকার লেখা। ইতিহাসের গল্প এমন করে বললেই পড়ে ফেলা যায় এক নিঃশ্বাসে।
অদ্ভুত !!অপূর্ব !! ইতিহাস কে একেবারে তুলে এনেছেন ছেঁড়া পাতা থেকে !!আরো জানতে চাই !!
পড়লাম। বেশ লাগল।
চমৎকার শুরু। ইতিহাস কবিতা হয়ে উঠেছে লেখিকার বোধে। ছবিগুলোও কথা বলছে। লেখিকাকে ধন্যবাদ।
পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।
জীবন্ত , নাটকীয় , তথ্যসমৃদ্ধ তথ্য
সিনেমা হোক
মুর্শিদাবাদে ইতিহাসের শুরু ইতিহাসের শেষ। আবার শুরু। তাই অজস্র কাহিনি। আর সেসব পড়ছি সুকলমে।
নিজে যেহেতু পলাশীর বাসিন্দা তাই বাড়ির কাছের মুর্শিদাবাদ নিয়ে আগ্রহ একটু বেশিই। মনোগ্রাহী ইতিহাস পড়তে ভালোই লাগল। ছবিগুলোর নিচে যদি এক লাইনের তথ্য দিতেন কোনটা কোন মহল তাহলে আরেকটু ভালো হতো। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
সিম্পলি ওয়াও
যেন টাইম মেশিনে চড়ে ইতিহাসের ভেতর যাত্রা। মসলিন মধু পর্ব শুধুই ঝলক বলে মনে হলো। আদ্যপ্রান্ত ক্রমশ প্রকাশ্য?
কথিত শান্তির ধর্ম ইসলামের (শান্তি) তরবারির গায়ে আরবি হরফ? সহজেই মওলানা ধরে তরজমা করা যেত কী? লেখার বয়ান জানতে ইচ্ছে করছে।
অবশ্য এ আর তেমন কি! বাদশা হুমায়ুনের হেরেমখানার ফটকে নাকি কোরানের আয়াত খোদাই করা আছে।
ক্ষমতা সব পাপাচারকেই বোধহয় বৈধতা দেয়। সে যাক।
খুবই চিত্তাকর্ষক লেখা। তারপর?
বড় সুন্দর।
বেশ মজাদার আদলে লিখেছেন। স্টাইলটা ভাল লেগেছে। নষ্টালজিক বিষয়। একসময় এই মুর্শিদাবাদ ছিল আমাদের পূর্ব পুরুষদের বসতভূমি। ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম মুর্শিদাবাদের নবাববাড়ী। এখন তেমন মনে নেই। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে আর একবার যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে।