ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হবার পর থেকেই ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে’ মন্বন্তর আর মহামারির স্বরূপ ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ শুরু হয়। বসন্ত, প্লেগ, কলেরা, ক্ষয়রোগ, জ্বর, ম্যালেরিয়া সেই দুর্যোগের অভিজ্ঞান স্বরূপ। তবে বাংলার ক্ষেত্রে কলেরা বা বিসূচিকার ঘটনা অন্য মারির থেকে আলাদা। কারণ, এটি একবার নয়, বারবার অতিমারি হয়ে বাংলায় ফেরত এসেছে। আর খালি তাই নয়, শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা কলেরার উৎস হিসেবে এ পোড়া বঙ্গদেশকেই দায়ী করেছেন। আর আমরা সেটি বিশ্বাসও করেছি। যেমন, রবীন্দ্রনাথ ‘ওলাউঠার বিস্তার’ প্রবন্ধে বলছেন “ভারতবর্ষ যে ওলাউঠা রোগের জন্মভূমি, এ সম্বন্ধে সন্দেহ অতি অল্পই আছে। ১৮১৭ খৃস্টাব্দে এই ভীষণ মড়ক বঙ্গদেশ হইতে দিগ্বিজয় করিতে বাহির হইয়া সিন্ধু, য়ুফ্রাটিস, নীল, দানিয়ুব, ভল্গা, অবশেষে আমেরিকার সেন্টলরেন্স এবং মিসিসিপি নদী পার হইয়া দেশবিদেশে হাহাকার ধ্বনি উত্থিত করিয়াছিল”। ১৮১৭ থেকে ১৯৭৫, পৃথিবীতে সাতবার কলেরা অতিমারি বা প্যানডেমিক হয়েছে। প্রথম অতিমারি (১৮১৭-১৮২৩) শুরু হয় যশোর আর কোলকাতায়, সেখান থেকে সারা ভারতে, দ্বিতীয় অতিমারি (১৮২৩-১৮৩৭) শুরু হয় সারা ভারতে, ছড়ায় ইউরোপে। তৃতীয় অতিমারি (১৮৪৬-১৮৬৩) বোম্বে থেকে শুরু হয়ে জাহাজযাত্রীদের মাধ্যমে ইজিপ্ট হয়ে ইউরোপ, সেখান থেকে অ্যামেরিকাতেও পৌঁছয়, বলে অনুমান। এই তিনটি বা এর পরের চারটি, প্রতি অতিমারিতেই বাংলায় অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে।
১৮২৭ সালে যে ‘ভীষণ মড়ক বঙ্গদেশ হইতে’ শুরু হয়েছিল, বিংশ শতক পর্যন্ত তার আতঙ্ক বঙ্গবাসীকে তটস্থ করে রেখেছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জয়া ভাদুড়ী অভিনীত ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল, হাড়ভাঙা গ্রামে কলেরা শুরু হয়েছে আর একের পর এক মড়া নিয়ে, লোকে পোড়াতে যাচ্ছে। মিথ্যে খবর ছিল যদিও। কিন্তু তা শুনে কোলকাতার খেলোয়াড়রা কলেরার ভয়ে সেই মুহূর্তে হাড়ভাঙা ত্যাগ করে। এমন ছিল তার আতঙ্ক। গত দুশো বছরে কলেরা বাংলায় কেড়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। উজাড় হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। কোলকাতায় মাত্র বাইশ বছর বয়েসে কলেরাতে মারা যান ইয়ং বেঙ্গল সোস্যাইটির প্রাণপুরুষ ডিরোজিও, মারা যান ভারত দরদী ডেভিড হেয়ার। দেড়শো বছরে বাংলা আর বাঙালির সাথে কলেরা নামক ব্যাকটিরিয়া ঘটিত অন্ত্রের এই সংক্রামক রোগটির সম্পর্ক এতই নিবিড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যে সে সময়ের বাংলা সাহিত্যের পাতাতে শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর সবার লেখায় ফিরে এসেছে সেই ভয়ঙ্কর মহামারি বা মড়কের কথা। “আমাদের শহরে তখন শীত পড়েছে, হঠাৎ কলেরা দেখা দিলে। তখনকার দিনে ওলাউঠার নামে মানুষে ভয়ে হতজ্ঞান হতো। কারও কলেরা হয়েছে শুনতে পেলে সে-পাড়ায় মানুষ থাকতো না। মারা গেলে দাহ করার লোক মেলা দুর্ঘট হতো”( লালু- শরৎচন্দ্র)। একই রকম বিবরণ ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে। “নাকে কাপড় চাপা দিয়া বলিলাম, নিশ্চয় কিছু পচেছে, ইন্দ্র! ইন্দ্র বলিল, মড়া। আজকাল ভয়ানক কলেরা হচ্ছে কিনা! সবাই ত পোড়াতে পারে না...মুখে একটুখানি আগুন ছুঁইয়ে ফেলে দিয়ে যায়। শিয়াল-কুকুরে খায় আর পচে। তারই অত গন্ধ”। এছাড়া পণ্ডিতমশাই, দেনাপাওনা উপন্যাসেও রয়েছে ভেদবমি, বিসূচিকা বা কলেরার নির্মম বর্ণনা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’-এ আছে- ‘সেবার শুয়োরমারি বস্তিতে ভয়ানক কলেরা আরম্ভ হইল, কাছারিতে বসিয়া খবর পাইলাম। শুয়োরমারি আমাদের এলাকার মধ্যে নয়, এখান থেকে আট-দশ ক্রোশ দূরে, কুশী ও কলবলিয়া নদীর ধারে। প্রতিদিন এত লোক মরিতে লাগিল যে, কুশী নদীর জলে সর্বদা মড়া ভাসিয়া যাইতেছে, দাহ করিবার ব্যবস্থা নাই।’ তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘গণদেবতা’, ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসেও এসেছে কলেরার কথা। তাঁর ‘জলসাঘর’ গল্পে দেখতে পাই, কিভাবে কলেরায় মাত্র সাতদিনে জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল। “বাড়িতে কলেরা দেখা দিল। তাহার পর সাত দিনের মধ্যে রায়গিন্নী, দুই পুত্র, এক কন্যা, কয়েকজন আত্মীয় – সব শেষ হইয়া গেল”।
কলেরার জন্য দায়ী ব্যাকটিরিয়া ভিভরিও কলেরি (Vibrio cholerae )। কলেরা হলে কোষের থেকে জল ও লবণ ডায়রিয়া ও বমির মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হয়। ধমনীর মাধ্যমে জল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় লবণ পাঠানোর তত্ত্ব ১৮৩২ সাল থেকেই ইউরোপে ‘ভারতীয় কলেরার’ জন্যে ভাবা হচ্ছিল, পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছিল, কিন্তু ‘স্যালাইন’ বা পরে রিঙ্গার সলিউশান তৈরি করতে বহু দশক কেটে গেছে। তাই সে সময় কলেরা নিয়ন্ত্রণের কোন উপায় জানা না থাকায়, গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। এই ভিভরিও কলেরি দূষিত খাবার ও মূলতঃ জল থেকে ছড়াতো। বাংলার জলীয় উষ্ণ আবহাওয়া হয়তো কলেরার অনুকূল ছিল, সাথে বর্ষার কারণে আর এত খাল বিল নদীর কারণে ছড়াতও বোধহয় বেশি। সাথে লোকজনের সচেতনতারও অভাব ছিল, কুসংস্কারও ছিল। তারা বুঝতেও পারতনা হয়তো, জল থেকেই ছড়াচ্ছে কলেরা। ওলাইচন্ডী বা ওলাইবিবির প্রকোপ হিসেবে মৃত্যুকে মেনে নিত। যেমন, ‘পণ্ডিতমশাই’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, গ্রামের একটিমাত্র পুকুরে কলেরা-আক্রান্ত রোগীর কাপড়চোপড় ধোওয়া হয়। আর সেই জল পান করে সারা গ্রামে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। বৃন্দাবন সেকথা বোঝাতে গিয়ে কি ভাবে গ্রাম্য রাজনীতির শিকার হন, তাও দেখা যায়। দূষিত জল থেকে যে কলেরা ছড়ায়, সেটা ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন স্নো বলেছিলেন। সেই মত ব্যবস্থা নিয়ে পরবর্তীতে ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয়রা নিজভূমে জনস্বাস্থ্যে ব্যাপক উন্নতি ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি করে কলেরা দূর করে। কিন্তু বাংলা তথা ভারতের গ্রামে গঞ্জে ‘মূর্খ-দরিদ্র-ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল’ ও নেটিভ ভারতবাসীকে বাঁচাবার জন্য ব্রিটিশ সরকার প্রকৃতই কতটা চেষ্টা করেছে, পরিকল্পনা করে এগিয়েছে, তা তো ষষ্ঠ অতিমারির ( ১৮৯৯-১৯২৩) ভারতে কলেরার কয়েক লাখ মৃত্যু আর বাংলা সাহিত্যের এই বিবরণগুলো পড়লেই বোঝা যায়। তাই সেই প্রশ্ন তুলে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা না হয় আর নাই বা জাগালাম।
১৮১৭ সালে যশোরে শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাই জনমানসে কলেরার জন্মভূমি বলে প্রসিদ্ধি পায়। ইউরোপীয়রা আসার আগে অবধি কলেরা মহামারির ভারতে কোথাও কোন বিবরণ না থাকলেও, ১৮৩০ সালে ইউরোপে যেই কলেরার প্রকোপ শুরু হল, ঔপনিবেশিক শাসকরা নির্দ্বিধায় স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে সেটির নাম দিল ‘ভারতীয় কলেরা’ আর বাংলা তথা ভারতকেই কলেরার জন্মভূমি হিসেবে দায়ী করতে লাগল। যদিও কলেরা কিন্তু সারা বিশ্বে আগে থেকেই ছিল, বিক্ষিপ্ত ভাবে। ইউরোপেও বিক্ষিপ্ত ভাবে কলেরার খবর লিপিবদ্ধ আছে। হিপক্রিটাসের বিবরণেও যেমন কলেরার কথা আছে, তেমন সুশ্রুত সংহিতাতেও 'বিসূচিকা'-র কথা আছে। এবার হল কি, ১৮১৭ সালে প্রথম অতিমারির সময়, ব্রিটিশ চিকিৎসক রজার্স ‘বিসূচিকা’কেই কলেরা বলে দেগে দিলেন, রাজা রাধাকান্তদেবও তাঁর বিখ্যাত অভিধান শব্দকল্পদ্রুমে বিসূচিকাকেই ওলাওঠা বললেন (সাহেবি প্রভাব কিনা বলতে পারবনা!)। কিন্তু সেই ‘বিসূচিকা’ই হালের কলেরা বা ওলাওঠা কিনা, তা নিয়ে কিন্তু এখনো যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ, ইউরোপীয়রা ভারতে আসার আগে ভারতে ‘বিসূচিকা’ কখনোই মহামারি হিসেবে উল্লেখ হয়নি কোথাও। হতে পারে, পরে ভিভরিও কলেরির নতুন কোন strain এসেছিল, যা আগের তুলনায় ভয়ঙ্কর। বা আগে জনঘনত্ব অনেক কম ছিল, তাই হয়তো তত ছড়াতে পারেনি আর মহামারিও হয়নি। আর ভারতে কলেরা মহামারির প্রথম লিপিবদ্ধ বিবরণ পাওয়া যায় ১৮১৭ সালে নয়, তারও তিনশো বছর আগে গোয়ায় ষোড়শ শতকের শুরুতে (১৫০৩ সালে)। মারা যায় কয়েক হাজার পর্তুগীজ নাবিক আর সেনা। এত মৃত্যু হয়েছিল, যে কবর দেবার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিলনা। তারাও যে অন্য বন্দরের মাধ্যমে কলেরা ভারতে নিয়ে আসেনি, তেমন কথাও নিঃসন্দেহে বলা যায় না। তবে ভারতীয়দের মধ্যে রোগের প্রকোপ ছিল কম। সেসময়কার পর্তুগীজ চিকিৎসক ক্রীস্টাভো ডি কোস্টার মতে, ‘হিন্দু’রা প্রতিদিন স্নান করে ও পরিচ্ছন্নতা মেনে চলে বলে তাদের মধ্যে কলেরার প্রভাব কম, অন্যদিকে পর্তুগীজ নাবিক ও সেনারা পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধির পরোয়া করেনা বলে কলেরায় মরে। এই পর্তুগীজরা এরপর বাংলায় বাণিজ্য করতে এসে,নদীপথ-সমুদ্রপথ সব দূষিত করতে করতে রোগটিকেও খুব সম্ভবতঃ বাংলায় নিয়ে এল১। এবং এই কলেরার ত্রাস যে ১৮১৭ সালের আগেই ছিল, তার প্রমাণ, ওলাওঠা থেকে বাঁচতে ডানকান নামে এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ী যে ১৭২০-র ও ১৭৫০-র দশকে বাংলায় ওলাই বিবির মন্দির বানাতে কয়েক হাজার টাকা অনুদান দেন। অর্থাৎ, ১৮১৭ সালের প্রথম অতিমারির অন্ততঃ এক শতক আগে থেকেই বাংলায় বিক্ষিপ্ত ভাবে ওলাওঠা ছিল এবং তার আতঙ্কও ছিল। কোলকাতাকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য ও নগরায়নের ফলে, প্রচুর লোক দেশ বিদেশ থেকে বাংলায় আসায় হয়তো বাংলাতেই প্রথম অতিমারি শুরু হয়েছিল।২
কলেরার ব্যাকটিরিয়া ভিভরিও কলেরি (Vibrio cholerae ) দায়ী, এটা ১৮৫৪ সালে ইটালিয়ান চিকিৎসক ফিলিপ্পো পাসিনি প্রথম বলেন। যদিও পাসিনির দেওয়া নামটি ছিল- Cholerigenic vibrios । কিন্তু ব্যাপারটা তখন অতটা প্রচার পায়নি। ১৮৮৩ সালে বাংলায় যখন কলেরা মহামারি চলছে, তখন কোলকাতায় কলেরার নমুনা সংগ্রহ করতে এলেন জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কক। এই রবার্ট কক হলেন আধুনিক অণুজীববিদ্যা (Microbiology) -র অন্যতম স্থপতি এবং জীবাণুই রোগের কারণ সম্বন্ধীয় অণুজীববিদ্যার বিখ্যাত মৌলিক নীতিগুলির প্রণেতা (Koch's postulates)। কক কোলকাতায় বসে ১৮৮৪ সালে রুগীর অন্ত্র ও মল থেকে থেকে কমার (,) মত আকৃতির ভিভরিও কলেরি আলাদা করেন। ককের মনে হয়েছিল, কলেরা জীবাণু নিঃসৃত ‘বিষ’ই (Poison) ডায়রিয়ার জন্যে দায়ী। কিন্তু এরপর কলেরা নিয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হয়নি আর। কারণ, দূষিত জলই কলেরার উৎস জানতে পারায়, পঞ্চম অতিমারির (১৮৮১-১৮৮৬) পর পশ্চিম ইউরোপে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক উন্নতি হয়। ফলে সেখানে বিংশ শতক থেকে আর কলেরার মহামারির কোন প্রাদুর্ভাব ঘটেনি। সেজন্যেই খুব সম্ভবতঃ কলেরা গবেষণাতেও ভাঁটা পড়ে। আর তাছাড়া আফ্রিকার, এশিয়ার কয়েক লাখ মানুষ মরলে, তাদের নিয়ে শাসক ইউরোপিয়ানদের বিশেষ কিছু দুর্ভাবনার কারণ ছিল বলে মনে হয়না! তাই হয়তো ককের সেই ‘বিসূচিকা বিষ’ নিয়ে বিশেষ আর কাজ হয়নি। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধও চলছিল। এদিকে ষষ্ঠ অতিমারিতে (১৮৯৯-১৯২৩) ভারতে মৃত্যু হয়েছিল আট লাখ মানুষের। ‘আজাদি ঝুটা’ ছিল কিনা জানিনা, তবে তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে ১৯৫০-র দশকের পটভূমিতে বাংলায় কলেরার বিবরণে, আর শরৎচন্দ্রের ব্রিটিশ আমলের বাংলায় কলেরার বিবরণের মধ্যে মূলগত কিছু ফারাক দেখা যায়। ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ কলেরা আটকাতে ‘শিক্ষিত ছেলেরা’ ‘কোদালি ব্রিগেড’ নামে পরিশ্রুত জলের জন্য কুয়ো খুঁড়ছে। সরকারি ‘স্যানিটারি ইনস্পেক্টরেরা পুকুরে ব্লিচিং পাউডার গুলে দিয়ে জলকে শোধন’ করছে, ‘অ্যান্টি-কলেরা ভ্যাকসিন ইনজেকশন’ বা ‘কলেরার টিকে’ দিচ্ছে।৩ এই ধরণের জনস্বাস্থ্যের কিছু তৎপরতা ও জনসচেতনতা কিন্তু বাংলায় কলেরা মোকাবিলায় দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি ককের ভিভরিও কলেরির বিষের ধারণার সাত দশক পরে স্বাধীন ভারতে ১৯৫১ সালে তা নিয়ে গবেষণায় এগিয়ে এলেন এক বাঙালিই। কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক, অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে। শম্ভুনাথ খরগোশে পরীক্ষা করে দেখলেন, কলেরার আক্রমণ স্থল অন্ত্র। ভিভরিও কলেরি থেকে তিনি কলেরার বিষ আলাদা করে খরগোশে প্রয়োগ করে ডায়রিয়া ঘটাতে সক্ষম হলেন। এটা কলেরা গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন এক দিশা দিল। এর আগে ধারণা ছিল, কলেরা টক্সিন আসলে ব্যাকটিরিয়ার কোষ প্রাচীরে থাকা এন্ডোটক্সিন থেকে হয়। শম্ভুনাথ প্রমাণ করলেন, কলেরা টক্সিন ব্যাকটিরিয়ার কোষ থেকে নিঃসৃত হয় (এক্সোটক্সিন)। তাই ব্যাকটিরিয়া ছাড়াও খালি এই বিষই ডায়রিয়া ঘটাতে সক্ষম। শম্ভুনাথ দের এই আবিষ্কারের পর দু'দশকের মধ্যেই কলেরা টক্সিনের গঠন, প্রকৃতি সবই জেনে ফেলা সম্ভব হয়। কোলকাতায় নিজের গবেষণাগারে যৎসামান্য যন্ত্রপাতির ওপর ভর করে ‘ভারতীয় কলেরা’র গবেষণায় বাঙালির এই অবদান স্বীকৃতি পায় বিশ্বে। ১৯৫৯ সালে বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর এই কাজ। তাঁর কাজ এতটাই আলোড়ন ফেলে যে নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী জসুয়া লিডারবার্গ শম্ভুনাথকে নোবেল পুরস্কারের জন্যেও মনোনীত করেন। শম্ভুনাথের দেখান পথে হেঁটে পরবর্তী কালে কলেরা গবেষণার দৃষ্টিকোণ পালটে যায়। এবং পরের ষাট বছরে সারা পৃথিবীতে কলেরা টক্সিনের ওপর হাজার হাজার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। অবশ্য বাঙালি স্বাভাবিক ভাবেই শম্ভুনাথের কথা বিশেষ জানেও না, আর জানলেও মনেও রাখেনি। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এদিকে ভারত সহ এশিয়া ও আফ্রিকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সর্বস্তরে না পৌঁছনোয় অতিমারি হিসেবে না হলেও কলেরার মহামারি ছিলই। এর মধ্যে ১৯৬১ এ তে ফিরে আসে সপ্তম কলেরা অতিমারি (১৯৬১-৭৫), যেখানে ভিভরিও কলেরি এর এক নতুন অধিকতর ক্ষতিকর strain-র মাধ্যমে আরও ভয়ঙ্কর ভাবে ফিরে আসে কলেরা। যার আঁচ পড়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে ওপার বাংলা থেকে কাতারে কাতারে উদ্বাস্তুর আসা শুরু হল এপার বাংলায়। বনগাঁয় চরম অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় তাদের ঠাঁই হল উদ্বাস্তু শিবিরে। সেখানে পড়ল অতিমারির কোপ। ছড়াল কলেরা৪। খবর পেয়েই সেখানে গেলেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক দিলীপ মহালানবিশ। দিলীপ সেখানে পৌঁছে দেখলেন ভয়াবহ অবস্থা। বনগাঁ হাসপাতালে শয্যার অভাবে মেঝেতে ঠাঁই হয়েছে রুগীদের। না আছে পর্যাপ্ত স্যালাইন না আছে স্যালাইন চালাবার মত পর্যাপ্ত কর্মী। বুঝলেন, এই যুদ্ধে হার অবশ্যম্ভাবী। না কোন বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করার সময় আছে, না আছে পর্যাপ্ত স্যালাইন বোতল আর কর্মী পাবার সম্ভাবনা। এদিকে প্রতিটি মুহুর্ত দামী এত প্রাণ বাঁচাবার জন্যে। উপায়ন্তর না দেখে, দিলীপ তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে স্যালাইনের বদলে জলে খাদ্য লবণ আর গ্লুকোজ গুললেন। রোগীদের বললেন, এটাও স্যালাইন, কিন্তু পান করতে হয় (Oral Saline)। ভাবলেন, দেখা যাক যদি কিছু কাজ হয়! দু সপ্তাহ বাদে দেখা গেল, অভাবনীয় সাফল্য। শয়ে শয়ে রোগীর প্রাণ বাঁচল কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। আবিষ্কার হল ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী চিকিৎসা Oral Rehydration Solution (ORS)। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বা WHO-র তৎপরতায় সারা বিশ্বে ORS-র মাধ্যমে কলেরা ছাড়াও অন্যান্য ডায়রিয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। কোলকাতার দুই বাঙালির গবেষণা আর উদ্যমে প্রাণ বাঁচতে লাগল কোটি কোটি মানুষের। বিনা প্রশিক্ষণ, বিনা চিকিৎসকে নামমাত্র খরচে এই চিকিৎসাকে ‘চিকিৎসাবিদ্যায় বিংশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিও’ বলেও Lancet পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব কলেরা মুক্ত হয়তো হয়নি। হত দরিদ্র আফ্রিকায় এখনো তার করাল থাবা পড়ে মাঝে মাঝে। তবে ORS-র কল্যাণে প্রাণহানি অনেক কম হয়। যাঁর কারণে এত প্রাণ বেঁচে গেল, সেই ডাঃ দিলীপ মহালানবিশের কথাও অবশ্য বাঙালি জানেনা।
মুঙ্গেরে কলেরা মহামারিতে মাত্র এগারো বছর বয়সে চলে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ সন্তান শমীন্দ্রনাথ, ১৯০৭ সালে। হোমিওপ্যাথি – অ্যালোপাথি দুরকমের চিকিৎসা করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। কবি পরে লিখেছিলেন, “শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্চে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি—সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে”। এখনও ভাবলে অসহায় লাগে, যে একটু জল ফুটিয়ে নুন চিনি মিশিয়ে বার বার খাওয়াতে পারলে শমী সত্যি সত্যিই রয়ে যেত, বড় হত। কবিকে এত বড় শোক পেতে হতনা।
তথ্য সমৃদ্ধ ।
খুব ভালো লাগল। নির্মাল্যর লেখা একদিকে যেমন তথ্য সমৃদ্ধ,অন্যদিকে স্বাদু। লেখার কায়দাটি বড় সুন্দর। গল্পের আদলে অনেক জটিল কথা সহজ সুন্দরভাবে উপস্থাপণ করে নির্মাল্য এটা আগেও দেখেছি এখানেও দেখলাম।
বাংলায় বিসূচিকা - নির্মাল্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাঙালির ইতিহাসকে মাটি খুঁড়ে যে ভাবে নিয়ে এসেছেন ,এক কথায় অনবদ্য।
অসাধারণ। এই সময়ে ভীষণ প্রাসঙ্গিক।
Darun hoache dada
পড়লাম। খুব ভালো তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।