নির্মাল্য দাশগুপ্ত, প্যারিস (২৫ জুন, ২৫২৫ সাল): ফ্রান্সের রাজনীতি গত কয়েক দশক ধরেই অ্যাস্টেরিক্সকে নিয়ে আবর্তিত হচ্ছে। আগামী বছর ফ্রান্সের সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে মাথায় রেখে, অ্যাস্টেরিক্স ভক্তরা গতকাল প্যারিসের রাস্তা জুড়ে অ্যাস্টেরিক্সের মন্দিরের দাবীতে বিশাল ‘ভ্যু’ বা সংকল্প যাত্রা করেন। গত কয়েক শতাব্দী ধরে অ্যাসটেরিক্স ফ্রান্সে লোকনায়কের মর্য্যাদা পাচ্ছেন। মনে করা হয়, বিংশ শতকের কোন সময়ে অ্যাসটেরিক্সের কমিক্স কাহিনী রচিত হয়েছিল। বন্ধু মহাবীর ওবেলিক্সকে সাথে নিয়ে অত্যাচারী রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের বাহিনীকে পরাজিত করার বীররসগাঁথা নিয়ে ঐ কাহিনী। ঠিক ঐ সময়ে প্রতিবেশি দেশ বেলজিয়ামে টিনটিন নামে আরেকটি কমিক্স চরিত্রের আবির্ভাব হয়। টিনটিনও ফ্রান্সে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। কাহিনী অনুসারে সাংবাদিক টিনটিন তাঁর বন্ধু ক্যাপ্টেন হ্যাডক, প্রফেসার ক্যালকুলাস আর কুকুর কুট্টুসকে নিয়ে মার্লিনস্পাইক নামক একটি বিশাল প্রাসাদে থাকতেন। বেশ কয়েকশো বছর আগে এক ফরাসী ধনী রাজনীতিবিদ মার্লিনস্পাইক প্রাসাদের আদলে একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন। সেটি পরবর্তীকালে টিনটিন সংগ্রহশালা হিসেবে জনপ্রিয় হয়, এবং সারা বিশ্বের টিনটিন অনুরাগীদের কাছে টিনটিনের বাড়ি হিসেবেই পরিচিতি পায়। কিন্তু, প্রায় ৭০ বছর আগে অ্যাস্টেরিক্স কট্টর ভক্তদের মধ্যে হঠাৎ দাবী ওঠে, মার্লিনস্পাইক আসলে অ্যাস্টেরিক্সের গ্রাম ও জন্মস্থান এবং সেই ধনী রাজনীতিক টিনটিন অনুরাগী হবার কারণে অ্যাসেটিরিক্সের সব প্রমাণ মুছে দিয়ে ঐ স্থানে প্রাসাদটি বানান। অনেক ঐতিহাসিক প্রতিবাদে বলেন, অ্যাস্টেরিক্স কমিক্স চরিত্র, তিনি বাস্তব চরিত্র নন। তাই তাঁর জন্মস্থান খোঁজা অবাস্তব। কিন্তু, ভক্তরা বলেন, লেখক কাহিনীতে মানচিত্র এঁকে গ্রামটি পরিষ্কার নির্দেশ করে গেছেন এবং সিজার, ক্লিওপেট্রা , ব্রুটাস, প্লেটো ইত্যাদি ঐতিহাসিক চরিত্রের সেখানে উল্লেখ আছে। উল্লেখ আছে ব্রিটেন, জার্মান, সুইটজারল্যান্ড ইত্যাদি নানা দেশের। সেসব যদি সত্যি হয়, অ্যাস্টেরিক্সও সত্য। অ্যাস্টেরিক্স ওখানেই জন্মেছেন। আর সর্বোপরি অ্যাস্টেরিক্স প্রতিটি ফরাসীর হৃদয়ে বাস করেন, এটা বিশ্বাসের প্রশ্ন, আবেগের প্রশ্ন; তর্কের প্রশ্ন নয়। তাই যারা এসব প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা আসলে টিনটিন অনুরাগী এবং বেলজিয়ামপন্থী। এরপর প্রত্নতত্ববিদরা প্রাসাদের মাটি খুঁড়ে কিছু পাথরের টুকরো পান, অ্যাস্টেরিক্স ভক্তরা বলেন, সেগুলো অ্যাস্টেরিক্স ও ওবেলিক্সের বাড়ির ভাঙা অংশ। প্রত্নতত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছবার আগেই, এই জনশ্রুতি দিকে দিকে আগুণের মত ছড়িয়ে যায়।
এরপর প্রতি রবিবার সকালে টিভিতে অ্যাসেটিরিক্সের কার্টুন আর সিনেমা দেখান শুরু হয়, যা ফরাসী জনতার মনকে অ্যাসেটিরিক্সের প্রতি আবেগমথিত করে তোলে। সারা ফ্রান্স জুড়ে মার্লিনস্পাইক ভেঙে অ্যাস্টেরিক্স মন্দির এবং সংগ্রহশালা বানাবার দাবী ওঠে। অ্যাসেটিরিক্স ভক্তরা বলেন, অ্যাস্টেরিক্স অত্যাচারিতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, অত্যাচারী সিজারের থেকে তাঁদের রক্ষা করেছেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। উনি এই গ্যল দেশের একান্ত আপনার। বিপরীতে টিনটিন সব দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে নাক গলিয়েছেন এবং বন্দুক-হানাহানি-মারামারি করে জয় লাভ করেছেন। তিনি মুখে শান্তির কথা বললেও, সব জায়গায় অশান্তি পাকিয়ে এসেছেন, গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে এসেছেন। এই ধরণের বিভেদকামী চরিত্রের পবিত্র গ্যল ভূমিতে, মহান গ্যল ঐতিহ্যের সাথে কোন সংস্রব থাকতে পারেনা। সর্বোপরি টিনটিন বেলজিয়ান এবং বিদেশী। এই দাবীর চরম পরিণতি হিসেবে, তাঁরা ‘আরেকবার ধাক্কা দাও, মার্লিনস্পাইক গুঁড়িয়ে দাও’ হুঙ্কারে সেই প্রাচীন প্রাসাদটি ধূলিসাৎ করেন। সারা ফ্রান্সে অ্যাস্টেরিক্সের মন্দির-সৌধ-সংগ্রহশালা তৈরীর জন্য দাবী ওঠে। টিনটিন অনুরাগীদের প্রতি বিদ্বেষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। প্রচুর ভাংচুর-দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়। টিনটিন অনুরাগীদের বেলজিয়াম চলে যেতে বলা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় টিনিটিনের কুকুর কুট্টুসের মূর্তির নীচে ‘ডগমাটিক্স’ (ওবেলিক্সের কুকুরের নাম) লিখে দেওয়া হয়। অনেকে আবার সদ্ভাবনার উদ্দেশে বলেন, মহাবীর অ্যাস্টেরিক্স, সরলমতি ওবেলিক্স, ভিষগ গেটাফিক্স আর কুকুর ডগমাটিক্স আসলে টিনটিন, ক্যাপ্টেন হ্যাডক, প্রফেসার ক্যালকুলাস আর কুট্টুসেরই অন্যরূপ। তাই বিতর্কিত স্থানে, দুই ব্যাক্তিতেরই সংগ্রহশালা হোক। এটা বেশির ভাগেই কাছেই কষ্টকল্পিত মনে হয়েছে আর বিবাদমান কোন পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। শেষ পর্যন্ত মন্দির বানানোর বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এরপর কেটে গেছে পঁচিশ বছর। বিভিন্ন ভোটে বারবার অ্যাস্টেরিক্সের মন্দির বিষয়টি ফিরে এসেছে। ফ্রান্সের ক্ষমতাসীন দলের এক কট্টর নেতা এর মধ্যে বলেছেন, তাঁদের সরকার এবার জিতলে প্যারিসের নাম বদলে অ্যাস্টেরিক্সের সময়ের ‘লুতেশিয়া’ নামটি ফিরিয়ে আনা হবে, বেলজিয়াম দখল করে ফ্রান্সের নাম অখন্ড গ্যল দেশ রাখা হবে এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অ্যাস্টেরিক্স মূর্তি তৈরী করা হবে। তিনি শ্রমজীবি ভোট পেতে আরো দাবী করেন, মহাবীর ওবেলিক্স পাথর ভেঙে মেনহির তৈরী করতেন, তাই তিনি শ্রমজীবি মানুষের প্রতিনিধি। যদিও তাঁর দলের অভিজাত শ্রেণীই এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। অনেকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মন্দা, বেকারি এসব নিয়ে আলোচনা না করে এসব অবান্তর বিষয়ে কালক্ষয় করে কি লাভ! কিন্তু, অ্যাস্টেরিক্স ভক্তদের মতে ওসব পরে হবে, আগে মন্দির ওখানেই বানাতে হবে, তার পর অন্য কথা। তাঁদের বক্তব্য, এই দাবী প্রতিটি খাঁটি ফরাসীর দাবী, ইচ্ছা। যারা ফ্রান্সে থেকেও এর বিরোধিতা করছেন, তারা আসলে বেলজিয়ামের চর। তাদের স্থান হওয়া উচিত বেলজিয়ামে বা মিউজিয়ামে। এর সাথে তাঁরা বেলজিয়ান চকলেট ত্যাগ করে বিশুদ্ধ ফরাসী চকলেট খাবার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন। বেলজিয়াম ফ্রান্সের আভ্যন্তরীণ ভোটের রাজনীতিতে বারবার তাদের নাম টেনে আনায়, তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। অ্যাসেটিরিক্সের বিষয়ে প্রধান বিরোধী দলের সভাপতিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই অ্যাসেটিরিক্সের ভক্ত, আর আমি টিনটিনেরও অনুরাগী”। কিন্তু সরকারী দলের প্রচারকরা এই বাক্যের প্রথম অংশটি বাদ দিয়ে “আমি টিনটিনের অনুরাগী’ কথাটিই ফলাও করে প্রচার করেন। জবাবে বিরোধী দল দলনেতার ছোটবেলায় অ্যাস্টেরিক্স পঠনরত একটি ছবি প্রকাশ করেন। ফলস্বরূপ সরকারি দলের মুখপাত্র বলেন, তাঁদের আন্দোলনের জন্যই টিনটিন ভক্তকে এতদিনে অ্যাস্টেরিক্স ভক্ত সাজতে হল। অনেকে আবার বিরোধী দলনেতার এসব কার্য্যকলাপকে সরকারি দলের ‘কট্টর অ্যাসটেরিক্সত্বের’ জায়গায়, বিরোধী দলের ‘নরম অ্যাসটেরিক্সত্ব’ বলে সমালোচনা করছেন। অ্যাসটেরিক্স ফ্রান্সের ভোটের রাজনীতিতে এবারও কতদূর প্রভাব ফেলেন, সেটা জানতে ফ্রান্সের পরের সাধারণ নির্বাচনের দিকে চোখ রাখতে হবে।
পাঁচশো বছর পরের কাল্পনিক গল্প হলেও সন তারিখ সঠিক হওয়া ভাল। টিনটিনের প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে, TinTin in the land of the Soviets.
অন্যদিক অ্যাস্টেরিক্স প্রথম বের হয় ১৯৫৯ সালে Asterix the Gaul.
অতএব এই লেখা অনুযায়ী এদের একই সময়ে জন্ম হয় নি। দুটির মধ্যে মাত্র একটি বিশ্বযুদ্ধের ব্যবধান আছে।
আরেকটি ছোট্ট কথা। শব্দটি হল ভিষক, যথা, ভিষকরত্ন। আর দেশটির নাম জার্মানী।
মজার লেখা। বর্তমান সময়ে বেশ প্রাসঙ্গি।