এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • প্যানডেমিক | এসব হয়না - ৬

    Anamitra Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ আগস্ট ২০২০ | ৩৪৪৮ বার পঠিত
  • | | | | | | |
    সুগত তৈরিই ছিল এই দিনটার জন্য সত্যি বলতে। যদিও প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এরকম একটা পরিস্থিতি, যার কথা ভেবে উঠতে পারাই সম্ভব নয়, তার জন্য কেউ আগে থেকে কিভাবেই বা তৈরি থেকে থাকতে পারে! এখন, সুগত যে হুবহু এরকমটাই ভেবেছিল সেটা বললে ভুল বলা হবে। তবে তার আন্দাজ ছিল যে পৃথিবীটা খুব একটা নিরুপদ্রব গ্রহ নয়। অকারণ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার কোনও কারণ নেই; এখানে যখন তখন যা খুশি তাই হতে পারে। সে একটা পারমাণবিক হিমযুগের কথা ভাবতে পেরেছিল। অথবা ভেবেছিল পৃথিবী থেকে সব জল উধাও হয়ে গেছে কয়েকমাসে --- এরকম একটা পরিস্থিতি। মোটের ওপর যে কোনও রকম আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্যই সে প্রস্তুত ছিল। অবশ্যই, গোটাটা হুবহু কেউই ভেবে উঠতে পারে না।

    আড়ষ্ট ভাবটা প্রথম ঠোঁট থেকে শুরু হয়। তখনও সেটা আবেশের মতো মনে হচ্ছিল। চুমু খাওয়ার সময় যেরকম হয়। কিন্তু চুমু সে খাচ্ছিলো না। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। কথাটা কী ছিল সেটা এখন আর মনে পড়ছে না। কিন্তু সেটা এমন কোনও কথা যেটা বলে উঠতে পারা খুব জরুরি ছিল। কথাটা বলা গেলে তার নিজের সম্বন্ধে নিজের ধারণাগুলো আরেকটু স্পষ্ট করে তুলে ধরা যেত সঙ্ঘমিত্রা-র কাছে। বলা যেত, আমি এই! এর বাইরে আমি অন্য কিছু নই। বাদবাকি যা তুমি বুঝেছো সেসব তোমার ধারণা মাত্র। তার সাথে আমার ভিতরের প্রকৃত আমি-টার কোনও সম্পর্ক নেই। সঙ্ঘমিত্রা-ও কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিলো, কথার পৃষ্ঠে কথা যেমন হয়। সেই কথাটা শোনাও প্রয়োজন ছিল। সেই কথাটার প্রেক্ষিতে আরেকটু গুছিয়ে বলে ওঠা যেত তাহলে নিজের কথাগুলো। অথচ, সেরকমটা হলো না। অবশ ভাবটা ক্রমশ ঠোঁট থেকে গালের দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তারপর বেড়ালের মতো গাল বেয়ে উঠে পড়লো মাথায়। মাথা থেকে ঘাড় হয়ে নেমে কাঁধ-হাত-পা-গোটা শরীরটাই অবশ হয়ে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। প্রথমে একটা ঝিনঝিন ভাব। তারপর সাড় চলে যাওয়া। সুগত-র অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আর তার নিয়ন্ত্রণে রইলো না। চোখের সামনে সে দেখতে পেলো সঙ্ঘমিত্রা একটা গাছ হয়ে যাচ্ছে। আর ক্রমশ ডালপালা বাড়িয়ে দিচ্ছে তার দিকে। অথবা বাড়িয়ে দিচ্ছে বললে ভুল বলা হবে। কিরকম একটা ঠেলে দিচ্ছে যেন। অথবা চোখ বসে যাওয়া অসহায়তার মধ্যে সঙ্ঘমিত্রা-র ডালপালা ক্রমশ নির্গত হয়ে আসছে সুগত-র অভিমুখে।

    ততক্ষণে ব্যাপারটা অনেকটাই পরিস্কার। সুগত নিজেও যে এখন একটা গাছের বেশি কিছু নয় সেটা সে দিব্যি টের পাচ্ছিলো। পার্থক্য এটুকুই যে সঙ্ঘমিত্রা-র কান্ডটা একটু বেশি চওড়া আর সুগত-র শিকড়গুলো একটু বেশি গভীরে। তারা দুজনেই এখন গাছ, কেউ কারও অবস্থান থেকে নড়তে পারছে না। অথচ এই ঘন্টাদুয়েক আগেও তারা কথা বলছিলো উত্তেজিতভাবে। অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল দুজন-দুজনকে। আর বোঝানোর চেষ্টা করছিল কেন এর মধ্যে একটি দৃষ্টিভঙ্গিই মাত্র সঠিক হতে পারে! এবং কেন একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যাই গ্রাহ্য নয়! কিছুদিন আগে প্যানডেমিকের খবরটা যখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তারা দুজনের কেউই ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। কতকিছুই তো রটে পৃথিবীতে! তার সবটুকুই যে সত্যি হতে হবে তার কী মানে আছে! মানুষ নাকি গাছ হয়ে যাচ্ছে; তাও কি সম্ভব? রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমগুলো অবশ্য বেশ জোর দিয়েই বলছিলো কথাগুলো। কী কী করা চলবে না সেসবও বলে দিয়েছিলো। নিজের অস্তিত্বের আগাপাশতলা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রোগটা শুরু হয় প্রথমে। তারপর সেই বিষয়ে কথা বলে উঠতে চাওয়াটা রোগের দ্বিতীয় ধাপ। এই অবধি অবশ্য এমনি এমনিও হতে পারে। এর মানেই নিশ্চিত সংক্রমণ নয়। সংক্রমণের ব্যাপারটায় নিশ্চিত হওয়া যায় একমাত্র তৃতীয় ধাপ থেকে। যখন একজন আসলেই কথা বলে ওঠে। যেসব কথার কোনও মাথামুন্ডু হয় না। যেসব কথার সাথে রাষ্ট্র কীভাবে চলছে, সোনার দর ওঠানামা করছে কেন, অথবা নিদেনপক্ষে মেরুপ্রদেশে বরফের স্তর কতটা গললো; এইসব কোনোকিছুরই কোনও সম্পর্ক নেই। যেসব কথা আসলে না বললেও চলে। অথবা না বলাই ভালো। এমন কিছু কেউ কেনই বা বলতে যাবে রোগগ্রস্ত না হলে? এই তৃতীয় পর্যায়েই সংক্রমিত ব্যক্তির মুখ থেকে 'আমি', 'আমার' জাতীয় শব্দ ছিটকে ছিটকে সামনের মানুষটিকেও সংক্রমিত করে। এরপর সেও ভাবতে শুরু করবে তাকে ঠিক কেমন দেখতে। সে আসলে কী চায় পৃথিবীর কাছে!

    এরপর রোগ চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছলে দুজন ক্রমশ ভুলে যাওয়া শুরু করবে যে উল্টোদিকে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। উত্তেজিত হবে, আর অনবরত প্রমাণ করে যাওয়ার চেষ্টা করে যাবে কেন তার চাওয়াটাই একমাত্র সঠিক। কেন এর বাইরে অন্যকিছুই আর সত্যি হতে পারে না। এইভাবে শেষ অবধি শিকড় ছড়িয়ে শাখা-প্রশাখা-পাতার বাহার মেলে ধরে ক্রমশ গাছ হয়ে যাবে দুজন যার যার নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে; ঠিক যেরকম সুগত আর সঙ্ঘমিত্রার সাথে হলো।

    বিশ্বাস হচ্ছে না, না?
    আপনি যেটুকু বিশ্বাস করেন শুধু সেইটুকুই কি ঘটে পৃথিবীতে? তার বাইরে অন্য কোনও সত্যি কি থাকতে পারে না সত্যিই?

    এরপরের ঘটনা আরও অবিশ্বাস্য। সেবার সুগত-র ঘুম ভেঙেছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পর। তাদের বাড়িটাও আর নেই, আর চারপাশটাও বদলে গেছে তখন। সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে আদিগন্ত ধু ধু বালির ওপর। উইকেন্ডে শহর থেকে ঘুরতে এসেছে সেখানে অরিন্দম আর শেলী। শেলী তখন অরিন্দমকে 'আলুর দম' বলে খেপাচ্ছিলো তার সদ্য গজানো ছোট্ট ভুঁড়িটায় খোঁচা মেরে। হঠাৎ তাদের চোখ গিয়ে পড়ে সুগত-র ওপর।
    "গাছটা কী অদ্ভুত, না?"--- অরিন্দম বলে, "কী গাছ এটা কে জানে!"
    বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারা সুগত-র দিকে। "আর পাশের গাছটাকে দেখো," আবারও বলে ওঠে অরিন্দম, "ঠিক যেন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এই গাছটার দিকে। অথচ ধরতে পারছে না!" সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শেলী ক্রমশ গায়ের কাছে ঘন হয়ে এসে হাত জড়িয়ে ধরে অরিন্দমের। কাঁধে মাথা রেখে দেয়। "আমরা বেশ মরলে এরকম গাছ হবো।" সে বলে আহ্লাদের মতো, "আর হাজার বছর দাঁড়িয়ে থাকবো পাশাপাশি। কী মজা হবে! তাই না?"
    --- কিছুটা সময় আর এইরকম আরও কিছু আহ্লাদ-ভালোবাসাবাসি মেশানো কথোপকথনের পর ক্রমশ তারা দূরে হেঁটে মিলিয়ে যেতে থাকে গাছেদের ভীড়ে। এই গোটা ঘটনাটাই সুগত-ও দেখছিলো। সে শুধু একবার চিৎকার করে বলতে চেয়েছিলো, "আমি সুগত। আমি গাছ নই। বাদবাকি যা তুমি বুঝেছো সেসব তোমার ধারণা মাত্র। তার সাথে আমার ভিতরের প্রকৃত আমি-টার কোনও সম্পর্ক নেই।"

    একটি ডাল দুলে উঠেছিল তার। আর পাতার শব্দ হয়েছিল সরসর করে।
    অরিন্দম ফিরে তাকিয়েছিলো সেদিকে। ভেবেছিলো, হাওয়া দিচ্ছে হয়তো। মানে, হাওয়া তো দিতেই পারে। তার জন্য তো আর অজুহাত লাগে না!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | |
  • ব্লগ | ১৭ আগস্ট ২০২০ | ৩৪৪৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Jishnu Mukherjee | ১৭ জুলাই ২০২৪ ১৮:১৮534822
  • চমৎকার 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন