ঘড়িটা কি স্লো যাচ্ছে? নাকি অপেক্ষা চিরকালই ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয়? নইলে, কোন সকাল থেকে তৈরি হয়ে বসে আছি, তার দেখা নেই। অথচ নিশ্চিত আসবে বলে জানিয়েছিল। কতদিন যেন আসে নি। মাঝে কাটল কত মাস? নাকি অনেক অনেক বছর?
দাঁড়ান দাঁড়ান মশাই। আপনি নিশ্চয় ভাবছেন যে আমি আমার প্রেমিক-প্রবরের অপেক্ষা করছি। ততটা রসসিক্ত হল না বলে দুঃখিত। তবে মশাই, এ প্রেমের থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান। পুরো এই আছি-এই নেই রকমের সমস্যা। জীবনের আধাআধি তো বইয়ের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। হঠাৎ, বাধ্য হয়ে মুখ তুললুম যখন, তখন দেখি দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, আশে পাশে মানুষজন বলতে আয়নায় সেই একা আমি, আর প্রত্যেকের মুখের বদলে মুখোশ (মন্দ নয়, অন্তত মুখোশগুলো আর লুকনো যাচ্ছে না।)। টিভিতে নতুন করে হাত ধোয়া শিখলাম। মা দেখলে কি খুশিই যে হত!
তা তো হল। কিন্তু অল্পদিন পরেই টের পেলাম যে, আমারও মেঘে মেঘে বেলা কম হয় নি। হাঁটু থেকে শুরু করে হার্ট – সবই জবাব দিয়ে দিয়েছে। এবার দেখছি আর কিছু না হোক, শুধু-মুদু হাঁফিয়েই মরে যাব। অগত্যা ফ্ল্যাটের দরজাটা একটু ফাঁক করে চুপিচুপি আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম সকলের বাড়ির ও হাঁড়ির খবর কি। হায় কপাল আমার, অমনি সঙ্গে সঙ্গে পাশের ফ্ল্যাটের টাকমাথা ভদ্রলোকও তাঁর দরজা খুলে মুণ্ডুখানা বাড়িয়ে দিলেন। - এই যে দিদি? হেঁ-হেঁ - কেমন আছেন? সব ঠিক তো? হেঁ-হেঁ- আপনার তো আবার ডায়াবেটিস আছে। জানেন তো যাঁরা মরছে, তাদের বেশিরভাগেরই আগের মেডিকাল হিস্ট্রি ছিল। খু-উ-ব সাবধান! কিছু হলে আপনি আর বাঁচবেন না কিন্তু –-
আমি সৌজন্য-টৌজন্য ভুলে দুম করে দরজাটা মুখের ওপর বন্ধ করে দিলাম। খনিক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে ভাবতে চেষ্টা করলাম লোকজনের খনার বচন কতদূর সত্যি হতে পারে। অথচ আমি ঠিক জানি ভদ্রলোকের স্ত্রীরও হাই সুগার। নিজের স্ত্রীকেও কি তিনি এরকম করে সমবেদনা দেখান নাকি? তাই কি মাথায় চুল আরো কম হয়েছে? নাকি অর্ধাঙ্গিনীকে বলতে না পারার দুঃখটা আমার ওপর উপুড় করে দিলেন? যা-তা পুরো।
অবশেষে ফোনটা করেই ফেললাম। জোছনাদিকে। জোছনাদি অনেক বছর ধরে আমার বাড়িতে কাজ করে। আমার সংসারটা প্রায় সামলে রাখত বলা চলে। কুশল বিনিময়ের পর ইতস্তত গলায় জিজ্ঞাসা করলাম – কি? আসবে নাকি? আমি যতটা মিনমিনিয়ে প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম, সে ততটাই উৎফুল্ল গলায় চিৎকার করে বলল - কি? আসব নাকি? সক্কলে তো কাজ নিচ্চে, শুধু তুমিই নিচ্চ না। - বুঝলাম, বিরহ দীর্ঘকালের হয়েছে।
তাই তো আজ সকাল থেকে মাস্কটাস্ক পরে স্যানেটাইজার হাতে নিয়ে দরজার ঠিক সামনের সোফাতে বসে আছি পথ চেয়ে – জোছোনারই গান গেয়ে। টং। কলিংবেলের আওয়াজ হতে লাফ দিয়ে দরজা খুললাম। উহু-উহু – গ্রিলে হাত দেবে না, দরজার হাতলও নয়। কোনকিছু ধরা-ধরি না করে সোজা নিজের ছোঁয়া বাঁচিয়ে ঘরে ঢোক দিকি। বাপরে, আমি কি পরিমাণ ছুঁচিবাইগ্রস্ত হয়েছি – যেন আদ্যিকালের বুড়ি ঠাক্মা। এই রেটে চলতে থাকলে আর কিছুদিন বাদেই কাফতান-হাউসকোট ছেড়ে বাড়িতে গামছা পরব।
জোছনাদি যথাসম্ভব সরু হয়ে দরজা দিয়ে ঢুকে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়াল। অমনি আমি হাতে লিকুইড স্যানেটাইজার স্প্রে করে দিলাম –ফুস ফুস ফুস। আর তারপর পায়েও। এরকম পদসেবা পেয়ে সে এক্কেবারে থতমত খেয়ে গেল। কে বলে আমি মানুষে মানুষে ভেদভাব করি? পুরোপুরি নারায়ণসেবা। এরপর পরপর সাবান, ফেনা, আলাদা করে রাখা জামা-কাপড়, মাস্ক – সব শেষ করে জোছনাদি যখন শুদ্ধ পবিত্র হয়ে আমার সামনে এসে উপস্থিত হল, তখনো আমি সোফার এক্কেবারে শেষ কোণায় বসে সন্দেহের চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলুম।
বেঁটে-খাটো চেহারার জোছনাদি প্রচুর কথা বলতে ভালোবাসে। নিশ্চয়ই ঝুড়ি ঝুড়ি কথা জমে আছে। দেখা যাক কি দিয়ে শুরু হয়। আমি প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু শুরুতেই যেটা এল, তাতে আমার প্রস্তুতি আমফানে (নাকি উমপুনে?) উড়ে গেল।
মাথা নেড়ে দুখী দুখী মুখ করে জোছনাদি বলল – করুণার অবস্থা খুব খারাপ।
করুণা? সেটা কে? তোমার সেই রামপুরহাটের বোনটি বুঝি? কি হয়েছে তার?
আমার অজ্ঞতায় জোছনাদি চোখে মুখে প্রথমে দিশেহারা ভাব ফুটে উঠল, তারপর বোধহয় মনে মনে ক্ষমা করে দিয়ে মৃদু ধিক্কারের সঙ্গে বলল – করুণা গো করুণা! এত লোক মারা যাচ্ছে সব দেশে – জান না বুঝি? টিভি দেখ না বুঝি? এ রোগের তো কোন ওষুদ বেরোচ্চে না গো।
ও হরি! আমার মাস্টারমশায় সত্তা জেগে উঠল ভেতর থেকে (ইউনিভারসিটি বন্ধ বলে ওয়ার্ক ফ্রম হোমটা এখানেই করে দিলাম আর কি)। বললাম - সে তো করোনা! করুণা নয়।
জোছনাদি মাথা নেড়ে জোরের সঙ্গে বলল – করুণা গো, করুণা। আমি পষ্ট শুনেছি। রোজ শুনি। নিউজ চ্যানেল। ফোঁৎ।
নাক দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে সে নিজের কাজে লেগে গেল। আমি আর কথা বাড়ালুম না।
কিন্তু তা বললে চলবে কেন? টিভির নিউজ চ্যানেল আর পাড়ার নিউজ চ্যানেলের খবর বিভিন্ন আকারে-আকৃতিতে ফুলে ফেঁপে রঙ বদলে রোজ আমার ঘরে ঢুকতে লাগল।
এখন তো দরজা খুলে হাতে–পায়ে স্যানেটাইজার দেবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। তার আগেই চল্লিশ মিনিট সঙ্গে জোছনাদি শুরু হয়ে যায়। আমি শুনি, অধিকাংশ সময়ই আনমনে, হুঁ-হ্যাঁ বলে বলে। তবু শুনি। কারণ, ‘করুণা’ আমায় শিখিয়েছে মানুষের সঙ্গ জরুরি – খুব জরুরি। অপেক্ষা করে আছি কবে আবার নির্দ্বিধায় মানুষকে ছুঁতেও পারব একটু।
তবে মাঝে মাঝে জোছনাদি বাক্যবাণ আমায় মন দিতে বাধ্য করে। যেমন সেদিন। আমি বিদেশী জার্নালের লেখাটা দাঁতে কাটতে না পেরে ভাবছি কি করি, এমন সময় বাসন মাজতে মাজতে-
-লকডাউন তো উটে যাচ্ছে।
-সেকি? টিভিতে বলল নাকি? শুনি নি তো। কোথায় উঠছে?
- আমেরিকাতে।
-দূর। তাতে আমাদের কি? আমরা কি অ্যামেরিকাতে থাকি?
- ঐ তো, আমেরিকাতে উটে গেলে আমাদেরও উটে যাবে।
জার্নালের লেখাটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, জোছনাদি কি আজকাল ইন্টারন্যাশানাল রিলেশানশিপ নিয়ে পড়াশোনা করছে?
দুদিন পরে জোছনাদি অন্য অবতার। ঘরে ঢুকে হাসি হাসি মুখে আঁচলের গিঁট খুলে একটা ছোট্ট কৌটো বার করল – এটা করুণার ওষুধ। খেলে করুণা হয় না। চারটে করে গুলি, পরপর দুদিন। আমি খাব, বাড়ির সকলে খাবে।
আমি আঁতকে উঠে বললাম – কোথায় পেলে? যে রোগের ওষুধ কেউ পাচ্ছে না, তুমি পেয়ে গেলে? ইয়ার্কি হচ্ছে? উল্টোপাল্টা জিনিষ খেও না।
আমার খ্যাঁচানিতে চুপচাপ কাজে লেগে গেল। কিন্তু সেই ছোট্ট কৌটটা আঁচলে বেঁধে নিল আবার। আর তিনদিন পরে আমাকে জানাতে ভুলল না যে, ঐ ওষুধ সে খেয়েছে, আর দিব্যি সুস্থ আছে। মানে আমিই পাগল। নিউজ চ্যানেল দেখি না যে। আসলে আমি যে সত্যি সত্যি টিভির কানেকশান খুলে রেখে দিয়েছি সেটা ওর চোখে পড়ে গেছে।
তারপর থেকে কদিন গম্ভীর গম্ভীর চলছে। আজ সকালে আমি খাটের ওপর লম্বা হয়ে একটা থিসিস কারেকশানের জোরদার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে যেন আকাশবাণী হল – কাল গ্রহণ আছে।
আমি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে দেখি জোছনাদি ন্যাতা হাতে দাঁড়িয়ে। বুঝলাম মৌনতা ভঙ্গের সময় এসেছে।
-কিসের গ্রহণ?
-সুজ্জগ্রহণ। কাল সাড়ে দশটার আগে খাওয়া দাওয়া নিও।
-আমি ওসব মানি না।
খানিক্ষণ চুপচাপ। তারপর নতুন উদ্যোমে -
-মালতী কি বলচিল জান?
মালতীকে চিনি। আমার অ্যাপার্টমেণ্টের দোতলায় কাজ করে। আমি হালকা স্বরে বললাম – কি বলছে সে?
-বলচিল কালকের গ্রহণ নাকি করুণাকে এক্কেবারে পিস পিস করে দেবে।
আমি আর থাকতে না পেরে খাটের ওপর উঠে বসলাম। - কি? করুণাকে পিস পিস করে দেবে?
-হ্যাঁ গো। দেবে। ঘর মুছতে মুছতে মালতী বলল। -নইলে কিচুতেই তো এই করুণা যেছে না (বানান ভুল নয়, খাস এদেশীয় ভাষা-ছাঁদ) । এত কিচু করল – প্রদীপ জ্বালাল, থালা-বাসন বাজাল – কিচুতেই যেছে না। কাল যদি এক গ্রহণে যায়। - বলে মেঝেতে ন্যাতার শেষ টানটা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি পুরো থ। হতভম্ব ভাব কাটতে না কাটতে ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’ স্টাইলে তার পুনরাবির্ভাব।
-জান তো? এবছর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে?
-তাই নাকি? এটা কে বলল?
-বলছে তো সবাই। সেই যে দুহাজার বারো সালে ধ্বংস হবার কথা ছিল, তখন হয় নি – এখন হবে।
আমি একটু বাস্তবতা আনার চেষ্টা করলাম । হ্যাঁ, ভুমিকম্পের সম্ভাবনার কথা অবশ্য স্যোশাল মিডিয়াতে বলছিল - ঐ বঙ্গোপসাগরের নিচে নাকি দুটো প্লেট –
কথা আমার শেষ হল না – না না, শুধু ভূমিকম্প নয়। আগুন, চারদিকে আগুন লেগে যাবে, কেউ বাঁচবে না, সব পুড়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে।
মনে হচ্ছে আমি হলিউডের স্পেশাল এফেক্টের সিনেমা দেখছি যেন।
সম্বিত ফিরে পেয়ে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলাম – যদি জেনেই যাও সব ধ্বংস হয়ে যাবে, সবাই মরে যাবে, তাহলে হাতে এই ন্যাতা-বালতি নিয়ে তুমি কি করছ? সামনে রথের দিনের জন্য টাকাই বা চাইছ কেন, আর আমিই বা ই ছাতার মাথা কাগজ-পত্তর নিয়ে কি করছি?
আবার খানিকক্ষণের বিরতি। মুখে একটু চিন্তার ভাঁজ। এবার জোছনা দেবী কুপোকাত হয়েছে মনে হচ্ছে। কিন্তু হায়, দেবীরা এত সহজে কুপোকাত হন না।
-সে তো খালি এই বছরটা। দুহাজার কুড়ি পেরিয়ে দিতে পারলেই হয়ে গেল। যেই দুহাজার একুশ পড়বে অমনি সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে তিনি বীরদর্পে আমাকে নস্যাত করে অন্য ঘর মুছতে লাগলেন।
সত্যি তো। বছরটার আধাআধি তো মেরেই এনেছি। আর আদ্ধেকটা বাকি। হবে না সব ঠিক?
ডাইনিং-এর জানলা দিয়ে দেখি জোছনাদি অল্প খুঁড়িয়ে চলছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে এলে বাবুদের বাড়িতে কাজে নেবে না, তাই রোজ অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হয়। এই দেখ, নিচে গিয়ে আবার মালতীর সঙ্গে গল্প জুড়েছে। কাল আবার নতুন নিউজ শোনা যাবে। তবে এই মানুষগুলোর একটা সরল মন আছে, আমাদের নেই। আমরা খুঁতটুকু নিজের কাছে আঁকড়ে রাখি, আর আশা-ভরসা-বিশ্বাসগুলোকে টাঙ্গিয়ে রাখি দেওয়ালে। বরং জোছনাদির নিউজ চ্যানেলে ‘করুণা’ আছে, করুণাধারাও আছে। এসো তবে, করুণাধারায় এসো।
হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ ঢুকল – কাল সূর্যগ্রহণ উপলক্ষ্যে এই এই কর্তব্য, এই এই নয়। এমনকি দেখছি একটা ওয়েবিনারের সময়ও চেঞ্জ করে দিয়েছে। তাহলে আর কি, কাল গ্রহণে করুণা পিস পিস হচ্ছেই।
পিস পিস হাসি :ডি
জোছনা দিকে ভাল লেগেছে। আরও লিখুন
#
অফটপিকে, গুরুচণ্ডালী সাইটের ওপরে সর্বডানে লগইন এর ঘরে "ব্যবহারকারীর খুঁটিনাটি" তে গিয়ে ইচ্ছে করলে নিজের নামটি বাংলায় করে নিতে পারেন।
বেশ, করে নিচ্ছি।
Sarash galpo
করুনাকালে অকাতরে বিতরণ করা বুক ভরা বাতাস - কোনো সেল্ফির প্রত্যাশা ছাড়াই । এমন লেখা পেলে ventilation machine এর প্রয়োজন হবে না ।