আচ্ছা, ‘নিউ নরমাল’-এর বাংলা তর্জমা করলে কী হয়, বলতে পারেন? গুগুল ট্রানসলেশানে দিব্যি দেখাল ‘নতুন স্বাভাবিক’। তাহলে আগের অবস্থাটা, মানে যতদিন করোনা আমাদের ঘর-দুয়ার-বার-অন্দর সব বেদখল করে নেন নি, ততদিন আমরা কী ছিলাম? ‘পুরোনো অস্বাভাবিক’? তা হবে হয়ত। এই যে একটা করে অতিমারির ঢেউ আসছে আর যাচ্ছে, যেন আপামর বাঙালী আমরা পুরীর সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্চি আর ঢেউ গুনছি, তেমনটা তো আগে ছিল না। তখন আমরা কাজকর্ম শুরুর আগে ক্যালেন্ডার দেখতাম, মনে ভয় কিংবা ভক্তি বেশি থাকলে পাঁজিও দেখতাম, এখন শুধু রোজের আক্রান্তের রেট দেখি, আর একে ওকে জিজ্ঞাসা করি, পরের ঢেউটা কখন আসছে মশাই, সে কি এসে গেল? এই অঘ্রাণে আসবে কি? নাকি শীত কাটিয়ে ঢুকবে? তারপর আশা-নিরাশার মাঝে সন্দিহান হয়ে বলি, আর বোধহয় এল না। এ হল নিউ নরমালের পটভূমি। মাস্ক কানে বা গলায় ঝুলিয়ে আপিস করছি, গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছি, আর বাড়িতে এসে গঙ্গাজল ছেটানোর মতো করে স্যানিটাইজার লাগাচ্ছি। তারপর ধরুন, কথাটা ‘মাস্ক’ না ‘মাক্স’ সে ব্যাপারে সন্দেহ আমার দিনদিন বাড়ছে। আরে, আমার ফ্ল্যাটের লিফটেই লেখা ‘মাক্স পরিধান করুণ’।
এত কথার অবতারণার কারণ যে, এই নতুন স্বাভাবিকের অনেক চেহারা, অনেক ফল। বিচিত্র তার রূপ-রস। তার মধ্যে আমার বাড়িতে অন্যতম ফল হল – জোছনা জমিয়ে গাদা গাদা বাসন কিনছে। বুঝতে পারলেন না তো? কী করে বুঝবেন, অত সোজা নয়, এ যে নিউ নরমাল। বলছি।
দুটো ভ্যাকসিন নেওয়া হতেই নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছিল। সেটা যে মনের আনন্দের কারণে শুধু নয়, অন্য কিছু হ্রাস পাবার কারণে, সেকথা বুঝতে ক’টা দিন সময় লাগল।
একদিন সকালে আধো ঘুমচোখে দেখলাম জোছনা খুব মনোযোগ দিয়ে ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। এমনকী, ফ্যানটাও বন্ধ করল, করার আগে আমায় জানান দিল – ও দিদি, পাখা বন্দ করতেছি।
জানেন, বেগম আখতারের ‘জোছোনা করেছে আড়ি/ আসে না আমার বাড়ি’ গানটা আমারও খুব প্রিয় ছিল একসময়, কিন্তু আজকাল গাইতে বড় ভয় লাগে, আমার বাড়ির জোছনা সত্যি সত্যি হঠাৎ আড়ি করলে আমার সংসার অচল হয়ে যাবে। আমি নেহাতই পরজীবী ধরণের মানুষ।
যাইহোক, জোছনার কাজকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে পাশবালিশ জড়িয়ে আবার নিদ্রাকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিদ্রাদেবী বিশেষ প্রসন্ন হলেন না, বাধ্য হয়ে উঠেই পড়লাম। দেখি, বালিশ আলো করে জড়িয়ে মড়িয়ে চুল। বিশেষ পাত্তা দিলাম না। এদিক ওদিক ঘুরে টুরে এসে দেখি পাপোষে আবার চুল, বেশ থোকা থোকা। জোছনাকে ডাকব কিনা ভাবছি, দেখি তিনি স্বয়ং সোৎসাহে ঝাঁটা হাতে হাজির। খুব যত্ন করে পাপোষ, বালিশ সব ঝেড়ে ঝুড়ে হাতে করে চুল-টুল গুটিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি থ মেরে ভাবতে লাগলুম, অনেকদিন কি মাইনে বাড়ানো হয় নি?
সেদিনটা বোধহয় রবিবার ছিল। ফোন আসার শেষ নেই। সন্ধ্যাবেলায় চা খেতে খেতে চিন্তা করে দেখলাম, চোদ্দটা ফোনের মধ্যে অন্তত সাড়ে বিরাশি শতাংশের বক্তব্য, চুল পড়ে যাচ্ছে। হয় করোনা-পরবর্তী সময়ে, নয় ভ্যাকসিন-পরবর্তী সময়ে। এক ছাত্রী বলল – জানেন দিদি, বাতাসে নিশ্চয় নতুন কোনো ভাইরাস ঘুরছে, তাতেই সবার চুল উঠে যাচ্ছে।
আমি সেসব পাত্তা দিলাম না।
বারবার পাত্তা না দেওয়ার ফলটা কিন্তু অতি লজ্জাজনক হল। এক বর্ষীয়ান সহকর্মীকে দুপুরে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, জল-স্থল-আকাশ কোনোরকম খাদ্যই বাদ পড়েনি, রান্নাও আমি নিজে করেছি। ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হল খুবই তৃপ্ত হয়েছেন। আমিও প্রশংসাবাক্য শুনব বলে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম, রিহার্সাল চলছিল –‘হেঁ হেঁ, এ আর এমনকী, আপনি আমার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন, তাতে আমি---’ ইত্যাদি-প্রভৃতি। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে, তিনিও ধন্যবাদাদি জ্ঞাপনের জন্য মুখ খুলেছেন সবে, হঠাৎ পাতের ওপর চুল - কালো, দীর্ঘ ও চকচকে। ভদ্রলোকের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের সৌজন্য দেওয়া-নেওয়ার পথটিও বন্ধ হয়ে গেল। দুজনেই সেই চুলের দিকে তাকিয়ে রইলুম, যেন শেষপাতে পান বা মুখশুদ্ধি পড়েছে। চুলের যা দৈর্ঘ্য তাতে সেটি যে আমারই, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ রইল না। আর সন্দেহ থাকেই বা কী করে, অতিথির তো মাথা জোড়া টাক। কেউই আর কোনো কথা বললাম না, অদ্ভুত কিছু কেঠো হাসি বিনিময়ে সেই কেশদুষ্ট ভোজনপর্ব সমাপ্ত হল কোনোক্রমে।
ভদ্রলোক বিদায় নিলে দরজা বন্ধ করে আমি আমার আরশি বার করে বললুম – আরশি আরশি, বলো দেখি কেশবরণ কন্যা কে? আরশি ওদিক থেকে মুখ বেঁকিয়ে বলল – আর যেই হোক তুমি নও বাপু। ওই তো পাতলা টিকটিকির মতো বিনুনি হয়, হুঁহ। এই বলে সে কেটে পড়ল। আমিও মন দিয়ে দেখলুম, মাথার সামনেটাতে নিম্নচাপের ঘূর্ণাবর্তের মতো দুটো গোলগোল ফাঁকা স্থান হয়েছে। এই দুটিই কি তবে আসন্ন ইন্দ্রলুপ্তের পূর্বাভাস? ওরে বাবা রে। রাতের ঘুম চলে গেল আমার।
পরদিন সকালে জোছনাকে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি, ঝাঁটপাটে আমার চুল দেখতে পাচ্ছে কিনা, তার আগে দেখি সে একগাল হেসে আমায় একটা স্টিলের ছোট বাটি দেখাচ্ছে। বাটিটি নবীন ও চাকচিক্যযুক্ত। জোছনা গর্বে মাথা উঁচু করে বললে – কিনলুম।
তা বেশ করেছে, জোছনার ধন-মান-বাসন বর্ধিত হউক, কিন্তু আমাকে দেখাবার কারণ কী? বুঝলাম না।
যাইহোক, আমার প্রশ্নটা করতে সে খানিক ঘাবড়াল, তারপর বলল – সে আর পড়ছে নি? গাদা গাদা পড়ছে – এত্তো এত্তো। - তার ‘এত্তো’ বলার ভঙ্গিটা আমার পক্ষে খুবই দুঃখজনক হল। কী আর করা।
বহুদিন বাদে পুরনো বাক্স খুলে মাথার তেল একখান বার করলাম। কার কাছ থেকে কবে কেন কিনেছিলাম, আজ আর মনে নেই। তারিখও উঠে গেছে। যা থাকে কপালে, মন শক্ত করে সেই তেল লাগাতে শুরু করলুম কষে। তাৎক্ষণিক ফল হল এই যে, তেলের গন্ধে আমার রুম পার্টনার মোটাসোটা টিকটিকিটা আমায় একা ফেলে দুদ্দাড় দৌড় লাগল।
পরবর্তী ফল এই যে, চুল আরো পড়তে শুরু করল। জামায় চুল, টবের গাছে চুল, কাগজ-ফাইল-সোফা-বিছানা সর্বত্র চুলে চুলময়। এমনকী, আমার ঠাকুরদার ফটোতেও দেখি চুল, তাতে মুণ্ডিত মস্তক বিংশশতকীয় পণ্ডিত ব্যক্তিও দেখছি ফ্রেমের ওপার থেকে হাসছেন। ব্যাপার ক্রমেই গুরুপাক হয়ে উঠল। এদিকে জোছনা খাটের তলা, টেবিলের তলা, আলমারির পশ্চাৎভাগ – সব জায়গা থেকে টেনে টেনে গোছা গোছা চুল বার করতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, তাতে তার কোনো ক্লান্তি দেখা গেল না। বরং মুখের হাসি চওড়া হতে শুরু করল। তারই মধ্যে একদিন স্টিলের একটা নতুন চামচ সে দেখিয়ে গেল।
কে বলে মানুষ আর আগের মতো পরোপকারী নেই? আমার এহেন দুর্দিনে সকলে এগিয়ে এল নিজ নিজ পরামর্শ নিয়ে। বন্ধু থেকে আত্মীয়, পাড়া-পড়শি, সহকর্মী থেকে শুরু করে ইন্টারনেট – কে নেই সেই তালিকায়। আমারও কেশ পরিচর্চার বহর বাড়তে লাগল চক্রবৃদ্ধিহারে। এই সকালে তেল লাগালুম, তারপর ডিম আর দই দিয়ে হেনা, তারপর শ্যাম্পু, তারপর কন্ডিশানার, তারপর ভার্টিলাইজার… হাঁফিয়ে যাচ্ছি, তবু লড়ে যাচ্ছি। পড়াশোনা মাথায় উঠল। কেবল একটা সমাস সত্য হল – ‘কেশাকেশি’, বা আরেকটু লঘু করলে বলতে হয় ‘চুলোচুলি’।
রান্নাঘরের দিক পারতপক্ষে মাড়াই না। সেখানে পিঁয়াজ খুঁজছি দেখে, রাধুঁনী দিদি অত্যন্ত সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসিল – কী ব্যাপার? পিঁয়াজ কিসে লাগবে?
আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বললুম – চুলে লাগাব।
রাঁধুনী পিঁয়াজ আগলে বলল – খপরদার, একখান মোটে আচে, মাছে দেবো বলে রেকেচি, তাতে হাত দিও নি বলচি।
তার রুদ্রমূর্তি দেখে সাহস হল না, সেই তো, মাছের বরাদ্দ আমার চুলে কী করে লাগাই। মরিয়া হয়ে বলি – তাহলে কালোজিরে বেটে দেবে খানিক? ওটা আসলে পিঁয়াজের বীজ কিনা, যাকে বলে ওনিয়ান সীডস্, চুলের পক্ষে খুব ভালো।
রাঁধুনী এই নতুন জ্ঞান আহরণ করে খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরের ভিতরে অদৃশ্য হল। কিছুক্ষণ পর কিছু কালোজিরে বেটে নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল – তাহলে দিদি, নিরামিষ তক্কারিতে যে কালোজিরে ফোড়ন দিই, আর দেব না তো? আমিষ হয়ে যাবে যে?
আমি খুব দ্বিধায় পড়ে গেলাম, তারপর রেগে গিয়ে বললুম – এ বাড়িতে কোনদিন নিরামিষ হয় শুনি? রন্ধনকারিণী দ্রুতপদে অন্তর্হিত হলেন। অবশ্য তাতে প্রশ্নের মীমাংসা কিছু হল না।
এত কাণ্ড তো হল, চুল পড়া কিন্তু কমল না। আরে, কমল না বলছি কেন, আসলে বেড়েই চলল। গুচ্ছ গুচ্ছ চুল আমার জীবন ভরে তুলল। জোছনা সেই ফাঁকে একটা নতুন স্টীলের গেলাশ দেখিয়ে গেল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম – আচ্ছা, চুল পড়া কি একটুও কমে নি?
জোছনা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল – কই কমল গো, এই দেখো কত্তো পড়েছে।
- কই, কতটা পড়েছে দেখি?
- সে আর কেমন করে দেকবে, সে আমি গুটিয়ে তুলে দিছি। তা বাপু, এমন চলতে থাকলে তো ন্যাড়া হয়ে যাবে গো শিগগির।
এ রকম অনিবার্য ভবিষ্যৎবাণী শুনে যারপরনাই মর্মাহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। আমার অবস্থা দেখে প্রচণ্ড আত্মম্ভরিতায় জোছনা বলল – তা, কত কিচুই তো লাগালে, কত্তো কিচু। চুল পড়া তোমার কমল নি। আর এই দেকো আমাদের, শুদু নারকেল তেল মাখি, আর সাপান, তাতে একটাও চুল পড়ে নি কো। - এই বলে সে একপাক ঘুরে গিয়ে তার একঢাল কালো চুল (মাসান্তে রঙও করে, আমি জানি) দুলিয়ে দুলিয়ে দেখাতে লাগল।
আর সহ্য হল না, আমি প্রচণ্ড জোরে ধমক লাগিয়ে কাজে মন দিতে বললাম। সে বেচারা গুটিয়ে গেল। আমি ঘরে এসে দোর দিলুম।
কী করা যায়? অনেক ভেবে ডাক্তারকে ফোন করলাম। ডাক্তার আমার পুরনো বন্ধু। হেসে বলল – কতটা করে উঠছে? রোজ কটা? গুনেছিস?
না, গুনি নি তো। সে বলল – এ সব স্ট্রেস থেকে হয়, ঘুমোচ্ছিস তো ঠিকঠাক?
- ঘুমবো কী? ঘুমোলেই স্বপ্ন দেখি গোছা ধরে চুল উঠছে।
- বুঝেছি। ঘুমো ভালো করে, প্রচুর জল খা, সবজি খা। বর্ষাটা গেলে আপনিই কমে যাবে। আর খুব বেশি উঠলে বলিস। ওষুধ দেব।
ফোন রেখে ঠিক করলাম, ঝাঁট দিয়ে চুল ফেলে দিলে চলবে না, এক জায়গায় জমিয়ে দেখতে হবে কটা চুল পড়ে।
পরদিন থেকে নিজের চুল সংগ্রহের কাজে লেগে গেলাম। একটা প্লাস্টিকের খামে ভরে ভরে রাখতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম, দিনে একশো পেরোচ্ছে কিনা।
দু’তিনদিন পর দেখলাম জোছনা খেপে উঠেছে। ঝাঁট দিচ্ছে আর বিড়বিড় করছে। মাঝে মাঝে রাঁধুনী দিদিকে গিয়ে কিছু বলছে, দুজনে আমাকে আপাদমস্তক মেপে যাচ্ছে।
এক সপ্তাহ পর চুল পড়ার একটা গ্রাফ আমার সেই ডাক্তার বন্ধুর কাছে পেশ করব ভাবছি, রৌদ্রমূর্তিতে জোছনা এলেন, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, কোমরও কষে বাঁধা, হাতে ঝাঁটা। প্রথমে সে জিজ্ঞাসা করল – চুল পড়া তোমার হটাৎ কমে গেল?
- সে আর কমল কোথায়?
- তবে দেকচি নে যে? একটাও তো পড়চে নি।
আমি বিজ্ঞের হাসি হেসে বললুম – পড়ছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ না, আমি একটা জায়গায় জমিয়ে রাখছি। এই দেখো – বলে তাকে সেই জমানো চুলের রাশি দেখালাম।
প্রথমে সে থ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হাত-পা ছুঁড়ে বলল – আমার আর পোষাচ্ছে নি তোমার বাড়ি। হয় আমার মাইনে বাড়াও, নয় তো এই আমি চললুম।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছু বলতে যাব তার আগেই সে আবার বলতে শুরু করল দ্বিগুণ জোরে, এবার হাত-পা ছুঁড়ে – এত্তো ট্যাকা মাইনে পাও, তবু গরীবের পেটে লাতি মারবে? আরো ট্যাকা তোমার চাই? অ্যাঁ? আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ – এই লাও রইল তোমার ঝ্যাঁটা, চুল ঝাঁট দাও গে। আমি চললুম।
বলে জোছনা ঝাঁটাগাছ সেইখানে ফেলে রেখে দুদ্দাড় চলে গেল।
এ পুরো, ‘কোথা হইতে কী হইয়া গেল, দস্যু মোহন পলাইয়া গেল’। পরদিন জোছনা এল না, কিছু খবরও দিল না। বেগম আখতারের গানটা এবার সত্যিই শুনতে হবে কিনা ভাবতে লাগলাম।
দু’দিন পরের কথা। রাঁধুনী দিদি রান্নাঘর থেকে খুব গজগজ করছিল, আমি সেদিকে কান না দিয়ে ততোধিক মনোযোগ নিয়ে পরীক্ষার খাতা দেখছিলুম। তার অসন্তোষের কারণ - রাতের রান্নার জন্য নির্ধারিত ডিমটি সে ফ্রিজে খুঁজে পাচ্ছে না। তা, পাবে কি করে, সেটি আমি দই সহযোগে মাথায় মেখে বসে আছি। এমন সময় কলিং বেল বাজল। রাঁধুনী দিদির যা মেজাজ দেখছি, তাতে সে দরজা খুলবে সেই আশা নেই। অগত্যা আমিই উঠলাম, মাথায় ডিম-দই নিয়েই।
দরজা খুলতে একজন অত্যন্ত সরু প্রকৃতির ছোকরা গোছের রঙচঙে টিশার্ট পরা ছেলে হাত-পা-গোটা শরীর দুলিয়ে বলল – নমস্কার দিদি। আমি সিনেমাতলার ন্যাপা।
এমন কাউকে আমি কস্মিনকালেও চিনি বলে তো মনে হল না। প্রতিনমস্কার করে আমি বললাম – কী ব্যাপার বলুন তো ন্যাপাবাবু?
ন্যাপা কিঞ্চিৎ এগিয়ে এসে কথা বলতে গিয়ে নাক কুঁচকে সরে দাঁড়াল। ডিম-দই-এর এলেম আছে বলতে হবে। দূর থেকে ন্যাপা বলল – আমায় জোছনা পাঠিয়েছে।
আমি খুব আশান্বিত হয়ে বললুম – জোছনা? তা, সে কবে থেকে আসবে?
- সে আমি কিছু বলতে পারব না দিদি। জোছনার সঙ্গে এতদিন আমার বিজনেসটা ভালোই চলছিল। তা আজ গেছিলুম তার বাড়ি হপ্তার মাল আনব বলে, তাতে সে বললে এখন নাকি আপনিই ডিরেক্ট মাল বেচছেন। তাই আপনার কাছে আসা দিদি। আমি লোক ভালো, কাউকে ঠকাই না, কোনো কমপ্লেন পাবেন না।
আমি নিজেকে আজ দুই যুগ যাবৎ ছাত্র ধরে ধরে জোয়ালে জুতবার সরকারী কাজ করি বলেই তো জানি, আমি আবার বিজনেস শুরু করলুম কবে থেকে? রীতিমতো খাবি খেয়ে বললাম – ন্যাপাবাবু, আপনি ভুল করছেন। আমি কোনো বিজনেসই করি না।
- আমরা সব খবর রাখি দিদি, ও আপনি না বললেও বুঝতে পারছি। শুনুন, আমি কিলো হিসাবে ছয়হাজার দেব। এর বেশি পারছি না। রাজি থাকেন তো বলুন।
- আরে কী মুস্কিল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ন্যাপাবাবু।
- আমি স-অ-অ-ব বুইতে পারচি। আপনি ওই ঘ্যাপলা ব্যাটার কাছে মাল বেচেন তো? ঘ্যাপলা তো ওজনে মারে। ন্যাপা সরু টিঙটিঙে আঙুলটা তার বুকে রেখে ঠেকিয়ে বলল - এ পাড়ায় মাল বেচতে হলে একমাত্তর এই আমি – এই একা ন্যাপা, আর কেউ নয়। - তারপর তার খুদি খুদি চোখদুটোকে যথাসম্ভব বড় করে গ্যাসঘ্যাসে স্বরে বলল - এ পাড়ায় থেকে অন্যরকম চলবে না, বলে দিচ্চি। আপনি ভেবে দেখুন, আমি আবার আসব, আজ চলি মাসিমা।
আমি থ মেরে দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাসিয়ে গেল নাকি? আর দিদি থেকে মাসিমায় উত্তরণটা তো অতি দ্রুত হল।
দরজা বন্ধ করে ফিরে দেখি রাঁধুনী দিদি খুব সন্দেহের চোখে আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে আছে। আবার কী হল রে বাবা? আর তো কিছু সরাই নি আমি রান্নাঘর থেকে। কিন্তু সে বলল – তাহলে তুমি চুল বেচো না?
আমি চুল বেচি? মানে? যৎপরনাস্তি অবাক হয়ে বললাম - চুল কেন বিক্রি করব? আর সে কি বিক্রি হয় নাকি?
রাঁধুনী অবাক হয়ে বলল – ওমা, তাই বলো। দেকো দিকিনি। ওদিকে জোচনা রেগে চলে গেল।
- ব্যাপারটা কী একটু খুলে বলবে?
- আর ব্যাপার। তোমার ক’দিন চুল যা পড়ছিল সেগুলোকে জোছনা একজাগায় করে বিক্কিরি করত, তাই দিয়ে বাসন কিনত। চুলের তো খুব দাম গো। কিলো ছয় হাজার ট্যাকা। শুনেছি তাই দিয়ে নকল চুল তৈরি হয়। ওই যে ন্যাপা এসেছিল, ওর কাছেই বেচত। ওই দিয়েই তো জোচনা বাটি কিনল, চামচ কিনল, গেলাস কিনল। তোমায় তো দেখিয়েওছিল। তা তোমার আরো কিছু চুল পড়লে একখান থালা হত ইস্টিলের, ও দেকে রেখেছিল। সে হল নি আর। - এই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল – তা তুমি তাইলে চুল জমাচ্ছিলে ক্যানে?
- সে তো কতটা চুল পড়ে দেখবার জন্য। হায় কপাল আমার।
রাঁধুনী দিদি আশ্বস্ত হয়ে বলল – তা আমি জোছনাকে গিয়ে বলব’খন। আপাতত তুমি চানে যাও দেখি। ডিমের গন্ধে তো আর টেকা যাচ্ছে না।
নতুন বিজনেস না ন্যাড়া মাথা – ঠিক করতে করতে দেখি, চুল পড়া যথা নিয়মে আপনাআপনিই কমে গেল। জোছনাও ফিরে এল।
মাস দুয়েক পরের কথা। ঘর মুছতে মুছতে জোছনা একদিন জিজ্ঞাসা করল – আচ্চা, তোমার চুল পড়া কমল কিসে?
আমি লেখা থেকে মুখ তুলে বললাম, এমনিই কমল।
তাতে তাকে নিরস্ত করা গেল না। সে আবার বলল – কেন পড়ছিল অত?
- বোধহয় ওই করোনার ভ্যাকসিনের জন্য। অথবা বর্ষার জন্য।
জোছনা আবার জিজ্ঞাসা করল – আর কি ভ্যাকসিন নিতে হবে না?
আমি আনমনে লিখতে লিখতে উত্তর দিলাম – কী জানি? কোনো কোনো দেশে তো তিননম্বর ভ্যাকসিনও নাকি নিতে হচ্ছে বলে শুনেছি। কেন বলো তো?
জোছনা সোৎসাহে উত্তর দিল – তাহলে ন্যাপাকে তখনকার কথা বলে রাকব’খন।
আমি চমকে উঠে জোছনার মুখের দিকে তাকালাম। দেখি তার চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। হায়, তাই কি কবি বলিয়াছেন – ‘তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ’?
[সমাপ্ত]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।