এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  খ্যাঁটন  চেখেছি পথে যেতে

  •  স্মৃতি-স্বাদ

    gargi bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    খ্যাঁটন | চেখেছি পথে যেতে | ১৮ জুন ২০২১ | ৩২৭০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • মাঝে মাঝে মনে হয় বয়স কি তবে সত্যিই হল? তা, বয়স তো তার নিয়মমতোই চলে, কখনো মহা ব্যস্তসমস্ত হয়ে, কখনো বেশ আয়েশি চালে, কখনো বা ঘুমঘোরে। তার মধ্যে বাপু আর নতুন করে বয়স হবার কী আছে? আছে গো আছে। সেই যে যখন পুরোনো কালটাকে বড্ড ভালো লাগতে থাকে, তরতাজা দুঃখগুলো সব সাবেকি চেহারা নেয়, ধূসর অ্যালবামে পড়ে থাকে শুধু হাসি হাসি মুখ, যদিও তার অনেকটাই এই এতদিনের পথ পেরিয়ে আসার গল্প দিয়ে তৈরি, হয়ত আদতে সেগুলো সেরকম ছিলই না -- কিন্তু সবমিলিয়ে মনে হয়ে যদি আবার ফিরতে পারতুম তেমন দিনে, সেদিন বুঝতে হয়, হ্যাঁ, বয়স হয়েছে। তুমি পড়ে রয়েছ যেখানে, তোমার আশপাশটা তার থেকে এগিয়ে চলে গেছে ঢের।

    আমার আজকাল বড্ড বেশি তেমনটা মনে হয়। আটের দশকের কলকাতায় উনুনের ধোঁয়াওয়ালা ভোর, হাতটানা রিক্সা আর মন্থরগতি ট্রামে টানা দিন, পায়রার আর বাসনওয়ালীর ডাকগমগম দুপুর, টিনের সেডে জলপড়ার শব্দভেজা রাত – এমন কত কী। জানো, বয়স হয়ে যাবার একটা বড় রোগ হল, এই এখনকার সময়টাকে সে এক্কেবারে পাত্তাই দিতে চায় না। একালের কিছু কথা উঠলেই, ছুতোয় নাতায় পুরোনো স্মৃতিগুলোকে নাড়িয়ে ঝুড়িয়ে কিছু না কিছু হাতে করে তুলে আনবেই, তা সে জীবনের ফালতু জিনিষপত্তরের যত নীচেই চাপা পড়ে থাকুক না কেন।

    স্মৃতির সাথে নাকি গন্ধের প্রবল যোগ থাকে, এমনটা পণ্ডিতরা বলেন, কিন্তু পুঁথির কথা বাদ দিয়ে যদি নিজের কথা ধরি তাহলে বলব, গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে স্বাদের দাবিও তেমনই জোরদার। সেকেলে বাংলায় যাকে বলে ভোজনরসিক, আর একেলে ভাবভঙ্গিতে যাকে বলে ‘ফুডি’, তুমি যদি তাই হও, তবে আমার কথাটি দিব্যি মনে ধরবে। এখনই বলতে শুরু করবে, আহা কী সেই যে চিকেন চাপ, ফিস কবিরাজি, ডিমের ডেভিল, মাটন রিরিয়ানীর আলু…। কিন্তু আমার গল্পটা অন্যরকম। কারণ আমার শৈশব-বাল্য-যৌবন নিতান্ত নিরামিষ খাদ্যাভাসে কেটেছে।

    এই কথাটা শুনেই ঝপ করে যখন লেখাটা পড়া বন্ধ করে দাও নি, তাহলে বাকিটা বলেই ফেলি। আসলে নিরামিষেরও তো স্মৃতি হয়, আমার কাছে খুব বেশি করেই হয়। এই যেমন ধরো, আজ বর্ষা। শহরের বাড়িগুলোর মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেঘগুলো থমকে দাঁড়িয়ে আছে দিনভর, মাঝে মাঝে খুব ঝেঁপে বৃষ্টি নামছে, কাকগুলো চুপচুপে হয়ে ভিজছে, বৃষ্টি থামলে পালক ঘষে ঘষে শুকনো হচ্ছে। এমন দিনে বাঙালীত্ব রক্ষার খাতিরে বিধিমতো খিচুড়ি হয়েছে। সঙ্গে পোস্তোর বড়া আর বেগুনি, চাটনি বাদ গেছে রক্তে চিনির ভাগের কথা মাথায় রেখে। খেতে বসে প্রথমটায় রাঁধুনী তাঁর প্রাপ্য প্রশংসাই পাচ্ছিলেন, কিন্তু ওই যে, বয়স। তা সে এখনকার খিচুড়ির কথা থেকে সোজা আমাদের রওনা করিয়ে দিল পঞ্চাশের দশকের খিচুড়িতে। পরিবারের বরিষ্ঠ ব্যক্তি, মানে আমার বাবা বলল - খিচুড়ি দেখলেই মনে পড়ে কিশোরীদার কথা। আমাদের বাড়ির নীচে দোকান দিয়েছিল। খিচুড়ি রান্না করলেই ডাক দিত আমায়। জানিস, শুধু পেঁয়াজি ভাজত, বেসন টেসন দিয়ে নয়, ডাল বেটে পিঁয়াজি। আহা কী তার স্বাদ। ঝুড়িতে পড়তে না পড়তে উবে যেত। তারপর একদিন মদ খেয়ে মাতালরা রাত্তিরবেলা পিঁয়াজির খোঁজে এল, পেল না তো অত রাত্তিরে। ব্যাস, দরজা ভেঙে দিয়ে চলে গেল। কিশোরীদাও বলল, দুত্তোর। তারপর দোকান তুলেই দিল। - বলে বাবা আজকের খিচুড়ি-পিঁয়াজির মধ্যে কিশোরবেলার কিশোরীদাকে খুঁজতে শুরু করল যেন।

    যে বাড়ির কথা উঠল, সেটা আমাদের পুরোনো বাড়ি, উত্তর কলকাতার সিমলে পাড়ায়। খাস বিবেকানন্দের বাড়ির কাছেই। কিন্তু এত কাছাকাছি বলেই হয়ত মহামানবের ব্যাপারটাতে তত গুরত্ব দিই নি। বরং তার থেকে আমার মন টানত বিবেকানন্দের বাড়ির ঠিক আগেই ডানদিকে একটা ছোট্টমত গুমটি ঘরের তেলেভাজার দোকান। তেমন নামকরা কিছু নয়। নাম ছিল বটে শ্যামবাজারের দিকে যেতে স্কটিসচার্চ স্কুল পার হয়ে তেলেভাজার মস্ত দোকানটার, সেখানে নাকি তেলেভাজা খেয়েছিলেন স্বয়ং নেতাজি। তার তুলনায় নিতান্ত অর্বাচীন আমাদের এই পাড়ারটি। কিন্তু শীতের দিনে ফুলকপির বড়া, তার তুলনা কোথাও হত না। বেসনের চামড়াটা তুললেই ভেতর থেকে সাদা ফুলকপির টুকরোকে পাশ কাটিয়ে গরম ভাপ বেরোতো, তাতে স্কুল থেকে ফেরার মনখারাপ ফুস হয়ে যেত নিমেষে।

    ফি সন্ধ্যায় না হলেও, মাঝে মাঝেই মেজ মেশোমশাই অফিস ফেরত বন্ধুদের আড্ডা ফেরত আমাদের বাড়িতে এসে জিরোতেন। সবদিনই শুধু চা খেতেন, অন্য কিছু খাবার অনুরোধ করলে বলতেন, নিরঞ্জনে খেয়ে এলুম বড়দি, পেটটা বড্ড আইঢাঁই করছে। পড়ার ঘর থেকে আড়ি পেতে শুনে ভাবতুম, নিরঞ্জনটা কি তাহলে লোকের নাম নয়? পরে জানলুম, সেটা চপ-কাটলেটের দোকান। গিরিশ পার্কের কাছে সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর এই দোকানে নাকি ডিমের ডেভিলের জন্য রোজ লাইন পড়ে। কিন্তু ডিম তো খাই না, অগত্যা সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো করে একদিন ভেজিটেবিল চপ এল। ওরে বাব্বা, কী তার চেহারা, খসখসে আস্তরণের নীচে বিটের লালচে আভা। হাঁফিয়ে যেতুম খেতে খেতে, অদ্ধেক শেষ হতে না হতে ভাগীদার খুঁজতুম। আর স্বাদ?

    পুরোনো দিনের খাবারের স্বাদ বলে আমরা আসলে যা ভাবি, জানো আমার মনে হয়, সেটা শুধু খাবারের স্বাদ নয়, আরো অনেক কিছু একসাথে। চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়-র সাথে জড়িয়ে থাকা ঘটনাগুলোর থেকেও যেন একধরণের রস নিঃসৃত হয়ে অতীতকে জারিত করে, পুরোনো মদের মতো তার নিজস্ব স্বাদকে ছাপিয়ে একটা আলগা, কখনো না ফুরোনো ভালোলাগা মনের জিভে লাগিয়ে রাখে আজন্মকাল।

    যে বাড়িতে থাকতাম, সেটা ভাড়ার বাড়ি ছিল। এখন যেমন নিজের অন্তত টুবিএইচকে ফ্ল্যাট না থাকলে মুখ দেখানোর উপায় নেই, এমনটা তখন ছিল না তো, তাই ভাড়ার বাড়িকেই দিব্যি নিজের বাড়ি বলে মনে হত। সে বাড়ির একতলায় একটা মিষ্টির দোকান। ভোর হলে কচুরির সঙ্গে সুজির হালুয়ার সুবাস ছড়িয়ে পড়ত। আমিও কচুরির জন্য নিয়মিত ঘ্যানঘ্যান জুড়তাম। অবশেষে দোতলা থেকে থলি নামত, থলিতে টাকা, আর সঙ্গে চেঁচানি – ওরে অমুক, কচুরি দে তো। অমুকমশাই জানত, ঠিক কটা কচুরি। ছোট ছোট ফুচকার মতো ক্লাব কচুরি আর হালুয়া শালপাতা জড়িয়ে থলেতে চড়ে বসে নাচতে নাচতে ওপরে উঠে আসত। এই থলিতে করে বিক্রিবাটা কেনাকাটা আজকের অনলাইন শপিং-এর ঠাকুরদা বলতে পারো। দড়ি বাঁধা থলেতে ভর দিয়েই উঠে আসত আলু-পিঁয়াজ-তেল-বিস্কুট-আটা, মায়, খাতা-পেন্সিল-চকোলেট-ক্যাম্পাকোলা পর্যন্ত। তো, তেমন করে থলিতে চড়ে আসা কচুরি খেতে খেতে একদিন দুম্‌ করে ভীষণ জোরে আওয়াজ শুনলাম। ছুটে গিয়ে জানলা দিয়ে দেখলাম, রক্তাক্ত একটা ছটফটানো লোককে ধরে কারা নিয়ে যাচ্ছে। বোমা বাঁধতে গিয়ে হাত উড়ে গিয়েছিল স্থানীয় মস্তানের। আর সেদিন কচুরি খাওয়া হয় নি আমার। তখন পাড়ায় পাড়ায় ঝামেলা আর বোমাবাজি লেগেই থাকত। ভয় পেতাম, আবার পেতামও না।

    হেদুয়ার দিকে যেতে বাঁদিকের ফুটপাত ঘেঁষে কাঠের বড় ডাব্বায় ডালপুরি নিয়ে বসত একটা লোক। পুরি ভাঙ্গলে ঝুরঝুরে ডাল গড়িয়ে পড়ত ফ্রকে। তার উলটো দিকে সরু দোকানে কাঁচের জারে নানা জন্তুজানোয়ারের আকারে ছোট ছোট বিস্কুট থাকত। পাশের জারে চিনি মাখানো জেলি লজেন্স আর হজমি। হজমির মধ্যে রাজা ছিল কারেণ্ট সল্ট। সম্ভবত লেবুমাখানো নুন শুকনো করে তৈরি। একবার চাখলে তুমি আর চোখ খুলে রাখতে পারবেই না, এমনই টক। আমরা বিচ্ছুরা বলতুম, চোখ মারা নুন। রীতিমতো বাজি ধরা হত, এটা খেয়ে চোখ খুলে রাখতে হবে পাক্কা এক মিনিট। না পারলে আজকের হজমির টাকা সে দেবে।

    সেই দিকে আরেকটু হাঁটলেই বেথুন কলেজের আগে চওড়া রাস্তায় সারি সারি মিষ্টির দোকান। এগারো-বারো ক্লাশে তখন বেথুন কলেজেই পড়ি। গার্লস কলেজ। তার উলটো দিকে হেদুয়া পেরিয়ে স্কটিশ, কোয়েড। বলাই বাহুল্য, নারীমাত্র-অধ্যুষিত মহাবিদ্যালয় থেকে হেদুয়া পেরিয়ে কৌতূহল নিত্যদিন আসাযাওয়া করত। তা ওপারেরও এ ব্যাপারে নিষ্ঠা কম ছিল না। কিন্তু সেসবে মন দিত না আমার নাদুসনুদুস গোলগাল চেহারার সহপাঠিনী। তার মনে মনে ভাসত নকুড় নন্দীর তালশাঁস। তার অবশ্য দোষ নেই। সার লাগানো দোকানে ঘোলা কাঁচের বারকোশ, তার মধ্যে থরে থরে অপেক্ষমান রকমারি সন্দেশ, পান্তুয়া, রাবড়ি, গুঁজিয়া। একটু দূরে বসে কয়েকজন কাঠের পাঠাতনে ছানা মাখছে ঘষে ঘষে, সেখান থেকে সেই মোলায়েম ছানামাখা নতুন চেহারা পেয়ে কিসমিস-রাংতা-এলাচ-লবঙ্গ পরে অ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে করে বারকোশে এসে ঢুকছে। তারও পেছনে বিশাল কড়াইতে দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। সেই ধোঁয়া ওঠা গন্ধ পারলে ওড়নাতে বেঁধে নিয়ে ফিরতাম। এই সব দেখে দেখিয়ে, চেখে চাখিয়ে একদিন আবিষ্কার করলাম আমি দিব্যি আমার সহপাঠিনীর কাবুলিওয়ালা বনে গেছি। বাড়ি থেকে হাতখরচা পেতুম দিনপ্রতি তিনটাকা (এখনকার কলেজপড়ুয়ারা শুনলে নির্ঘাত নাক সিঁটকবে), তার থেকে ধার দিয়ে সপ্তাহান্তে কিছুই বাঁচাতে পারতুম না, সবই ফাঁকা হয়ে যেত তার মিষ্টির যোগান দিতে। অনেক পরে খবর নিয়ে দেখেছি, তার নাকি বর্তমানে হাই ডায়াবেটিস। হায় রে!

    এদিকে আমার নজরও ছিল হেদুয়া পেরিয়ে। না না কোয়েডের দিকে নয়, বসন্ত কেবিন পেরিয়ে ক্যাপ্রির (নাকি ক্যাফ্রি?) দিকে। সে অঞ্চলের প্রথম চাইনিজ দোকান। চাইনিজ মানে আমার জন্য শুধু ভেজ ফ্রায়েড রাইস আর চাউমিন। কুচোনো লঙ্কা মেশানো ভিনিগারে সেই প্রথম চিনকে চিনে নেওয়া। ইস্‌স্‌। ভাবতেই জিভে জল।

    মিষ্টির কথা উঠল যখন তখন বলি, এক নামকরা দোকানের কল্যাণে রাবড়ি বলে দুধে ডোবানো ব্লটিং পেপার খেয়েছি বহুদিন। পরে জানাজানি হতে থানা পুলিশ হয়ে বন্ধ হয়ে যায় দোকান। কিন্তু বলতে বাধা নেই, ওমন খাসা রাবড়ি আর কোথাও পাই নি।

    নোনতা খেতে ভালোবাসতুম বেশি। তাই রূপবাণী সিনেমাহলের নীচের দোকানে ছোট ভেজিটেবল চপ সিনেমা দেখতে যাবার আসল আকর্ষণ ছিল। রূপবাণী উঠে গেছে অনেকদিন। যেমন উঠে গেছে সেই বিশাল বিশাল আকারের ল্যাংচা বিক্রেতা দোকান। ওপাশে আবার শ্রীমাণি মার্কেটের দিকে যেতে একফালি সরু দোকান। ঋষির দোকান। সরবতের জন্য লম্বা লাইন পড়ত। অমন জাদু ঋষিমশাই কোন হিমালয়ে তপস্যা করে পেয়েছিলেন কে জানে? অত নামডাক ছিল, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার আমি কোনোদিন চাখি নি।

    বাজারের গা-লাগোয়া আরেকটা খাবারের দোকানের নাম না করলেই নয়। আরে, নাম বলতে তো তেমন কিছু ছিলই না। সক্কলে একডাকে চিনত উড়ের দোকান বলে। সেটাই নাম গো। উনুনের ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া দেওয়াল, মধ্যিখানে কাঠের বেঞ্চি-টেবিলে বসার ব্যবস্থা। কিন্তু বেশ পরিষ্কার। জলখাবারের লুচি থেকে শুরু করে দুপুরের ভাত, রাতের রুটি সব পাওয়া যেত, তবে সবই ষোলআনা পাক্কা নিরামিষ। বসে খাবার সাথে টেক অ্যাওয়েও ছিল। আমাদের বাড়িতে রান্না না হলেই সোজা উড়ের দোকান। চেহারায়-বয়সে ছোট্টখাট্ট আমি মাথা উঁচিয়ে দেখবার চেষ্টা করতাম, ওই যে কেমন গায়ে সুন্দর করে দাগ কাটা এক সাইজের পটলভাজা, টকটকে লাল রঙের ঝোলে ডোবানো ধোকা, লম্বা ফালি করে কাটা বেগুন ভাজা, তপতপে নরম ছানার বল। তার ঠিক পেছনেই পৈতেওয়ালা সরু ডিগডিগে খালি গায়ে কাঁধের ওপর লাগানো একটা তিলককাটা মুখ। ইনিই স্বয়ং উড়েমশাই। নিজের কাজ সম্বন্ধে খুব নিষ্ঠাবান। বাজারে এঁর দর্শন পাওয়া মানে নাকি আর কোনো তরতাজা সবজি অবশিষ্ট নেই, সবই বেছেবুছে তাঁর থলিতে গিয়ে ঢুকেছে। দীর্ঘদিন কলকাতায় কাটানো উড়েমশাই অর্ডার নিতেন আর হেঁকে বলতেন – গোটে বেগোন দিবে, চারিটা ধোকা দিবেএএ।

    তা, পাড়ার দোকানগুলোর সব এইরকমই নাম হত। এই যেমন ধরো, খুড়োর মিষ্টির দোকান। শুনেছি সেই নামটাই আজও আছে। খুড়োর বয়সের গাছপাথর ছিল না। সর্বজনীন খুড়ো, পাড়ার সবাই বংশপরম্পরায় খুড়ো বলেই ডাকে।

    বাবা বলল - ওরে বাবা, খুড়োর কথা আর বলিস না। একবার দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই সন্দেশটা বাসি নয় তো? হঠাৎ দেখি সন্দেশের ওপার থেকে একটা কালোমতো মুণ্ডু বেরিয়ে এল। তারপর চোখ ঘুরিয়ে বলল, শোনো খোকা, আমার দোকানে কোনো কিছু বাসি হয় না, বুঝলে?

    - তোমাদের ছোটবেলাতেও খুড়োর দোকান ছিল নাকি?

    - ছিল না মানে? ওখান থেকেই তো আমরা ছাই নিতাম। সবচেয়ে বেশি ছাই তো ওখানেই পাওয়া যেত।

    - ছাই??

    - মশাল জ্বালাতে ছাই লাগত তো। সেই করতে গিয়ে একবার মাথার চুল পুড়িয়ে ফেলেছিলাম।

    - সেকি?

    - আরে, শোন তাহলে। নেতাজির জন্মদিন। মশাল নিয়ে লাইন দিয়ে শোভাযাত্রা। গান হচ্ছে, ভেঙ্গেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়। মহাজাতি সদনের কাছাকাছি, হঠাৎ একটা ষাঁড় কী করে জানি ভয় পেয়ে ঢুকে গেল লাইনে। লাইন ছত্রভঙ্গ। এ ওর ঘাড়ে, সে তার ঘাড়ে মশাল ফেলে দিল, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। দমকল এসে শেষমেষ আগুন নেভাল। মাঝখান থেকে আমার চুল গেল পুড়ে। বাড়িতে ফিরে বাবার হাতে কী মার।

    আমি জোরে হাসতে হাসতে উঠে পড়তে গেলাম, হাত ধুতে হবে, খাওয়া তো কখনই শেষ, খিচুড়ি লাগা হাত শুকিয়ে কাঠ। এদিকে আবার বৃষ্টি আসছে। জানলাগুলো বন্ধ করতে হবে। বাবা বলল – বোস। গল্পটা এখনো শেষ হয় নি। সেদিন আরো একটা ঘটনা ঘটেছিল। পাড়ায় একটা লোহার দোকান ছিল। কামারের ছেলেটা বড় দুষ্টু। তাই সুন্দর করে তার পায়ে লোহার আলগা বেড়ি পরিয়ে রাখত, আর নিজে হাপর টানত। সেদিন সেই নেতাজীর প্রশেসানে যাবার জন্য ছোট ছেলে বায়না ধরেছিল খুব। নিয়তির কী অদ্ভুত খেলা, সেদিনই ওর বাবা বেড়িটা কেটে আর কারোর সাথে যেতে দিয়েছিল। জানিস, ওই আগুনে ছেলেটা মারা যায়। - বাবা হঠাৎ চুপ করে গেল।

    বাইরে বাজ পড়ল খুব জোরে। আমি ধড়ফড় করে উঠে গিয়ে জানলার পাল্লাটা ধরে টান দিলাম। ঝোড়ো হাওয়ায় উথালপাতাল হয়ে গেল ভেতরটা। এপাড়াটায় শোরগোল কম, মানুষের বসতি আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দ্রুত ওপরে উঠছে, মাটির সাথে দূরত্ব বাড়ছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে যেন গাছের মাথা ভেদ করে ওঠা ওই কেঠো চেহারার বাড়িগুলো ধারাস্নান করছে। হয়ত ওখানেও অনেক কথা জমে, সেগুলো তরল হচ্ছে এই মরসুমি আবেগে।

    স্মৃতি কি বিষম বস্তু। ওই আবছায়া হয়ে আসা রাস্তার মতো, খানিক দেখা যায়, খানিক নয়। ওপথে চলে এসেছি, ফেলে এসেছি কত। তবু সে চলাটা পায়ে পায়ে থেকেই যায়, জড়িয়ে ধরে, অকারণে পিছু টানে। বৃষ্টির এপারে দাঁড়িয়ে আমরা জলের ছাঁটে চোখ বুজি, মন ভিজে যায়। বয়স হল হে, সত্যিই বয়স হল।

    [সমাপ্ত]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • খ্যাঁটন | ১৮ জুন ২০২১ | ৩২৭০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    দরজা - gargi bhattacharya
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৯ জুন ২০২১ ০৭:০৮495065
  • এই রকম বয়স হওয়া ভাল। নইলে এতো সুন্দর নস্টালজিক লেখা পেতাম কি করে? দিদি, আপনার লেখার গ্রাহক হলাম। 


    এই লেখায় আটের দশকের কলকাতার সঙ্গে শৈশবের ঢাকার একটি অস্পষ্ট মিলও যেন পেলাম, বেহায়া মন। 


    "পুরোনো দিনের খাবারের স্বাদ বলে আমরা আসলে যা ভাবি, জানো আমার মনে হয়, সেটা শুধু খাবারের স্বাদ নয়, আরো অনেক কিছু একসাথে।"


    এই হলো মোদ্দা কথা। আপনার বাবার শেষ স্মৃতিকথায় মন বিষন্ন হলো, অনেক বছর আগের কথা তবু। 


    অনুগ্রহ করে দেখুন তো, ফন্টটি বদলে "বংশী আলপনা" বা "কালপুরুষ" করা যায় কি না, এই ফন্টটি খুব চোখে লাগছে।


    অনেক শুভ কামনা। আরও লিখুন

  • Ranjan Roy | ১৯ জুন ২০২১ ০৭:৪৩495068
  • খুব ভাল লাগল। 

  • gargi bhattacharya | ১৯ জুন ২০২১ ০৮:৩৬495069
  • অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। 


    আমি আসলে ডক-ফাইলে লিখে এখানে কাট-পেস্ট করি। সেখানে লিখি কালপুরুষে, এখানে এসে কোন মন্ত্রবলে এমন একখান ফন্টের চেহারা নেয় কে জানে! তবু, পরের বার খেয়াল রাখব, দেখব যদি যন্ত্রপাতির কেরামতি কিছু করতে পারি।

  • সায়ন্তন চৌধুরী | ১৯ জুন ২০২১ ০৯:১৬495070
  • পেস্ট করার সময় Ctrl+V না মেরে Ctrl+Shift+V মারুন; ফরম্যাটিং ছাড়া শুধু টেক্সট আসবে।

  • gargi bhattacharya | ১৯ জুন ২০২১ ০৯:৫৯495071
  • বেশ, তাই করব। ধন্যবাদ। 

  • Ranjan Roy | ১৯ জুন ২০২১ ১১:৪২495074
  • সায়ন্তন,


      ধন্যবাদ। এটা আমিও শিখে নিলাম।ঃ))

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন