শীতের বেলা পড়ে এলে তাতে কেমন করে জানি মনখারাপের সুরটি আপনাআপনিই বাঁধা পড়ে। যেন কেউ একান্তে নিমগ্ন হয়ে চক্ষু মুদে বেহালার ছড় বাজাতে থাকে, তার বিষাদ-যন্ত্রের রাগ-রাগিনী দূর হতে দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে - চরাচরকে ছুঁয়ে ফেলে, আমায় ছোঁয় নিবিড় করে - আমার এই জ্বরসন্তপ্ত বিছানায় সে নিজেকে বিছিয়ে দেয়।
আজ আমার ছুটি। আজ কেন, ক'দিন ধরেই ছুটি। বন্ধ দরজার এপাশে সঙ্গী বলতে ওষুধের ঢের, যদি প্রয়োজনে লাগে এমন অক্সিজেনের ক্যান, আর উদ্বিগ্ন কাছের মানুষদের ফোনালাপ। কথাও বেশি বলতে ইচ্ছে হয় না। কেমন যেন ঝিম ধরে আসে। বেহালার বিষাদ শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে চায়। কিন্তু চোখ বুজলে দেখতে পাই ঘন অরণ্যে সন্ধ্যা নামছে দ্রুত, আমরা ক'জন পথ হারিয়ে উৎকণ্ঠায় এবড়োখেবড়ো পাথুরে মাটিতে ছুটে চলা জিপের হাতল শক্ত করে ধরে বসে আছি। দরজা যখন আজ আবার বন্ধই হয়ে গেছে, তখন এই মুক্তির গল্পটাই বলি নাহয়। হয়ত ক'দিন আগে এসব না ঘটলে আজকের কষ্টটাকে এত সহজে এমন করে উপেক্ষা করতে পারতুম না।
এই তো জীবন দিব্যি গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছিল, হঠাৎ থামে গেল। বহু যত্নে শিখেছি, জীবনে এমন অনেক চাওয়াই হঠাৎ করে থেমে যায়, স্রেফ হয় না। কে জানে সে যে কীসের দুর্ভেদ্য ভাগ্যরেখাজাল, যার মধ্যে আটকে পড়ে আকাশ দেখা হয় না, ছোঁয়া হয় না যা আপন করতে চেয়েছিলাম কখনো। কিন্তু সেই না দেখা, না ছোঁয়াগুলো কখনোই ততটা বড় নয়, যতটা জীবনের ব্যাপ্তি। যেখানে কেবল আমিই আমি, সেখানে সেই নেই-এর পর্বগুলো দীর্ঘায়িত হতে থাকে, যন্ত্রণা গভীরতর হয়। তাই বৃহতের সামনে গিয়ে কি কখনো দাঁড়াতে হয়? - যে বিপুলতার মাঝে আপনাআপনই মাথা নত হতে আসে, নিজেকে এক বিশাল অপরিমেয় ছবির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ বলে দেখতে পাওয়া যায়? সেই অচিন চিত্রকরের তুলির একটি টানে আমার জিয়ন কাঠি জাগে। নাকি আমরা চিরাচরিত এক স্রোতে ভেসে যাচ্ছি, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাই, তার কোনো ঠিকানা নেই। শুধু সেই বৃহতের ক্যানভাসে স্থানে স্থানে নির্দিষ্ট আকৃতি-রঙ ভরার জন্য আমি, ব্যাস সেটুকুই, আর কিছু নয়।
লোকে বাঘ দেখতে যায় রণথম্ভোর। শুনেছি কেবল অতি দুর্ভাগাদেরই দর্শন হয় না। তা, আমিও সেই দুর্ভাগাদের একজন বলে ভাগ্যবানরা দেগে দিল। আমি নির্বিকারই ছিলাম। কারণ আমি শুধুমাত্তর বাঘ দেখতে যাই নি। বরং দেখতে পেলেই অবাক হতুম। বাঘেদের সাথে আমার চিরকালের আড়ি। তা, জঙ্গল কি আর কেবল বাঘের? কতশত যে শম্বর হরিণ দেখলুম, তার কি? আমরা তাদের দেখলুম, তারাও আমাদের দেখলে, অবাক চোখে নয় মোটেই। আমাদের মতো জীব তারা নিত্য দেখে, এই এমন করে ‘হরিণ হরিণ’ বলে লাফিয়ে ওঠা, সাতহাত লম্বা যন্তর বার করে ঝপাঝপ ছবি তোলা - এসব তাদের রোজকার জলভাত- থুড়ি জলঘাস। তাই তারা নিশ্চিন্তে চরতে লাগল।
দেখি দীর্ঘদেহী একা পুরুষ শম্বর জল খেতে এসে কাদায় মাখামাখি হয় আপনমনে, শিং দিয়ে গা ঘষে পরম সুখে। খেয়ালও করে না আমরা সেসব হাঁ করে গিলছি। তার থেকেও দীর্ঘদেহী নীলগাই গাছের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে পাতা চিবোয়। সত্যি, কালোর মধ্যে একটা নীল আভা গায়ে। নীলগাই আসলে এর ডাক নাম, দেবভাষায় ভালো নাম গবয়। আস্ত একখান প্রমাণলক্ষণ জুড়ে গবয়ের নাম, বর্ণনা। প্রতিবছর পড়াতে গিয়ে ছেলেপুলের মুখে বিশ্বাসের ভঙ্গী ফোটে না দেখেছি। তাই এবার হাতেনাতে ফোটোবন্দী করলাম।
আচ্ছা, পাথুরে জমির মাঝে ঘাস দেখতে পায় কি করে ওরা? ওই ছোট ছোট হরিণেরা? যাদের সকলের মাথায় ঘোরানো ঘোরানো ছোট ছোট শিং। গাইড বলে, ওরা গজল। যদিও ইন্টারনেট বলে এরা gazelle, তবু পীতাভ এই বনে নিশ্চিন্তে কেমন নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ানো এদের গজল বলতেই ইচ্ছে করে।
বড় হরিণদের মাথায় শিং-এর কত কারিকুরি। কিন্তু বিপদেরও। গাছের ডালে আটকে যায়। শিং-এ আঘাত লাগলে তারপর মাংসপিণ্ড হয়ে ঝুলতে থাকে কান বরাবর। অমন একটা করুণমুখের হরিণও দেখলাম। আর সেই তন্বী সুন্দরী শম্বর হরিণীকে তো ভোলবার নয়। সরু পাহাড়ি রাস্তায় একা তার সাথে মুখোমুখি। দুখানি দূরসঞ্চরমাণ আঁখি নিয়ে সে নির্নিমেষে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলে। আজকের অমিত-লাবণ্যের দেখা এখানেই হতে পারত। সকালের হালকা রোদে তার অপরূপ মরমিয়া ভঙ্গীটি আমি সারা জীবন মনে রাখব। আমাদের জীপ নাছোড়বান্দা হয়ে সেখানেই দাঁডিয়ে রইল দেখে সে মুখ নিচু করে রাস্তা ছেড়ে পাহাড় বরাবর নেমে গেল।
যদিও এটি ১৩৩৪ স্কোয়ার কিলোমিটার জুড়ে ন্যাশানাল রিজার্ভ ফরেষ্ট, প্রহরা আছে আধুনিক। তবু মন কেন বলে, কে যেন এই পাহাড় ঘেরা অরণ্যে এই কাজলনয়নাদের দূর হতে লক্ষ রাখে, রক্ষা করে। যেন আরেকটু এগোলেই জটাজূট খষি এসে ঋজু ভঙ্গীতে হাত তুলে দৃঢ়স্বরে বলবে - দাঁড়াও হে, কোথায় তোমার বজ্রকঠিন তীক্ষ্ণধার বাণ, কোথায় এই হরিণদের কোমল দেহ! ফুলে কি আগুন লাগাতে চাও? কিন্তু হায়, তবু তো দুষ্যন্তের বাণ থেকে শকুন্তলার আহত মন কেউ রক্ষা করতে পারে নি।
সে তো সেই মালিনী নদীর তীরের গল্প, কিন্তু তেমনই এখানেও এই চম্বল আর বনাশ নদীর মাঝের বন্যভূমিতে কত বাঘ-বন্য জন্তু কেবলমাত্র মৃগয়ার উত্তেজনায় বলি হয়ে গেছে। শুনেছি এই রণথম্ভোরের নামটা রণস্তম্ভ থেকে এসেছে। চৌহানদের যুদ্ধজয়ের নিশানা বোধহয়। এ অঞ্চলে তাদের একটা দুর্গও এখনো আছে, তাতে আজ গাঁ-ঘেঁষাঘেঁষি সপ্তাহান্তিক ভিড়ও আছে। দুর্গ লাগোয়া জঙ্গলে রাজাদের বাঘ শিকারের আয়োজন হত, পরে জয়পুরের মহারাজারাও নাকি আসতেন এখানেই। নিশ্চয়ই অনেক তামঝাম করে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে মশাল জ্বালিয়ে। জানি না, হয়ত এমনটাই হয়েছে। যাক, সেসব দিন গেছে। পড়ে রয়েছে দুর্গের পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষ - এদিক সেদিক আনাচে কানাচে। জঙ্গলে ঢোকার অনেক আগেই চওড়া পিচ বাঁধানো রাস্তার একপাশে শুকিয়ে আসা জল, তার মধ্যে লম্বা প্রাচীরের অংশ। পরিখা কি এটাই ছিল? অতীত কিছু বলে না। আমাদের জিপও হিমশীতল বাতাসকে চিরে চলে যায়। তারমাঝে মুখ তুলে দেখি, ওই ওই দূরে পাহাড়ের ওপর দিয়ে সীমানার প্রাচীর চলে গেছে, হলদেটে ঘাসেদের মাঝে মিলিয়ে গেছে ভাঙ্গা টুকরো তাদের। রাজবংশ আসে যায়, ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীদের কলমে। দৃপ্ত উদ্ধত পাহারা দেবার গম্বুজ ওই প্রাকারের শেষে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে - আজ শূন্য, নির্বাক, একাকী।
প্রকৃতির রূপের তুলনা করা নেহাত মূর্খামি, তবু বলি, জঙ্গল অনেক ঘুরলেও এমন পাহাড় ঘেরা বনভূমি দেখার সৌভাগ্য হয় নি আগে। কিন্তু সহযাত্রীরা যে খোঁজে শুধু বাঘ। দশ নম্বর ট্র্যাকে বাঘিনী দুটো বাচ্ছা দিয়েছে। কদিন আগে অরণ্য-ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। তার ওপর উপরি পাওনা, এইখানেই কাল একজন বাঘমহাশয় একটা গরু মেরেছে। আজ সকালে সাত নম্বর ট্র্যাকের ড্রাইভারটি একটিও বাঘ বাগাতে না পেরে বিনিপয়সায় দেদার জ্ঞান দান করেছে। তারই কিছু রইল এখানে - বাঘ খুবই স্বার্থপর প্রাণী, এবং গম্ভীর। একা ঘুরতে ভালোবাসে, একা থাকতে ভালোবাসে। নিজের করা শিকার ভোলে না, একাই খায়, ভাগ দেয় না, অন্তত যতক্ষণ না তার পেট ভরেছে। কেবলমাত্র, বাঘিনীর সঙ্গে মিটিং-এর সময় যদি কোনো শিকার হয়, তবে বাঘিনী ভাগ পায়। তারপর যে যার পথে। আমার এক মিচকে বন্ধু শুনে বলল - ব্যাপারটা মন্দ নয় বলো? মনুষ্যসমাজ এখনো কতো পেছিয়ে। আমি বললুম, য্যাঃ।
যাইহোক, এইটুকু অন্তত বোঝা গেল, আজ দশ নম্বরে সে সদ্য শিকারী বাঘ তার মৃত শিকার খেতে আসবেই। সে জায়গাটা ভারি সুন্দর। জিপ চলে তৈরি হওয়া রাস্তা ভিজিয়ে এদিক থেকে ওদিক বিস্তৃত জমা জল। জল যেখানে শেষ সেখানে ঘাসে ঢাকা জমি শুরু, তারপর সবুজ পাহাড় মিশে যাচ্ছে দুপুর-শেষের ধোঁয়া ধোঁয়া আলোয়। কাছেই প্রচুর পানকৌড়ি চান সারছে, ভেজা ডানা উন্মুক্ত করে জলে নিজের ছায়া দেখছে। জলের আরেকদিকে দুটো লম্বা-পা পাখি জলের ধার ধরে ঘোরাফেরা করছে, একে অপরকে ক্রমাগত ডেকেই যাচ্ছে। গাছের ডালে বসে মাছরাঙা মাছের জন্য তাক করছে। এমন সময় মন্থর গতিতে জলের ওপাশে পাহাড়ের দিকটাতে একটা শম্বর হরিণ এসে দাঁড়াল। গাইড ফিসফিস করে বলল - অব কলিং হোগা। কলিং মানে বাঘ আসেপাশে থাকলে প্রাণীকুল, বিশেষত এই শম্বর হরিণরা ডাকের মাধ্যমে ইঙ্গিত দেয়। গাইড দেখালো ওই ঝোপের মধ্যে গরু মেরেছে বাঘ। আমরাও ঠায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু শম্বরেরও দেখলুম কোনো হেলদোল নেই। সে পাতা চিবোচ্ছে, কালচে পাথরের খাঁজে মুখ ঢুকিয়ে জল খাচ্ছে নিজের মনে। অবশেষে আমরা রওনা দিলুম সামনের দিকে।
বেশ কিছুটা গেছি, হঠাৎ দেখি পেছন থেকে বিচিত্র শব্দ। শম্বর ডাকছে। সে কি অদ্ভুত ডাক, বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের জিপ সাঁ করে সেদিকে চলতে শুরু করল। চলছে মানে ব্যাকে, রাস্তা এত সরু যে ঘোরাবার জায়গাই নি। আবার সেই জল, সেই ঘাস, ঝোপ, পাখি। আমরা শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষায়। জঙ্গল এমনিতেই শান্ত। কিন্তু এমন নৈঃশব্দ বুঝি আর হয় না। খস করে পাতা পড়লেও শোনা যায়। বাতাসও যেন স্থির। কেবল ওই পাখিরা ডেকে যায় একটানা।
আর নিস্তব্ধতা! সবকিছু খানখান করে দুটো ক্যান্টর এসে দাঁড়াল। তাতে মোট জনা তিরিশেক মানুষ। আমাদের ওভাবে অপেক্ষায় দেখে তারা সব বুঝে গেছে। হই-হই লেগে গেল, সকলে বাঘের জন্য সেলফি তোলার জন্য প্রস্তুত। আজ সকালে এরকমই একটা গল্প শুনেছিলাম বটে ড্রাইভারের মুখে। সকলে মিলে বাঘের সাথে গ্রুপফি তুলতে গাড়ির একেবারে কোণে গিয়ে ঝুঁকে পড়েছে, গাড়ি গেছে উলটে, বাঘ চম্পট। তা এখানে এত কিছু হল না। এই বাঘটি বুদ্ধিমান। সোস্যাল মিডিয়ায় তার কোনো উৎসাহ নেই বোঝা গেল। সে ঝোপের মধ্যে বসে বোধহয় লাঞ্চ সারল। শম্বরও কখন যেন বিদায় নিল। নিরাশ সেলফিপ্রেমী বাকিরাও। তবে আমার মনে এই বিক্ষিপ্ত জলাভূমির শান্ত রেশটি ঘর করল চিরদিনের মতো।
এই জঙ্গলে মাঝে মাঝেই এমন জলাভূমি। ছোটো বড়। অনেকগুলোই তার মধ্যে বৃষ্টির জল নিচু জমিতে আটকে পড়ে তৈরি। তাই প্রান্তর জুড়ে ডুবে যাওয়া গাছ মগ্ন মৈনাকের মতো মাথা তুলে থাকে। ভারি অদ্ভুত সেসব দেখতে। মোটা চওড়া হাতের মতো শাখা, মুষ্টি তুলে আকাশের দিকে কিসের অপেক্ষায়। পাতা নেই একটাও। শুধাই ড্রাইভারজিকে। তিনি বলেন - ইসকা নাম খেজরি। সাংরি ইসকা ফল হ্যায়। সাংরি মাড়োয়াড়ি থালীর অপরিহার্য পদ-উপকরণ। শুকনো জায়গায় হয় গাছগুলো। আমাদের পুরুলিয়াতেও হয়। তবে গাছের নাম যে খেজরি তা জানতুম না।
দূর দেশে আপন কিছু চেনা দেখলে মনের মধ্যে একটা কেমন খুশির ভাব আসে, তাই না? যেন প্রবাসে বন্ধুর সাথে দেখা? গাইড দেখি অনেকক্ষণ ধরে বার বার একটা গাছের পাতা দেখাচ্ছে, গোল তিনকোণা, তিনটে করে পাতা, গ্রীষ্মের শুরুতে নাকি লাল ফুল হয়। আমি আর থাকতে না পেরে যা থাকে কপালে ভেবে ঠুকেই দিলুম - ড্রাইভারজি, কেয়া ইয়ে পলাশ হ্যায়? ড্রাইভারজি চমকে উঠে বলল - হাঁ হাঁ প্লাশ প্লাশ। আপ পেহেচান্তে হ্যায়? বোঝো, এ পুরো বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো হয়ে গেল না? হতে পারে এই পাহাড়ে পলাশ গাছ একটু বেশি হৃষ্টপুষ্ট বলে চট করে ধরতে পারি নি, তাবলে, রবিকবির দেশের লোকেকে প্লাশ চেনাচ্ছে? মনে হল বলি - আরে, ওরা কিংশুক। কত বাঙালি এর রাগে-গানে বসন্ত এসে গেল বলে ফি বছর চেঁচায়, তা তো আর জানো না। যাগগে, ওর ওসব জানার কথাও নয়। কিন্তু চোখ মেলে দেখি, সত্যি এই অরণ্যভূমিতে কিংশুকের রক্তরাগ ছড়িয়ে পড়ার আয়োজন শুরু হবে আর ক’মাস বাদেই। এত পলাশ গাছ, এত? বসন্তোৎসব বুঝি এখানেও হয়? নিভৃতে, লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত জনতার ভিড় এড়িয়ে, প্রকৃতির এই নিজের উৎসবকে শত কোটি নমস্কার। ক্লেদমুক্ত এরা, আকাশে কোরকের মতো অঙ্গুলি তুলে নবীনকে বরণ করে। আমরা চর্বিতচর্বন করি, পুরোনোকেই টেনে হিঁচড়ে যা হোক করে মধুঋতুকে ঘরে তুলতে চাই, মনে ঠাঁই দিতে পারি কই?
দূর পাহাড়ের দিকে ইশারা করে ড্রাইভারজি আরো বলেন যে, ফেব্রুয়রির শেষ থেকে লালে লাল হয়ে যায় জমিন। খেয়াল করি, পলাশ ছাড়াও আরেকরকম গাছ এই পাহাড়, পথ - সর্বত্র ছড়িয়ে। বাবলা নয়, ছোট ছোট পাতা, ফল শুদ্ধু সরু ডাল। এখনই লালচে আভা তাতে। সন্ধানে জানা গেল, এ গাছের নাম ধোঁক। গোটা আরাবল্লি জুড়ে এই গাছ। যত গরম পড়ে তার রক্তিম আভা ততই বাড়ে। তারপর একদিন পলাশ আর ধোঁক মিলে ষড়যন্ত্র করে এই জঙ্গলে-পাহাড়ে-পাথুরে মাটিতে আগুন জ্বালায় বসন্ত এলে। কে দেখল কে দেখল না - কিই বা তাতে, খেয়াল যখন জাগে তখন নিয়ম কোথায়, বাধাই বা কোথায়? আহা, একবার মার্চে আসা যায় না এখানে?
তবে এখনই বা শীতে মন্দ কি? সকাল হতে যে সাত নম্বর ট্র্যাকে ঢুকেছিলাম, তার অমন পাহাড়িয়া দৃশ্য দেখে চোখ ফেরাতে পারি নি। রাস্তা বলে তো কিছুই নেই। আগের জিপের এঁকে যাওয়া দাগে দাগ বুলিয়ে এবড়োখেবড়ো পাথুরে মাটি ধরে এগোনো। বাকিটা ড্রাইভারজির হাতের কারসাজি। একদিকে ঘন খাদ, অন্যদিকে হলুদ ঘাসে উত্তরে হাওয়ার হিন্দোল। মনে হল, নেমে পড়ি এখানেই। থেকে যাই। ওই দূরে কেল্লার প্রাকারের আভাস দেখা যায়। যদি থেকে যাই, তবে আকাশের নিচে মুক্তি, নরম ঘাস আমার শরীর ছোঁবে, কখনো তোমার মুখ দেখব আগুন রঙা সূর্যাস্তের মেঘে।
মেঘ একটা আকাশে ঘনাচ্ছিল। পরদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল অরণ্য আর অরণ্যপরিধি জুড়ে। তবে আগের দিনই সেকথার আন্দাজ পাচ্ছিলাম, যখন পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে অন্ধকার জমাট বাঁধছিল। তার মাঝে কিছু নগ্ন শীর্ণ গাছ সাদাটে অনাবৃত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাহাড়ের ধমনী যেন ওরা। শীতঘুম এখন, তাই রক্ত নেই। ভয় লাগে। এ বৃহতের বুকে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে ভয় লাগে। অতি সুন্দর, তবু ভয়ঙ্কর।
গোধুলি গড়িয়ে গেল, বাঘিনী ও তার সন্তানদের দেখা পেলাম না। সহযাত্রীদের হা হুতাশ বাড়ছে। গাছের ফাঁকে বাঁক খাওয়া রাস্তায় অন্ধকার জমছে। ধীর গতিতে মনখারাপের জিপ ছোট একটা গেট ধরে বেরোতে গিয়ে দেখি, সর্বনাশ। যে দরজা দিয়ে ধীরে সুস্থে সময়মতো বেরোবার কথা ছিল, সে দরজার সামনে বিচ্ছিরি রকমের খোঁড়া। চোরাগোপ্তা পথে প্রহরা এড়িয়ে কম পয়সায় জঙ্গলে ঢুকে পড়ার ব্যাপারটা হামেশাই ঘটে, তবে ওই যে, চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা...ইত্যাদি। কাল তেমনই কেউ পড়িয়াছে ধরা। অমনি আমাদের মতো নিয়মের পায়ে নিয়ত মাথা খুঁড়ে মরা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ভ্রমণপিপাসু বাঙালিদের (কারণ এই জাতিই সর্বাপেক্ষা পিপাসু রাজস্থানে) ঘরে পড়িয়াছে ঢেড়া। অতএব শুধু 'পথিক তুমি কোথা হইতে আসিতেছ' এর উত্তর দিলেই চলছে না, আধার-আধেয় সর্বপ্রকার কার্ডসহযোগে রীতিমতো তল্লাসি চলছে। সে তো না হয় হল। কিন্তু তাবলে জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা কাটা, আর সে খবর নেই সরকারি চালক ও গাইডের কাছে? সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!
এদিকে সময়ের মধ্যে বেরোতে না পারলে এদের চাকরি যাবে। গম্ভীর মুখে ড্রাইভার বলল - পকড়কে বৈঠিয়ে। আমরা পকড়কে বসবার আগেই জিপ দুদ্দাড় করে ছুটে চলল। পাথরে গোত্তা খেয়ে খেয়ে, শব্দ করে। বাবলা আর ধোঁকের কাঁটাভর্তি সরু ডাল আমার কপালে সপাসপ মারতে লাগল, আমি মাথা নিচু করে বসি, মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখি কেমন সন্ধ্যা ঘনায়। তারারা উঠল কি? তবে ড্রাইভারের আনতাবড়ি চালানো দেখে মনে হচ্ছিল, সে এ পথের কিছু জানে না। হাঁফাচ্ছিল। আমরাও ভেতরে ভেতরে। কিন্তু তার মাঝেই দেখি পাখিরা সব কুলায় ফিরেছে, কুয়াশার আস্তরণ ধীরে নামছে মাটির দিকে, রাত আসছে দুবাহু মেলে। সম্মোহিত করছে, যেন বলছে - এসো, আমাতে প্রবেশ করো। এই আমি তোমার সকল জ্বালা জুড়িয়ে দেব, চন্দ্রশীতল প্রলেপ দেব।
ঝিম ধরে আসছিল অদ্ভুত। ভেঙে গেল সহসা। সকলে হই হই করে উঠল - ওই ওই, গেট দেখা গেছে। ড্রাইভারও দেখি বলছে - হাম ভি নেহি পেহচান্তে থে ইয়ে রাস্তে। আজ হি আয়া।
দেখতে দেখতে জিপ উঠে পড়ল বাঁধের ওপর। ডানপাশে দেবপুরা জলাধার রেখে উড়ে চলল মুক্তির আনন্দে। জলাধারের ওপাশে বড় বড় সবুজ পাহাড় ডুব দিয়েছে জলে, কেমন ধোঁয়া উঠছে জল দিয়ে, খেজরি গাছেদের ঢের ঘুমিয়ে পড়ছে আকাশের দিকে হাত তুলে। হে বৃহৎ, তোমার অপার লীলা, যে পথে আসার কোনো কথাই ছিল না, কেমন করে এই আসন্ন আধা তমসাবৃত বনানীর মধ্যে জলাভূমির মধ্যে দিয়ে টেনে আনলে। অকারণ, তবু অকারণ নয়। যেন এ গম্ভীর শান্ত রূপের ছোঁয়াটুক না পেলে অসম্পূর্ণ থেকে যেত এ যাত্রা। তোমায় প্রণাম।
এই বন্ধ দরজার এপারে বেহালার ছড় আবার বিষাদ বোনে। আমার ঘরের মেঝেতে শেষ বিকেলের আলো আল্পনা দেয়। রণথম্ভোর যাই যখন, তখন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা দিনে চল্লিশ, ফিরি যখন তখন আড়াইশো। আর আজ সাড়ে পাঁচহাজার।
ফেরার আগের দিন স্থানীয় একটা শিল্পগ্রামে গিয়েছিলাম। ঘোমটা পরা মেয়েরা বাঁধনির কাজ করছে। আমার সঙ্গীরা সব কেনাকাটা করছিল। আমি সেই ফাঁকে একটু দূরে বসে থাকা একটি মেয়ের সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। সহজ সরল ফরসা মুখের মেয়ে, নাকি নাকচাবি। নাম তার ঊর্মিলা। ওই যে বাজোরিয়া স্টেশান, সেখান থেকে আসে। এ স্টেশানটা আমি দেখেছি। সোয়াই মাধোপুর ঢোকার আগে বনাশ নদী শুকনো খাতে বয়ে চলে, তারপরই বাজোরিয়া। সেখান থেকে আসে ঊর্মিলা। রোজ তিরিশ তিরিশ করে ষাট টাকা লাগে এখানে আসতে যেতে। দিন হিসেবে টাকা পায়। তাও তো বাড়িতে বসে থাকার থেকে ভালো। কাপড়ের ওপর দ্রুত হাত চলে তার আপন ছন্দে। আমার সাথে কথা বলতে আটকায় না। বিয়ে হয়ে গেছে কোন ছোট বয়সে, বিয়ের মানেই জানত না তখন। এখন দুই সন্তানের মা। ইস্কুল বন্ধ, তাই ছেলেমেয়ে বাড়িতে। শশুর-শাশুড়ি বাড়িতে। তাদের জন্য রসুই করে তবে সে আসে এখানে। তবু তো কিছু রোজগার হয়। ঊর্মিলা শুধোয়, আমার বাড়িতে কে কে আছে? মরদ কি করে? আমার শহরলালিত গলায় কথা আটকে যায়। আমি হেসে বলি - তোমায় খুব সুন্দর দেখতে ঊর্মিলা। সে বলে - তুমে ভি। আমি বলি - কেমন করে বুঝলে? মুখ তো মুখোশে ঢাকা। সে বলে - কই, এত লোক তো আসে, এমন করে কেউ তো তার সাথে কথা বলে নি। ও মুখোশের ওপার হতেই আমায় চিনেছে - আমি সুন্দর। কত সহজ কথা, তবু এমন করে কেউ তো কোনোদিন বলে নি। তুমি সুন্দর - একথার মায়া আছে, জাদু আছে মনছোঁয়া। আমি ভেসে গেলুম।
সেকথা আশ্রয় নেয় আজ এই তপ্ত শয্যায়। ঊর্মিলাদের কাজ নিশ্চয়ই এখন বন্ধ। বন্ধ রোজগার। রণথম্ভোর জুড়ে পেয়ারা পাওয়া যায় বড় বড়, কী মিষ্টি। সকলে যাতায়াতের পথে গাড়ি থামিয়ে কেনে। আজ সেই অম্রুদওয়ালী নিশ্চয়ই একা বসে থাকে শূন্য পথে। এই অরণ্য, এই মানুষজন, তাদের নিয়ত সুখদুঃখ, এই প্রাকারের মাঝে অতীত, ওই দূর পাহাড়ের হলদে গালিচা, নিঝুম হয়ে আসা সন্ধ্যে - বৃহৎ এ সংসারের মাঝে ক্ষুদ্র আমি - আমার কষ্টগুলো ধুয়ে যায়, ক্ষতে হাত বোলায় কেউ। চোখ বুজলে তপ্ত বিছানার আশেপাশে হলদে ঘাস গজায়, মৃদু দোলা দেয়, রৌদ্র পোড়া ঘ্রাণ আসে, ঘরের ছাদ কখন খুলে গিয়ে ওই পাহাড়ে মিশে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
যে বৃহতকে কাছে যেতে পারলে মাথা আপনি নত হয়ে আসে, যার কাছে দাঁড়ালে নিজের সত্তাকে তুচ্ছ মনে হয়, সেই তো শক্তি যোগায়। বেহালার ছড়ে যতই বিষাদ থাকুক না কেন, তা ছাপিয়ে কে যেন গায় – “সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে”। আমার ওষুধের ঢের নগণ্য হয়ে যায়।
[সমাপ্ত]
পুনশ্চঃ কয়টা স্কেচ থাকল সাথে, অবশ্যই স্মৃতি রোমন্থন করা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।