এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বাকিসব

  • দরজা

    gargi bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৯৩৫ বার পঠিত
  • বহুকাল বাদে দিনকয়েকের জন্য ম্যাড়ম্যাড়ে মফস্‌সলের বাস তুলে আলো ঝলমল নগরীর পথে পা বাড়াতে গিয়ে দেখি, অব্যবহারের ফলে দরজার চাবিখান অকেজো হয়েছে। আরেকবার মনে পড়ল, ডিসেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহ চলছে বটে।

    অবশেষে বছরটা শেষ হয়েই গেল, কী বলুন? সময় অতি দ্রুত বয়ে গেল, অথচ, অবাক করা ব্যাপার, থমকে রইল একই জায়গায়। সেই যে সেই কবে প্রচুর বাজারপাতি করে ঘরে ঢুকে দোর দিলুম, আজও তো সেই দরজা খুলল না। মধ্যে কতবার সেই দরজা দিয়ে আতঙ্ক মেশানো মনে যাতায়াত করলুম, কত কাছের মানুষ দূরের মানুষের ভালোমন্দ বার্তা আদানপ্রদান হল, কত মার্জনা, সম্মার্জনা, কত অস্পৃশ্য কেনাকাটা - কতকিছু, দরজা কিন্তু আসলে খুলল না।

    দরজাটা তো ঘরের বাইরের ছিল না, ওটা মনের বাইরের। তার আগে বেশ চলছিল দিনের পর দিন বিনা কাজে আয়ুক্ষয় করে, অন্যের চকচকে জীবনের দিকে আড়চোখে চেয়ে আঙুরফল টক বলে জিভে-টাগরায় আওয়াজ করে, নিজেরটাকে ঘষে মেজে কারিকুরি করে বিক্কিরির জন্য পসার সাজিয়ে, কিন্তু দরজাটা হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল। দুম করে। বলাকওয়া না করে। অপ্রস্তুত। অপ্রত্যাশিত। সেদিন রুদ্ধ দ্বারের এপাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সকল বিশ্ব পড়ে রইল ওপারে। এমনকি আমার আমিটাও সেখানেই রয়ে গেল।

    তাহলে কি আমার সাথে আমার কোনদিন দেখাই হয় নি? যাকে 'আমি' বলে জানতাম, আমার নামের আগে অন্যের নাম এলে সজোরে নিঃশঙ্কোচে তাকে ঠেলে দিয়ে নিজেকে সেজায়গায় বসিয়ে দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করতুম, সেই আমি আসলে বাইরের একটা খোলসমাত্র, যার ভেতরে আর কিছু নেই, কিচ্ছুটি না? তাই তো চারধারে বেড়া উঠতেই নিজেকে ভয়ানক একা মনে হতে শুরু করল, যেন ওই বাইরের অস্তিত্বটা ছাড়া আমিও নেই। দেখনদারি যখন সত্যি সত্যি বাইরের হল, তখন বুঝলাম ভেতরের আমি-র খবর কেউ রাখি নি। সেদিন সেকথা সবাই বুঝেতে পেরেছিল তা হলফ করে বলা যায়। প্রতিটি সংলাপে, ছবিতে, আলাপে শুধু সেসব কথা ফুটে বেরোত, আমরা সবাই বলতাম, বড্ড বোর হচ্ছি, বড্ড একা লাগছে। অথচ একটা আস্ত আমি-র তো আমার সাথেই থাকার কথা।

    সেইসময় আমি-র খোঁজে আমরা হাত লাগিয়েছিলাম পুরোনো সব সত্যি সম্পর্কের ওপর থেকে ধুলোর পরত হঠাতে। হারমোনিয়ামের সাথে স্বরলিপির খাতাখানি জুড়ে দিতে, অসম্পূর্ণ ছবিতে ফাঁকা জায়গাটা ভরাতে, বইএর র‍্যাক থেকে আবোলতাবোল পেড়ে নিয়ে নতুন করে পড়তে, এরকম আরো কত কী। সহসা মনে হয়েছিল, আমরা কত স্বার্থপর ছিলাম, কোনদিন তো ভাবি নি ঘরের পাশে কারা থাকে, কারা ওই ছাদের ওপর ফুলের বাগান করে, কেমন করে দুপুর আড়মোড়া ভাঙ্গে, সন্ধ্যাতারা ফোটে ঘন নীলচে কালো আকাশে। ছোটবেলার বৃষ্টির পর সোঁদা গন্ধ কবে গেলাম ভুলে, কেমন করে ভুলে গেলাম আমার পেছনের বেঞ্চিতে বসত যে ফরসা মেয়েটি, তার নাম? এমন করে উথালপাতাল চলল আমি-কে খোঁজা, হাতড়াতে হাতড়াতে বুঝলাম সবাই হয়ত খানিক ফেলেই এসেছি সেই আমি-কে। মনে হচ্ছিল, দূর বিদেশে ঘরে বসা উদাস চোখের মানুষটি, ওপাড়ার কাজ হারানো মধ্যবয়সী লোকটি আর আমি যেন একই সূত্রে গাঁথা, তারা আমার খুব কাছের, নাম না দেওয়া আত্মীয়তা তাদের সাথে সেই কবে থেকে।

    বছর কিন্তু ঘুরল। বসন্তের কিংশুকের রঙ পালটাতে পালটাতে যূথিকার গন্ধ পেরিয়ে কবে পদ্ম ভরা শরত এল, মনখারাপের বিষণ্ণ বিকেল নিয়ে হেমন্ত গেল, শীত এল। এবার চমকে দেখলাম, আমি-র যে খোঁজ চলছিল অন্তরের খনি খনন করে, তাও গেছে কখন থেমে। সকলকিছুই গা-সওয়া হয়ে গেছে। বাইরেটা আবার প্রকট হয়ে আমাদের চিরস্থায়ী মুখোশ পরিয়েছে। এক অভিশপ্ত অন্ধকারে ভয় পেয়ে যে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনটাকে বুঝে খরচা করব, সুখ নয়, আনন্দের সন্ধানে যাব, সেই আমি কখন ছোট ছোট ব্যাপারে ঝগড়া শুরু করেছি। মানুষকে অবিশ্বাস করছি তুচ্ছ কারণে, দুপয়সা কাকে না দিয়ে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখা যায়, তাই নিয়ে চুলচেরা অঙ্ক কষছি। সন্দেহ করছি, হিংসে করছি আবার, আবারও। যা কিছু বিদায় দিয়েছি ভেবে মনে মনে শান্তি পেয়েছিলাম, সেই তাকে আবার আহ্বান করে এনেছি অকারণ জমায়েত হওয়া ভিড়ে। সেই ভিড়ে আবার নতুন করে খুঁজতে শুরু করা আমি-টা গেছে হারিয়ে। এদিকে আবার আমি-টা ক্ষুদ্র ঘেরাটোপে বন্দী হয়েছে।

    যেখানে ছিলাম, সেখানেই ফিরেছি। যেদিন দরজা খুলবে, মনে হয়েছিল, সেদিন বুঝি অনেক আলো এক ঝলকে মনের ভিতরটাকে ধুইয়ে নিয়ে যাবে, সব খুব সুন্দর হবে, শান্ত হবে। কিন্তু আলোকের সে উৎসার আজও উন্মুক্ত হয় নি। এদিকে বছর তার দিন গুনছে।

    এক বছরের বিদায়, আরেক বছরের আসার মাঝের সময়টুকুর ফারাক কতটা থাকে, কে বলতে পারে। ব্যবধানের অতি সূক্ষ্ম সীমারেখার অর্থ একটাই, ফেলে আসা দিনগুলোকে একবার ঘুরে দেখা, মেপে নেওয়া। যদি তাই হয় রাত বারোটার এপার-ওপার হবার মাহেন্দ্রক্ষণের মাহাত্ম্য, যদি সত্যিই উল্লাসভরা মুহূর্ত গোনার মধ্যে গভীর কিছু থাকে, তাহলে, এই ২০২০ সাল আমাদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার কথা স্মরণ করায়। সে পরীক্ষায় বাইরের দিকে যদি বা টেনেটুনে পাশ করেছি, অন্তরের পরীক্ষায় তো প্রশ্নপত্রের সঠিক মানেটাও বুঝতে পারি নি। লকডাউনের দিনগুলোতে মানুষের সান্নিধ্য পাবার জন্য আকুল হয়ে উঠতাম, সে মানুষ কিন্তু বিশ্বজোড়া মানুষের বোধের মাঝে থাকে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে যতই আমরা আড়ম্বরে মাতি না কেন, তাতে আর যাই হোক, নতুন বছরের আবাহন হয় না, দরজাটা খোলে না। গৃহবাসীকে খোল দ্বার খোল বলতে গেলে নিজের মনের বাইরের দোরের আগল সবার আগে খুলতে হয় যে।

    দরজা খুলুক, চৌকাঠ পেরিয়ে মুক্ত বাতাস আসুক, মেঘ সরিয়ে আলো আসুক, বছর আসুক নতুন করে, পুরনোকে ভুলিয়ে নয়, তাকে আরো বেশি করে মনে রেখে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • বাকিসব | ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৯৩৫ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    উংলি - Malay Roychoudhury
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন