ফোন করল এক ভাগ্নে। কলকাতা, করোনা, কোকিলের ডাক (লকডাউন প্ররোচিত) পার হয়ে কেরালায় পৌঁছল বাক্যালাপ।
- খুব তো কেরল কেরল করো, দেখলে তো পনের বছরের প্রেগন্যান্ট হাতিটার কী হাল করল কেরালার লোক গুলো?
- হ্যাঁ, খারাপ লাগলো খুব। কারা যে করলো? কেন যে করলো?
- কারা আবার? মানেকা গান্ধীর স্টেটমেন্ট পড়নি। মাল্লাপুরে! মাইনরিটি এলাকা! কেরালায় বছরে ৬০০ হাতি মারা পড়ে বলেছেন।
- হ্যাঁ দেখলাম, টুইট করেছেন ৩রা জুন। কিন্তু বুঝলাম না কী বলছেন! ভারত সরকার সংসদে ২০১৯ সালে একটা প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন ভারতে গড়ে বছরে ৫৬.৬ টা হাতি মারা যায়। ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো একটা তারিখে দ্য হিন্দু পত্রিকায় বেড়িয়েছিল যে ২০১৮ সালে ৭৫টা হাতি মারা গেছে এলিফেন্ট সেন্সাস অনুযায়ী। ৬০০ র অঙ্কটা ঠিক কোথায় পাওয়া গেল? দ্বিতীয়ত ঘটনাটা তো মাল্লাপুরে ঘটেইনি। ঘটেছে পালাক্কাড জেলার মান্নারকাড বন বিভাগের কোট্টোপাডাম পঞ্চায়েতে। এর মধ্যে খামোখা মাইনোরিটি মেজরিটির গল্প আনা কেন?
- ও: মাইনোরিটি নাও হতে পারে বলছো!কিন্তু করেছে তো কেরালার লোকেরাই। স্রেফ মজা দেখতে একটা মা হতে যাওয়া হাতি কে আনারসের মধ্যে বোমা পুড়ে খাইয়েছে! জঘন্য ক্রিমিনাল এরা!
- বুনো হাতির মুখোমুখি হয়েছিস কখনো?
- না!
- আমি হয়েছি।
- সে তো জানি, রাজাভাতখাওয়ায় থেকেছ ছোটবেলায়, হাতির পাল আসতো জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তোমাদের বাড়ির পাশে; মা'র কাছে শুনেছি।
- হ্যাঁ আমি বুনো হাতির খবর কিছু জানি। চাক্ষুষও করেছি অনেকবার। সে জন্তুটি পাড়ার নেড়ি কুকুর নয় যে ইচ্ছে করলে ল্যাজে পটকা বেঁধে দেবে, কিম্বা তু বলে ডেকে এঁটোকাঁটা খেতে দেবে।
- তাহলে, তুমি কি বলছো পটকা ভরা আনারস খাওয়ানো হয়নি মা হাতিটাকে?
- আমি সেরকম কিছু বলছি না। এই হাতিটাকে ঠিক কোন সংবাদ মাধ্যম, টিভি কিম্বা প্রিন্ট প্রথম দেখেছে বলতে পারিস?
- সেটা মনে করতে পারছি না, তবে জলে দাঁড়িয়ে থাকা হাতিটার ছবিটা দেখেছি টিভিতে। কোনো টিভি চ্যানেল তুলেছিল নিশ্চয়ই। লোকাল ও হতে পারে।
- ছবিটার সোর্স নিয়ে ঘাঁটিস নি দেখছি। হাতিটা মারা গেছে ২৭শে মে আর তার মৃত্যু খবরে উঠে এসেছে তার বেশ কয়েকদিন পরে। যদি কোনো সংবাদ মাধ্যম করতো তাহলে তো ২৭ কিম্বা ২৮শেই উঠে আসতো না কী? এ ছবিটা ঘুরছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর হবার বেশ কিছু দিন আগে থেকেই। কেরলের বন বিভাগের এক অফিসার, নাম মোহন কুমার, যিনি নিজে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের র্যাপিড রেসপন্স টিমের সদস্য। নিজের ফেসবুক পাতায় জলমগ্ন হাতির ছবি দিয়ে লিখেছিলেন "আমরা যখন ওর দেখা পাই তখন ও জলে মুখ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে, বোধহয় বুঝতে পারছিল ওর সময় শেষ হয়ে আসছে।" যন্ত্রণাবিদ্ধ প্রাণীটির চুপচাপ জলে দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে খুব মর্মস্পর্শী সেই পোস্টটা ভাইরাল হয়ে উঠে খবর হয়ে গেল। এখানে কোনো ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম খুঁজে পাচ্ছি না।
- তাহলে আনারসের ভেতরের বোমা ফেটে হাতির মারা যাওয়ার ব্যাপারটা জানা গেল কী করে?
- সেটাই তো আমি তোকে জিজ্ঞেস করলাম, আনারস খাওয়ানো, বোমা বিস্ফারণ এসব কে চাক্ষুষ করেছেন? মান্নারকাড বন বিভাগের বিভাগীয় বন আধিকারিক একটি সংবাদ মাধ্যম কে জানিয়েছেন (The News Minute) যে হাতির মুখের ক্ষতের চরিত্র দেখে তাঁদের মনে হচ্ছে যে মুখের ভেতর কোনো বিস্ফারণ থেকে এই ক্ষত সৃষ্ট হয়েছে। এরকম ভাবার কারণও আছে। মান্নারকাড জঙ্গলের আশপাশের গ্রামগুলোর মানুষ জন বুনো শুয়োর এবং অন্যান্য বন্য প্রাণীদের থেকে তাঁদের এলাকার ফসল এবং নিজেদের বাঁচাতে উঁচু বেড়া বেঁধে তাতে পটকা ইত্যাদি ভরা ফল ভরে রাখে। এই অন্ত:সত্ত্বা হাতিটি তার শিকারও হতে পারে।
- একজনকে তো অ্যারেস্ট করে ফেলেছে দেখলাম!
- যে রেটে দেশশুদ্ধ লোক হত্যাকারীর শাস্তির দাবী তুলছে তাতে কাউকে না কাউকে অ্যারেস্টে না করলে তো প্রশাসন - সংবাদ মাধ্যম কারুরই মান থাকে না, অ্যারেস্ট তো করতেই হবে ওই ধারে কাছের গ্রাম থেকে কাউকে!
- তুমি কি তাহলে বলতে চাও যে কেউ যখন তখন বন্যপ্রাণী মারবে আর কেউ কিছু বলতে পারবে না।
- একটু তলিয়ে যদি দেখিস তাহলে দেখবি বন্যপ্রাণী আর বনের ধারে বাস করা মানুষ একে অপরের প্রতিবেশী হয়ে বাস করতো প্রাক - ঔপনিবেশিক আমল পর্যন্ত। সাহেবরা দখল নেওয়ার আগে অরণ্য সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সাহেবরা দখল নেওয়ার পর বন পণ্য হয়ে উঠল। রিজার্ভ ফরেস্ট আইন হল, বনবাসী পশু আর মানুষে বিভাজন শুরু হল। সেই বিভাজন এখনো চলছে। হয় বনের পশু মরে নয় তার প্রান্তবাসী মানুষ। অরণ্য লুট করে যারা, তাঁরাই আবার নানা মাধ্যমে জনমত তৈরি করে বনের প্রান্তে থাকা মানুষজনের বিরুদ্ধে, সুতরাং অ্যারেস্ট তো কেউ না কেউ হবেই! কিন্তু সব ধরনের বন্যপ্রাণী হত্যার জন্যে অ্যারেস্ট হয় কি? রাজ্যসভায় একটা প্রশ্নের উত্তরে সরকার জানাচ্ছেন ২০১৬-১৮ য় ৪৯ টা হাতি আর ১১টা বাঘ ১০ টা সিংহ রেলগাড়ির ধাক্কায় কিম্বা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে (এর মধ্যে গর্ভবতী কেউ ছিল কি না জানায় নি অবশ্য)। এই ৪৯ টা হাতির মধ্যে ৩৭টা মৃত্যুই হয় পশ্চিমবাংলায় নয় আসামে। কোনো অ্যারেস্টের গল্প শুনেছিস?
- ( ও প্রান্তে কিছুক্ষণ নীরবতার পর) আজ রাখি মামা, আমার আবার একগাদা অফিসের কাজ আছে, ওয়ার্ক ফ্রম হোমে কাজের চাপ বেড়েছে।
ফোনটা ঠিক বন্ধ হওয়ার আগে শুনলাম শ্রীমান তার মাকে বলছে, "তোমার ভাইয়ের মাথাটা রিটায়ার করার পর ভালই বিগড়েছে মনে হচ্ছে! আজকাল বোধহয় নিজেকে বামপন্থী সিধুজ্যাঠা ভাবে"।
বাহ
এই শেষ লাইনগুলোই দেশের সার সত্য। কি করুণা হয় এই আপাত শিক্ষিত ও বিক্রিত মস্তিস্ক এই সকলকে দেখে।
@হুতো গুরুর লেখাটা খুললে "কপি লিঙ্ক" এর অপশন আজকাল আর পাই না তো
বাংলাদেশে মাঝে-মধ্যে একটি খবর চোখে পড়ে হাতি লোকালয়ে হামলা করেছে। কিন্তু খবরের কাগজে কখনও এটি লেখা হয় না যে, যে লোকালয়ে হামলা করেছে, সেই এলাকাটি ৫০ বছর আগে হাতিরই আবাসস্থল ছিল। হাতির বিচরণ ও বিপুল পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহের জন্য তার যে পরিমাণ জায়গা দরকার সেখানে মানুষ বসতি গড়েছে। হাতি খাদ্য সংগ্রহের জন্য কোনো না-কোনো সময় সেখানে তো আসবেই। ২. গর্ভবতী হাতিটিকে বিস্ফোরকের সাহায্যে আহত করার এক পর্যায়ে মৃত্যুবরণ করেছে। দুঃখজনক। প্রতিবাদযোগ্য নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই পৃথিবীতে কত শত-হাজার নিরপরাধ মানুষকে বিস্ফোরকের সাহায্যে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের জন্যও আমাদের বিবেক জাগ্রত হোক।
The Hindu also mentioned "Later, officials said it was too early to say if the fruit was meant for the elephant".
পাশবিক কথাটির সংগা বদলের বোধহয় সময় এসেছে।
পুনশ্চঃ নিহত হাতির লাশ সরানো হলো হাতি দিয়েই। আয়রনি!
খাসা হোয়াটঅ্যাবাউটরি।