আমার উড়ানভীতি আছে। কোথাও উড়োজাহাজে যেতে হবে শুনলেই ভয় পাই। বছর কয়েক আগের কথা। ঢাকা টু কলকাতা। মেরে কেটে এক ঘন্টার উড়ান। একা যাচ্ছি। ভয় তাড়াতে তাই স্থির করেছিলাম, সিট বেল্ট বেঁধে ম্যাগাজিন থেকে কিছুতেই চোখ সরাবো না।
টালুমালু করে এগোচ্ছি, সামনে দেখি স্যার। সেই চিরাচরিত পিতৃসম হাসিমুখ। ঢোলা সাদা পাজামা, ঘিয়ে পাঞ্জাবীতে চিকন সূচী কাজ। আমার বাপ চাচারাও সারাজীবন এই পোশাক পরে এসেছেন। শীতকালে এই পোশাকের উপর চাপিয়ে নিতেন মোটা শাল বা কোট। কালো জুতা উলের মোজা,একটি হ্যাট। একেবারে চিরচেনা আপন দৃশ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা বরাবরই সাহসি। কর্মঠ। উদ্যমী। দুরন্ত সংগঠক। সময় অসময় ডাক পড়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে। সে সময় আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ছিল একতলায়। বাংলা বিভাগ দোতলায় । যে কোন দরকারে ছুটে গেছি স্যারের কাছে। নব্বই দশকের রাজনৈতিক সংকটকালে দিকনির্দেশনা পেতে আমরা লাট্টুর মত ছুটাছুটি করতাম। ভুল হলে বকতেন।শুদ্ধ উচ্চারণ। নম্র রাগত স্বর। যেন ছেলেমেয়েদের বাধ্য হয়ে মৃদু বকে দিচ্ছেন কোন পিতা।
অভিভাবকত্বের গৌরব মুকুটে স্যার তখনই ছিলেন সুশোভিত।
বায়ান্নোর ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানী সৈন্যরা । তরুণ আনিসুজ্জামান আর তার সহযোদ্ধাদের পাঁজর ভেঙ্গে যাচ্ছিল তাই দেখে। তার আগের বিকেলেই আনিসুজ্জামানের আম্মা স্থায়ী শহীদ মিনার গড়ার জন্যে মৃত বোন নাজমুনের সোনার গহনা দিয়ে এসেছেন শহীদ বেদিতে।
রাতে শহীদ মিনার ভাঙ্গার খবর পেয়ে মলিন হয়ে গেছিল মায়ের মুখ। পিতার কাছে শুনলেন, তোমার আম্মা বড় কাঁদছেন।
বায়ান্নোর রক্তস্নাত ফেব্রুয়ারী মাসের রাত। মায়ের গহন গভীর দুঃখী মুখে বেদনার অশ্রুজল। আনিসুজ্জামান ঘ্রান পেলেন বাংলার পলিমাটির। বর্ণমালা খচিত আলপথের ধারে পথ হারানো মা যেন চিরদিনের আকাশ, বাতাস, বাঁশি নিয়ে ভয়ার্ত, সন্ত্রস্ত। সারাজীবনের জন্যে বুকে গেঁথে ছিল দৃশ্যটি। পরবর্তী জীবনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ঋদ্ধ করে তুলতে তার সমস্ত মেধা, শ্রম, চিন্তাকর্মকে সমিধ করে তুলেছিলেন বিপুল নিষ্ঠা, সন্মান ও ভক্তিতে।
জাতির এক ভ্রষ্টলগ্নে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম। তদ্দিনে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিয়েছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধকালে কালুরঘাট থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের পাঠ করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থেকেও ড্রপ আউট করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। বাংলাদেশের রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় লেগেছে জলপাই রঙ। বঙ্গবন্ধুর রক্তরেখায় পা রেখে ক্ষমতায় এসেছে মেজর জেলারেল জিয়াউর রহমান। তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর জামায়াতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন।
আটাত্তরে পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা জামায়াতের আমীর গোলাম আযম তখন জাঁকিয়ে বসেছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংবাদপত্র জগতে। তাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা সংগঠিতভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
জিয়াউর রহমান তৈরি করলেন নতুন রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ ন্যাশোনালিস্ট পার্টি বা বিএনপি। পরীক্ষিত অনেক নেতা মাথা মুড়ে লেজ গুটিয়ে বিক্রি হয়ে গেলো। যড়যন্ত্রী ফুৎকারে বাংগালীর মরণবাঁচন শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ হলো, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। সংবিধানের মূলস্তম্ভ থেকে ছেঁটে ফেলা হলো ধর্মনিরপেক্ষাতাকে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বহুদলীয় রাজনীতির দ্বার উন্মুক্ত হলোর উচ্ছ্বাসে যোগ দিয়েছে বিএনপিতে। আমরা অবাক। বিস্ময়ের বিচ্যুতি নিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে দেখলাম অবিকৃত শিরদাঁড়াসম্পন্ন কিছু মানুষকে। দলভুক্ত হলেন না স্যার। শত বাঁধা উপেক্ষা করে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর মুক্তবুদ্ধিচর্চার ধ্বজা অটুট রেখে তিনি কাজ করে গেলেন।
এরমধ্যে খুন হয়ে গেলেন জিয়াউর রহমান। ছাগলপাগল অবস্থা তখন বাংলাদেশে। এরকম একটি সময়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ফিরে এলেন শেখ হাসিনা। সে বছরই মিলিটারি ক্যু করে ক্ষমতা হাতিয়ে নিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ। তিনি এসেই নতুন দল গঠন করলেন, জাতীয় পার্টি। আমরা আগুনের মত ছড়িয়ে গেলাম সারা বাংলাদেশে। আমাদের ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন যে বাতিস্তম্ভগুলো, আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন সেই বাতিস্তম্ভের একটি অগ্নিপুরুষ। আমাদের পথ হারানোর ভয় রইল না।
বাংলা, বাঙ্গালী, বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নিরলস সেনাপতি হিসেবে তিনি কাজ করে গেছেন। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম একাত্তরের যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের দাবীতে প্রতীক গণআদালত গঠন করেছিলেন। সেই আদালতে বাংলা, বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশ ও বিদেশে গোলাম আযমের যড়যন্ত্রমুলক কৃতকর্মের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তুলে ধরেছিলেন ডঃ আনিসুজ্জামান। পরবর্তিকালে শাহবাগ জ্বলে উঠেছিল এই গণআদালতের বিচার প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করতে। সে এক নতুন ইতিহাস।
তারুণ্যে তিনি সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নকে লালন করে গেছেন আজীবন। বিশ্বজোড়া মৈত্রী ও শান্তি আন্দোলনে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক কালো অধ্যায়ে সরকার, রাজনীতিবিদ ও নেতাদের তিনি স্পষ্ট করে সতর্কবার্তা ব্যক্ত করেছেন। অনুত্তেজিত কিন্তু দৃঢ়ভাবে তিনি বক্তব্য প্রকাশ করতেন।
দেশী বিদেশী পুরস্কারে তিনি কখনও অহংকারী ছিলেন না। যাপিত জীবনে ছিলেন সরল ও সাদাসিধে। মৃত্যুর পর তাকে যেন অস্থায়ী কবরে গোর দেওয়া হয় এমন ইচ্ছে ছিল বলে জানিয়েছে তার ছেলে আনন্দ জামান।
ইছামতী নদীর তীরে অবিভক্ত ভারতের বশিরহাট। সেখানেই ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহন করেন ডঃ আনিসুজ্জামান। চলে আসেন কলকাতা। ১০ বছর পর্যন্ত পড়াশুনা করেন কলকাতার পার্কসার্কাসের এক ইশকুলে। দেশভাগের ধাক্কায় প্রথমে খুলনা পরে পুরনো ঢাকায় বসবাস গড়ে তোলেন তার পিতা হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক মোয়াজ্জেম হোসেন। ছিলেন প্রখর মেধাবী। মাত্র পচিশ বছর বয়সে তিনি পিএইচডি লাভ করেন। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় করেছেন শিক্ষকতা। তার স্নেহধন্য ছাত্রছাত্রীরা আজ শোকে মুহ্যমান। গুচ্ছ গুচ্ছ শোকবার্তায় তারা তাদের ভালবাসা জানাচ্ছে।
ছাত্র অবস্থায় যুক্ত ছিলেন বাম রাজনীতির সাথে । বাংলা এবং বাঙ্গালীর স্বাধিকার আন্দোলনে ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী। সরাসরি অংশগ্রহন করেন বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে । রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করায় পাকিস্তান সরকারের বিপক্ষে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ করেন। যাবতীয় হুমকি ধামকি উপেক্ষা করে রবীন্দ্র শতবর্ষ উপলক্ষ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে সম্পাদনা করেছিলেন একটি সংকলনগ্রন্থ। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছিলেন সংযুক্ত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তার সক্রিয় অনুপ্রেরণা। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নসংক্রান্ত গণপরিষদের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হন। উল্লেখ্য যে তার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা অনুবাদ সম্পাদন করেছিল।
৮৩ বছরের দীর্ঘ কর্মক্ষম জীবনে তিনি ছিলে বাঙ্গালীর সচেতন অভিভাবক। মৃত্যুকেও বরণ করে নিয়েছেন স্বমহিমায়। তার মৃত্যু বাংলাদেশ ও বাঙালীকে শূন্য করেনি। বরং নতুন কালের জন্যে একটি নতুন পথের আরেকটি খাতা তিনি খুলে দিয়ে গেছেন।
বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সাথে তাকে স্মরণ করবে আজীবনব্যেপে।
ডঃ আনিসুজ্জামানের কিছু উল্লেখযোগ্য বইঃ মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, বিপুলা পৃথিবী, Creativity, Reality and Identity, Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity (১৯৭৯),Identity, Religion and Recent History (পরিচয়, ধর্ম এবং সাম্প্রতিক ইতিহাস) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী (১ ও ৩ খণ্ড) নারীর কথা (যৌথ, ১৯৯৪)ফতোয়া (যৌথ, ১৯৯৭)আইন-শব্দকোষ (যৌথ, ২০০৬)।
শ্রদ্ধা
স্মৃতিচারণ সুলিখিত।
বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনি থাকছেন স্যার