মুসলিম বিয়ের গানের শিল্পী মদিনার লকডাউন
মদিনার লকডাউন সফর
বদলে গেল সব এক ঝটাকায়! কে জানত লকডাউনের জেরে নিজের সংসারটাই তুলে নিয়ে আসতে হবে বাপের বাড়ি। মুসলিম বিয়ের গানের শিল্পী মদিনার স্বামী আজফার সেখ সৌদিতে আটকে। কাজ আছে কি নেই তাও জানে না আজফার। বাড়িতে পাঠানোর জন্য জমানো টাকাটুকুই বিদেশে সম্বল। শেষ হয়ে গেলে কি হবে জানা নেই। একটা ঘরে আজফারদের রেখে কোম্পানি তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। খাবার দিতে লোক আসছে। কখনও দিনে একবারও দেখা নেই। কখনও দুই দিন। স্বামীর কাছে এমন অশান্তির কথা শুনে ভেঙে পড়ে মদিনা। এদিকে অভাবের মধ্যে শ্বশুর বাড়িতে ছেলে নিয়ে পড়ে থাকতে পারল না মদিনা। তার উপর রোজা শুরু হয়ে গেল। স্বামীও টাকা পাঠাতে পারেনি সংসারে। খরচের বোঝা শ্বশুরবাড়িতে না বাড়িয়ে শেষমেশ বাপের বাড়ি ফেরে মদিনা। বাপের বাড়ির হালও ভাল না। বৃষ্টিতে ধানের ক্ষতি হয়েছে । দিন মজুরের দাম বেড়ে যাওয়ায় ধান কাটা নিয়েও বিড়ম্বনা। মদিনা খুব অসহায় হয়ে বলে, "লকডাউনের জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম। এখানেও স্বস্তি নেই। কি যে করি ছেলে নিয়ে!
মদিনা মুসলিম বিয়ের গান করে। কাজের প্রয়োজনে নানা জায়গায় যাওয়া। গতবার যাদবপুর ঘুরে এসেছে। আগের মত এখন আর মুসলিম বিয়ের গানের চর্চা নেই। অনুষ্ঠানও বেশি হয় না। এখন বছরে দুইবার বাইরে যাওয়ার ডাক পায়। বাকি সময় পলিথিন ও পাথরের ব্যাগ ও ফুলদানি তৈরি করে মদিনা। এখন বেকার বাড়িতে বসে। লকডাউনে পাথর,পলিথিন কিছুই পাওয়া যায়নি। হাতে কাজ নেই। আবার স্বামীর চিন্তা। অন্যদিকে ছেলে রিয়াজের পড়াশুনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। স্কুল বন্ধ। বই-খাতা সব তোলা। পড়তে বসালেই ছেলের খাওয়ার বায়না। নইলে ফোনে আব্বার সঙ্গে কথা বলার আবদার। মদিনা এসব নিয়ে জেরবার। ইদে একসঙ্গে তিনমাসের টাকা নিয়ে আসবে। কথা হয়েছিল রিয়াজের আব্বার সঙ্গে এমনটাই। তাই হাত টান ছিলই। কিন্তু লকডাউনের ফলে পয়সার অভাব মদিনাকে একদম অপ্রস্তুত করে দিয়েছে। খুব আড়ষ্ঠ হয়ে মদিনা বলে,"কাকে কি বলবো! চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। রাতে ঘুম আসেনা। ছোট্ট সংসারে অভাব ছিলট, কিন্তু শান্তিও ছিল। এখন শান্তি কবে ফিরবে জানিনা।"
মদিনার মাত্র তেরো বছরেই বিয়ে। চাষবাস করে সংসার কোনোরকমে চললেও অভাব মেটে না। সংসারের হাল ফেরাতে না পেরে স্বামী শেষমেশ গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মদিনা আগেই যুক্ত হয় বিয়ের গান ও হস্ত শিল্পে। হাতে কিছু পয়সা না থাকলে ছেলেকে নিয়ে চালিয়ে যাওয়া কঠিন। এই ভেবেই মদিনার কাজে হাত দেওয়া। লকডাউন সেই সফরে এক অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছে। মদিনা বলে, "মানুষের আর কি করার ক্ষমতা আছে! নতুন অসুখ। আল্লার কাছে তাই মোনাজাত করছি যে, স্বামীর মুখের আহার যেন কেড়ে না নেয় । ছেলেটার পড়াশুনাটা যেন ঠিকঠাক হয়।"
মদিনার কাছে লকডাউন নিয়ে যত অনিশ্চতা তার চেয়ে অনেক বেশী কষ্ট হাতে কাজ না থাকায়। এতদিনের অভ্যাস। দুপুরে হাত খালি থাকে না কখনও। মদিনা বলে, "কিছু না হলে দলবেঁধে বিয়ের গানটাও বসে বসে করি। এখন তো দলের অন্য মেয়েরা আসতেও পারছেনা। ভালোবেসে কাজটা করি তো! নিজের অভাবের কথা বলিনা, ওদেরটা শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়! কাজের সরঞ্জাম নেই,গানের ডাকও নেই।" মদিনার অভাব চেনা। হেঁশেল ঘরে ভাতের হাঁড়িতে চাল না ফুটাতে পারার দিনও দেখা। অন্যমনস্ক হয়ে বলে, "ভাবছি ছেলের কাছে পড়াটা শিখব। পারব তো দিদি শিখতে? স্বামী মেসেজ পাঠায় মোবাইলে। পড়তে পারিনা। ভাবছি শিখে রাখি যদি কাজে লাগে। যদি কোনও কাজ পাই!"
এমন সরল ও সুন্দর মানুষগুলো কি অসহায় হয়ে পড়েছে আজ! এই দেশের প্রতি গলি,প্রতি মহল্লায় মদিনারা ভিড় করে আছে। এদের কাহিনী বহুদিন ধরে জানা। এদের হাতের রেখা ও ললাট লিখন কেউ বদলানোর কথা ভাবে না । কেননা এত লোকের অভাব কি বদলের? শুধু একজন মদিনার হাত যদি কেউ শক্ত করে ধরত তবে এরা পাহাড় ভেঙে দেখাতে পারত! প্রায় বছর পয়ত্রিশের মদিনা স্বপ্ন দেখে তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া ছেলের কাছে লেখাপড়া শিখে লকডাউনের পর সে একটা কাজ পেতেও পারে! বিয়ের গান ও হাতের কাজের ফাঁকের দিনকটা বসে না থেকে কাজ করবে। এই স্বপ্ন দেখার চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় বার বার। কত লক্ষ -কোটি লোক জগত জুড়ে বেকার হচ্ছে মদিনা জানে না ,জানতে চায়ও না। ওঁর জগতে ও নিজেকে বেকার ও ঘরে বসা রান্না করা মেয়ে ও মা হিসেবে কখনও দেখতে চায়নি। আজও চায় না। লকডাউন পায়ে বেড়ী পরিয়েছে ঠিকই। কিন্তু মদিনা থেমে থাকার দলে নয়।
দুর্গাপুর, জীবন্তি, ভরতপুর-২,মুর্শিদাবাদ
দুই বিধবার লকডাউনের দিন
সামিলা ও লাইলির লকডাউন
লকডাউন শুধু সামাজিক দূরত্ব রক্ষার অগ্নিপরীক্ষা নয়। অসময়ে বন্ধুত্ব গড়ার দিশাও দেখাচ্ছে লকডাউন। সামিলা ও লাইলির ষাট পেরিয়ে গেছে। স্বামী নেই প্রায় দুই যুগ। একজনের বারো ,অন্যজনের তেরোতেই বিয়ে। চল্লিশ হতে না হতেই স্বামী মরে গেল। তারপরে প্রায় আঠারো- কুড়ি বছর ধরে লড়াই। স্বামীর ভিটে-মাটি আগলে একা। অভাবের দিনে চলছে দুইজনের খুদ,রুটি বিনিময়। আঁচলে বেঁধে সামিলা নিয়ে আসছে খুদ ও আটার নাড়ু লাইলির জন্য। লাইলিও সামিলাকে দিচ্ছে পরের বাড়ী থেকে চেয়ে আনা ভাত-রুটি। লকডাউনের দিনে কেমন আছেন? জিজ্ঞাসা করতেই মাথা নীচু দুইজনের। ধরা গলায় বলে,"কাজ নাই ,পায়সাও নাই।" জীবনের নানা হারানোর দুঃখের সঙ্গে এখন কাজ হারানোর দুঃখ মিলেমিশে গেছে। বিড়ি বাঁধা বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। ছেলেদের কাছে হাত পাততে মন চায় না ওদের। গর্ব করে বলছে, "ব্যাটারঘের কাছে হাত পাতি না। কাজ করেই খাই। বাতাসের অসুখটা চলে গেলে একটু হাড়ে হাওয়া লাগবে।"
সামিলাকে ব্যাটা খেতে দেয় না। মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল। জামাই আবার বিয়ে করেছে। 'ছাড়ান' হয়ে গেছে। বিটি এখন বাড়িতে বসে। বছর চল্লিশ হয়ে গেল। বিড়ি বেঁধেই পেট চলে। সামিলা চোখ মুছে বলে,"আমার স্বামী মরে গেল। তাই একলাই কাটনু। বিটির বিহার পর স্বামী ছেড়ে দিল। ও একলা হল ফের। কপালের দোষ কি কেউ খন্ডাতে পারে?"
লাইলির স্বামীর পরেই মারা গেল বাপ-ভাই এক এক করে। লাইলি স্বজন হারাতে হারাতে শেষমেশ একা হয়ে গেল। দুই ব্যাটা। মাঠে খাটে। মেয়ে জাহিরুন্নেশা তিরিশ পেরিয়েছে। আজন্ম মাথার অসুখ। পা-হাত নিয়ে পারেনা চলতে। কানেও ভালো শুনতে পায় না। এখন বাড়িতে চুলা জ্বলে না। সকালেই বেরিয়ে পড়ছে জাহিরুন্নেশা। ঘুরে ঘুরে খাবার চেয়ে বেড়ায়। যেদিন আনে, ভাগ করেই খায়। নইলে জলটাও চায় না মায়ের কাছে। লাইলি বলে,"মেয়েটা খেপি। খেতে দিতে পারিনা। ও লকডাউনে চেহে চিনতে যা আনছে তাই খেছে। আমি তো মুখ পানে সাহস করে দেখিনা।"
কোনও সাহায্য পেয়েছেন আপনারা? সামিলা মাটির ভাঙা জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,"জীবন কেটে গেল আমাদের। কেউ কিছু তো দিলে না। এখন খেতে পেছি না। কেউ ভুলেও জিজ্ঞাসা করে না।" লাইলি বলে, "হাঁড়িতে ভাত আছে কিনা, চুলা জ্বলছে কিনা কেউ ভুলেও হাঁক দেয় না একবার।"
দুই বিধবার এই বেঁধে বেঁধে থাকা জীবন লকডাউনকে যেন অন্য পথ দেখাচ্ছে । দূরত্ব বলে কি সত্যিই কিছু হয়? অভাব যাদের স্বভাব নষ্ট করতে পারেনি সেই সামিলারা ঝরা পাতার মত উড়ে যাওয়ার সব সম্ভাবনাকে হার মানাচ্ছে। নিজের যা কিছু আছে তার আন্তরিক বিনিময় করে,বিলিয়ে দিয়ে বাঁচার নিত্যনতুন কৌশল রপ্ত করছে। 'চোখের পুতুল' নষ্ট হয়েছে সামিলার কিন্তু লাইলির মনের দৃষ্টি অনেকদূর দেখে আজও। বৈধব্য তো মনে লাগে! শরীর কি আর চিহ্ন বহন করে? ভাতার কাগজে কি লেখা থাকে লাইলি -সামিলাদের সত্যিকারের অভাবের কথা! স্বামী মরার পরদিন থেকেই তো এদের জীবনজুড়ে লকডাউনের ছায়া। আজকের লকডাউন উঠে গেলেও লাইলিদের সঙ্গে সমাজের 'দো গজ দূরি'র লক্ষ্মণ রেখা মেটায় কার সাধ্য!
লালখানদিয়ার,জঙ্গীপুর, মুর্শিদাবাদ
বিড়ি শ্রমিক ফরজনার লকডাউনের দিন
ফরজনার লকডাউনের যাপন
বাচ্চা কটা জিজ্ঞাসা করতেই ফরজনা চমকে ওঠে। কোলের বাচ্চাকে দেখিয়ে বলে,"এই তো!" পাশে আরও তিনটে বাচ্চা কাড়াকাড়ি করছে একটি বাটি নিয়ে। কি খাচ্ছ ? উত্তর দেয়, "চাল ভাজা।" এরা কারা? জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে ফেলে ফরজনা। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, "বাচ্চাদের খেতে দিতে পারি না কি বলব! সব কটাই আমার বাচ্চা।" চার সন্তানের মা ফরজনা। ছাতু আর চালভাজা মায়ের বাড়ি থেকে দিয়ে গেছে বাচ্চাদের জন্য। খাবার কিছু নাই যে! বিড়ি বেঁধে চালায় বাচ্চাদের পেট ফরজনা । স্বামী বাইরে কাজে যায় বছরে একবার। যে কটা টাকা স্বামী নিয়ে এসেছিল তা দিয়ে চারদিক খোলা ঘর ঢেকেছিল ফরজনা শীতের সময়। কাজে যাওয়ার কথা ছিল মার্চ মাসে। বন্ধ হয়ে গেল। নিজের বিড়িও বন্ধ। কি করে কাটছে দিন? মাথায় কাপড় টেনে ফরজনা বলে, "কাল থেকে চুলা জ্বলেনি। মেয়ে মানুষ,কোথায় চাইতে যাবো?" স্বামী আলঙ্গীর লজ্জায় মাথা খেয়ে বলে, "চা করে দিতাম কিন্তু ঘরে কেরোসিন শেষ। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে বলে, অভাবের সংসারে চারটি ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রীর না খেয়ে মরতে ভয় নেই। কিন্তু বাচ্চাগুলো নিয়ে এখন কি করি! ভিক্ষা করতে যাবো তারও উপায় নেই।"
ফরজনা বলে, সরকার ঘরে থাকতে বলেছে। আমাদের তো ঘর নেই,ত্রিপল দিয়ে ঘর বেঁধেছি। ঝড় আসছে,বৃষ্টি আসছে আবার ভাইরাসও আসছে এখন। গরীবের জান সব সহ্য করতে পারে। শুধু ক্ষিদেটাই বেশি লাগে অভাবের দিনে।"
ছবি দেবেন একটা? হাসিমুখে ফরজনা বলে, "একটু দাঁড়ান, শাড়ি পড়ে আসি একটা।" একদম রানীর মত বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে পড়ল ফরজনা। স্বামীও যেন সুলতান! চোখের কোনে তখনও জল শুকায়নি ফরজনার। এরা ভোট দেয়। ভোটের পর ফেলে দেওয়া প্ল্যাকার্ড দিয়ে দেওয়াল ভাঙা ঘরে নিজেদের আব্রু বাঁচায়। এরা বিশ্বাস করে অভাবের কপাল বদলাবার নয়। কিন্তু কোলের ছোট্ট মেয়েটি সে কি জানে খেতে না পাওয়াটাও জীবনের একটা ধর্ম? বা ফরজনার ঐ বাচ্চাগুলো যারা এক বাটি চালভাজা নিয়ে তিনজন মিলে কাড়াকাড়ি করছিল ওরাও কি বোঝে কেন ওদের ভরপেট খাবারের অধিকার নেই? ওরাও তো দেশের ভবিষ্যৎ।
ইমামনগর,লালখানদিয়ার,মুর্শিদাবাদ।
সাঁওতালি নৃত্য দলের বালিকা কিস্কুর লকডাউনের জীবন
বালিকা কিস্কুর লকডাউনের দিন
জনগনের ভোটে ক্ষমতায় আসা নির্বাচিত সরকার কি সত্যি সত্যি নাগরিকের ভুখা পেটে ব্যথিত হয়? তবে বালিকা কিস্কুদের দেশ কোথায়? সারাবছর বালিকাদের খাবার জোটে না। অভাব যায় না। কেননা নির্দিষ্ট উপার্জন নেই। এদের মাথায় উপরে কেউ হাত রাখার নেই। এবারে এসেছে ভাইরাসের দাপট। নতুন পরিস্থতি। এখন প্রতিদিন সকাল হলেই ভয়। অভাব আর অবসাদ। বালিকা কিস্কুর জীবিকা বলতে সাঁওতালি নাচ প্রদর্শন। বছরের বাকি দিন বালিকা দিনমজুরি করে। মাঝে মাঝে জমিতে চাষের কাজে ডাক পায়। স্বামীও লেবার খাটে। তিন সন্তান ও শাশুড়ি নিয়ে এভাবেই চলে সংসার। শাশুড়ির ভাতাও বন্ধ । দুইবার পেয়েছে এক হাজার করে টাকা। বালিকা কিস্কুর বিদ্যালয়ের মুখ দেখা হয়নি। তবু নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বালিকা খুব সচেতন। ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে এবার। মেয়ে একাদশ শ্রেণি। অভাবের সংসারে এক নতুন পরিস্থিতি লকডাউন। বালিকা কিস্কু খুব সহজেই বলছে, “ভাইরাসের লেগে খাওয়া বন্ধ। দিনে আটা গুলে খাচ্ছি। রাতে ভাত।”
প্রথমে আলু জুটলেও এখন ভরসা মাঠের মিশেলি শাক। ঠিক এই সময় ধান কাটা ও পাটের জন্য লেবার খাটে বালিকা ও তার স্বামী । লকডাউনের জন্য সেটাও বন্ধ। আখার খড়ি ফুরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কেরোসিন কেনার পয়সা নেই। রেশনে থেকে দুই কেজি চাল ও দুই কেজি আটা মিলেছে। তা দিয়ে ছয়জনের আর ক’দিন চলবে!
জনগণের শাসনে জনগণের চেয়ে অসহায় কেউ নেই। কার্লাইল গণতন্ত্রের সমালোচনা করে বলেছিলেন, “এটি হল মূর্খদের শাসন। অশিক্ষিত ও অজ্ঞদের পরিচালিত শাসন ভাল হতে পারে না।” নিজেদের মূর্খ স্বীকার করে নেওয়ার মানে হয় না। কিন্তু অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সত্যিই কি কোনও মানে হয়?এই বিতর্কটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব দরকার ।
বিড়ি শ্রমিক তসলেমার লকডাউনের দিন
বিড়ি শ্রমিক তসলেমার দিনযাপণ
একটি পরিবারের কোনও জীবিকা নেই। কিন্তু তারা বেঁচে আছে। পরিবারের বাচ্চা দুটোও হাড় জিরজিরে অবস্থায় শ্বাস নিচ্ছে। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। গল্প, উপন্যাস ও সিনেমা কিছুর সঙ্গে মেলানো যায় না মুখোমুখি পাওয়া এমন মানুষদের। দেখামাত্রই ছন্দপতন ঘটে নিমেষে। এমনই একজন তসলেমা। বিড়ি বেঁধে জীবনধারণ বছর বত্রিশের মহিলার। স্বামী অসুস্থ। দুই ছেলে। দেড়শো টাকা হাজারে দিনে পাঁচশোর বেশি বিড়ি বাঁধতে পারে না তসলেমা। শরীরে কুলায় না। বিয়ের আগে থেকেই বিড়ি বাঁধা শুরু। ছোটবেলায় মা মারা গেছে। নানির বাড়িতে মানুষ। খালার চেষ্টায় হয় বিয়ে। বিদ্যালয়ের মুখ দেখেনি কখনও। বিয়েই ছিল থাকা খাওয়ার সংস্থান। কিন্তু বাদ সাধল কপাল। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ল। অভাবে শুরু হল আবার বিড়ি বাঁধা। এভাবেই কোনওরকমে চলতে থাকল সংসার। বিড়ি বাঁধা বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে তা কখনও কল্পনাও করেনি তসলেমা। অভাবের সময় গ্রামে গ্রামে চাইতে বেরোতে হয় তসলেমাকে। কখনও মেলে। আবার কখনও খালি হাতে ফিরতে হয়।
খাবার জোগাড় করতে পারলে খাওয়া হয় নইলে খাওয়া হয় না। সারাবছর একই রকম। দিন বদলায় না। সরকারি সুবিধা তেমন জানা নেই। সন্ধান করে দেওয়ার মানুষও নেই। অভাবের দিন তাই প্রতিদিন। লডাউনের জন্য এখন বিড়ি বাঁধা বন্ধ। যদিও এমন অভিজ্ঞতা নতুন নয়। নোটবন্দির সময় এমনটা হয়েছিল। বিড়ি জমা ও পাতা দেওয়া বন্ধ ছিল অনেকদিন। সমস্যা এই যে তখন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চাইতে বেরোনোর বাধা ছিল না। এখন মুশকিল গ্রামের সীমানা পেরিয়ে অন্যত্র যাওয়া। তাই ছেলেকে দিয়ে কলা বা ছুটির পাতা বা কচুর শাক বা কুমড়োর পাতা বা আমড়া পেড়ে এনে তাই ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ করে খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।
তসলেমা দুই সন্তান নিয়ে জেরবার। ছেলেদের খাবার বাঁচানোর জন্য নিজে একবেলা খাচ্ছে। রাতে মাঝে মাঝে খাচ্ছেও না। রান্না আখাতেই। কিন্তু ক’দিন দুই বেলা চলবে জানে না তসলেমা। প্রতিদিন লকড়ি জোগাড় করে এনে দেয় বারো বছরের ছেলে। সময় পেলে নিজেও ঘুরে ঘুরে জোগাড় করে শুকনো পাতা ও কাঠ-কুঠালি। পরিবারকে খাওয়াতে একটুও ক্লান্তি নেই তসলেমার। নেই চেষ্টার ত্রুটি। গ্রামের অবস্থাপন্নদের বাড়িতে কাজ করে দিয়েও খাবার জোগাড় করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিন তো আর এভাবে চারজনের খাবার সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। বিড়ি বাঁধার পয়সা হাতে থাকলে স্বামীর ওষুধটা কেনা হয়। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন ধরে। গ্রামে চাল-আলু বিলি হয়েছে। তসলেমা বলে, “এগুলো তো রান্না করতে হবে। কি দিয়ে করব? একটা ষ্টোভ আছে পুরানো। কেরোসিনের অভাবে পড়ে আছে। লকড়িতে ভাত ফুটনোই কঠিন। আলু রান্না করার তেল- মশলা নেই। চাল-আলু রান্নার ব্যবস্থা করার সাধ্য কি আমার আছে! তাও দুই কেজি চালে চারজনের ক’দিন যাবে? শুধু ভাতটাই তো জোটে না প্রতিদিন।”
এভাবেই লকডাউন ধীরে ধীরে তসলেমাদের পরিবারে মরণ -বাঁচন সংগ্রাম এনে দিচ্ছে। এমনিতেই প্রতিদিন দুবেলা খাবার জোগাড়ের চ্যালেঞ্জ ছিল এতদিন। এখন তো টিকে থাকা নিয়ে আশঙ্কা। পরিবারের অসুস্থতা ও দৈনন্দিন চাহিদা নিয়ে অকুল পাথারে পথ হারাচ্ছে তসলেমারা।
হস্তশিল্পী রীনার লকডাউনের দিন
কাঁচের কারিগর রীনা
পঁচিশ বছর ধরে চলছে পরিবারের কাঁচের শো-পিস তৈরির কাজ। স্বামীর ডাক পড়েছিল আগ্রায় গিয়ে নতুন ডিজাইন শেখার। তাই বিয়ের পরই পাড়ি দেয় রীনা চৌধুরী। ঘর সংসার সামলে সময় নষ্ট করেনি রীনা। স্বামীর কাছে বসেই তালিম নেয় কাজের। স্বামীর মৃত্যুর পর সাময়িক ভেঙে পড়ে রীনা। তবুও দমে না গিয়ে শুরু করে কাজ। ধীরে ধীরে নিজের তিন ছেলে মেয়েকে কাজের সঙ্গে যুক্ত করে। ঝাউ গাছ, পাখি ,নানা দেব-দেবীর মূর্তি, নৌকা, গরুর গাড়ি এমন সব শো-পিস তৈরি করে নিজের হাতে কাঁচ দিয়ে।
খুচরো,পাইকারি বিক্রি ও নানা মেলায় জিনিষ পৌঁছে দেয় রীনার একুশ বছরের ছেলে। ষাট টাকা থেকে আড়াইশো টাকা পর্যন্ত শো-পিস প্রতি দাম পেয়ে থাকে রীনা। মা-ছেলে বাজার ধরে নিয়েছিল একেবারে নিপুণ হাতে। তখনই বাদ সাধল লকডাউন। ঘরে অর্ডারের জিনিষ তৈরি। নেওয়ার লোক এল না। অন্যদিকে নতুন কাজও বন্ধ।
ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে এখনো কাঁচের শো-পিসে চাহিদা অনেকটাই কম। কিন্তু তা রীনাদের উপর প্রভাব ফেলেনি তেমন। চাহিদা ও বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভালোই এগিয়েছে রীনারা। রিসেপসন, পুরস্কার ও উপহারের জন্য রীনার বাড়ি বয়ে আসে নিয়মিত ক্রেতা। অর্ডার মেলে প্রতিদিন। পুজোর সময় বেশি। কাজ শেষ করতে পরিবারের সকলকে দিন রাত এক করতে হয়। একমাত্র দুশ্চিন্তা এখন কবে অক্সিজেন ও গ্যাস সিলিন্ডার মিলবে। অক্সিজেনের অভাবে পড়ে আছে হাতের কাজ। কাঁচ না গলাতে পারলে কাজই শুরু করা যাবে না। একমাসে প্রায় আশি হাজার টাকার ক্ষতি। সরকারি সাহায্য না পেলে টাকা শোধ তো দূরের কথা দিন চালানো কঠিন হবে। ভবিষ্যতের অনিশ্চতায় অন্যমনস্ক রীনা জানায়, যা আয় হয় তা দিয়ে ঘর বাড়ির মেরামত ও খরচ করে সংসার চলে যায় আমাদের। বাকি টাকা দিয়ে লোন মেটাতে থাকি প্রতিমাসে। ইনকাম বন্ধ হলে তো অভাবে মারা পড়ার কথা।” লোনের টাকা তিন মাস দিতে হবে না সে নিয়ে খুব বেশি খুশি নয় রীনা। হাত তো শূন্য হয়ে পড়বে তার আগেই। সাহায্য বলতে এখন পর্যন্ত রেশন থেকে দুই কেজি চাল জুটেছে।
এত বছর ধরে জুড়ে থাকা এই কাজ এভাবে থেমে গেলে কী করে সামাল দেওয়া যাবে জানে না রীনারা। হতাশ রীনা বলে,”অক্সিজেনটাও যদি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিত কেউ কাজটা তো চালিয়ে যেতে পারতাম!” সারা পৃথিবী তো আসলে এই অক্সিজেনের খোঁজে এখন মরিয়া। রীনাদের এই অভাবনীয় সঙ্কটের সঙ্গে জুড়েছে নতুন বিপদ। সেটা ভাঙনের। জীবন বাঁচলেও এই ধেয়ে আসা দু-পাড় ভাঙা বিপদে বাঁধ দেওয়ার কোনও আগাম সতর্কতা হাতের কাছে নেই রীনাদের।
খুব ভালো লাগল । বাস্তব ছব।
দেশের হব মানুষের জন্য কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া লকডাউন চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে । কলোনার চাইতে বেশী মৃত্যু হয়তো আসছে ক্ষিদের জন্য !!
দেশের হব মানুষের জন্য কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া লকডাউন চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে । কলোনার চাইতে বেশী মৃত্যু হয়তো আসছে ক্ষিদের জন্য !!
নাগরিক সনদের অভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রান্তজনকে দেশ থেকে তাড়িয়ে না দিলেও তাদের কী লকডাউনের অদৃশ্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ঠেলে দিয়েছে মোদি সরকার?
ত্রাণের নামে প্রহসনের এ-ও এক নয়া রূপ।
পুনশ্চঃ মূল ধারার মিডিয়াতে এসব কেস স্টাডি আসছে কী না কেউ বলতে পারেন?
মদিনা, রীনা, বালিকাদের খবর রাখার সময় কোথায় ডিজিটাল ভারতবর্ষের?
ধীমান মণ্ডল,
জেনে আরও মন খারাপ খারাপ হলো। এপারে আমরা মূল ধারার মিডিয়ায় এসব বঞ্চনার কথা অল্প বিস্তর কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি চাল চুরির খবরও আসছে।
কিন্তু করোনায় মৃত্যুর আগেই এই দুঃখি মানুষেরা না জানি না খেয়ে মারা যান!
#
গুরুতে আপনার লেখা নিয়মিত অনুসরণ করছি। আরও লিখুন