অনেক কিছু স্মৃতি উঠে আসছে – ২০০০ সাল অবধি তেমন ভাবে ‘কবিতা’ নিয়ে চর্চা বা ভাবনা হয়ে ওঠে নি। ওই গোঁফ ওঠার বয়সে যা ছড়া/কবিতা লেখে সবাই তেমন কিছু ছাড়া। আর সব প্রচলিত বিখ্যাত কবির কবিতা পড়া – সেই সময় ছিল সমকালীন জয় গোস্বামী টাইপের ইত্যাদি।
এমন এক সময়ে পরিচয় হয়ে যায় এক অদ্ভুত ওয়েবসাইটের সাথে – যার কবিতা পোর্টালের নাম ছিল ‘মুক্তমঞ্চ’ ( । মনে রাখতে হবে তখনো ইন্টারনেট এমন প্রচলিত হয়ে ওঠে নি, ব্রড ব্যান্ড ইত্যাদি তো দূরের কথা – অর্কূট, ফেসবুক, ইউটিউব কিছুই নেই। এমনকি সেই সাইটে তখন বাংলায় লিখে পোষ্ট করার মত উপায়ও ছিল না। অনেক অনেক বিষ্ময়কর ব্যাপার ছিল এই সাইট ঘিরে – কোন একদিন সময় করে সেই সব লেখা যাবে। আমার জানামতে শুধুমাত্র ‘কবিতা’ নিয়ে মুক্তমঞ্চের থেকে বেশী আর কোন ওয়েবসাইট আলোচনা বা অবদান রাখেনি বাংলা ভাষায় গত ২০ বছরে। এই সাইটে কোন বিজ্ঞাপন নেই – ইনফ্যাক্ট কেউ জানেও না এই সাইটটা কেউ চালায়! এমন ভাবে নিরলস কবিতার সাধনা করে যাওয়া সাইট বিরল। দুই বাংলার অনেক এখনকার চেনা এবং জনপ্রিয় কবি এই সাইটে হাত পাকিয়েছিলেন এখানে। ভাবছি তেমন কারো কারো দের দিয়েই কিছু লেখা যাক টুকটাক।
রাদ আহমেদের কবিতা
----------------------------------
এই মুক্তমঞ্চের সাইটেই প্রথম আলাপ হয় রাদ আহমেদের সাথে, বাংলাদেশের কবি – এবং বলতে দ্বিধা নেই আমাদের কাছাকাছি সময়কালের কবির অন্যধরণের কবিতার সাথে সেই প্রথম আলাপ আমার নিজের। এবং আজও রাদ আমার এক অন্যতম প্রিয় কবি হয়ে আছে। আরো অনেককেই জানি যারা আমার মতই রাদের কবিতায় মোহিত ছিল একসময়।
এই লেখাটা ‘রাদ আহমেদের কবিতা’ বলা উচিত নয়, কারণ রাদের কবিতার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে বসি নি বা হয়ত সেই মূল্যায়ন আমার ক্ষমতার বাইরে। এই মুর্হতে হাতের কাছে রয়েছে রাদের একখানি কবিতার বই, সেই ২০০৫ সালে প্রকাশিত, বইটার নাম “ব্রথেল মালিকের কারপার্ক”, কৌরব থেকে বেরিয়েছিল। বইটির প্রচ্ছদ করেছিল সব্যদা, সব্যসাচী সান্যাল। দেখতে পাচ্ছি বই উৎসর্গ করা হয়েছিল সব্যদা, বাল্মিকী এবং মুক্তমঞ্চ-কে। বাল্মিকী এবং মুক্তমঞ্চ নিয়ে অন্য কোন সময় বিস্তারে লেখার ইচ্ছা আছে।
বইটি পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল সেই খাতার কথা যেখানে আমার ভালো লাগা পঙতি লিখে রাখতাম – সেই খাতায় রাদের কবিতার অনেক পঙ্গতি লেখা আছে। পরে কোন দিন সেই লেখা রেফার করে প্রবন্ধ লিখব এমন তো মনে ছিল না – তাই প্রায় সব ক্ষেত্রেই কবিতার নাম লিখে রাখি নি! শুধু লেখা আছে ভালো লাগা কিছু শব্দবন্ধ!
“হাসি গড়িয়ে পড়বে ওই মুখ বেয়ে
গড়িয়ে পড়বে একশত ভাগ আলো
আজ পূর্ণিমা কাটাবে তুমি কার সাথে?”
“আজ পূর্ণিমা কাটাবে তুমি কার সাথে” – এই লাইনটা আমাকে কি অমোঘ আকর্ষণ করেছিল বলতে বোঝাতে পারব না। জানি না কেন – অমৃতা-কে শুনিয়েছি এই কবিতা অনেকবার। আর শুনিয়েছি এটাওঃ
“স্যান্ডেল জানে না কোন বিরহ
হাসতে চাইলে হয়ত যায় না হাসা
মুখে এসে লাগে আর্দ্র ঝাপট
হয়ত তুমি মুখ কুঁচকে নেবে
সত্যি বলছি বিরহ আমি জানি না”।
সময় বদলে যায়, বদলে যায় অনুভবও – এই শেষ লাইনটার সাথে আর নিজেকে একাত্ম করতে পারি না আজকাল।
বড় ভালো লাগত সেই স্কুটার নিয়ে রাদের কবিতা – এত অন্যভাবেও যে প্রেমের গল্প বলা যায় জানা ছিল না আগে, সে এক অচেনা আঙ্গিকে চেনা গল্প।
“স্কুটারের গায়ে একটা নকশি করা টিপ
লেপটে আছে কোন অভিমানী কিশোরী
লাগিয়ে রেখে চলে গেছে যাকে ভালোবসত তাকে
সব ভালোবাসা শেষ – সব ভালোবাসা শেষে
স্কুটারের গায়ে আমাদের সৌন্দর্যচেতনা
স্কুটারের বাইরে রোদ”।
এই বইয়ের নানা কবিতায় গানের পঙতি উঠে এসেছে। উঠে এসেছে শচীনদেবের কথা, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নেই’, হাসন রাজা তার ‘ঘরবাড়ি ভালা না আমার’ নিয়ে, রুবি রায়কে মনে পড়া, ‘সে আমার ছোট বোন’ – প্রতি ক্ষেত্রেই সেই গান যেন মিশে গ্যাছে কবিতার সাথে, সেই গান আর উদ্ধৃতি নয়, হয়ে উঠেছে কবিতার অঙ্গ – অনায়স, বড় মর্মভেদী এবং তীক্ষ্ণ মাঝে মাঝে।
“আড়ি – তোমার চায়ের কাপে আড়ি
ফিরিয়ে নেই প্রয়োজনহীন ইউক্যালিপটাস বন
মনের ভিতরে শন শন করে ওঠা সমুদ্রপাড়
রেষ্টুরান্টে সাজানো রুমাল
তোমার গায়ে লেগে থাকা আমার চোখের পাপড়ী”।
এ কি আমার কথা নয়? আমাদের কথা নয়? পাতা উলটে পড়ে নিই ‘দুপুর আড়াইটায় ভালোবাসা’ –
“গরম পড়েছে রিকশাওয়ালা মলিন গেঞ্জিতে ঘামছে একজন মফস্বলাগত
যুবক দোকানদার মনে মনে ভাবছে এবার আচরণে অল্প-স্বল্প টাউটেপনার
আমদানী করলে খারাপ হয় না – খারাপ হয়না
যদি ভালোবাসো
দুপুর আড়াইটায় কালো কাকের মত উড়ে যাব লাল বিকেলের দিকে”।
কত কত ভালো লাগা কবিতা – শুধু তো প্রেমের কবিতা নয়, শুধু তো মৃদুভাষ্য নয় – প্রতিফলিত হয়েছে সমকালীন আমাদের গল্পও। আমি পড়তে থাকি, যেন নিজেদেরই চিনে নিতে থাকি নতুন করে, আমি ও আমার আশপাশঃ
“বৃষ্টিতে হাসছ তোমরা শিয়ালের মত
রাস্তারোপরে সুগন্ধিযুক্ত বৃষ্টিফোঁটা রুমালের মত সাজে
গ্লাসের ভিতরে ভাঁজ করা ন্যাপকিন যেমন
হেঁটে নিয়ে আসে ভগ্নপায়ে ওয়েটার –
টাই
ঠিক করো – টাই
ঠিক করো মাটির সুনাম
তোমার গভীরে আলোকিত পুকুরপাড়
বাইরে ধানের গন্ধ সাইকেল চালাচ্ছে –
কিরিং কিরিং বৃষ্টি পড়ছে – বৃষ্টিতে
একপাশে ভিজে যাওয়া ঘর
শিয়ালেরা প্রকৃতির সন্তান বলে
এখনো বৃষ্টিতে হাসতে আছে”।
অচেনা কোন বাংলা শব্দ প্রায় নেই – নেই কোন কৃত্রিম ধোঁয়াশা বা তত্ত্বের আড়ালে চমক দেবার প্রচেষ্টা। রাদ যেন মানুষের চারিপাশের চিন্তাকে নিয়ে খেলছে – পুকুরপাড় আমি দেখতে পাচ্ছি, ভাবতে পাচ্ছি, জানি সাইকেলের গন্ধও, কিন্তু রাদ জানাবার আগে আমি আগে কোনদিন ‘কিরিং কিরিং’ বৃষ্টি নিয়ে ভাবি নি! যেন চোখ খুলে যায়, সত্যিই দেখি তাইতো, বৃষ্টির তো এমন শব্দও হয়, বৃষ্টি ভেজা সাইকেলের ঘন্টায় লেগে থাকে সুগন্ধি – আরো কিছু ক্ষণ, নাহয় তার পরে মুছে যাবে – এবার আমি তত চেনা নয় এমন শিয়ালদের নিয়ে ভাবতে বসি – রাদের কবিতা আমাকে নাড়িয়ে দেয়।
প্রবাসের প্রেমও রাদ লিখতে পেরেছিল কত অন্যরকম করেঃ
“প্রতি সপ্তাহের ফোন করা যেন প্রতি সপ্তাহে বলাৎকার
প্রতি সপ্তাহে আমি বলাত্কার করি আমার সে নতুন কাগজের মত পরিচ্ছন্ন স্মৃতিগুলো এবং
বলাৎকার শেষে জিজ্ঞেস করি তুমি
ঠিক আছ তো?
আসলে কেউই ঠিক নেই
সকলেই যার যার বলাৎকার শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে
বলে
সেই বেশ ভালো করলাম-তো
অথচ ভালোগুলো সব
হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে পাওয়া গোরস্থান
যেখানে মানুষেরা গোলাপ বাগান করেছে
কেন করেছে তুমি জানো?
হয়ত জাহাজ কারখানা তার ভালো লাগে নি
হয়ত প্রথমস্থান অধিকার করার জন্যে সকলের উঠে পড়ে লাগা”।
এই ভাবেই কবিতা পড়তে পড়তে আমি নগ্ন হয়ে যাই – তখন আমি সেই কাঠের বাড়িতে। পাশের ঘর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে, কেউ খুলছে রেড ওয়াইনের বোতল – আমি ভাবছি গোলাপ বাগানের গল্প। সংসারী গোলাপের সাথে, ব্যবসার গোলাপের সাথে আলাদা হয়ে যাচ্ছে বিরহী গোলাপ – রাস্তার ধারে আমি গোলাপ খুঁজে বেড়াই যেই, অথচ ঠিক জানি এই প্রবল ঠান্ডায় গোলাপ ফোটে না – তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভাবি অন্তত খোঁজার চেষ্টা তো করেছিলাম।
আসলে ভেবে দেখি রাদের প্রতিটি কবিতাই আমার প্রিয় – অনুভবেও। কিছু বছরের ব্যবধানে রাদের কোন কোন কবিতা পাঠ করতে গিয়ে দেখেছি পঙতিগুলো অচেনা হয়ে গ্যাছে যেন – সেই প্রবাসী জীবন অন্য ভাবে ধরা দেয় – রোজকার বাস্তব ছেড়ে স্মৃতিমেদুরতার উস্কানি দিয়ে দিচ্ছে শব্দের যাদু, এক ক্ষণিকের স্তব্ধতা –
“অনেক অনেক ভুল করেছি অনেক ভুলে ভরিয়েছি খাতা
নখেরোপোর নেলপালিশ দিয়েছি নখেরোপর সাদা
পায়রারা উড়ে যায় তামাটে মাঠে দূর থেকে
বাড়িটার ছবিটা ভালো আসল না ক্যামেরায়
সেই কতদিন আগে একটা কাঁকড়া
বালু ছেড়ে সমুদ্রে হারিয়ে যায় আমার
পদচ্ছাপ ডুবে আছে এখনো ছাই বালুতে”।
রাদ জানতও না - সম্পূর্ণ অন্যপ্রসঙ্গে, বা হয়ত একই ভাবনা নিয়ে ভৌগলিক অন্যপ্রান্তে বসে আমিও নেলপালিশ চর্চা করছিলাম সেই একই সময়ে!
“দূর থেকে সমুদ্রের চেহারা দেখেছ কি?
দূর থেকে সমুদ্রের চেহারায় জগত সংসার হাসে আর
রাস্তার দুইপাশ পিছে চলে যায়
পিছে পিছে চলে যায়
আলোকিত গণিকাবৃন্দ
তাদের গায়ে তোমার চোখের অশ্রু লেগে থাকে”।
[ক্রমশঃ]
-------------------------------------------------------------------------------
সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
---------------------------------------
কবিতার অনেক ব্যবচ্ছেদ, তত্ত্ব, তথ্য – নতুন কিছু করার প্রচেষ্টা, বিজ্ঞান, প্রগতির – যুগের সাথে কবিতাকে মিলিয়ে দেবার নানা চেষ্টার পরেও যেটা একমাত্র সত্যি হিসাবে থেকে যায় তা হল ‘ভালো কবিতা’ – আর কবি হয়ে উঠতে পারা। চমকের খোলস, শব্দের কারিগরি, ধ্বনির মাধুর্যও ফিকে হয়ে এলে একাকী সামনে পরে থাকে কবি এবং তার কবিতা – একদম নগ্ন – পোষাকি বাহুল্য ছাড়া।
আর এইখানেই সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমের সার্থকতা – সে প্রকৃত কবি হয়ে উঠতে পেরেছিল। আমরা যারা একসাথে কবিতা লিখতাম তাদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় কবি ছিল এবং আজও আছে সে। সে কেমন কবি ছিল? রোমান্টিক, নাগরিক, প্রেমিক কবি? নাকি জীবনকে ভালোবেসে চলা এক কথক? সুদীপ্তর অনেক অনেক লেখা একই সাথে হয়ে উঠেছে সময়ের কথকতা, প্রেমিকের দিনলিপি, এবং পরিপূর্ণ কবিতা।
সুদীপ্ত ছিল যেন আমাদের কবিতার কিশোরকুমার। অনেক শিল্পী যারা শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা করছে নিয়মিত, চাইছে হয়ে উঠতে শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী হিসাবেই সিদ্ধি এবং পরিচিত – তারাও যেন এক ক্লান্ত বিকেলে, পরিশান্ত দুপুরে, ঈষৎ মন খারাপের সময়ে জানালার বাইরের উদাসী আকাশের দিকে তাকিয়ে শুনছে কিশোর কুমারের গান। কারণ সেই এক – গান তো গানই! পরিশেষে গানকে গান হয়ে উঠতে হবে, যেমন হয়ে উঠতে হবে কবিতাকে কবিতা।
আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় ইদানিং কালে সুদীপ্তর থেকে ভালো প্রেমের কবিতা কেউ আর লেখেনি – না মেনস্ট্রীমে না ব্যতিক্রমী কবিতার জগতে। কিন্তু প্রচার বিমুখ এই কবির কবিতা পাঠের আনন্দ পোঁছলো না আরো বেশী বেশী পাঠকের কাছে, সেটাই আমার এক অনেক বড় আক্ষেপ। অনেক অনেক তাগাদার ফলে, এবং বিশেষ করে সুদীপ্তর এক বিশেষ বন্ধুর প্রচেষ্টাতেই বলতে গেলে ২০১৯ সালের বইমেলায় সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় সুদীপ্তর প্রথম এবং এখনো পর্যন্ত একমাত্র কবিতার বই “বেথুনবালিকা স্কটিশবালক”। জানি সুদীপ্ত নিজে পুরষ্কার বা স্বীকৃতীর খুব বেশী তোয়াক্কা করে না – কিন্তু এই বই পড়লে বোঝা যায় বাংলা তথাকথিত প্রচলিত, বিখ্যাত কবিদের ফালতু কবিতার বাইরেও এমন কবি রত্ন সব লুকিয়ে আছে – বাংলা ভাষার এটাই ভরসা। যাঁরা ভয় পান কবিতার কি হবে, সে দিন চলে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি – তাদের জানাই অত বেশী ভয় পাবার কিছু নেই। যতদিন সুদীপ্তর মত কবি বাংলা ভাষায় লিখবে ততদিন ওই ‘লিরিক্যাল’ ব্যাপারটা ছিনিয়ে নেওয়া অতো সোজা না।
“এত ক্লান্তি দিলে যদি, কী করে ভুলেছো দিতে
দিনলিপি, দেবী?
ঐ দ্যাখো, শহরের সব ইস্তেহারে আলকাতরার পোঁচ
ঐ দ্যাখো কেউ আজ রাত্রি জাগেনি
ঐ দ্যাখো কোনো কার্ণিশে, বেআব্রু অশথচারায়, দুলছে না চাঁদিয়াল ঘুড়ি
ঐ দ্যাখো কেউ আর চিঠি লিখছে না
তোমার বেদীর থেকে নেমে এসো দেবী
চলো একবার যাই ট্রামগুমটিতে
কত যে আগাছা সেথা, কত লোহা জং ধরে বাতিল হয়েছে যদি দ্যাখো
পুষ্পশাখায় জানি আঁকবে না সোহাগশিশির
চলো একবার যাই গঙ্গার ধারে
গহণার নৌকা বাঁধা, স্তূপীকৃত খড়, মাঝিদের জটলায় রান্না বসেছে
ওদের শুধাও দেখি, 'ভাটিয়ালি জানো?
আহ্লাদী চাঁদ এসে মাঝরাত্তিরে নদীতে বাসন ধোয়, দেখেছো কখনো?'
হে দেবী, কল্যাণময়ী, আলোকসম্ভূতা
আমাকে তৃপ্তি দাও – হাসিমুখে মরি
তোলপাড় করে ছেঁড়ো বাচালের সব তঞ্চকতা
প্রণয় সুলভ হোক আগামীর সংস্করণে
প্রপাতের শব্দ ভাসে রাতের কোটরে
কানে হাত চাপা দিই, তবু কই সাগর ডাকে না
হে দেবী, শুনেছো না কি, আজ কেউ রাত্রি জাগেনি?
হে দেবী, শুনেছো তুমি, কেউ আর চিঠি লিখবে না?”
“চিলেকোঠার দরজাটাতে তালা
আমার সবই কেউ করেছে নিলাম
এবার নিজের বিক্রী হবার পালা
সারা দুপুর এসব ভেবেছিলাম
ফিরবো কোথায় - হারিয়ে গেছে সিঁড়ি
ফেরার কথা তুমিও কি আর ভাবো?
কেমন করে তোমার কাছে ফিরি?
কোন ঠিকানায় তোমার দেখা পাবো?
চিলেকোঠার দরজাটা আটকানো
এবার আমি হচ্ছি নিজেই নিলাম
আমার কোন ঈশ্বর নেই, জানো
আমি শুধুই তোমায় জেনেছিলাম”
আধুনিক কবিতা নিয়ে অনেকের ছুতমার্গ আছে – আছে ছন্দ নিয়েও। অনেকে আক্ষেপ করেন যে আজকালকার কবিতা ছন্দ ইত্যাদি কিছু নিয়ে না জেনে, ছন্দ না বুঝে শুধ গদ্য কবিতা লেখে! তাদের জন্যও আশ্বাস – ছন্দের দখলে সুদীপ্ত সেই অনায়স দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে সে যা চেয়েছে এবং পাঠককে খুলে দিয়েছে অনুরূপ চিন্তার ও কল্পনার জগত। কবিতায় যেন মিলেমিশে গেছে ইতিহাস, উপকথা ও মানবিক যন্ত্রণা – পেরেকের গল্প আজ এই কয়েক হাজার বছর পেরিয়েও কত প্রাসঙ্গিক।
“কিছুটা প্রকাশ্য হই, বাদবাকি আছি রেখেঢেকে
হে আমার আবিলতা, হে আমার সারিবদ্ধ ছুতো
তোমরা সকলই জানো - কী উপায়ে তিনটে পেরেকে
ক্রুশবিদ্ধ হওয়া যায়, নিরাপদে, মোটামুটি দ্রুত
আকাশের চৌকাঠে মাথা কুটে রঙ চিনে শিখি
কিভাবে জলের দাগে মুছে যায় বর্ণপরিচয়
অক্ষরে মেশে কালি - রোজনামচায় সবই লিখি
এতদিন যা লিখেছি, লিখিনা কেবল প্রত্যয়
হে আমার আবিলতা, হে আমার সারিবদ্ধ ছুতো
তোমরা তো জানো, কেন মরেছি এভাবে মাথা কুটে
ইশারা চুপটি করে পাশে আসে, বলে, 'অনাহূত
এবারে তোমার পালা, অভিষেক কাঁটার মুকুটে'”
অনেক সময় কবিতার ‘ঘর’-এ ঢোকার দরজার তালাটি দেখে ঘাবড়ে যাই। সেই তালা কেমন করে খুলব সেই নিয়েই ভাবতে বসি – চিন্তায় চলে আসে এই ভাবনা যে কবি বড় যত্ন করে তালাটি বানিয়েছেন – যেন চট করে কেউ সে তালা খুলতে না পারে! অনায়স দক্ষতায় তোমার সেই ঘরে ঢোকার অধিকার নেই বলে যেন কবি অলেক্ষ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন পাঠকের দিকে – আগে অভ্যাস করে সেই তালা খোলার অধিকার অর্জন করে এসো! অনেক সময় সেই তালার চ্যালেঞ্জে পাঠক পরিশ্রান্ত হয়ে গিয়ে ঘরের ভিতরে ঢোকার উদ্দীপনাটাই হারিয়ে ফেলেন। কবি হিসাবে সুদীপ্ত সেই দরজার তালায় জোর দেন নি – বরং তিনি জোর দিয়েছেন ঘরের ভিতরের ঐশ্চর্য্যকে। পাঠক অনায়সে চৌকাঠ পেরিয়ে যান – চমকে যান ভিতরে ঢুকে, এতো অভাবনীয় জিনিস – যে জিনিস দেখতে পাব বলে পাঠক প্রস্তুত হয়ে আসে নি। এক যেন এক জাদুঘর – কবিতার অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে পাঠক নিজের মত করে খুঁজে নেবেন গোপন রত্ন ভান্ডারের খবর।
“ষড়যন্ত্র করতে হলেও নই পিছপা। তোমায় ছুঁয়ে দেখতে আমার
প্রবল এমন ইচ্ছে হলো, বুকের মধ্যে ম্লান হারিকেন পুড়তে পুড়তে
জ্বালছে আগুন এখন মেঘের পর্দাগুলোয় - এর নামই কি বসন্তকাল?
প্রবল যখন ইচ্ছে হলো জাপটে ধরি, নিষ্পেষণে সাপের মতন জড়াই এবং
ঢেউযুগলে জিভ রাখি খুব শান্ত হয়ে, ক্লান্ত হয়ে, ঠিক তখনই সিংদরজায়
কে বা কারা উচ্চকিত কলিংবেলে হাত রেখেছে। কে বা কারা ঠিক তখনই
বিশ্বজোড়া উষ্ণায়নের বিরুদ্ধতায় নামলো পথে। আমায় তারা মিছিলনামক
হাতকড়া আর পায়ের বেড়ির সঙ্গে দেবে আপ্যায়নের উত্তরীয়, সসম্মানে।
কিন্তু তখন ইচ্ছে আমার দঙ্গলে নয়, খুব নিরালায়, বিপজ্জনক। কিন্তু তখন
ইচ্ছে আমার দশ আঙুলে হাতড়ে দেখি উচ্চাবচ কোনখানে বেশ বৃষ্টি হলো
দৃষ্টিগোচর। ভূলুন্ঠিত ঊর্ণা তোমার গুচ্ছ যেন রুদ্রপলাশ, স্যাঁতস্যাঁতে লাল।
এর নামই কি বসন্তকাল?”
আবার অন্য দিকও আছে – সেটা হচ্ছে প্রেডিক্টেবিলিটি – সুদীপ্তর কবিতা পড়তে গেলে অনেক সময় মনের মধ্যে একটা ধারণা তৈরী করে গেছি – মানে কবিতার মধ্যে কি পেতে পারি। কিন্তু কবিতা পড়তে গিয়ে দেখেছি, হ্যাঁ যেটা ভেবেছিলাম তেমনি বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে হয়ত – কিন্তু এমন ভাবে তো ভাবি নি কোনদিন! এ যেন সেই তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে তার ব্যপ্তি দেখে বিষ্ময়ে থমকে দাঁড়ানো – জানতাম তাজমহল দেখতে যাচ্ছি, কিন্তু কাছে গিয়ে সে যে অন্যরূপে ধরা দেবে তা আগে বুঝতে পারি নি। এ জিনিস আমার হয়েছে এই কবির অনেক অনেক কবিতা পড়তে গিয়ে। নীচের কবিতার পঙতিমালাই না হয় একটু ফিরে দেখা যাক -
“আলাপ তেমন নেই, বিস্তারে ছোঁয়নি বিকেল।
গল্পে যেমন হয় – তেমনই দু’জনে পাশাপাশি
কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ। বাসপ্রত্যাশী
অথবা জমির নীচে, প্ল্যাটফর্ম, পাতালের রেল।
গল্পে তো কত কিছু মিলে যায়। অঙ্কের মতো
পূর্ণসংখ্যা আর দশমিকে হেসে ওঠে উত্তরমালা।
শহরও মেলায়, যত কফিশপ, চায়ের পেয়ালা
কথারা ঠুনকো থেকে ভারী হয়, আলোচনারত।
দু’জনের কথা বলি, সেই যে দু’জন আধচেনা।
একই সাথে যাতায়াত। বসবাস একই তল্লাটে।
কাছাকাছি পিনকোড। ভাড়াবাড়ি। দু’জনই ভাড়াটে।
সঞ্চয় কিছু আছে দু’জনেরই কিছু ধারদেনা।
এটুকু ভূমিকা পড়ে হে পাঠক, হে প্রিয় পাঠিকা আমার
আপনারা মত দিন, ওদের কি কথা হতে পারে?
আড্ডা যেমন হয়, প্রিয় বই, সিনেমা বা যৌথখামার।
নির্জন গলিপথে, টলটলে দীঘির কিনারে।
হতে পারে? ধরে নিন হয়েছিল তবে।
ধরে নিন হাত ধরে হেঁটেছিল ওরা। বাস্তবে।
তার পরে কী কী হলো? জানলেও বলব না আমি।
বলব না আজও ওরা পাশাপাশি দাঁড়াচ্ছে কি না।
একই বৃষ্টির ছাঁটে ওদের ভেজায় যদি শ্রাবণ মাহিনা,
ওরা কি নির্বিবাদে মেনে নেয় শহরের সেই পাগলামি।
বিরক্ত হলেন বুঝি হে পাঠিকা, হে আমার নিবিড় পাঠক?
একটি ছেলের পাশে এক নারী – এইটুকু দেখেছি আসলে
বাসস্টপে, মেট্রোতে। বাকি কল্পনা। উপসংহারে তাই হোক
প্রেমের গল্প বড় ভাল লাগে যেমনটা হলে।“
সুদীপ্ত কলকাতার ছেলে – তাই তার প্রেমের গল্পে প্রেমের কবিতায় কলকাতার রাস্তা, রাতের ল্যাম্পপোষ্ট থাকবে – কিন্তু এই ভাবে শহরের পাগলামি ধরবে পঙতিমালা এমনটা কি ভেবেছিলাম আমি? বাসপ্রত্যাশী দুজনকে নিয়ে অঙ্কের মতো পূর্ণসংখ্যা আর দশমিকে হেসে ওঠা উত্তরমালা।
মাঝে মাঝে পেয়েছি এমন কিছু কবিতা যা তথাকথিত সুদীপ্তর কাছে প্রত্যাশা করি নি – এমন কবিতায় কবি চিনিয়ে দিয়েছেন তিনি কোন বাস্তব বিচ্ছিন্ন সমুদ্রবিলাসী পৃথক কবি স্বত্তা নয় – বরং আমাদের মতনই চারপাশ দেখে ক্ষোভ, যন্ত্রণা – এক যেন অব্যক্ত বেদনায় বিদ্ধ নাগরিক।
“পিস্তল শুদ্ধু বেল্ট খুলে রাখছি তোমার দু'হাতে
কাঁধ থেকে ছিঁড়ে দিচ্ছি সামরিক তারা
আর কত সমর্পণ চাও?
রক্তপাতের কথা, যুদ্ধের যাবতীয় ক্ষতি
জলপ্রপাতে বাঁধ, জড়তায় ডুবে যাওয়া সব রাত্তির
সূচীমুখ তুরপুণ, লেভেল ক্রসিং জুড়ে লাল চোখ সিগন্যাল
মেঘে ঢাকা লক্ষ গোধূলি - সব দায় কাঁধে নিলে
হেরে যেতে হয় যদি, হেরে গেছি আমি
আর কত সমর্পণ চাও?”
এ কার সমর্পণ? কার কাছে? প্রেমের কাছে প্রেমিকের – প্রেমিকার? নাকি রাষ্ট্রের কলঙ্কিত এবং ন্যাক্কারজনক ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে বিষণ্ণ কবি জানতে চাইছেন আর কত! যে কবি বিনা প্রত্যাশায় প্রেমের নিবেদন নিয়ে অনেক পঙতি লিপিবদ্ধ করেছেন, “আমি তো অল্পে সুখী, অস্থায়ী... অন্তরাতে” – সেই কবিই অর্ন্তস্থল থেকে তুলে এনেছেন আকুতি, আর কত সমর্পণে খুশী হবে তুমি বা তোমরা? এইভাবেই শাশ্বত প্রেম থেকে সমকালের সীমানায় ঢুকে যান কবি অনায়সে
“...তোমাদের যন্ত্রণারা, তাদেরও দেখছি বটে
কার কাছে ঘোড়ার গাড়ি, কে চড়ে গোশকটে
কে পরে রাজার মুকুট, কে পেল জীয়নকাঠি
আমি তো শূন্য থেকেই পেড়ে আনি ঝগড়াঝাঁটি
কেড়ে আনি জাদুর টুপি, কেড়ে আনি জাদুই চিরাগ
অনুগত জ্বীনকে দিলাম মুক্তি, শুনছি বিরাগ
জন্মেছে তার অধুনায় – চোখ বুজে হুকুমতামিল
করতে চায় না সেও, গোঁজামিল আর গোঁজামিল
দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে সেও চায় উঠোন জুড়ে
অনাবিল আলপনা হোক, কুয়োতলা একটু দূরে
আরও দূরে দুপুরবেলায় পুকুরের শাণবাঁধা ঘাট
আমি চাই সামান্য সব, মস্ত নয় বা বিরাট
আমি চাই আঁটবে যা যা দু’খানি মুঠোয় হাতের
আমি তো অল্পে সুখী, অস্থায়ী... অন্তরাতে...”
প্রেমের সাথে, সম্পর্কের সাথে পায়ে পায়ে এসে গেছে সুখ, এসে গেছে দুঃখের দু-চার কলি। কিন্তু এ যেন নিজেকেই দেখা, সব শেষ হয়ে গেল বলে কোন করুণ আর্তি নয়, বরং কালবৈশাখীর শেষে সন্ধ্যাকালীন সূর্য একবার উঁকি দিয়ে যাবে এমন বিশ্বাসের স্পষ্ট উচ্চারণ – আশে পাশে থাকা চেনাদেরও জীবনের মোহবৃত্তে ঢুকিয়ে নেওয়া – সেই মোহ বড় চাওয়ার এবং বর্ণিত অস্থায়ী বেদনারও।
“এভাবে কাঁদেনা
এভাবে কাঁদেনা, বলো, কেন টের পাবে অন্যরা
দরজার কোন দিকে আমি আছি, কোন দিকে ঘর
কোথায় বেজেছে সুখ - সুরটুকু রাংতায় মোড়া
উজল তারার রাতে কী করে লুকোবে নিশাচর
সুখ
হে সুখ, তোমার সাথে দেখা হবে প্রাচীন নগরে
শুকতারা নিভে গেলে, বেকারির গাড়ির আওয়াজে
নিঃস্ব সেকেণ্ড ক্লাসে, গ্যালিফ স্ট্রীটের ট্রামে চড়ে
সারা রাত জেগে, সুখ, ভোরাই শুনেছ? এস্রাজে?”
কবি সুদীপ্ত এই ভাবে নিপুণ দক্ষতায় সুখের সাথে কান্নার সাথে জড়িয়ে দেন কলিকাতার চেনা ট্রাম – ভোরের বেলা – আর কয়েকজনের বড় কাছের গ্যালিফ স্ট্রীট। সে কান্না ক্ষণিকের, দৃঢ় বিশ্বাসে তাই উচ্চারিত হয়েছে অন্যদের টের না পাবার কথা – এর পর হয়ত সত্যিই সুখের রাঙতায় মোড়া ভোরের সুর খুলেছিল রাতক্লান্ত দুজনে, একসাথে – হাতে হাত রেখে।
আসলে সুদীপ্তর কবিতার ব্যাখার দরকার হয় না – হয় না দরকার ভাষ্যের। পাঠক নিজেই নিজের মত করে যুক্ত করে নিতে পারেন কবিতার অন্তর্লীন সুরের সাথে। অস্ফুট কথা – সন্ধ্যার গায়ে মানুষের নিজেদেরই গল্প লেখা – সময় করে কেউ খুঁজে নিতে চায় হাবিজাবি – এক সময় হয়ত বহুতল বাড়ির ফাঁকে ডুবে যায় সূর্য, শহরের দূষণ আর কোলাহল ছুঁতে দেয় না প্রকৃত সন্ধ্যা – এই বার বাড়ির ফেরার পালা – শেষবারের মত সেই দিনের মত নিভৃত হয়ে গিয়ে নিজের পাড়ায় রওয়ানা দেওয়া – কত প্রতিবেশী থেকেও রাত বড় করে দেওয়া যায় আলোর সড়ক এঁকে।
“অস্ফুট থেকে যায় কথা
কোথা থেকে হাওয়া এসে হাবিজাবি লিখে দেয় সন্ধের গায়ে
শাঁখ বাজে, আলো জ্বলে, পর্দারা দোলে মৃদু মৃদু
আমরা নিভৃত হই, ফিরে যাই নিজের পাড়ায়
তারপরে, তার আগে পিছে
বাঁশুরিয়া ধুন যেন পোষ মেনে কোলে এসে বসে
কবেকার ছেঁড়া খাতা অক্ষর চিনতে শেখেনি
হাতেখড়ি হয় তার ঘামে ভেজা চৈত্রদিবসে
কালকের চিরকুট, আজকের আলোর সড়কে
হিজিবিজি দাগ টেনে রাস্তা পেরোবে বলে আলুথালু দু'হাত বাড়ায়
শহর যে ভাবে শেখে শুশ্রূষা ঠোঁটে ঠোঁট রেখে
আমরা নিভৃত হই, ফিরে যাই যে যার পাড়ায়”
একসময় কবি লিখেছেন “তার পরে কী কী হলো? জানলেও বলব না আমি। বলব না আজও ওরা পাশাপাশি দাঁড়াচ্ছে কি না”। আবার দেখি এক কবিতার নাম ‘পরস্ত্রী’! তাহলে কবি যা আগে বলেননি সেটাই এই কবিতায় লুকিয়ে আছে? পাশাপাশি দাঁড়ানো বা না-দাঁড়ানোর ধাঁধার পরিসমাপ্তি? কবিতা দুটির সাল তারিখ দেখে কিছু মিমাংসা করতে ইচ্ছে করে না – এর থেকে তো সম্ভাবনাই ভালো। সম্ভবনায় ডুব দিই আরো ভিতরে আরো গভীরে
““শীতের মধ্যে পড়ল হঠাৎ এমন গরম, চোত-বোশেখে
যেমনটা হয়, গেঞ্জী সোঁদা, ঘাম চাটছে জামার কলার।
রোদ্দুর দাও বলব না আর, সত্যি বলছি, ঘাট হয়েছে
আর তাছাড়া আমার কাছে অনেক কথা – তোমায় বলার।
তেইশ থেকে ছাব্বিশ তো লম্বা ছুটি। কোথাও যাবে?
ছুটির কথায় পড়ল মনে, তোমার বিয়ে, ফাল্গুনে কী?
শহর ছেড়ে পালিয়েছিলাম, মুখ লুকিয়ে, শীত ছিল খুব।
মাস মনে নেই। খুঁজলে পাব যদিও জানি, ডাইরি দেখি।
শহর ছেড়ে পালিয়েছিলাম। শহর ছাড়ে! আষ্টেপৃষ্টে জড়ায়।
শেষে ফিরতে হল। কয়েকটা দিন বিকেলটুকু খাদের ধারে
সিঙ্কোনা গাছ আর কুয়াশায় রাত কাটিয়ে ফিরছি যখন
খবর পেলাম চাঁদ গিয়েছে, মধুর খোঁজে, সেই পাহাড়ে।’’
লম্বা চিঠি। আগের মতোই, জানলাটাতেও একটা শালিখ
মন দিয়েছে কাচের দিকে – শীত ফিরবেই, সোমবারে ঠিক”
এ তাহলে কি এক অবৈধ কিন্তু আদপে রোমান্টিক সম্ভাবনার ঈঙ্গিত নাকি ভীতু প্রেমিকের চিঠির গল্পই শুধু! শহর ছেলে পালানোর গল্পে হয়ত অনেক পাঠক নিজেকে খুঁজে পাবে আর খাদের ধারে আত্মহননের সম্ভাবনা। শীত ফিরবে বলেই কবির দৃঢ় বিশ্বাস – কিন্তু সেই ওম্-নিয়ে করণীয় কি হতে পারে কবি তা আমাদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। কিংবা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে প্রেমিকের হাতে – কবি শুধ খবর টুকু দিয়ে দিয়েছেন মধুর খোঁজে চাঁদের সেই পাহাড়ে যাবার -
“তুমি নেই। তোমরাও নেই।
তোমাদের ওই দিকে ঘাসে রোদ পড়ে।
তোমাদের ওই দিকে চাঁদ ওঠে থালার গড়ন।
আমার সামনে সাঁকো। তোমরা উদার এত, পথ খোলা রাখো -
যদি যাই তোমাদের কাছে। তোমাদের কাছে গেলে
জল দেবে কালো কলসীর, কাঁসার রেকাবী আছে
ফল কেটে দেবে। গরল কী কাজে লাগে, তোমরা তা
শেখোনি এখনও।
তবুও যাই না আমি। তবুও শহরই চাই শিরা-ধমনীতে।
এবং বৃষ্টি নামে। এই পাড়ে নেমে আসে আকাশের জল।
আমি সাধ করে ভিজি। ভুলে যাই, জ্বর হবে। ভুলে যাই
তোমরাও আসো না এপাড়ে – জলপট্টির ছোঁয়া
কপালে কে দেবে আর, তোমাদের ওই দিকে চাঁদ ওঠে
থালার গড়ন।“
কিন্তু শহর ছেড়ে সেই চাঁদ দেখতে যাওয়া আর হয় না পাহাড়ে – শহুরে ভীতি নিজেই নিজেকে সনাক্ত করতে পেরে অস্ফুটে বলতে পেরেছে ‘তুমি নেই’। অবচেতন কিন্তু স্পর্শ পেতে চায় – কারো ঠান্ডা হাত, সে তো বড় চেনা ছোঁওয়া। ছাদে উঠে বৃষ্টি ভেজার গল্প এর পর – সন্ধ্যে নেমে আসে রাত গাঢ় হয়। কেউ এগিয়ে আসে না, কেউ কড়া নারে না জলপটি নিয়ে – ঘোরের মধ্যে প্রবল তাপ নিয়ে আর একবার ছাদে উঠি – ওই তো চাঁদ দেখা যায় – পাহাড়ে উঠে চাঁদ ছুঁয়ে আসতে পারি নি। একবার না হয় এইভাবেই ছাঁদ ছুঁয়ে দিই –
“...তোমাদের যন্ত্রণারা, তাদেরও দেখছি বটে
কার কাছে ঘোড়ার গাড়ি, কে চড়ে গোশকটে
কে পরে রাজার মুকুট, কে পেল জীয়নকাঠি
আমি তো শূন্য থেকেই পেড়ে আনি ঝগড়াঝাঁটি
কেড়ে আনি জাদুর টুপি, কেড়ে আনি জাদুই চিরাগ
অনুগত জ্বীনকে দিলাম মুক্তি, শুনছি বিরাগ
জন্মেছে তার অধুনায় – চোখ বুজে হুকুমতামিল
করতে চায় না সেও, গোঁজামিল আর গোঁজামিল
দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে সেও চায় উঠোন জুড়ে
অনাবিল আলপনা হোক, কুয়োতলা একটু দূরে
আরও দূরে দুপুরবেলায় পুকুরের শাণবাঁধা ঘাট
আমি চাই সামান্য সব, মস্ত নয় বা বিরাট
আমি চাই আঁটবে যা যা দু’খানি মুঠোয় হাতের
আমি তো অল্পে সুখী, অস্থায়ী... অন্তরাতে...”
সুদীপ্ত চেনা ভাবেও কবিতা লিখেছে, কিন্তু অন্যভাবে। কবি নিজের সাথে কথা বলেছে – সামনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে – কিন্তু সেই সামনে দাঁড়ানো কেউ প্রতিপক্ষ হয় নেই। কবি কোন ছায়া যুদ্ধে মেতে কাউকে পরাজিত করার প্রচেষ্টায় নামেন নি। বরং সেই সামনে দাঁড়ানো হয়ে গেছে কখনো ধ্রুব, কখনো অনিমেষ। নিজের না বলা কথা কবি অস্ফুটে বলছেন – কবি অনিমেষ হয়ে গভীরে ঢুকে যাচ্ছে প্রতিটা পঙতিতে ক্রমশঃ
“তুমি চলো, অনিমেষ, তোমার মন্দভালো সে সবে যাদের যায় আসে
তারা ঠিক খুঁজে নেবে তোমার ঠিকানা একদিন
মেটেনি যাদের ঋণ, তারাও কি খুঁজবে না?
অনিমেষ, এ জীবন তোমার তো চেনা, এই যে উচ্চাবচ রাস্তাকে
চিরদিন দিয়ে এলে ফাঁকি, জোছনাকে ভয় পেয়ে রাত্রিকে দিয়েছ জোনাকি
দুপুরের রোদ ভালবেসে, অনিমেষ, ভেবেছ কি পাথরেরা কোন সুখে এসে
থেমেছে নদীর জলে, আরশিমহলে, কার ছায়া ভরে আছে
নিষ্প্রাণ সহস্র কাচে, অনিমেষ, আনাচেকানাচে, জমে থাকা সুখে
দেখেছ কি, মরা ডাল, তেষ্টায়, বসে থাকে ঝুঁকে, ইচ্ছের আঙুল বাড়ায়,
অনিমেষ, তোমারই মতন প্রায়
বছর গড়িয়ে যায়, অনিমেষ, তোমাদের পুরোনো পাড়ায়
রংখেলা শেষ হলে সকলেই কলঘরে ফেরে – দীর্ঘ স্নানের শেষে
ধুয়ে যায় গাঢ়তর ফাগ, অনিমেষ, তুমি তো নিজেও জানো, আদরের দাগ
কিভাবে মিলিয়ে যায়, পড়ে থাকে ভুলগুলো, শাস্তিযোগ্য সব ত্রুটি
তোমাকে বলার ছিল অনিমেষ, বছর ফুরিয়ে এল, তুমিও তো নিতে পার ছুটি”
আসলে অনেক কথাই বলার থেকে যায় প্রতি বছরই বাকি – পরের বছর বলব বলে তুলে রাখা হয়, অনিমেষ জানে সেটা – পাঠকের সাথে সাথে কবিও মনে করে নেন আরেকবার। এমন কবি-কবিতা-প্রতিপক্ষের খেলা চেনা, কিন্তু সুদীপ্ত লুকানোর প্রচেষ্টা করেন না সেই খেলা – বরং পাঠককে ছেড়ে দেন এমন সম্ভাবনায় যেখানে নিজের মত খেলা যাবে কোন প্রচলিত নিয়ম ছাড়াই
“ ধ্রুবর সাথে কথা হচ্ছিল, ধ্রুবজিতের সাথে
বন্ধ চটকলের গল্প থেকে হেঁটে হেঁটে
বিধান সরণির মোড়ে পৌঁছে, উত্তরে যাওয়া উচিত
না কি বছর বাইশ আগে, সেই নিয়ে প্রবল তর্ক তখন।
সিগারেটের আগুন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উশকে দেবার মতন
শীত রয়েছে শহরে। হাতিবাগান বাজারে
ফলের দোকানে কমলালেবুর তিন রকম দাম।
সব ক’টা গুড়ের মতন মিষ্টি আর ধ্রুবজিত
ওর ছ’ফুট টপকানো ভুরু কুঁচকিয়ে আকাশের শহর খুঁজছে।
আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছে
ট্রামের সেকেণ্ড ক্লাস বেঞ্চির মতন একটানা কথা হচ্ছে।
বন্ধুরা নেমে যাচ্ছে যে যার স্টপেজে।
ফাঁকা সীটগুলোতে থেবড়ে বসছে প্রেমিকা, অফিসকলিগ
কিছু উড়নচাকীর পাইলট।
ধ্রুব বলছে – সিনেমার শেষ দৃশ্যে
রাত্রি নেমে এল কীভাবে কোমলপ্রাণ
পরিচালকের জাম্প-কাট বিষয়ক দুর্বলতার কথা ধ্রুব জানে।
“আসলে বনেদীবাড়ি, বুঝলি তো...”, সন্ধের টানেলে
ঢুকে পড়ছে ট্রাম। আকাশী আর নীল ঘন ইউনিফর্মের
গোছা গোছা হাতে মুঠো করে ধরা আকাশের ঘরবাড়ি।
আর আমাদের প্রবল তর্কবিতর্কে বাইশ বছর
পিছনে ফিরবো না কি উত্তরের দিকে তাই নিয়ে
ধ্রুবর সাথে কথা হতে থাকে, ধ্রুবজিতের সাথে।“
স্মৃতি তো সর্বদাই সুখের নয় – শুধুই সুখের কথা শোনালে মনে হত হয়ত আরোপিত। কিন্তু এর বাইরে বেরিয়ে কবি দেখিয়ে দেন ধ্রুবর হাত ধরে বন্ধ হওয়া চট কলের গল্প - গোছা গোছা হাতে মুঠো করে ধরা আকাশের ঘরবাড়ি। কবি হয়ত বেদানার্ত হন, সে তো মুহুর্ত কথা – তাই ধ্রুব-র তরফে আরো অগণিত পাঠকের সাথে লিখে দেন
“সুন্দরের কথা আপনিই লিখুন, ছবিতে আঁকুন অনেকটা সবুজ
আদিগন্ত নীল, রক্তিম ভালবাসা, আপেলকে রাখুন পল্লবসর্বস্ব
নারীর বাঁহাতে, পুরুষের নজরে দিন সাতখানা দ্বীপ আর সপ্তসাগর
ওদের জাহাজে দিন রামধনু পাল, পায়রার ঠোঁটে দিন অলিভের পাতা
আমাকে রেহাই দিন, ছেড়ে দিন, একা
বাইরে বৃষ্টি এখন, ছাতা রাখা বন্ধ দ্বারে
আমি – এই দিব্যি আছি, ঘিচিমিচি অন্ধকারে
সুন্দর, সত্য ও শিব
লকলকে আধচেরা জিভ
অর্থ বুঝব না থাক, বুঝলেই দ্বন্দ্ব বাড়ে
এ জীবন ঝিম ধরাল, সূর্য চাইছি না তাও
জলে রোজ আঁক কষেছি, হারাল অঙ্ক খাতাও
অজ্ঞান এই তিমিরে
বার বার আসছি ফিরে
কেন যে কষ্ট করে বেয়াকুব আমায় মাতাও!
বাইরে বৃষ্টি হল, ভিতরে জলপ্রপাত – এমনটা আপনি লিখুন
আমি তো অন্ধকারেই অকাতর চোখ বুজেছি, খুঁজেছি অন্ধকারই
ঘিচিমিচি, মোচড়াদলা, জটপড়া মনের মতন, খড়িওঠা চামড়াতে আর
কাঁটাগাছ – এই যা আছে।
সুন্দর আপনি লিখুন... আমি এই অন্ধকারেই...”
কিন্তু সুদীপ্ত কবিতাকে কেন জানি না আমার কোন সমাজ চেতনার দলিল হিসাবে দেখতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় এই কবির কবিতার মূল সুর যেন এক জন্ম রোমান্টিক – রোমান্টিকতা আমাকে আচ্ছন্ন করে – আর সেই রোমান্সের শেষে কোন ভাবেই যে বিষাদ কিছু পরে থাকবে না এমন তো নয় – তবে এমন কবিতার সাথে মিশে গিয়ে তেমন বিষাদের ভার বইতেও রাজী হয়ে যাই। আমি মনে মনে চাইতে থাকি সুদীপ্ত আরো অনেক অনেক প্রেমের কবিতা লিখুক
“জানলায় কড়া নাড়ো, প্রেমের কবিতা লেখা হবে -
ডেকে আনো বরাভয়, ছেঁকে আনো সবুজ আকাশ
পায়রার দঙ্গলে ডেকে আনো শান্ত বিড়ালটিকে, আমি
প্রেমের কবিতা লিখে যেতে চাই এই অবেলায়।
শহরে জানিয়ে দাও – প্রতিটি তোরণদ্বার খোলা
দেওয়াললিখনে মোছো যুক্তাক্ষর যত আছে
সরল সহজ কথা, তাও যদি বলে যেতে পারি
এই হাতে কোন দিন প্রেমের কবিতা লেখা হবে।
জানলায় কড়া নাড়ো, ভেঙে দাও দুপুরের ঘুম
বিকেলের কান মুলে বলো ওকে, ‘আজ রবিবার’
আজ সেই গোধূলিটি গৈরিক বেশভূষা পরে
নহবতে রেখে দেবে একমুঠো আবছা প্রলাপ
প্রেমের কবিতা লেখা হবে – সব্বাই জানুক এবার
অন্য ভ্রূকুটি নয়, চুমু নয় ওষ্ঠে অধরে
হাত-ধরাধরি খেলা, শিহরণ ট্যাক্সির সীটে
ওসব পেরিয়ে গিয়ে, ডিঙিয়ে যাবত হুটোপাটি
শান্ত বিড়ালটিকে ডেকে দাও পায়রাসকাশে, আমি
প্রেমের কবিতা লিখে ফেলি আজ, এই অবেলায়।“
সুদীপ্ত শুধু আমার প্রিয় কবি ছিল এমন নয় – অমৃতারও বড় প্রিয় কবি ছিল সে। সামনা সামনি কোনদিন সে কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠে নি অমৃতার – নাহলে হয়ত আবৃত্তি করে শোনাতো আমাদের গল্প, এই এমন ভাবেঃ
“ভালোবাসা কে যেন খুঁজিছে দেখি শব্দের ঠুনকো আড়ালে
আমাকে প্রহর দাও, ঘোর দিয়ো কিছু, যদি রেখে থাকো
কোথাও গুছিয়ে। দু’চোখ মুছিয়ে দিয়ো। এর থেকে বেশি
চাওয়াগুলো প্যাস্টেল রঙে আঁকা বেলুনের দলে মিশে
ভিনদেশি আকাশের গায়ে নিষ্পাপ ভেসেছিলো। তুমি
দেখেছিলে কি ভাবে সবুজ রঙ প্রায় যেন নীলের কোমল
ছুঁয়ে আছে? তুমি দেখেছিলে আনাচেকানাচে কোত্থাও
সবিশেষ ভালোবাসাবাসি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই
ইতিউতি চাউনির মতো?
ভালো হতো, খুবই ভালো হতো যদি তুমি আর আমি
অথবা আমরা একই সাথে কাগজের ফুল তুলে ইকেবানা
শিখে ফেলি আজ। আরও ভালো হতো যদি আমাদের
সাথে আমি আর তুমি যাই ছবি আঁকা শেখবার স্কুলে
ঠিকানা খুঁজব বলে, পাহাড় আর বনস্থলীর।
সেই ভরসায় তবে গলা ছেড়ে বলি? বলি আমি অনেক ভেবেছি।
আসলে ভাবতে চেয়ে থেমে যাওয়া অনেক সহজ।
আসলে থামতে চেয়ে বেশ সোজা রাস্তা হারানো।
সব তুমি জানো। সোজা রাস্তার পাশে আসলে
জটিল হয়ে শুয়ে থাকে রাস্তার শাখা ও প্রশাখা।
কেউ বড় একা হয়ে থাকে… কিছু শব্দের মতো… ফাঁকা…”
আজো সময় পেলেই সুদীপ্তর কবিতা পড়ি – অনেক অনেক কিছু চর্চা করেও, তর্ক করেও দিনের শেষে সেই প্রেমের কাছেই ফিরতে ইচ্ছে করে। আর আমার কথাটিও কি অপূর্ব লিখে রেখেছিলেন অনেক আগেই – আমার এখনকার কথাটি – অনেক দিন আগেই প্রিয় কবি, না জেনেই -
“সকাল হলো তার – বেরঙ স্বপ্নরা এই তো কিছু আগে
ফিরেছে নিজেদের ভাঙা কুলুঙ্গিতে, এখন তার চোখে
রোদের কড়া নাড়া, শহুরে শোরগোল, মুখের তেতো ভাব
বিছানা এলোমেলো, খানিক পড়া বই উলটে শুয়ে আছে
মেঝেতে একলাটি
গত রাতের স্মৃতি সত্যি ছিল না কি? কেউ কি বসেছিল
জানলা ঘেঁষে তার? কেউ কি এসেছিল ফিরিয়ে দিতে চিঠি,
দগ্ধ ধূপ, এক নিহত বনসাই?
জানলা ঘেঁষে তার নরম সোফাসেট, পুরোনো পত্রিকা
ছড়িয়ে আছে আর সুরভি খুব চেনা, কানের লতিটিও
ঝুমকো দুলে রাত কত কি শেষ করে সকাল হলো আজ -
শহুরে শোরগোল, মুখের তেতোভাব, বিছানা এলোমেলো
বালিশ একলাটি...”
তোমার কলম এমন ভাবেই চলতে থাকুক কবি -
[ক্রমশঃ]
----------------------------------------------------------------------
মেসবা আলম অর্ঘ্য-র কবিতা
---------------------------------------------------------------------
অর্ঘ্যর সাথেও প্রথম আলাপ সেই মুক্তমঞ্চেই – তাও আজ নয় নয় করে প্রায় ১৬-১৭ বছর হয়ে গেল। অর্ঘ্য-ও বাংলাদেশের ছেলে, কিন্তু ওর সাথে যখন থেকে আলাপ তখন যতদূর মনে পড়ছে ও কানাডায় পড়াশুনা করছে, আর তারপর তো এখন চাকুরীর সূত্রেও তার কানাডারই বিভিন্ন শহরে বসবাস।
অর্ঘ্য-র প্রথম কবিতার বই ‘আমি কালরাতে কোথাও যাই নাই’ বের হয় ২০০৮ সালে ‘কৌরব প্রকাশনী’ থেকে। মনে আছে সেই বছর সে কলকাতা বইমেলাতেও এসেছিল, কিন্তু কোনদিন তার সাথে মুখোমুখি দেখা হয় নি – দুইজনে ভৌগলিক দুই প্রান্তে বসবাস করার জন্য। ২০১১ সালে বাংলাদেশের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় অর্ঘ্যের আরো দুই কবিতার বই, ‘তোমার বন্ধুরা বনে চলে গেছে’ আর ‘মেওয়াবনে গাণিতিক গাধা’ । তারপর ২০১৬ সালে প্রকশিত হয় তার সাম্প্রতিকতম কবিতার বই, “তোমার সাথে আক্ষরিক”।
মনে পড়ছে ২০০৯ সাল নাগাদ অর্ঘ্য-র সাথে মিলে একটা কবিতা প্রচেষ্টা করেছিলাম কৌরবের এক সংখ্যায় যার মূল কনসেপ্ট ছিল ‘যৌথকবিতা’। অর্ঘ্য তখন কানাডার অটোয়া শহরে, আমি আমষ্টারডামে আর অরিন্দমদা মুম্বাই-য়ে। আমরা তিনজন দিনের কোন এক বিশেষ্য সময়কে পৃথিবীরে তিনপ্রান্তে কেমন ভাবে দেখা যাচ্ছে সেটা লেখার চেষ্টা করেছিলাম, সেই প্রচেষ্টা নিয়ে বিস্তারে আগে লিখেছিঃ
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=13766
আগের পর্বে সুদীপ্ত-র কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম – যদিও কবিদের মধ্যে তুলনা একটা ফালতু কনসেপ্ট, আমার নিজের মতে কবিদের তুলনা হয় না। প্রত্যেক সার্থক কবির থাকে স্বতন্ত্রতা। একটা বিষয়ে রাদের বা সুদীপ্ত-র কবিতার সাথে অর্ঘ্যের কবিতার মিল আছে – সেটা হল এই তিন জনই নিজের চারপাশ থেকে নিয়েছে কবিতার বিষয় বস্তু বা অন্য ভাবে বলতে গেলে তাদের চারপাশ-কেই করে তুলেছে কবিতা। রাদ অষ্ট্রেলিয়া নিয়ে লিখেছে, সুদীপ্ত লিখেছে উত্তর কলকাতার গল্প আর অর্ঘ্য জড়িয়ে নিয়েছে তার কবিতায় কানাডার শহরকে।
সুদীপ্ত যেখানে শব্দের বিস্তারে মোহজাল, অন্য অনুভব সৃষ্টি করেছে – সেই তুলনায় দেখতে গেলে অর্ঘ্য-র কবিতা যেন ‘মিনিমালিষ্টিক’ – এত অল্প শব্দের ব্যবহারে এমন আবহাওয়া সৃষ্টি করতে আমি খুব কম সমকালীন কবিকেই দেখেছি। অর্ঘ্য নিপুণ দক্ষতায় পাঠক-কে হাত ধরে যেন ছেড়ে দিচ্ছে এক পাঁচ মাথার মোড়ে – এই দ্যাখো তুমি কবিতার সরণি বেয়ে এইখানে পৌঁছে গেছ, এবার এখান থেকে তুমি কি করতে চাও বা কোন দিকে আরো এক্সপ্লোর করতে চাও সেটা তোমার ব্যাপার। তোমাকে সেই সম্ভাবনার হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে -
“আমি আর কারো কাছে যাবো না।
প্যারামেডিকের গাড়ি, দুইটা থেমেছে আর
দমকল এসেছে
স্ট্রেচার, পুলিশ, সিঁড়ির গোড়ায় বৃদ্ধার চোখ
আমি আর কারো কাছে যাবো না। কখনো দেখাবো না
খুলে দেখালে
রাতের বেলা ঘুম আসে না;
সবার মুচকি হাসিতে এত বোকা হয়ে যাই
দাঁড়িয়ে থাকি শুধু
এর থেকে বিস্কুট কেনা ভাল। আর আমি তো রাগ করি না
একদম রাগ করি না
দালানের ছাদ থেকে নিচের রডগুলি দেখি
একটা ছুরি দেখি। রাগ করি না আসলে...
রডগুলি, ভাঙা বোতল
আর পুলিশ
কুকুরটা কেন উড়তেছে?
আমার পায়ের পাতা ঝরে ঝরে শুকিয়ে গেছে গলি
দাঁড়িয়ে থাকি তাও বোকার মতন
কোনো ঝামেলা নাই
মেঘের নিচে নিচে পুলিশের সজাগ চাহনি
ঘুম আসে না। খুলে দেখালে
শুধু একদম ঘুম আসে না কোনোদিন”
[কখনো দেখাবো না – ২০০৬]
এ যেন এক রহস্যও – কোন অচেনা শব্দের ব্যবহার নেই, এমনকি বিদেশী শহরের এক আপাত স্বাভাবিক দৃশ্য হিসাবেও এটা ভেবে নেওয়া যেতে পারে। “ আমি আর কারো কাছে যাবো না। কখনো দেখাবো না - খুলে দেখালে - রাতের বেলা ঘুম আসে না”। কি খুলে দেখালে, আর তার জন্য রাতের বেলা ঘুমই বা আসবে না কেন? এর আগের পঙতিতে দেখি, প্যারাডেমিকের, দমকলের উল্লেখ – তাহলে কি কোন আগুনে পোড়ার ঘটনা? বড় ধরণের আগুন নিশ্চয়ই নয়, কারণ সিঁড়িতে তখনো এক বৃদ্ধা বসে আছে। তাহলে কি রান্না ইত্যাদি করতে গিয়ে কেউ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত পুড়ে গেছে? পুড়ে যাওয়া শরীর বড়ই বিভৎস – তাই কি দেখতে না চাওয়া?
কিন্তু তাহলে ‘দেখাবো না’ ব্যাপারটা কি? আর তার পরেই বলা হচ্ছে ‘সবার মুচকি হাসি’ – এমন কি ভাবে হতে পারে যে প্রতিবেশীর দূর্ঘটনা, কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ মুচকি হাসছে! চকিতে ভাবনা খেলে যায়, তাহলে কি এ গল্প কি আদপে আকর্ষণের গল্প, যেখানে বাণিজ্য যুক্ত থাকে ক্ষণিকের মোহে? এখানে হাসি কি ব্যবহৃত হয় প্রতিযোগীতার অস্ত্র হিসাবে বা আহ্বানের? এইভাবে একটার পর একটা সূত্র ক্র্যাক করে কবিতার পঙতিমালা বরাবর এগিয়ে যাওয়া যায়।
“কবিতা টিউন তুমি মলিন দুপুর
ঘুরে গলি ঘুরে গলে পড়েছো নিপুণ
ভঙ্গিমা—
ক্ষণিক এই,
ক্ষণিক হয়েছে ভালো
মোড়ের মুদির মেয়ে
ইরানী ললনা
উড়ে যাও
পাখির মতো
উচ্ছ্বসিত এই
এতো, এতো একা
আমি
একা একা বর্ণভোলা চোখ
শব্দভোলা চোখ
সুদীর্ঘ পেতে রাখি তোমার উদ্দেশে!
দুঃখের রাতে আমার অশ্রু ঝরে
গরম করে আনা ফন্ড্যু চকোলেটে
চক্চকে উজ্জ্বল
হাতি হয়ে, ঘোড়া হয়ে
চকোলেটে ডুবে যেতে যেতে গুলি
মাথার খুলিতে চেপে ঘুমিয়ে পড়েছি কবে
দুঃখের রাতে!
চকোলেটে ডুবে যাওয়া আমার মলিন ব্যথা কবিতা টিউন
বা হাতে পালক নিয়ে
কোন্ সে পাখি সে যে
ঘুরে গলি ঘুরে থামো নিবিড় ভেঙে যাওয়া
একটা হাতুড়ি দেখি আমি
মুদির দোকানে
ডিপ ফ্রিজে
গভীর
গভীর শুয়ে থাকা”
[কবিতা টিউন – ২০০৬]
এ তো আমার কাছে প্রেমের গল্প – নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারি, ঠিক যেমন ভাবে আমি আমষ্টারডামের শনিবারের মার্কেটে রুটির দোকানে প্রতি সপ্তাহে দেখে ফেলতাম সেই ম্যানিকিওর নখ আর লাল অ্যাপ্রণ পরা কাউকে। এই কবিতায় মনে হয়ে ঢুকে পরে কোন এক ইমিগ্র্যান্ট পাড়ার গল্প – এক মুদির দোকান, ইরাণী মেয়ে এবং তার গভীর চোখ। ভেবে নিতে ভালো লাগে নিয়মিত দেখা এক ক্রেতার সাথে হয়ত বিনা কথার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজনের কেউই হয়ত প্রথম প্রথম সরাসরি কথা বলে উঠতে পারত না – কিন্তু ওই দোকানেই তো যাওয়া, আর তার উচ্ছসিত হয়ে ওঠা “শব্দভোলা চোখ - সুদীর্ঘ পেতে রাখি তোমার উদ্দেশে”। ডিপ ফ্রীজে, গভীর শুয়ে থাকার ব্যাখ্যা আমার নিজের মত করে নিয়ে ইচ্ছে করে – আমি ভাবি সেই জমাট বাঁধা বরফে শুয়ে থাকা মাছের স্থির বড় চোখের কথা – কেউ যেন পরখ করে যাচ্ছে অবিরাম, আপাত শীতলতা ঢেকে -
“ছয়তলার জানালা থেকে মাথা বার করে আছে একটা মেয়ে
মধ্যরাতে এক্স টেসি
সেকার জানতে চাইছে, সেকার ?
তুমি কি তেল আর জল দেখোনি
করিডোরের ছাদে
পার্কের উপর
আসলো কেমন মধ্যরাতে তুষার দেখোনি ?
মিশ খাচ্ছে আমাকে
মিশ খাচ্ছে তোমাকে
মিশ খাচ্ছে ছয়তলার জানালা
আমি তো সেই আততায়ী চাই - যে আমার পানিতে
মিশিয়ে দেবে মধ্যরাতের এক্স
বান্ধবির টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা
অর্থাৎ অপেক্ষা, হাসতে হাসতে লোল
নেমে আসছে আমাদের হাতে ধরা মাংসের উপর”
[মধ্যরাতে এক্সটেসি]
অর্ঘ্যর কবিতায় শব্দের অপ্রতুলতা নেই – কিন্তু ইচ্ছাকৃত কৃপণতা আছে। এ যেন সেই নিজের সাথেই চ্যালেঞ্জ, সীমিত শব্দেই যদি বলতে পারা যায়, তাহলে অযথা শব্দ খরচ কেন! আমি অনেক বারই জেনে শুনেই পুনরাবৃত্তি করেছি একটি বিষয়ের – তা হল ‘রিলেট’ করতে পারা কবিতার সাথে। প্রশ্ন এই নয় যে মধ্য রাতে তুষার না দেখলে এই কবিতার আনন্দ উপভোগ করা যাবে না – বা কবিতার ভিতরে ঢোকা যাবে না। কিন্তু সেই ভিতরে ঢুকতে চাওয়ার সময় যদি সাহায্য করে নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা, তাহলে কি আপনার মনে হয় না কবিতার ব্যখ্যা এক অন্যরূপ নিতে পারে? যতই হোক মানুষ যে কোন জিনিস ডি-কোড করে নিজের অর্জিত বা অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের মাধ্যমেই! যেমন এই কবিতা আমি নিজের সাথে মাখিয়ে নিতে পারি – এখানে এক্সটেসিকে দেখতে পারি বিনোদনকারী ড্রাগ হিসাবেও আবার সেই কল্পলোকের অনুভূতিকেও – সেই কল্পলোকের অনুভুতি-তেই কি ধরা দেয় এক্স বান্ধবী? টিকিট হাতে কি বাস্তবতা নাকি অবচেতন মনের কিছু চাওয়া ফিরে আসছে নিজের অজান্তেই? এই স্তবক আবার “মিশিয়ে দেবে মধ্যরাতের এক্স” এখানেই যতি দিলে দেখতে পাব সেই সম্ভাবনায় ‘এক্স’ অর্থে কোন অচেনা রূপ হতে পারে মধ্যরাতের – আর সেই সম্ভাবনায় আমি বান্ধবীর সাথে নিজের ছয়তলায় বাসাবাড়িতে ফিরতে পারি ধীর পায়ে – সিনেমার শেষে – আর মধ্যরাতের পরের মাংসের গল্প।
অর্ঘ্য আলাদা করে প্রেমের কবিতা লিখব বলে মনে হয় কিছু লেখে নি – আদপেই কি আলাদা করে প্রেমের কবিতা বলে কিছু হয়? হতে পারে – আবার নাও পারে – তার একটি কবিতা যার নাম পেয়েছি “তোমার প্রেমের কবিতা” –
“তোমার প্রেমের কবিতাটা জমাট বাঁধে যদি
কেমন চেহারা নেবে
সারি সারি ছাদের ওই সেফ্টি ট্যাঙ্কগুলি?
পাইপ্ কল বালতি মগ
কাপ পিরিচ ড্রেন কিরিচ
খাল নদী বিলবোর্ড
সিমেন্ট বালু মুক্তি যুক্তি রাইট-লেফট সামরিক নায়ক ও খল্
গণতন্ত্রের পিস্তল
কুরিল টু গুলিস্থান
পিকক নাকি শ্যালে
প্রেস কাগজ মলাট দোয়াত কালিমা
শ্মশানে জাগিছেন
অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে
ভূতেরগলি শাহবাগ নীলক্ষেত বাংলাবাজার
ডিস্ট্রিবিউশন সেলফ-প্রমোশন
রিক্রুট বিস্কুট মুনাফা লেফাফা ঝালমুড়ি টোস্ট
এবং সোহরাওয়ার্দী’র এগজিট-রুটের অন্ধকারে
জোনাকি’র মতো জ্বলতে থাকা একটা একশত ভাগ সবুজ জয়েন্ট—
সরকারি, সরকারবিরোধী, অটোক্র্যাটিক, ধর্মভিত্তিক, কিংবা সেক্যুলার
প্রমাণসাপেক্ষ মিথিকাল এথিকাল সাবঅল্টার্ন মরমী মর্ষকামী নারীবাদী
হত্যাবাদী কাপুরুষ ও আন্ডারগ্রাউন্ড—
সর্বপ্রকার সাবান-চিরুনি ব্যতিরেকে
তোমার নিতান্ত ফ্যালনা, সহজ
গোল গোল চোখের
প্রেমের কবিতাটা আজ
জমাট বাঁধে যদি?
আমরা একে অপরের স্বার্থপরতার সহাবস্থান মেনে নিতেও পারি তো!
সোহরাওয়ার্দী’র অবশিষ্ট প্রাচীন গাছগুলি
নতুন লাগানো সম্ভাবনাময় আর প্রচণ্ড ছায়াহীন
শিশু গাছগুলি’র সাথে নিজ নিজ স্বার্থপরতা
যেমন নিয়েছে মেনে চুপচাপ
ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি রাতে
অভিজিৎ খুন হওয়ার ঠিক পর পর
কী এক অজানা ভয়ে যেন কাঁপতে কাঁপতে মনে হলো...
তোমার প্রেমের কবিতাটা তুমি লিখো,
তারপরও”
এই কবিতায় কি প্রেমের গল্প আছে নাকি আছে রোমাণ্টিকতা? প্রচলিত অর্থে হয়ত নেই – তেমন ভাবে দেখতে গেলে এই কবিতায় ঢাকার তৎকালীন পরিপার্শ্ব জড়িয়ে আছে – অভিজিৎ রায় খুনের প্রসঙ্গ চলে এসেছে – কবিতা পড়তে গিয়ে মনে পরে যাচ্ছে বান্ধবীর/স্ত্রীর সাথে বইমেলা থেকে ফেরার পথেই খুন হয়েছিল – তাইতো বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না অজানা ভয়ের প্রসঙ্গ। কিন্তু আমি দেখছি এক শাশ্বত ভালোবাসার পরিস্ফুটন। অন্ধকারের উপরে উঠে যেন কবি আশ্বাস দিচ্ছেন এই সময় কেটে যাবে – আর এই কাপুরুষ আক্রমণ যদি চলতেও থাকে তাহলেও তা থামাতে পারবে না প্রেমের দানা বাঁধা – আর তাইতো “তোমার নিতান্ত ফ্যালনা, সহজ গোল গোল চোখের প্রেমের কবিতাটা আজ জমাট বাঁধে যদি?” এই পঙতি গুলিকে আমার প্রেমের ভাষ্য হিসাবেই পড়তে ইচ্ছে করে। যেখানে অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকা সহজ গোল গোল চোখ প্রেমের কবিতা লিখতেই থাকবে।
“আমরা খুব আলাদা আলাদা আর
ও আমায় পাহাড়ের গায়ে এক
লুকানো গোরস্থান দেখাতে এনেছে
পূর্ণিমা রাতে, পাহাড়ের, পাহাড়ের
গায়ে এত তারা!
দিগন্তে ঘুটঘুটে পানির আওয়াজ
বহু নিচে—
দেখা যায় না তাই
তাকিয়ে দেখছি এমন রূপালি
শাড়ি, শাড়ি
লুটাচ্ছে ওর
খরগোশের মতো চঞ্চল, অন্ধকার
স্বরের পেছনে
টিলার চামড়ায়
গোরস্থানের গায়ে বোনা
চাক্ চাক্ আদ্যন্ত ফলকগুলিতে
দিনের আলোর মতো!
আলাদা, আলাদা ও আমার দু’ আঙুল দূরে
পাহাড়ের গাভরা পূর্ণিমায়
লুকানো এক গোরস্থান
দেখাতে এনেছে”
[আলাদা – ২০১৯]
এই কবিতাটি আমি কোন চাতুর্য বা বাঘ-বন্দী খেলা হিসাবে নিচ্ছি না, এটাও আমার কাছে যেন আরো বেশী করে প্রেমেরই কবিতা – প্রেমিকের সাথে খরগোশের মত চঞ্চল, লখু পায়ের শাড়ি পরা প্রেমিকা রয়েছে যেন। এক পূর্ণিমা রাতে দুই জন হাঁটছে হয়ত কিছু শুরুর স্বপ্ন নিয়ে সেই গোরস্থানে যেখানে পোঁছালে ‘সম্ভাবনার’ স্থান খুব একটা থাকে না – পরে থাকে শুধুই নিখাদ বাস্তব আর অন্তিম সত্যি। তাহলে কি এই কবিতা কি নতুন কিছু সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে? অর্ঘ্যর কবিতায় উপমার ব্যবহার খুব নিয়মিত নয় – এখানে যেমন ব্যবহৃত হয়েছে “খরগোশের মতো চঞ্চল” – আর তাই বড় মানান সই হয়েছে শাড়ির গল্প, রূপালি শাড়ির গল্প যার ব্যাকড্রপে পাহাড়ের গায়ে তারা ফুটে আছে।
“আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা
প্রিয় আমার, বড় উতলা আজ বৃষ্টির পানি লাগে ঘরের কোণায়
আমাদের কাচের গুড়া মাখা তুলা
যত্নে ঘষে দাও যেখানে যেখানে আছে ঘা
তারপর শিথিল হয়ে যেও
শিথিল হবে বলেই তো ওড়নাটা টেনে টেনে রাখো
শিথিল হয়ে যাবে তার কাছে আমার ঘায়ে ডুবে থাকা কাচ
তুমি ভুলে যাবে”
[প্রাণের খেলা – ২০০৬]
ইচ্ছা করেই কবিতার কালক্রম অনুযায়ী লিখছি না এই লেখা - এই কবিতায় উঠে এসেছে উড়নার প্রসঙ্গ। মুদির দোকানের ইরাণী মেয়ের সাথে এই ভাবে জুড়ে যায় শাড়ি এবং উড়নার গল্প। “আমাদের কাচের গুড়া মাখা তুলা যত্নে ঘষে দাও যেখানে যেখানে আছে ঘা” – কাচের গুড়া মাখা তুলা বাক্যবন্ধ কিভাবে ভাঙবো বুঝতে পারি না – কিছু আগেই বৃষ্টির পানির কথা বলা হয়েছে, তাহলে কি বৃষ্টির পরে রোদ উঠেছে আর বিন্দু বিন্দু জলকণার বিচ্ছুরণ করে তুলেছে তাদের কাচের মতন – নাকি কাচের মত চকচক করে ওঠা মেকাপের কথা বলা হচ্ছে যা কিছু আগে তুলা দিয়ে লাগানো হয়েছে? নাকি পুরোটাই বিভ্রম? নিজের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখা অন্য কোন জানালার দূরাগত আলোতে কেউ শিথিল হয়ে যাচ্ছে চেনা অন্য কারো বুকে? কাচ যেমন ধারালো ভেবে কেটে দেয় অনেক সময় যা টের পাওয়া যায় বেশ কিছু পর – সেই কাচ কাটা ক্ষত তো শুধু তোমারই কি কবি? অন্য জানালার ওপাশে থাকা সে কি আজ অন্যজনা হয়ে উঠেছে?
এমন নয় যে অর্ঘ্যর কবিতায় শুধু কানাডার বা আরো অন্য বিদেশী শহর উঠে এসেছে – তার কবিতায় উঠে এসেছে নানা ভাবে ঢাকা শহরের কথাও – সে সব এসেছে স্মৃতি থেকে বা মাঝে মাঝে দেশে ঘুরতে এলে সেই অনেকদিন পরে ঘুরে দেখাও
“মুনির চৌধুরীদের সেন্ট্রালরোডের বাসায়
একটা জবাগাছ ছিল
আমি বায়লজি ব্যবহারিকের দিন
ফুল পাড়তে যেতাম
হাতিরপুলে আর কোন জবাগাছ চিনতাম না
মুনির চৌধুরীকে যেই বাসা থেকে জিপে তোলা হয়
সেই বাসার স্বাধীন জবাগাছ থেকে
ফুল তুলে আমি
পরীক্ষাগারে নিশ্চিহ্ন করতাম
পাপড়িগুলি চিরে
গর্ভপত্র আলাদা করে করে সাবধানে
ফুলটার সবচেয়ে তীব্র,
সবচেয়ে প্রেমের জায়গাগুলি খুলতে হতো
পরীক্ষার পর ওরা আর কোথাও থাকতো না
একটা স্বাধীন ব্লেডে
প্রচণ্ড উজ্জ্বল
প্রচণ্ড অর্থহীন কিছু রেণুর দাগ
লেগে লেগে থাকতো কেবল
এবং আমি পাসমার্কের হিসাব করতাম”
[চোদ্দই ডিসেম্বর]
এ তো স্পষ্ট স্কুলবেলার স্মৃতির দেখা, সেই যখন কবি হয়ত ক্লাশ টুয়েলভে বায়োলজির ক্লাসের প্র্যাক্টিক্যাল করত। এখানে জবা ফুলের কথা হয়েছে – জবার রঙ লাল। সেই লালের সাথে কি তা হলে মিশে গেছে কোনভাবে রক্তের লাল রঙ এবং তার অনুভূব? খুব সাবধানেই কবি আলদা করে খুলে নেওয়ার কথা বলেন সবচেয়ে প্রেমের জায়গাগুলি – পরীক্ষার পরে সেই খুলে নেওয়া পাপড়ির আর প্রয়োজন হত না, ব্লেডে লেগে থাকত কেব কিছু স্মৃতি, কিন্তু হয়ত বা বেদনা। এখানে মুনির চৌধুরী কি অন্য কোন প্রতীকি হয়ে ধরা দিয়েছে? তীব্র প্রেমের জায়গা কি এইখানে দেশের প্রতি ভালোবাসা? মুনির চৌধুরী কি তাহলে কোনসময় সেই জবা ফুলের মতই ব্যবহৃত হয়েছে কারো দ্বারা – প্রয়োজন শেষে যাকে ফেলে দেওয়াটাই দুরস্ত। মুনির চৌধুরীর ইতিহাস হয়ত এখন গুগুল করে আবার পড়ে নিতে পারি, কিন্তু আর ইচ্ছা করে না – বরং থাক না আমার কাছে এই কবিতার এমন পাঠটাই!
“আজিমপুর গোরস্থানে লাশ যাচ্ছে
গোলাপ জল জরি
নতুন তোলা কবরের মাটিতে পূর্বাপর
হাড্ডি দেখা যায়
দুধ ছাড়া চা খাওয়া যায় না - কষ্টা লাগে
ফুটপাথে নবজাতক
এখনো ওর কাঁধ ফোটেনি
ফুটপাথের পাশ দিয়ে লাশটি গোরস্থানে ঢুকে যাওয়ার পর
আমি চায়ে আরেকটু দুধ মিশাতে বললাম”
[আজিমপুর গোরস্থানে ১]
গোরস্থানের দেখাও কবিতা হয়ে এসেছে অর্ঘ্যর কবিতায় – আজিমপুরের। এই কবিতায় মিশে আছে শুরু আর শেষ – জীবনের দুই প্রান্তকে একই দেখে নেবার চোখ। এতে কি কবির জীবন এবং প্রাণের প্রতি ভালোবাসাই প্রকাশ পায় না? অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এবং মানুষের বেঁচে থাকার প্রবল অভ্যাসের আভাস সবই কি নিপুণ দক্ষতায় কবি বুনে দিয়েছেন এত অল্প শব্দে! মাটি খুঁড়ে উঠে অতীতের হাড় – সদ্যমৃত লাশ দেখাচ্ছে বর্তমানের ছবি, ফুটপাথে নবজাতক যার এখনো কাঁধ ফোটেনি তার আশ্বাস ভবিষ্যতের। কিন্তু এর মধ্যেও কবি খেয়ে প্রবল অভ্যাস বসে চা খাবার কথা ভোলেন নি বা চায়ের দুধ না দিলে খেতে ভালো না লাগার গল্প। মহানাগরিক জীবন কিভাবে আমাদের উদাসীন করে তোলে পারিপার্শিকের থেকে, তার উদাহরণেও রয়ে গেল চায়ে দুধ মেশানোর অনুরোধে।
আগে যেমন লিখেছি, তুলনমূলক কম কবিতাতেই অর্ঘ্যকে অনেক বাক্যব্যায় করতে দেখেছি – দীর্ঘকবিতাও তেমন পাই নি কবির কাছে। তবুও তারই মধ্যে –
“ছুটির দিন... আকাশে রঙিন দাগ কাটা ফাইটার প্লেন...
টিভিতে কুচকাওয়াজ ... সাঁজোয়া গার্ড অফ অনার...
নায়ক, সর্বাধিনায়ক...
ছুটির দিন...
আমাদের অনেক আর্মি তো! অনেক আর্মির গাড়ি আমাদের...
টিভি ভর্তি ট্যাঙ্ক... কত না সুন্দর ট্যাঙ্ক বাবা!...
দুই ইঞ্চির কাগজের পতাকা... পাটের দড়িতে ভাতের আঁঠা দিয়ে লাগানো সারি সারি... সর্বত্র... মাইকে গান... মাইকভরা গান... রাস্তা ভেসে যাচ্ছে গানে...
মোরা নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি
মোরা নতুন একটি গানের জন্য যুদ্ধ করি
মোরা একখানা ভাল ছবির জন্য যুদ্ধ করি
মোরা সারা বিশ্বের শান্তি বাঁচাতে আজকে লড়ি !
যে নারীর মধুপ্রেমেতে আমার রক্ত দোলে
যে শিশুর মায়াহাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে
যে গৃহকপোত সুখস্বর্গের দুয়ার খোলে !
সেই শান্তির শিবির বাঁচাতে শপথ করি ...
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি...
মোরা একটি মুখে হাসির জন্য অস্ত্র ধরি...
------ ওই "একটি ফুল"... "একটি মুখের হাসি"... ফাইটারের কাটা দাগগুলির ভিতর খুঁজতাম
ষোলই ডিসেম্বরের আকাশে...
মাইকে গান শুনতাম ... আর ওই "একটি ফুল"... "একটি মুখের হাসি কে" খুঁজতাম টিভি পর্দায়... কুচকাওয়াজের ভিতর... আর্মির ভিতর... ট্যাঙ্কের নলে... বাতাসে দুলতে থাকা পাতলা কাগজের পতাকায়...
খুঁজতে খুঁজতে গানের কথাগুলি শুনতাম আবার, আরো মনযোগ সহকারে... পরের বছর... তারপরের বছর...
এখন বহুদিন হয় টিভি দেখা হয় না! ষোলই ডিসেম্বর আসে যায়... আমি আর আর্মি দেখি না... ট্যাঙ্ক দেখি না... তবে গানগুলি শুনি... সেই পুরাতন মনযোগ সহকারে...
যে নারীর মধুপ্রেমেতে আমার রক্ত দোলে
যে শিশুর মায়াহাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে ...
আহ্! কী সুন্দর গান!”
যখন লিখেছে কবি এমন কবিতা – বেশী শব্দের, বেশী বাক্যের – সেই কবিতায় উঠে এসেছে ছোটবেলার স্মৃতি। চিত্রকল্প ইত্যাদি কিছু আঁকতে চাননি কবি – আমার মনে হয় কবি ফ্রীজ ফ্রেমে আটকে দিয়ে চেয়েছিলেন কোন বিশেষ স্মৃতি বা কোন ঘটনাকে। এই কবিতায় যেমন বলা হয়েছে ১৬ই ফেব্রুয়ারীর ঘটনা, যার গায়ে বাবার গন্ধ লেগে আছে। তবে এই কবিতাতেও লেগে আছে মানবতার প্রতি কবির অগাধ বিশ্বাসের কথা – ‘মানবতার প্রতি’ কথাটা গালভারি শোনালেও আদতে এ এক নতুন পৃথিবী দেখার বা গড়ে তোলার স্বপ্ন – যে পৃথিবীতে কোন বাচ্চাকে স্মৃতি হাঁটকে ট্যাঙ্ক, আর্মির কুচকাওয়াজ ইত্যাদির কথা মনে করতে হবে না – বরং সেই সব যুদ্ধ, ফাইটার মুছে গিয়ে স্মৃতিপটে লেগে থাকবে শুধুই সুন্দর সব গান – আগমণির গান - যে শিশুর মায়াহাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে।
“ হে মহান শেকল!
আমি খাবার প্লেট কিনলাম
পাপোষ আর তোয়ালে কিনলাম
আমি আমার নতুন ফ্ল্যাটে উঠছি না
আমি এখন ওদের গায়ে বরফ মাখাবো
ওই ফ্ল্যাটে যেন মাত্র কেউ মারা গেছে
চিহ্নগুলি যত্নে মুছে পরিষ্ককার করেছে ওরা
আমার নতুন বাসা একটা স্টুডিও
খুব ছোট – কিন্তু বিশাল বারান্দা
সামনেই নদী - শীতে জমে গেছে মোহনা
স্টুডিওতে কারো কিছু নেই”
নতুন গৃহ বসাবার কথা উঠে আসছে – গৃহ নাকি বাসা? গৃহ-কে যতটা শিকল বলে মনে হয়, একাকী থাকার বাসা-কেও কি ততটাই বন্ধন লাগে? অন্য কারো ছেড়ে যাওয়া ফ্ল্যাটে তো লেগে থাকেই কিছুটা শীতলতা, অন্তত বেশীর ভাগ সময়েই – তবে এখনি ফ্ল্যাটের অনুসঙ্গ কিনলেও সেখানে চট করে ওঠা হবে না। আগের বসবাসকারীর স্মৃতিচিহ্ন মুছে যাচ্ছে ক্রমে, মুছে দিচ্ছে ওরা। বরফ মাখানো অর্থে হয়ত কবি এখানে বলতে চেয়েছেন ফ্ল্যাটে সাদা রঙ করার কথা – সাদা বরফে কিছু লেগে থাকে শীতলতাও!
“নিজেকে লটকে না রাখা, না রূপকথা ভাবা
একটা সিগারেট পুনরায় ধরিয়ে ধরিয়ে পিস্তলের দরখাস্ত জমা দেবো
যত্নে লাগিয়ে দেবো ঠোঁটে ঠোঁটে
যেখানে যতটুকু লাম্পট্য প্রয়োজন
যতটুকু সততা
যে যার শিশি জমা দিচ্ছে
আলগা হয়ে আসছে বন্ধুর স্যুটে নখ বিঁধিয়ে সদ্য বিবাহিতার পেছনে দাঁড়ানো খয়েরি ঝর্ণা আমি
মদের বোতল লুকিয়ে রাখবো”
[বন্ধুর বিয়ে]
অর্ঘ্যর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে নিজের কথা, নিজের যাপন – আর তার ফাঁকে নিজেকে কাটা-ছেঁড়া করে দেখা। অর্ঘ্যর কবিতা তাই যদি লেখার কালক্রম অনুযায়ী পড়া হয়, তাহলে কবিকেও চেনা হয়ে যেতে পারে অনেকটা কাছের করে। কবি সততার সাথেই লাম্পট্যের প্রয়োজনীয়তার কথাই যেন তুলে ধরেছেন – না চাইলেও সামাজিক কারণে যার শুরু, সেই সম্পর্কের মধুর পরিণতির সম্ভাবনা কি একেবারেই সরিয়ে রাখা যায়?
“স্পষ্ট ভাবে মাওফুল ধরা গেলোনা
মাওফুল কোথায় ফুঁটেছে বোঝা গেলোনা, এইতো হালকা গিটারের ভিতর নেমে আসছিল
ভায়োলিনে নেমে আসছিল রাত বারটার শীতের রাতে
একজোড়া মধ্যবয়স্কার বার থেকে বেরিয়ে লিফট চাওয়া – রাস্তার উল্টাপাশের লোকটা জানালো
ওরা জনালো চিকন লোকটা থেকে দূরে থাকো
ধরা গেলো না কারণ
ধরা গেলোনার কারণ খুজতে চাওয়ার কারণে
না কি অন্য কিছু, স্পষ্ট করে ঢুকে যাচ্ছিল নানান মুখের নিচে ভারি নিশ্বাসে
যেখানে চোয়াল নাড়ালে বোঝা যায়
একজোড়া মধ্যবয়স্কা জানালো তাদের মেয়ে আটকা পড়েছে ২ মাইল দূরে
কেউ নাই । তাই মাওফুল কেউ কখনো দেখে নাই
সেটা ফোটে দূরে, পাহাড়ে, নদির ওইপারে বিশ বছরের মেয়েটির খোঁজে
পুলিশ এসে চলে গেছে
গুলির শব্দ ভুলে রেডিও রেডিও রেডিও পাহাড়ের অন্যপাশে
হলুদ আলো ভরা মধ্যরাতের রাস্তায় কফি পাওয়া যায়। ভাল কফি পাওয়া যায় না
ওদের গাড়িতে তুলে নেওয়ার। যেমন একটা মৌলিক চাওয়া স্পষ্ট ভাবে মাওফুল ধরতে চায়
সময় নিয়ে চিন্তা করে পরিনতি, পরিবর্তন – এইসব – অন্য জায়গায় রেখে এসে নিজের ভিতর দেখা
একটা লাটিম খুলে রাখছে অফুরন্ত পাক
একটা শিশুর কান্না। একজোড়া মধ্যবয়স্কা সেক্সসপের কাছে নেমে যায়”
[মাওফুল]
অর্ঘ্যর কবিতায় এইভাবেই নাগরিক জীবন ধরা পড়েছে ঘুরে ফিরে – আর এই কবিতাটি আমার বড় প্রিয় হয়ে আছে – কি অদ্ভূত ভাবে আমি নিজের দেখার সাথে মিলিয়ে নিতে পারি কবির চারিপাশ – মধ্যরাতের কফির দোকান, রাত বারোটার শীতের রাতে ভায়োলিন, সেক্স-শপের মধ্যে দিয়ে কিভাবে যেন মিশে যায় কানাডার কোন এক শহরের সাথে আমার প্রিয় শহর আমষ্টারডাম। আমার গল্পের সাথে আরো মিলে যায় তেমনি এক বছর কুড়ির মেয়ের গল্প – অর্ঘ্যের কবিতায় নদী আছে, আর আমার কবিতায় ছিল ক্যানাল। বাতাসহীন রাতে নদী আর ক্যানালের জলে আলোর প্রতিফলন যে প্রকারের!
“প্রশ্ন করতে করতে একটা ঘটনায়
আমি প্রশ্ন করবো বলে ঘটনা এড়াতে চাই
এড়ানো যায় না - আজকে যদি আমি হতাম
ওই যে , না পকেটে হাত দিয়ে অন্ধকারে
ওই যে অন্ধকারে একজোড়া শাদা জুতা
জ্বলছে আর নিভছে
একটা বিলীয়মান পিঠ
প্রশ্ন করতে করতে আমি অনেক কিছু ভুলে যেতে পারি
কুয়াশা কেমন -- হাত দিয়ে ধরা যায় ছয় তলা থেকে...
ছয় তলা মাখা রাত
ছয় তলা মাখা লাল আস্তিন আর
আসলে তো বৃষ্টি থেমেছে অনেক্ষণ আগে
এক ব্যাগ বরফ গলছে টেবিলের উপর
আস্তিকতায় আমি একটা ঘটনা ।
একটা বিলীয়মান পিঠের মধ্য দিকে সরে যেতে যেতে...
আর উপরতলায় ধপ ধপ শব্দ
নাকি শব্দ যাকে বলছি
আমি যাকে শব্দ বলছি
সে আমার গায়ে মাখিয়ে দিচ্ছে ছয় তলা
যুক্তি আর বিশ্বাসের মধ্যে একটা ব্যাগ
ভাসিয়ে নিচ্ছে সিঁড়ি, করিডোর, উপরতলার ভোতা
শব্দ হতে থাকে - মাথার ভিতর , না পকেটে
হাত ঢুকিয়ে অন্ধকারে অনেক্ষণ আগে
আমি ছয়তলায় এক খন্ড বরফ
হাতে ধরে দেখেছিলাম
খুব ঠান্ডা বাতাস আসছিল জানালা দিয়ে”
কবিতার কি শেষ হয়? নাকি কবির দেখার? প্রতিদিনের, প্রতিরাতের কানাডার নানা শহর এই ভাবে ধরা থাকবে অর্ঘ্য-র কবিতায়। আর থাকবে ঢাকার গলির গল্প, মাঝে মাঝে কয়েক সপ্তাহের জন্য বাঙলাদেশে ঘুরে যাবার গল্প – আজিমগঞ্জের গোরস্থানে নবজাতক আর মৃতর একই সাথে সহবাসের কথাও। আমার মজাহে মাঝে মনে হয় হয়তবা অর্ঘ্য-র কবিতায় কোথায় যেন একটু ‘ডার্ক’ ব্যাপার লুকিয়ে আছে? সত্যিই কি তাই? নাকি তা আমার নিজের অনুধাবন মাত্র? অর্ঘ্য-র কবিতায় কবির নিজেকে খুঁজে যাওয়া পাই, আর পাই বিশ্বাসের গল্প – আশ্বাসেরও
“মঙ্গল গ্রহ খুঁজছি আকাশে
কিন্তু সে নাই
তার বদলে আছে কমলা একটা দাগ
আর মেঘ,
মেঘ আর
বিভিন্ন অস্বাভাবিক কল্পনার
বোদলেয়ার
কাটাতে না পারা তোমাকে এসব নিয়ে
কিছুই বলতে না পারার উছিলায়
বন্যার কথা ভাবতে থাকি আমি--
মঙ্গলগ্রহ খুব কাছে আসলে তো জলোচ্ছ্বাস হবে
অনেক মানুষ মারা যাবে পৃথিবীতে
তাও যদি আসতো!
অভিব্যক্তি না
গুজব, ছন্দ ইত্যাদি না
আমি খুঁজছি নিতান্ত স্বাভাবিক একটা গ্রহ
ক্রমে থির হয়ে
পৃথিবীর
একটা বোতলের
পাশে
ক্রমে আর
তোমার প্রিয়
কবিতা লিখছি না বলে, যে
তুমি দেখতে ভালো তাই
কবিতার একটা মান তৈরি হয়ে যাবে
যে তুমি আকর্ষণীয় এবং
অপমানিত - পৃথিবীর এহেন
নানা ধর্মের মানুষের মদের বোতলে
খুব গভীর কিছু কথা
লেখা হয়ে যাবে
[মঙ্গল গ্রহ]
আরো অনেক কবিতা আসতে থাকুক অর্ঘ্য তোমার কলম থেকে।
[ক্রমশঃ]
একলহমা, ধীমান বাবু - আপনাদের ধন্যবাদ লেখা পড়ার জন্য।
অর্ঘ্য-র লেখা কবিতা যোগ করলাম আজকে।
ভালো লাগলো এখানে আপনাকে দেখে
আপনাকে অন্য সাইট থেকে চিনি
ভালো থাকবেন ।