(লেখাটি কিঞ্চিৎ পুরোন। মানে জানুয়ারির গোড়ায়)
১
জাতীয় নাগরিকপঞ্জী এবং তৎসংক্রান্ত অন্য আইনগুলোর বিরোধিতায় দেশজুড়ে যে বিক্ষোভ চলছে, তাতে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর নেমে আসা আক্রমণ নিয়ে সবচেয়ে বেশী আলোচনা হচ্ছে। তার মধ্যে , প্রথমটি হল জামিয়া ইসলামিয়ার ঘটনা। যেখানে, আপনারা জানেন , পুলিশ রাতের অন্ধকারে প্রায় পেশাদার গুন্ডার মত প্রথমে সি সি টি ভি ক্যামেরাগুলো ভেঙ্গে দেয় ,এবং সাথে সাথে আলোর উৎসগুলো ভেঙ্গে অন্ধকার করে দেয়। তারপরে, টিভি ও সংবাদপত্রে যে ছবিগুলো আমরা দেখেছি, তারা বাইরে এবং পাঠাগারে পাঠরত ছাত্র- ছাত্রীদের যথেচ্ছ পেটায় এবং একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক লাইব্রেরী তছনছ করে। উল্টে যাওয়া ভাঙা চেয়ার- টেবিল , আলমারির ভাঙা কাঁচের টুকরো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্র- ছাত্রীদের ব্যাকপ্যাক ব্যাগ এবং মেয়েদের ছেঁড়া দোপাট্টার চিত্র আমাদের ধারণা দেয় নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের ভিতরে অমিত শাহের পুলিশ ঠিক কি করেছে।
জামিয়া এবছর শতাব্দী- প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে এবং যে সময়ে তাঁদের প্রাক- শতবর্ষ উৎসব পালনের কথা সেই সময়ে তাঁদের অন্য সংকটের ভিতর দিয়ে চলতে হচ্ছে। ধারণা নেই, শুধু নামটি শুনে ( কে বলে যে নামে কি এসে যায়?) যাদের মনে হয়েছে যে এই বিশ্ববিদ্যালয় বোধহয় মাদ্রাসার একটি উন্নত রূপ বা একটি টিপিক্যাল “মুসলিম” বিশ্ববিদ্যালয় , তাঁদের জানাই যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গান্ধীজীর অনুপ্রেরণায় এবং প্রথম উপাচার্য ছিলেন হেকিম আজমল খান। “হেকিম” সাহেব নিজের পেশায় খুব জনপ্রিয় ছিলেন এবং হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে তার সেই জনপ্রিয়তা ছিল। ডাক্তারির পাশাপাশি তিনি ছিলেন স্বাধীনতা- সংগ্রামী এবং আজীবন কংগ্রেসের সদস্য। ১৯২৭ সালে তার আকস্মিক মৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অনাথ করে দেয় সাময়িকভাবে। ভারতের যেসব রাষ্ট্রপতি আমাদের মাথা উঁচু করে দেয়- তাঁদের অন্যতম ডঃ জাকির হুসেন এর পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস- চ্যান্সেলর ছিলেন দীর্ঘদিন। এদের চিন্তন জামিয়ার আত্মায় বসে আছে। সম্ভবত, আলিগড় ও জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিশেষ বিশেষ “মুস্লিম” নামের পঠন-কেন্দ্রে (শুধুই নামটুকু - আদতে উর্দুর পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষার চর্চা ও বিভাগও আছে এখানে) এই নগ্ন পুলিশী আক্রমণ পরিকল্পিত, এক শ্রেণীর মানুষের কাছে বার্তাবাহক এবং উদ্দ্যেশ্যবাহী। স্বশাসিত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের অনুমতি ছাড়া কি পুলিশের প্রবেশ বৈধ? এখন আর সেইসব প্রশ্নের কোন মানে নেই।
আক্রমণের সন্ধ্যেতে একটি ভিডিও খুবই ভাইরাল হয়েছে যেখানে আয়েশা রেনা নামে এক ছাত্রী ও তার আরো কিছু বন্ধু তাঁদের একজন ছাত্র- সহপাঠীকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা একেবারে খালি হাতে । নিরস্ত্র , অসহায়ের সামনে হাতের লাঠি বাতাসে ঘোরাতে বা পাথর ছুঁড়তে খুব একটা সাহস লাগে না, কিন্তু সেই নির্মম লাঠির সামনে শরীর ও হাত পেতে দেওয়ার জন্য লাগে অসম্ভব মানসিক জোর । একেবারে সত্যিকারের সত্যাগ্রহীর মত অকুতোভয়ের সেই ছবি দেখিয়েছে আয়েশা ও তার বান্ধবীরা । গান্ধীজী বেঁচে থাকলে আয়েশা রেনা-র জন্য নিশ্চয়ই গর্ববোধ করতেন। এমনিতেও, এই পুরো প্রতিবাদ- পক্ষ জুড়ে সবথেকে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন মুসলিম নারীসমাজ – যারা আলোকপ্রাপ্তা নারী হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে এতদিন খুব একটা পাত্তা পেতেন না। এই আন্দোলন আদতে ভারতের অনেক নতুন উজ্জ্বল বিন্দুকেও দেখাচ্ছে ।
কিন্তু , এসবের মধ্যেই আরো একটা প্রশ্ন উঠছে , অতীতেও পুলিশ ছাত্র সংঘর্ষ হয়েছে বহুবার। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ আমলে, স্বাধীনতার পরেও – বিশেষত জরুরী অবস্থার সময় প্রতিবাদে বহু ছাত্রের মাথা, হাত-পা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশ দিয়ে । কিন্তু পুলিস কখনো কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার তছনছ করেছি কি? নাহ, কখনো এমনটা শুনিনি অথবা পড়িনি। তার কারণ কি, স্বৈরাচারী ইন্দিরা বা ব্রিটিশ ভাইসরয়রা অন্তত বই- পত্তর পড়তেন? সেটাই কি কারণ ? আপনারা বলবেন।
২
এন আর সি এবং সি এ এ নিয়ে আসল ভয়টা অনেকের মনেই শুরু হয়েছে অসমের এন আর সি থেকে। বলা বাহুল্য, মোট সাড়ে তিন কোটি মানুষের মধ্যে যে ১৯ লক্ষ লোককে বিদেশী অনুপ্রবেশকারীর তালিকায় রাখা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ আবার হিন্দু (প্রায় ১২ লক্ষ) । ফলত, শাসক দল বিজেপি যে বেশ বেকায়দায় পড়েছে তা বলাই বাহুল্য। এখন দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপের পালা চলছে, ড্যামেজ কন্ট্রোলে আনা হয়েছে সি এ এ ( যা আবার অসম চুক্তির বিপরীতে অবস্থান করছে) । কিন্তু, কেমন করে ব্যাপারটা একটা বিজেপি শাসিত রাজ্যে ঘটেছে , তা কি লক্ষ্য করেছেন?
গুয়াহাটি হাইকোর্টে দেওয়া একটি সরকারী এফিডেবিটে “ ফরেনারস ট্রাইবুন্যালের” কার্যপদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। জানা যাচ্ছে, এই সংক্রান্ত বিষয়ে দুবছরের জন্য আংশিক সময়ের জন্য লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। এবং , তাঁদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ কোন নির্দিষ্ট ছিল না- বলা হয়েছিল, যত বেশী সংখ্যক “বিদেশী” তারা নথিভুক্ত করতে পারবেন, তত বেশী তারা পারিশ্রমিক পাবেন। এমনকি, প্রথম দফায় যাদের তালিকায় বিদেশীদের সংখ্যা কম ছিল , তাঁদের আর দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ করা হয়নি। এবার, আপনি যদি ঐ পদে কাজ করতেন , তাহলে আপনি ঠিক কি করতেন? কার উর্বর মাথা থেকে এই রকমের পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা মাথায় এসেছিল জানিনা- কিন্তু, সংখ্যা- গরিষ্ঠতার মুক্তোর মালা বানরের গলায় ঝোলালে যা ঘটবার ছিল- ঠিক তাই ঘটেছে।
এখন চাপে পড়ে প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা চাপে পড়ে অর্ধ- সত্য ও নির্জলা মিথ্যাও বলে যাচ্ছেন।যেমন সম্প্রতি একটি সভায় মোদীজী বলেছেন, (কোট) যো হিন্দুস্থান কি মিট্টি কা মুসলমান হ্যায়, জিনকি পুরখ-এ মা ভারতী কি সন্তান হ্যায়...... উন পর নাগরিকতা কানুন ঔর এন আর সি, দোনো কা কোই লেনাদেনা নেহি হ্যায়। কোই দেশ কে মুসলমানো কো না ডিটেনশন সেন্টার মে ভেজে যা রহা হ্যায় , না হিন্দুস্তান মে কোই ডিটেনশন সেন্টার হ্যায়। ইয়ে সফেদ ঝুট হ্যায়, ইয়ে না-পাক খেল হ্যায়...” (আনকোট) ইত্যাদি।
অথচ , বাস্তব হল আসামে ৬টি ডিটেনশন সেন্টার আছে দীর্ঘদিন ধরেই , যদিও সরকার জেলের ভিতরেই সেগুলিকে রেখেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত হিসেব, ১০৩৭ জনকে এই ছটি জেলখানায় রাখা হয়েছে। আলাদা করে, গুয়াহাটির কাছে গোয়ালপাড়াতে ৩ হাজার লোককে রাখার জন্য একটি বড় ডিটেনশন সেন্টার হচ্ছে ৪৬.৪১ কোটি টাকা ব্যয় করে, এবং যার জন্য গৃহ- মন্ত্রক থেকে আলাদা করে এর জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। তাহলে, যে কাজ মোদীজী ও তার মন্ত্রীসভা করেছেন , তাকে অস্বীকার কেন ? উনি কি ভুলে গেছেন নিজের মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত ?
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গত জানুয়ারী ১৮তে তিন সদস্যের একটি টিম পাঠান এদের অবস্থা জানতে (কমিশনের রিপোর্টের খসড়ার লিংক দিলাম, আগ্রহীদের জন্য , যারা বিস্তারিত জানতে চানঃ https://cjp.org.in/wp-content/uploads/2018/11/NHRC-Report-Assam-Detention-Centres-26-3-2018-1.pdf ) । এই রিপোর্টে যা বলা আছে তা মোটেই সুখপাঠ্য নয়। এদের অনেককেই কেন এখানে রাখা হয়েছে , তা তারা জানেনা। জেলের ভিতরেই যাদের জন্ম হয়েছে , সেই সব শিশুদের রেখে দেওয়া হয়েছে জেলখানাতেই। যেহেতু, রাষ্ট্র ডিটেনশন ক্যাম্প এবং জেলখানার তফাৎ করতে পারেনি, তাই এখানে যারা আছে- তারা কয়েদীর মত আছে ঠিকই , কিন্তু তাঁদের সাধারণ কয়েদীদের অধিকার নেই। যেমন, তাঁদের কাজ এবং তার বদলে মজুরী নেই, প্যারোলে সাময়িক মুক্তির নীতি নেই। গরীব মানুষের জন্য আইন –বেআইনী কাজের সীমারেখার ধূসর করিডোরে দাঁড়িয়ে , এদের নিজেদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ নেই – স্বামী- স্ত্রীকে আলাদা আলাদা ভাবে রাখা হয়েছে মাসের পর মাস । মহিলাদের ক্যাম্পে নারীদের নিরন্তর কান্নার অশ্রু বয়ে চলে নিশ্চুপভাবে। সারাদিনে কাজ বলতে সকালে প্রাতরাশ, দুপুরে ভোজন আর রাতের জন্য খাওয়া বিকেল ৪টের মধ্যে খেয়ে একেবারে সারা রাতের জন্য কুঠুরীতে প্রবেশ। আর তারপর, যন্ত্রণাদায়ক শূন্যতা। কারণ, এদের জন্য না আছে টিভি, না কোন সংবাদপত্র , না কোন পাঠাগার বা বইয়ের ব্যবস্থা। একথা স্বতন্ত্র, যে কমিশনের প্রধান, প্রাক্তন বিচারপতি ডাত্তু , অফিসিয়ালি এই রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করেননি। হয়ত, মানবাধিকারের মত একটা নোংরা বিষয় নিয়ে তিনি সরকারকে বিব্রত করতে চাননি।
এবার প্রশ্ন হল সি এ এ এবং এন আর সি-র এন্ড গেমটা ঠিক কি হবে? যদি ধরেও নিই যে সি এ এ-র পরে, হিন্দু/ খ্রীস্টান/ শিখ ইত্যাদিদের বাদ দিয়ে, সারা দেশের ২৫-৩০ লক্ষ মুসলিমকে মোদী সরকার “বিদেশী” ঘোষণা করল, তাঁদের নিয়ে সরকার এবার কি করবে? এত মানুষকে “পুশ- ব্যাক” করে বাংলাদেশ। পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে পাঠাতে পারবে না, সেদেশের সরকার এই বিশাল বোঝা কেন বইবে? আবার , যদি ধরে নিই “ডিটেনসন ক্যাম্প” নামক জেলখানায় অনন্তকাল ধরে এদের বন্দী বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে, এই আধুনিক বিশ্বে বিশ্ব মানবাধিকার ও রাষ্ট্রপুঞ্জের উষ্মা এড়িয়ে সেটা অনন্তকাল চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ( যদি ধরেও নিই, যে দেশের দুর্বল আইন- ব্যবস্থা এই কয়েদখানাকে মান্যতাও দিয়ে দেয়) ? মনে হয় না।
তাছাড়া, যারা পাকিস্তানের খ্রীস্টান নিয়ে এত চিন্তিত, তারা কি ভারতীয় ক্রিস্টানদের ভালো রেখেছেন? অন্য ধর্ম ছেড়ে দিন, তথাকথিত নীচু জাতের হিন্দুদের হিন্দীবলয় ও দক্ষিণ ভারতের একাংশে কি অবস্থা? ৭১-৭২এ বাংলাদেশের খান সেনার দ্বারা বিতাড়িত যে কোন নমশূদ্র হিন্দুদের জিজ্ঞেস করুন। জিজ্ঞেস করুন, বাম আমলে মরিচঝাপি গণহত্যা এড়িয়ে যারা পালাতে পেরেছিলেন সেই ওপার- বাঙলার মানুষদের? জিজ্ঞেস করুন,হিন্দীবলয়ে অনেক গ্রামে তথাকথিত নীচু জাতের কুয়ো কেন আলাদা , কেন অনেক মন্দিরে তাঁদের প্রবেশাধিকার নেই? আসলে, পাকিস্তানে যদি তারা হিন্দু বলে বিপদে পড়ে, ভারতে তাঁদের বিপদ কম কিছু নয়, যেহেতু তারা হিন্দু মুচি- মেথর- চামার বলে। এদের স্বাধীনতা আর সুরক্ষা কোন সি এ এ বা এন আর সি দেবে ?
৩
আপনারা যখন হায়দ্রাবাদে এনকাউন্টার কিলিং এবং এন আর সি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখনই পৃথিবীর মানচিত্রে যুক্ত হয়েছে একটি নতুন দেশ এবং সেই দেশের প্রধান ভারতবর্ষের লোক। ২০১০ সাল থেকে গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ধর্ষক-বাবা স্বামী নিত্যানন্দ ওরফে এ রাজাশেখরন, এদেশ ছেড়ে চুপচাপ পালিয়েছেন এবং অসমর্থিত সূত্র অনুযায়ী, ভারত থেকে নেপাল হয়ে তিনি পালিয়ে গেছেন, “ কৈলাশা” নামের দেশে।
এর আগে অন্য ধর্ষক- বাবা আশানন্দ বা সচ্চা ডেরা রাম রহিমের মত ধরা পড়ে জেল না খেটে, তিনি দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরের কাছ থেকে আস্ত একটা দ্বীপ নিয়ে সেখানে একটি দেশ স্থাপন করেছেন , যার নাম দিয়েছেন “কৈলাশা”। সে দেশের আলাদা একটি পতাকা আছে, আছে নিজস্ব সরকার ও জাতীয় সংগীত। নিজেদের হিন্দু- রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় দিয়ে সেই দেশের ওয়েবসাইট (https://kailaasa.org ) জানাচ্ছে এই দেশের উদ্দ্যেশ্য , “Kailaasa is a nation without borders created by dispossessed Hindus from around the world who lost the right to practice Hinduism authentically in their own countries.” এই বক্তব্যের সাথে আমদের দেশের সরকারের কারো কারো সাথে যদি আপনি মিল খুঁজে পান , তাহলে আমি অপারগ।
যারা নিত্যানন্দের অতীত জানেন না, তাদের জন্য সংক্ষেপে বলি আদতে তামিলনাড়ুতে জন্ম নেওয়া, ভন্ড এই বাবা কর্ণাটকের বিডাডিতে আশ্রম স্থাপন করেন। ২০১০ সালে “অমলা’ (নাম পরিবর্তিত) নামের একজন ভক্ত ও গৃহবধূ প্রথম তার বিরুদ্ধে ৬ মাস ধরে লাগাতর ধর্ষণের অভিযোগ আনেন। এর কিছুদিন পরেই আরেকজন প্রখ্যাত অভিনেত্রীর সাথে তার একটি ভিডিও, দক্ষিণের জনপ্রিয় চ্যানেল “সান টি ভি”- সহ অন্য চ্যানেলগুলোতে ( ভিডিওটি তার ড্রাইভার , গুরুজীর একাধিক মহিলার সাথে জড়িয়ে থাকা অনৈতিক জীবনযাপনে, তার ওপরে নাকি আস্থা হারিয়ে – ভিডিওটি রেকর্ড করেন) প্রচারিত হলে সারা দেশের লোক তার সম্বন্ধে জানতে পারে।
২০১০ সালের নভেম্বর মাসে পুলিশ রামানাগারা কোর্টে চার্জশীট পেশ করে। ধারা ৩৭৬ (ধর্ষণ), ৩৭৭ (অস্বাভাবিক যৌনতা), ৪২০ (ঠকানো), ২০১ ( প্রমাণ গায়েব এবং মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণ) ইত্যাদি বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ আনে পুলিশ। সেই চার্জশীটে এও জানা যায় যে রীতিমত চুক্তিপত্রে সই করিয়ে, “আত্মিক উন্নতি”-র নামে করা হত এই সব ন্যক্কারজনক কাজ। সেই চুক্তিপত্রের দশম পাতার একটি অনুচ্ছেদে বলা আছেঃ
"Volunteer understands that the Program may involve the learning and practice of ancient tantric secrets associated with male and female ecstasy, including the use of sexual energy for increased intimacy/spiritual connection, pleasure, harmony, and freedom. Volunteer understands that these activities could be physically and mentally challenging, and may involve nudity, access to visual images, graphic visual depictions, and descriptions of nudity and sexual activity, close physical proximity and intimacy, verbal and written descriptions and audio sounds of a sexually oriented, and erotic nature, etc."
বুঝতেই পারছেন কি অবস্থা!
যাই হোক, নানা টালাবাহানা করে, এই মামলার প্রগতি আটকে গেছে বারে বারে এবং নিত্যানন্দ সেটি ইচ্ছাকৃতভাবে চালিয়ে গেছেন। ২০১৪ সালে হঠাত একবার “স্বামীজী” নিজেকে নপুংসক ঘোষণা করেন এবং সুপ্রীম কোর্ট থেকে মামলার ‘স্টে” অর্ডার যোগাড় করে নেন। পরে, অবশ্য কোর্টের ডাক্তারী পরীক্ষায় এই দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কিন্তু ততদিনে, ৭ বছর কেটে গিয়েছে। ২০১৯-এ মাঝে মাঝে শুনানী চলছিল- এবং নিত্যানন্দের শাস্তির ব্যাপারটি ক্রমশই নিশ্চিত হচ্ছিল। কিন্তু এবার আর স্বাক্ষ্য-প্রমাণ নয়, খোদ অভিযুক্তই গায়েব হয়ে গেছেন।
এমনিতে, বিভিন্ন শক্তিশালী রাজনেতার সাথে তার সম্পর্ক আছে বা ছিল। আমাদের দেশে বিগত কয়েক দশক ধরে তো ধর্ম আর রাজনীতি স্বাভাবিক শয্যাসঙ্গী। স্বয়ং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী (অবশ্য, তিনি আরেক ধর্ষক- বাবা আশানন্দজীরও গুণগ্রাহী ছিলেন। এই ধরণের বাবাজীরা মোদীজীকে ঠিক কি ধরনের প্রেরণা দেয়, তা বড় জানতে ইচ্ছে করে), বর্তমান কর্ণাটক মুখ্যমন্ত্রী ইয়াদুরাপ্পা, কর্ণাটক বিরোধী দলের প্রমুখ নেতা কংগ্রসের ডি কে শিবকুমার – এইরকম অনেক শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে নিত্যানন্দ-এর সুসম্পর্ক ছিল। তাই, এরকম গুরুতর অভিযোগের বিচারাধীন ব্যক্তির, দেশের সুরক্ষা ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে হঠাত করে উধাও হয়ে যাওয়ার পিছনে, কোন ধরণের রাজনৈতিক মদত আছে কিনা , তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
সুতরাং, এই “ধর্মগুরু” যে বেশ তালেবর তা তো বুঝতেই পারছেন। যা নীরব মোদী বা বিজয় মাল্য পর্যন্ত ভাবতে পারেননি, নিত্যানন্দ তাই করে দেখিয়েছেন। ঠিক কত কোটি ডলারের বিনিময়ে বা অন্য কোন শর্তে, তিনি ইকুয়েডরের কাছ থেকে এই দ্বীপ-দেশটি কিনেছেন বা পেয়েছেন তা স্পষ্ট না হলেও, ওয়েবসাইটে “কৈলাশা”-র জনসংখ্যা বলা হয়েছে ১০ মিলিয়ন (সম্ভবত, সংখ্যাটি অনেক বাড়িয়ে বলা আছে) ! এত টাকার যোগান ও তার উৎস কিভাবে এল- তাও গবেষণার বস্তু হতে পারে।“খাবো না, খেতেও দেব না”- এই উক্তি তো এখন আমাদের কাছে সবথেকে বড় কৌতুকের বিষয়। স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, এই দেশের সরকারী ভাষা হিসেবে কিন্তু রাখা হয়েছেঃ সংস্কৃত, তামিল এবং ইংরেজি (হিন্দী তালিকায় নেই, খেয়াল করুন)।
“ কৈলাশা” অবশ্য একমাত্র এরকম দেশ নয়, এরকম Micro-nation আরো আছে পৃথিবীতে। যেমন , ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের ক্রিসচিয়ানা এরকম একটি দেশ। ১ হাজারের সামান্য বেশী এই দেশটি পর্যটকদের জন্য স্বর্গরাজ্য। সেরকম, উরুগুয়ের পারভা ডোমাস বা ধরুন সেলেসিয়া, লাভলি, আসগারডিয়া –এরকমই Micro-nation। এদের প্রায় সবারই পতাকা আছে, আছে তথাকথিত স্বশাসিত অঞ্চল। “ কৈলাশা”-রও পতাকা আছে, আছে নিজেদের পাসপোর্ট , যা আপনাকে “১১টি মাত্রা ( Dimension) এবং ১৪টি লোকে (দ্যুলোক, গোলক ইত্যাদি) ” নিয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতে, “কৈলাশা”-র নিজস্ব “ক্রিপটো- কারেন্সী” হবার কথা , যা তাঁদের অভ্যন্তরীণ আর্থিক মুদ্রা-র কাজ করবে। আর হ্যাঁ, এখন , “কৈলাশা”-তে বেশ কিছু আংশিক সময়ের এবং বেশ কিছু পূর্ণ সময়ের “সরকারী চাকরী” –র কর্ম খালির বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে ( মহিলারা নিজ দায়িত্বে আবেদন করবেন) ।
তাই যাই বলুন, সাধারণ ধর্ষকদের থেকে স্বামী নিত্যানন্দ কিন্তু অনেক বেশী “প্রতিভাবান”!