১
আধার, পাসপোর্ট বা ভোটার কার্ড কোনটাই নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ হিসেবে ধরা হবে না- ঘোষণা করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। আমাদের রাজ্যেও দুধে-সোনা বিজেপি সভাপতি, যিনি ২০২১-তে বিজেপি জিতলে, সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী, তিনিও তাই বলেছেন। আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে যে এই মাটিতে একটি নির্দিষ্ট দিনের আগে আপনি জন্মেছেন। অর্থাৎ, এদেশের জন্মপত্রী বা বার্থ- সার্টিফিকেট থাকলে প্রমাণিত হবে আপনার নাগরিকত্ব। অসমের এন আর সি-তেও একে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে- বিশেষত, ১৮ বছরের নীচে , যাদের ভোটার কার্ড নেই/ বোর্ডের দেওয়া স্কুল সার্টিফিকেটও নেই (৩০ শতাংশ নিরক্ষরের দেশে, মাধ্যমিক বোর্ডের সার্টিফিকেট চাওয়া অনেকের কাছেই খুব করুণ রসিকতা হয়ে যাবে, তাই না?) - তাঁদের ক্ষেত্রে বার্থ- সার্টিফিকেট নাগরিকত্ব এনে দিতে পারে।
তাই, এমন একটা রিপোর্ট খুঁজছিলাম যেখানে জানা যাবে, আমাদের দেশে কতজন শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে এই সার্টিফিকেট নিতে যান শিশুর জন্মের পরে? ইদানীং, বেসরকারি সূত্রের তথ্য ব্যবহার করা বেশ বিপজ্জনক, এই “ফেক” আর “পেড” মিডিয়ার বাজারে। ঠিক এইসময়েই, নেটে একটি সরকারী সমীক্ষা পেয়ে গেলাম ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সারভের সূত্রে । এদের শেষ প্রকাশিত সমীক্ষাটি যাকে “ NFHS-4” নাম দেওয়া হয়েছে ( উৎসাহীরা আরও বিস্তারে জানতে পড়ুন/ দেখুনঃ http://rchiips.org/NFHS/factsheet_NFHS-4.shtml ওয়েবসাইটটি) এব্যাপারে দৃষ্টিপাত করেছে ।
খুব সংক্ষেপে, দীর্ঘ সমীক্ষাটির সারমর্ম এইরকম। আইন অনুযায়ী, জন্ম ও মৃত্যুর ২১ দিনের মধ্যে তার পঞ্জীকরণ করাতে হয় নির্দিষ্ট অধিকারীদের কাছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত, মোট জন্মের ৮৪.৯ শতাংশ রেজিস্টার করা হয়েছে, অর্থাৎ, উল্টোদিকে, ১০০ শিশুর মধ্যে ঐ বছরে জন্ম নেওয়া ১৫ জনের বার্থ- সার্টিফিকেট নেই। এই পুরো শতকে (মানে, ১৭ বছরে), তা মাত্র দুবার ৮৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে এবং প্রথম দশকে, অর্থাৎ ২০১০ সাল অব্ধি তা গড়ে ৭৫ শতাংশ ছাড়ায়নি। সারা পৃথিবীর নিরিখে, এব্যাপারে শতাংশের হিসবে ভারত ৫ম স্থানে দাঁড়িয়ে, আমাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে শুধু কঙ্গো, ইথিওপিয়া , নাইজেরিয়া এবং পাকিস্তান। আবার, ২০০০,২০০১, ২০০২ ও ২০০৩ সালে এই শতাংশ ছিল যথাক্রমে ৫৬, ৫৮, ৫৯ ও ৫৭ শতাংশ, অর্থাৎ, যাদের বয়স আজ ১৬ থেকে ১৮-১৯ (অর্থাৎ, তাদের ভোটার লিস্টে নাম নেই ধরে নেওয়া যায়), তাঁদের প্রায় অর্ধেকের বার্থ- সার্টিফিকেট নেই। আর সেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিৎকার করে “কাগজ” চাইছেন। গত শতাব্দীতে , তাঁদের বাবা- মায়ের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবেই আরো কম।
এবার দেখুন সমীক্ষার ভিত্তিতে, কোন শিশুদের কাছে বার্থ- সার্টিফিকেট নেই? সমীক্ষা জানাচ্ছে, সবথেকে দরিদ্র অংশের শিশুদের মধ্যে মাত্র ৪০,৭ শতাংশের পঞ্জীকরণ হয়েছে, অর্থাৎ, বিপিএল অংশে থাকা শিশুদের ৫ জনের মধ্যে তিনজনের কাছেই বার্থ- সার্টিফিকেট নেই। সামগ্রিকভাবে তফসিলী জাতি ও উপজাতি শিশুদের মধ্যে যথাক্রমে মাত্র ৬০ শতাংশ ও ৫৬ শতাংশের কাছে এই সার্টিফিকেট আছে। কাজেই, অসমে হত-দরিদ্র মানুষেরা কেন “ডিটেনশন ক্যাম্পের” শুয়োরের খোঁয়াড়ে জমা পড়েছে, তা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না । সারা দেশে এন আর সি চালু হলে, আরো অনেক হত- দরিদ্র পরিবার বেশী বিপদে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক, এই সমীক্ষা থেকে।
কেন করান নি শিশুর জন্মের পঞ্জীকরণ? এর উত্তরে বাবা-মায়েরা কেউ বলেছেন, নিকটস্থ পঞ্জীকরণ কেন্দ্রে যাতায়াতের খরচ তারা জোটাতে পারেন নি, কেউ বলেছেন দু-তিন দিনের মজুরীর বিনিময়ে পঞ্জীকরণ কেন্দ্রে গিয়ে লাইন দিয়ে বসে থাকা সম্ভব হয়নি। তাই, এন আর সি, আদতে গরীবদের বিপক্ষে- একথায় কিন্তু আদৌ কোন অত্যুক্তি নেই। এদের একটা বড় অংশ, হয় সি এ এ-তে শরণার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করতে বাধ্য থাকবে (হিন্দু, শিখ ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীদের হলে) অথবা, মুসলিম হলে ঠাই পাবে “ডিটেনশন ক্যাম্পে”।
২
তবে, মানুষের জন্য না হলেও, এদেশে এখন গোরুদের পক্ষে বড় সুখের সময়। যারা ইদানীংকালে Bombay Panjrapole-র বিশাল গোশালাটি দর্শন করে কৃতার্থ হয়েছেন, তারা তো একবাক্যে একথা স্বীকার করবেন। যে মুম্বাই শহরে একজন ভালো মাইনের চাকুরীজীবীও শহরের আশপাশে একটি “ওয়ান বি- এইচ-কে” ফ্ল্যাটে মাথা গোঁজার আশ্রয় জোটাতে হিমশিম খান, সেখানে শহরের কেন্দ্রে ২-একর জমিতে এই বিশাল গোশালা আমার এই কথাকে নিশ্চয়ই সমর্থন করবে।
অথচ, ঐ ২ একর জমিতে , মোটামুটি ৩২০টা ৫০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট হয়ে যেত, হাজার দেড়েক মানুষ থাকতে পারতেন সেখানে। গত ১৮-১৯ অর্থ বর্ষে এই গোশালায়, গরুর খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয়েছে ৯ কোটি এগারো লাখ , এবছরের বাজেট অবশ্য আরো প্রায় ৪০ শতাংশ বেশী, সাড়ে বারো কোটির কিছু বেশী। ৭ টাকার সরকারী মিড-ডে মিলের খরচে, এই টাকায়, প্রায় ৪৯ হাজার অভুক্ত মানবশিশুর সারা বছরের একবেলার খাবার খরচ চলে যেত। যাক, গরু বলে কি মানুষ নয়?
কারা দিচ্ছে এইসব খরচ? অনেকেই জানেন, কোম্পানীগুলোর সামাজিক দায়িত্ব প্রকল্পে(Corporate Social responsibility) , যা ২০১৩ সালের কোম্পানী আইন অনুযায়ী, লাভজনক সংস্থার লভ্যাংশের একটি অংশ খরচ করা বাধ্যতামূলক। জানলে অবাক হবেন, “গো-সেবা”কে সামাজিক দায়িত্বের অংশ মেনে, বেশ কিছু কোম্পানি এই গোশালার খরচ চালাচ্ছে। গো-সেবা কর্পোরেটের কাছেও “সামাজিক দায়িত্ব” হয় নাকি? আপনার ভুরু কুঁচকোতে পারে, কিন্তু, আইন পালটে, ২০২০-র নিরিখে, ভারতবর্ষে এটাই সত্য। এমনকি এমন সব সংস্থা যাদের সাথে দূর- দূর পর্যন্ত গরুর সাথে কোন লেনদেন নেই , যেমন “ফেবিকল” প্রস্তুতকারক পিডিলাইট ইন্ড্রাস্টিজ, তাঁরাও এই গো-শালার রক্ষণাবেক্ষণে ও গো-সেবায়, এখনো পর্যন্ত ৯ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা সামাজিক দায়িত্ব প্রকল্পে খরচ হিসেবে দান করেছে। এমন উদাহরণ আরো অনেক আছে।
তাই, মানুষ ভুলে যান, আসুন , গো-মাতাকে নমন করুন।
৩
অন্ধ্রপ্রদেশে যখন একটি ধর্ষণ ও পুড়িয়ে মারার ঘটনার অভিযুক্তরা, দু দিন পরে ভোর রাতে পুলিশের গুলিতে মারা গেল, তখন সভ্য সমাজ স্পষ্টতই দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সংখ্যালঘু একদল, এই বিচার- বহির্ভূত খুনের জন্য আইনের শাসনের ফাঁস আলগা হয়ে যাওয়ায় আশংকা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, বেশীর ভাগ লোক এই তাৎক্ষণিক বিচারে সন্তুষ্ট হয়ে আনন্দ-প্রকাশ করেন। অভিনেতা ঋষি কাপুর পুলিশ- বিভাগকে অভিনন্দন জানান, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় সাইনা নেহওয়াল স্যালুট জানান ওঁদের, জয়া বচ্চন গণপিটুনিতে অভিযুক্তদের হত্যা করার পরামর্শ দেন। তবে দুপক্ষই, এই গুলি যে পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে চালিয়েছে- সে বিষয়ে একমত।
কিন্তু, এত এত লোক কেন দেশের বিচার ব্যবস্থায় আস্থা হারাচ্ছে? অপরাধী প্রমাণ করার জন্য, যে সময়, যুক্তির কষ্টি পাথরে ফেলে বিচারব্যবস্থার যে ইতিহাস - তার ওপর এত অনাস্থা কেন? গত নভেম্বর মাসে প্রকাশিত “ইন্ডিয়া জাস্টিস রিপোর্ট ২০১৯”-এ ওকবার চোখ বোলালেই আপনি এর কারণ বুঝতে পারবেন। কতগুলো শুকনো তথ্য প্রথমে দেওয়া যাক। নীচু-তলার কোর্টে ( Sub- ordinate Court) গোটা দেশে ২ কোটি ৮০ লক্ষ কেস অসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে- যার মধ্যে ৬৭ লক্ষ মামলা পড়ে আছে ৫ বছরের ওপর আর ২৩ লক্ষ মামলা ১০ বছরেরও বেশী। এই নিরিখে, সবচেয়ে খারাপ রাজ্য উত্তরপ্রদেশে , যেখানে ৯০ ভাগের বেশী মামলা ৫ বছরেরও বেশী পুরোন।
কেন মামলা এগোয় না? তার একটি প্রধান কারণ, পুলিশ প্রশাসনে এবং বিচারক আসনে পর্যাপ্ত লোক না থাকা। পুলিসবাহিনীতে খালি পদের সংখ্যা সবথেকে কম মহারাষ্ট্রে (৮.২ শতাংশ) এবং সবথেকে বেশী উত্তরপ্রদেশে ( প্রায় ৬৩ শতাংশ!)। তার চেয়েও, হতাশার কথা, এই অপ্রতুল পুলিশ-বাহিনী মন্ত্রী- সান্ত্রীদের নিরাপত্তা দিতেই ব্যস্ত থাকেন। ১৪৮৪২ জন ভি আই পি-কে সুরক্ষা দিতে ৪৭৫০০ পুলিশ অফিসাদের ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ একজন ভি আই পি পিছু গড়ে ৩ জনেরও বেশী । অন্যদিকে, সাধারণ মানুষদের জন্য, শহরাঞ্চলে প্রত্যক থানা পিছু গড়ে ৩৩ হাজার (ওড়িশা) লোককে থেকে ২ লক্ষ ৪০ হাজার (গুজরাট) লোককে সুরক্ষা দিতে হয় – বলা বাহুল্য, সুরক্ষার ব্যবস্থাটি ভীষণভাবে কম, প্রায় না থাকার মতোই। গ্রামাঞ্চলে এই সংখ্যা আরো বেশী। অন্যদিকে, বিচারকদের মধ্যে খালি পদের সংখ্যা মোট পদের বিভিন্ন রাজ্যে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ!
তাই, ঐ “তারিখ পে তারিখ”-এর প্রথার কোন পরিবর্তন হয় না। লোকের অভাবে পুলিশের কেস সাজাতে দেরী হয়ে যায়। দিল্লীর নির্ভয়ার কেসের মত, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে হাই প্রোফাইল কেসের বিচার এবং দৈনিক শুনানীর পরেও, শুনানী থেকে সাজা কার্যকর হতে প্রায় ৮ বছর লেগে যায়। অন্য সাধারণ কেসগুলোর কথা না বলাই ভাল। এর ওপর আছে কথায় কথায় উকিল বাবুদের আন্দোলন, আদালতের শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন দীর্ঘ ছুটিসহ আরো নানা দীর্ঘসূত্রিতা। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের বিচারব্যবস্থায় আস্থা হারানো স্বাভাবিক, যদিও গণতন্ত্রের পক্ষে তা শুভ নয়।
এর ওপরে যুক্ত হয়েছে, বিচারকদের একাংশের ভূমিকা, বিশেষত, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-র সময়ে যা কিছু ঘটতে শুরু করেছে , তাতে এটি একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। যারা হায়দ্রাবাদের ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়েছেন,সেই পাঠকদের মনে করিয়ে দিই, আমাদের প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধেও কিন্তু সুপ্রীম কোর্টে কর্মরত একজন মহিলা কর্মী, যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন। সুপ্রীম কোর্টেরই “বিশাখা প্যানেলের” নির্দেশ না মেনে, তিনজন পুরুষ বিচারকদের অভ্যন্তরীণ প্যানেল তৈরী করে, তদন্ত শুরু করেন। সেখানে অভিযুক্তের বক্তব্য শোনা হয়নি বলে অভিযোগ। অন্যদিকে, ঐ ভদ্রমহিলার স্বামী ও দেবর, যারা পুলিশে চাকরী করতেন, তারা হঠাত করে, এই ঘটনার পরে সাসপেন্ড হয়ে যান, খুবই সামান্য কারণে এবং একটি পুরোন অভিযোগের ভিত্তিতে । এমনকি, যৌন হেনস্থার ঐ তদন্ত কমিটির সামনে, কোন আইনজীবীর সহায়তা দিতেও কমিটির বিচারপতিরা অস্বীকার করেন। যথেষ্ট চাপ তৈরী করে এবং অভিযুক্তের বক্তব্য না শুনেই, কমিটি সিদ্ধান্তে আসেন- যে প্রধান বিচারপতি নির্দোষ। অভিযুক্ত চুপচাপ এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলে, উনার স্বামী আর দেবরকে পুলিশের চাকরীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
আখিল কুরেশীকে মনে আছে? গুজরাটের এই বিচারপতিকে মধ্যপ্রদেশের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত করেও কেন্দ্রের আপত্তিতে তা রদ করে দেওয়া হয় এবং পাঠিয়ে দেওয়া হয় অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ ত্রিপুরা হাইকোর্টে। কুরেশীর অপরাধ সম্ভবত এই ছিল, যে তিনি গুজরাটের তৎকালীন গৃহ- মন্ত্রী (যিনি এখন দেশের গৃহমন্ত্রী) শ্রী অমিত শাহকে সোহারবুদ্দিন কেসে ২ দিনের জন্য জেলে পাঠিয়েছিলেন। খুব অদ্ভুতভাবে, মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট অমিত শাহের ইচ্ছের কাছে মাথা নত করে এবং কলেজিয়ামের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে জাস্টিস কুরেশী-র মধ্যপ্রদেশে নিযুক্তি রদ করে দেয়। গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তম্ভ, প্রথম ও দ্বিতীয়-এর সাথে হাত মেলাচ্ছে- এ এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি, অনভিপ্রেতও বটে। সাম্প্রতিককালে, এমন উদাহরণ আরো আছে।
এন আর সি বিষয়েও কোর্টের ভূমিকা খুবই বিস্ময়কর ও ব্যতিক্রমী। দেখুন, অসম চুক্তির হাত ধরে যে নাগরিক আইনের পরিবর্তন এবং নাগরিকদের জাতীয় পঞ্জীকরণ করার কথা অসমে ছিল, তা একটি সরকারী সিদ্ধান্ত এবং প্রশাসনিক আমলাদের কাজ হল সেই সিদ্ধান্তকে কাজে রূপ দেবার। এতে গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তম্ভের কোন ভূমিকা থাকার কথা নয়। অথচ, জে নারিম্যানের সাথে বসে, আমাদের এই প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, এন আর সি-তে সরাসরি নজরদারির আদেশ দিলেন।
এন আর সি কোন সাধারণ সরকারী প্রক্রিয়া নয়। এখানে একজন মানুষ দেশের নাগরিক থাকবেন কিনা তাই নিয়ে প্রশ্ন, নিজের পায়ের তলার মাটিতে আপনার অধিকার আছে কি না- তার পরীক্ষা । এখানে, সংবিধানের দেওয়া নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকছে কিনা তা নিয়ে লড়াই হবে এবং আপনি যদি প্রশাসনিক বা সরকারী সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না থাকেন, তাহলে আপনি কোর্টের দ্বারস্থ হবেন, সংবিধানের ১৪ ও ১৫ নং ধারাকে আশ্রয় করে আদালতের হস্তক্ষেপ চাইবেন- এটাই সংবিধানের ও আইনের দেখানো পথ। কিন্তু, সেই প্রক্রিয়া যদি কোর্টের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে? কোর্ট-এর নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোর্টে যাবেন? এন আর সি কো- অরডিনারেটরের সাথে সুপ্রীম কোর্টের বন্ধ দরজার পিছনে এর “ Modalities” বা কারয পদ্ধতি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হয়েছে এবং তারপরে, কোর্ট অতি- সক্রিয় হয়ে, এমন একটি তারিখের মধ্যে এই তালিকা চূড়ান্ত করতে বলেছে- যে তারিখের মধ্যে লক্ষ্যপূরণ দুরুহ ছিল। এমনকি, সরকার ও তার আমলারা যখন অসমের তালিকা চূড়ান্ত করার জন্য আরো কিছু সময়ের জন্য আবেদন করেছে, কোর্ট থেকে তাও নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। এত হুড়োহুড়ি!! বলতে চাইছি, যে সংবিধানের সাবেক গঠনকে পালটে দিয়ে উচ্চ আদালতের এই প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তম্ভের মত কাজ করা- নিঃসন্দেহে আর একটি ব্যতিক্রমী ও বিপজ্জনক উদাহরণ।
সুপ্রীম কোর্ট আরেকটি বিতর্কিত পদ্ধতি যেটি আমদানি করেছে, সেটি হল “বন্ধ খামের” কারসাজি। মুক্ত বিচারব্যবস্থা, যা স্বাধীনতার পরে ভারতীয়রা দেখতে অভ্যস্ত এবং যেখানে সওয়াল –জবাব হবে সবার সামনে – সেই স্বচ্ছ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে , গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে সবকিছুকে “বন্ধ খামে” বন্দী করার একটা প্রবণতা- মানুষের বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা নড়িয়ে দিতে পারে। সাক্ষ্যপ্রমাণ , যার ভিত্তিতে বিচারকেরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, সেটাই যদি বন্ধ খামে গোপন রাখা হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে রায় পুনর্বিবেচনা বা রিভিউ পিটিশন করা মুশকিল হয়ে পড়ে- কারণ, তা অন্ধকারে তীর মারার মত অনিশ্চিত। ২০১৩-র আই পি এল ঘটনায় আমরা বন্ধ খামের ব্যবহার দেখেছি, দেখেছি এন আর সি কেসে, দেখেছি রাফেল বিতর্কে, দেখেছি সি বি আই কর্তা অলোক ভারমার কেসে। এমনকি নির্বাচনী বন্ডের ব্যাপারে যে মামলা, তাতেও এই বন্ধ খামের প্রয়োগ দেখেছি। যুদ্ধ পরিকল্পনার মত কয়েকটি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া, বিচারকদের সাক্ষ্য প্রমাণ বন্ধ খামে রেখে দেওয়াকে একধরণের স্বৈরাচার বলা চলে। আর, কোর্ট যদি ভাবেই বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় ও এতখানি রাষ্ট্র সুরক্ষার সাথে যুক্ত, তাহলে, কোর্ট তার শুনানী শুনতে অস্বীকার করতে পারে।কিন্তু, তা না হলে গণতন্ত্র এভাবে চলে না- সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নে্তৃত্বাধীন সুপ্রীম কোর্ট যা করেছে। এবং এখন এই সব অবাঞ্ছিত উদাহরণ নীচের কোরটেও প্রভাব ফেলতে আরম্ভ করেছে। দিল্লী হাইকোর্ট বিগত কয়েকমাসে একাধিকবার “বন্ধ খামের” প্রয়োগ করেছেন।
তাই , সাধারণ মানুষের কোর্টকে এড়িয়ে যাওয়ার বা বিচার-ব্যবস্থার সমন্ধে নেতিবাচক চিন্তা- ভাবনার পক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে- যদিও, তা দুঃখের এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে খুব ভালো বিজ্ঞাপণ নয়।