এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • এক যে ছিল ট্রাম / পর্ব ৩

    Tirtho Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯৭ বার পঠিত
  • | | |
    || গরম সিঙ্গারা আর ভোরের ট্রামের গল্প  ||

    তখন সবে স্কুলে সাদা হাফপ্যান্ট ছেড়ে খাঁকি হাফপ্যান্ট পড়া শুরু করেছি | ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি বেহালা বাজারের উল্টো দিকে সারি-সারি হকার ভরা ফুটপাথের ভীড় আর শব্দ-ব্রহ্ম ঠেলে ট্রাম গুলো ট্রাম-ডিপোতে ঢুকে যেত | মহেন্দ্র-দার স্কুল বাসের শেষ স্টপ-ও ছিল বেহালা ট্রামডিপো যেখান থেকে ট্রাম গুলো বেড়িয়ে আসে, সেটা পেরিয়ে ভারত ব্রান্ডের জুতোর দোকানের সামনে | এইরকম একটা সময় শুনলাম বেহালা থেকে জোকা ট্রাম চলবে | খিদিরপুর থেকে জোকা যাবে ২৯ নম্বর ট্রাম | বিবাদীবাগ থেকে আসবে ৩৭ নম্বর ট্রাম | আরো পরে বালিগঞ্জ থেকে জোকা যাবে ২৪/৩৭ ট্রাম | 

    আমার পাশের বাড়িতে থাকতো বাপ্পা | আমাদের স্কুলেই পড়তো |  ওর বাবা বললো - চল নতুন ট্রামে চড়ে ঘুরে আসি জোকা | আমাদের আনন্দ দেখে কে ! এক রবিবারের সকাল | গরম তখন ও  পড়েনি তেমন | ওর বাবার সাথে আমরা সব মিলিয়ে চার জনের একটা দল, ট্রাম-ডিপোতে গিয়ে জোকার ট্রামে চড়ে বসলাম | প্রথম শ্রেণী | বাঁ-দিকে যে সিঙ্গেল সিট্ গুলো থাকতো, তাতেই চেপে বসলাম | ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে মিনিট কুড়ির মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জোকা ট্রাম - ডিপো | 

    ছোটো অস্থায়ী ডিপো-অফিস ছিল, বেহালার মতো অত বড় না | তা হোক | জোকা তখন ও বৃহত্তর কলকাতার অন্তর্ভুক্ত হয়নি | চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি | আমরা একটু চারপাশ ঘুরলাম-ফিরলাম | তারপর ট্রামডিপোর পাশে একটা দোকানে গরম-গরম ধোঁয়া ওঠা সিঙ্গারা দিয়ে প্রাতরাশ করলাম | একটু পরে আবার একটা ট্রাম ধরে ফিরে এলাম | এবার আর বেহালা ট্রাম-ডিপো পর্যন্ত না, তার বেশ কিছু আগেই বেহালা ব্লাইন্ড স্কুল স্টপে নেমে গেলাম | ওখান থেকে আমাদের বাড়ি ফেরা সহজ হয় | 

    সেই প্রথম জীবনে অমন শুধুমাত্র ট্রামে চাপার জন্যে চাপা | হৈহৈ করতে করতে যাওয়া আর আসা |  আমাদের সারাজীবনের অজস্র মুহূর্তের মধ্যে শুধু কয়েকটি মনে থেকে যায় | সেইসব মুহূর্ত গুলো সবগুলোই যে খুব স্মরণীয়, জীবন ওলোট-পালট করে দেয়া মুহূর্ত হবে তা নয়, অতি সাধারণ, আটপৌরে কিছু সময়ের টুকরো ও আটকে থাকে স্মৃতির ঝাঁপিতে  | এটাও তেমন কিছু ছিল বোধয় |

    || ২৭ নম্বর ট্রাম ||

    " আরে আজকে স্নান করে আয়নার সামনে টাইগার ব্যালেন্স করতে গিয়ে উল্টে পরে গেছি | টেবিলে এক লাথি | বাড়ির লোকজন ছুটে এসেছে কি হলো কি হলো বলে |" " আর আমি খাটের উপর শুয়ে করতে গিয়ে ঘাড়ে লেগেছে |" হা হা হা হা | বক্তারা হলো পার্থ দা, দিব্যেন্দু দা, সৌম্য দা | আমাদের থেকে তিন বছরের সিনিয়র | পরের বার মাধ্যমিক | পিটি ক্লাসে দীপক বাবুর কঠোর নির্দেশ | তাই বাড়িতে প্র্যাকটিস করতে গিয়েই বিপত্তি | 

    ২৭ নম্বর ট্রামে করে বেহালা থেকে হাজরা স্কুলে যাবার পথে এই কথোপকথন | মুগ্ধ শ্রোতার দলে সেভেন বি-র আমি আর সি সেকশনের ইন্দ্র আর পুলক | আমার স্কুল ছিল বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয় - সেই সময় কলকাতার প্রথম সারির স্কুল | সত্যজিৎ রায়, শম্ভু মিত্র, আর ডি বর্মন দের স্কুল | বেলতলা মোটর ভেহিকেলস এর ঠিক পেছনে | হাজরা রোড থেকে বাঁদিকে বেলতলা রোড থেকে শর্টকার্ট করে ল্যান্সডাউন বা  শরৎ বসু রোড ক্রস করে নরেশ মিত্র সারণি |

    স্কুলের বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ট্রাম | তখন আমার, ইন্দ্র বা পুলক কারোর একজনের অভিভাবক  থাকতো | পালা করে দেয়া নেয়া করা |  সেই শুরু | তারপর মাঝে কিছুদিন প্রাইভেট বাসে গেলেও উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে স্কুল ছাড়ার আগে পর্যন্ত আমাদের গেম টিচার - শ্রদ্ধেয় দীপক বাবুর ভাষায় 'বেহালার ছেলেদের' - ট্রামটাই ছিল স্কুলে যাবার প্রধান যানবাহন |

     ওই তিন দাদাদের মুখে স্কুলের অজস্র গল্প শুনতে শুনতে যেতাম | ওরা মাধ্যমিক দিচ্ছে, এই ব্যাপারটা কেমন যেন একটা সম্ভ্রম, মুগ্ধতা তৈরী করতো | পরবর্তীতে আমরা যখন ওদের জায়গায় পৌছালাম তখন আমাদের থেকে ছোটরাও আমাদের গল্প শুনে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো | আর আমরা আমরাও সেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম |  ট্রামযাত্রাটা যেন ছিল একটা সেতু | অতীত থেকে ভবিষ্যৎ-এর  |

    বেহালা ট্রামডিপোটা তখন ছিল নেহাতই একটা সাদামাটা দোতলা অফিস ঘর | নিচে কন্ডাক্টর, ড্রাইভাররা সব বসে হিসেবে-নিকেশ করতো  গুলতানি মারতো, চা-বিড়ি খেত |  অফিসের পাশে একটা খোলা শৌচালয় ছিল | তার মারাত্বক গন্ধ এড়াবার জন্যে ট্রাম থামার আগেই দুদ্দাড় করে নেমে পড়তাম | ২৭ আর ৩৫ নম্বর ট্রাম দঁড়িয়ে থাকতো | ৩৫ খিদিরপুর হয়ে ধর্মতলা,মোমিনপুর থেকে সোজা চলে যেত | ২৭ ডানদিকে বেঁকে লালবাতি | 

    ট্রামডিপোর যেদিকটা দিয়ে ট্রামগুলো ঢুকতো সেদিকটা বেহালার প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে | হকার আর পথচারীর ভিড় কাটিয়ে, অনবরত টং টং করতে করতে, উদাসীন  ট্রামগুলো ঢুকতো তারপর ট্রামডিপো অফিসের সামনে দাঁড়াতো এবং যেদিক দিয়ে ঢুকেছে তার উল্টোদিকে ওরকমই একটা গলি দিয়ে বেরোতো, সবমিলিয়ে অনেকটা ইংরেজি 'u ' অক্ষরের মতো  গতিপথ | 

    স্কুল যাওয়ার সময় দরজার দিকে প্রথম শ্রেণীর সিঙ্গেল সিটগুলোতে ব্যাগ বা রুমাল দিয়ে জায়গা পেতে নিচে নেমে আড্ডা দিতাম | স্কুলের জন্যে হাজরাতে নামতাম | ওখান থেকে বেলতলা রোড ধরে স্কুল | কখনো কখনো গোপাল নগরের মোড়ে নেমে ২০৪  বাসে উঠতাম | সেটা সোজা ল্যান্ডসডাউন মোটরভেহিকেলসে নামাতো আমাদের |  

    ফেরার সময় হাজরা হয়েই ট্রামে উঠতাম | রাসবিহারী মোড় থেকে সোজা এসে বাঁ দিক ঘুরে হাজরা স্টপে এসে দাঁড়াতো ট্রামগুলো | ঐদিকটাতে তখন ফুটপাথের ধারে রেলিং ছিল | কয়েকটা তার মধ্যে বাঁকা টেরা | তার উপর বসে আমাদের রকবাজি চলতো ট্রাম না আসা পর্যন্ত | পেছনে একটা ক্যাসেটের দোকান থেকে অবিরাম গেয়ে যেত কুমার শানু, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, উদিত নারায়ণ, এলাকা ইয়াগনিকরা | ম্যানে প্যার কিয়া, পারিন্দা, আশিকি, দিল, সাজন | 

    ক্লাস নাইন থেকে একা একাই যাতায়াত | দল বেঁধে যাওয়া - আসা |  বড় হচ্ছি আমরা | স্বাধীনতার দিকে এক পা দু পা | বয়ঃসন্ধি কাটিয়ে সাবালক হবার প্রস্তুতি | কখনো বিকেলের পড়ন্ত আলোয় কালীঘাটের ব্রিজের একপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চড়া মেকাপ আর রহস্যময়  চোখগুলোর দিকে নিষিদ্ধ কৌতূহলে আড়চোখে তাকিয়ে থাকা ট্রামের জানলা দিয়ে | কখনো সদ্য শাড়ি, দু - বেণী মাথা, ট্রাম থেকে নামার সময় এক পলক ঘুরে তাকালেই বুকের মধ্যে সমুদ্র গর্জন | 

    আর যখন মাঝেরহাট ব্রিজের উপর  ট্রামে, পশ্চিম আকাশে সূর্য ডোবার পালা, ব্রিজের তলা দিয়ে ভোঁ বাজিয়ে বজবজ লোকাল টা ছুটে যেত দিগন্তের লাল আকাশটার দিকে, সেই ছবির মতো দৃশ্যটা উপভোগ করতে না দিয়ে কানের পাশে সমানে ব্যাজোর, ব্যাজোর করে যেত ইন্দ্র, মনে হতো থাপ্পড় মেরে দিই | ইন্দ্র একবার তিনদিন ধরে পারিন্দা সিনেমার গল্পটা শুনিয়েছিল |

    (ক্রমশ:)
     

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | |
  • ধারাবাহিক | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন