|| ২৭ নম্বর ট্রাম ||
" আরে আজকে স্নান করে আয়নার সামনে টাইগার ব্যালেন্স করতে গিয়ে উল্টে পরে গেছি | টেবিলে এক লাথি | বাড়ির লোকজন ছুটে এসেছে কি হলো কি হলো বলে |" " আর আমি খাটের উপর শুয়ে করতে গিয়ে ঘাড়ে লেগেছে |" হা হা হা হা | বক্তারা হলো পার্থ দা, দিব্যেন্দু দা, সৌম্য দা | আমাদের থেকে তিন বছরের সিনিয়র | পরের বার মাধ্যমিক | পিটি ক্লাসে দীপক বাবুর কঠোর নির্দেশ | তাই বাড়িতে প্র্যাকটিস করতে গিয়েই বিপত্তি |
২৭ নম্বর ট্রামে করে বেহালা থেকে হাজরা স্কুলে যাবার পথে এই কথোপকথন | মুগ্ধ শ্রোতার দলে সেভেন বি-র আমি আর সি সেকশনের ইন্দ্র আর পুলক | আমার স্কুল ছিল বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয় - সেই সময় কলকাতার প্রথম সারির স্কুল | সত্যজিৎ রায়, শম্ভু মিত্র, আর ডি বর্মন দের স্কুল | বেলতলা মোটর ভেহিকেলস এর ঠিক পেছনে | হাজরা রোড থেকে বাঁদিকে বেলতলা রোড থেকে শর্টকার্ট করে ল্যান্সডাউন বা শরৎ বসু রোড ক্রস করে নরেশ মিত্র সারণি |
স্কুলের বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ট্রাম | তখন আমার, ইন্দ্র বা পুলক কারোর একজনের অভিভাবক থাকতো | পালা করে দেয়া নেয়া করা | সেই শুরু | তারপর মাঝে কিছুদিন প্রাইভেট বাসে গেলেও উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে স্কুল ছাড়ার আগে পর্যন্ত আমাদের গেম টিচার - শ্রদ্ধেয় দীপক বাবুর ভাষায় 'বেহালার ছেলেদের' - ট্রামটাই ছিল স্কুলে যাবার প্রধান যানবাহন |
ওই তিন দাদাদের মুখে স্কুলের অজস্র গল্প শুনতে শুনতে যেতাম | ওরা মাধ্যমিক দিচ্ছে, এই ব্যাপারটা কেমন যেন একটা সম্ভ্রম, মুগ্ধতা তৈরী করতো | পরবর্তীতে আমরা যখন ওদের জায়গায় পৌছালাম তখন আমাদের থেকে ছোটরাও আমাদের গল্প শুনে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো | আর আমরা আমরাও সেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম | ট্রামযাত্রাটা যেন ছিল একটা সেতু | অতীত থেকে ভবিষ্যৎ-এর |
বেহালা ট্রামডিপোটা তখন ছিল নেহাতই একটা সাদামাটা দোতলা অফিস ঘর | নিচে কন্ডাক্টর, ড্রাইভাররা সব বসে হিসেবে-নিকেশ করতো গুলতানি মারতো, চা-বিড়ি খেত | অফিসের পাশে একটা খোলা শৌচালয় ছিল | তার মারাত্বক গন্ধ এড়াবার জন্যে ট্রাম থামার আগেই দুদ্দাড় করে নেমে পড়তাম | ২৭ আর ৩৫ নম্বর ট্রাম দঁড়িয়ে থাকতো | ৩৫ খিদিরপুর হয়ে ধর্মতলা,মোমিনপুর থেকে সোজা চলে যেত | ২৭ ডানদিকে বেঁকে লালবাতি |
ট্রামডিপোর যেদিকটা দিয়ে ট্রামগুলো ঢুকতো সেদিকটা বেহালার প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে | হকার আর পথচারীর ভিড় কাটিয়ে, অনবরত টং টং করতে করতে, উদাসীন ট্রামগুলো ঢুকতো তারপর ট্রামডিপো অফিসের সামনে দাঁড়াতো এবং যেদিক দিয়ে ঢুকেছে তার উল্টোদিকে ওরকমই একটা গলি দিয়ে বেরোতো, সবমিলিয়ে অনেকটা ইংরেজি 'u ' অক্ষরের মতো গতিপথ |
স্কুল যাওয়ার সময় দরজার দিকে প্রথম শ্রেণীর সিঙ্গেল সিটগুলোতে ব্যাগ বা রুমাল দিয়ে জায়গা পেতে নিচে নেমে আড্ডা দিতাম | স্কুলের জন্যে হাজরাতে নামতাম | ওখান থেকে বেলতলা রোড ধরে স্কুল | কখনো কখনো গোপাল নগরের মোড়ে নেমে ২০৪ বাসে উঠতাম | সেটা সোজা ল্যান্ডসডাউন মোটরভেহিকেলসে নামাতো আমাদের |
ফেরার সময় হাজরা হয়েই ট্রামে উঠতাম | রাসবিহারী মোড় থেকে সোজা এসে বাঁ দিক ঘুরে হাজরা স্টপে এসে দাঁড়াতো ট্রামগুলো | ঐদিকটাতে তখন ফুটপাথের ধারে রেলিং ছিল | কয়েকটা তার মধ্যে বাঁকা টেরা | তার উপর বসে আমাদের রকবাজি চলতো ট্রাম না আসা পর্যন্ত | পেছনে একটা ক্যাসেটের দোকান থেকে অবিরাম গেয়ে যেত কুমার শানু, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, উদিত নারায়ণ, এলাকা ইয়াগনিকরা | ম্যানে প্যার কিয়া, পারিন্দা, আশিকি, দিল, সাজন |
ক্লাস নাইন থেকে একা একাই যাতায়াত | দল বেঁধে যাওয়া - আসা | বড় হচ্ছি আমরা | স্বাধীনতার দিকে এক পা দু পা | বয়ঃসন্ধি কাটিয়ে সাবালক হবার প্রস্তুতি | কখনো বিকেলের পড়ন্ত আলোয় কালীঘাটের ব্রিজের একপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চড়া মেকাপ আর রহস্যময় চোখগুলোর দিকে নিষিদ্ধ কৌতূহলে আড়চোখে তাকিয়ে থাকা ট্রামের জানলা দিয়ে | কখনো সদ্য শাড়ি, দু - বেণী মাথা, ট্রাম থেকে নামার সময় এক পলক ঘুরে তাকালেই বুকের মধ্যে সমুদ্র গর্জন |
আর যখন মাঝেরহাট ব্রিজের উপর ট্রামে, পশ্চিম আকাশে সূর্য ডোবার পালা, ব্রিজের তলা দিয়ে ভোঁ বাজিয়ে বজবজ লোকাল টা ছুটে যেত দিগন্তের লাল আকাশটার দিকে, সেই ছবির মতো দৃশ্যটা উপভোগ করতে না দিয়ে কানের পাশে সমানে ব্যাজোর, ব্যাজোর করে যেত ইন্দ্র, মনে হতো থাপ্পড় মেরে দিই | ইন্দ্র একবার তিনদিন ধরে পারিন্দা সিনেমার গল্পটা শুনিয়েছিল |
(ক্রমশ:)