এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • এক যে ছিল ট্রাম / পর্ব - ৫

    Tirtho Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০১ অক্টোবর ২০২৪ | ১৪১ বার পঠিত
  • || রক্তে লাল ট্রামলাইনে মহিনের ঘোড়াগুলি চরে ||

    "আমরা যাই নি মরে আজও--তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:
    মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে,
    প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন--এখনও ঘাসের লোভে চরে
    পৃথিবীর কিমাবার ডাইনামোর 'পরে।"

    কার্তিকের জোৎস্নায় ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে ধু ধু প্রান্তরে বরিশালের কোনো এক অখ্যাত গ্রামে | হয়তো তিনি দেখে থাকতে পারেন | যে অপার্থিব দৃশ্য দেখে তার মনে হয়েছিল আমৃত্যু আমাদের সামনে এসে এমনি দাঁড়ায় অজস্র দৃশ্য | কবির ছাত্র প্রখ্যাত কবি অরবিন্দ গুহ এক লেখায় বলেছেন বরিশালে  তাঁর মামাবাড়ি তে লক্ষ্মী পুজোতে নেমন্তন্ন থাকতো, তিনি অনেকবার দেখেছেন মন্তাজ মিয়াঁর আস্তাবলের ঘোড়াগুলি কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে চারিদিক ভেসে যাওয়া জোত্স্ন্যায় স্কুলের বিরাট  মাঠে ঘাস খাচ্ছে | জীবনানন্দ কি দেখেছিলেন ওই ঘোড়াগুলি ?  

    কবি হেঁটে বেড়াতেন - কখনো বরিশালের মাঠ ধরে, কখনো বা কলকাতার ফুটপাথ ধরে আবার কখনো বা সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে | সেদিন ও তিনি অমন হাঁটছিলেন রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্ডসডাউন রোডের সংযোগস্থলে ট্রামলাইনের পাশে সবুজ ঘাসের গালিচা ধরে | হয়তো হেমন্তের শিশিরের গন্ধ নাকে নিয়ে বরিশালের মেঠো আলপথে হাঁটছিলেন | তাই শুনতে পাননি মৃত্যুর দূত হয়ে ধেয়ে আসা ট্রামটির বিপন্ন ঘন্টি | শুনতে পাননি ট্রাম চালক ও আশেপাশের লোকেদের সমবেত চিৎকার, সাবধানবাণী | 

    গতিজাড্যের নিয়ম মেনে ট্রামটি যখন থামে, তখন তার ক্যাচারের তলায় ঢুকে গেছে কবির দেহ | তাকে যখন বার করে আনা হয় ক্যাচারের তলা থেকে ততক্ষণে তার বুকের পাঁজর ভেঙে গিয়ে ফুসফুসে ঘা দিয়েছে | রক্ত জমাট বেঁধে গেছে | যে পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন এই পৃথিবীর বুকে হাজার বছর ধরে সেই পা ও উরুর হার ভেঙে দুটুকরো | রাস্তার পাশে জলযোগের দোকানে অচৈতন্য কবিকে বসানো হলে তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে কিছু পরে প্রাথমিক শুশ্রূষার পর | চৈতন্য ফিরে পেতেই তিনি ফের উঠে পড়েন হাঁটবেন বলে কিন্তু পায়ের হার-গোর আস্ত না থাকায় মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়েন |

    শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের যে ঘরে তিনি ছিলেন সে ঘরে আরো ছিল  এক  কুখ্যাত খুনি | কি চমৎকার সহাবস্থান - কবি ও খুনি | ফুল ও রক্ত | সেই খুনি সারা রাত চিৎকার করতো যন্ত্রনায় | কবি বন্ধু সঞ্জয় ভট্টাচার্য কবিকে দেখতে | কবি জিজ্ঞেস করেন তিনি কি একটি কমলালেবু খেতে পারেন ? একদিন রাতে তিনি বলেন আকাশে দেখেছেন ধূসর পাণ্ডুলিপির রং | যে কার্তিক মাস ও হেমন্তর কথা ঘুরে ফিরে এসেছে তার কবিতায়, যে কার্তিকের নিওলিথ স্তব্ধতার জোৎস্না রাতে তিনি দেখেন মহিনের ঘোড়াগুলি, শোনেন বিষন্ন খড়ের শব্দ ইস্পাতের কলে, তেমনি এক রাতে সেই জোৎস্না ভরা মাঠ ছেড়ে শম্ভূনাথ পন্ডিতের বিবর্ণ এক ঘরে তাঁর দৃশ্য দেখা শেষ হল | ২২ শে অক্টবর, রাত ১১ টা বেজে ৩৫ | হাসপাতালের জানলার বাইরে কার্তিকের পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর | কবি দেখছেন মহিনের ঘোড়াগুলি এসে দাঁড়িয়েছে জানলার বাইরে | তাঁকে নিয়ে যাবার জন্যে তার প্রিয় বরিশালের খাল, বিল, পথে, প্রান্তরে |

    কলকাতার ইতিহাসে তখনও  পর্যন্ত, অর্থাৎ সেই ১৯৫৪ পর্যন্ত একজন মানুষ ও ট্রামে চাপা পড়েন নি | দুর্ভাগ্য আমাদের | দুর্ভাগ্য বাংলা কবিতার | ট্রাম নিয়ে অজস্র পংক্তি লিখে যাওয়া মানুষটি শেষে ট্রাম দুর্ঘটনায় চলে গেলেন | যে মৃত্যু তার কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে বারংবার সেই মৃত্যু তার বাস্তব জীবনে অসময়ে, অদ্ভুত ভাবে এসে তাকে দেখা দিল | কবি কি স্বেচ্ছা মৃত্যু বরণ করেছিলেন বাস্তব পৃথিবীর কঠোরতা সামলাতে না পেরে ? কিছু লোক সেই প্রশ্ন তুললেও কবির মৃত্যু তার কবিতার মতোই যেন ধূসর, ইঙ্গিত পূর্ণ | কি হয়েছিল সেই ঘাতক ট্রামটির ? শোনা যায় এক বিধ্বংসী আগুনে ডিপোতেই পুড়ে ছারখার হয়ে গেছিলো সেই ট্রামটি রহস্যজনক ভাবে | কবির অভিশাপ ? পোয়েটিক জাস্টিস ? জানিনা, তবে রবীন্দ্রোত্তর যুগের শ্ৰেষ্ঠ বাঙালি কবির লেখায়, তার কলকাতা জীবনে এবং তার মৃত্যুর সাথে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে কলকাতার ট্রাম |

    || উপসংহার ||

    প্রথম ছবিটি শুরু হচ্ছে ট্রামের  টিকি শহরের বিদ্যুৎবাহী তার ছুঁয়ে চলছে, এই দৃশ্য দিয়ে |  মাঝে মধ্যে ঝিলিক দিচ্ছে বিদ্যুৎ | ব্যাকগ্রাউন্ডে ট্রাম চলার ঘর ঘর শব্দ | দ্বিতীয়  ছবিতে  ট্রামলাইনে সরে সরে যাচ্ছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে ট্রামের ঘন্টি, ট্রামের কন্ডাক্টরের ক্লোস - আপ , ট্রাম থামার  দড়িতে টান  দিয়ে ট্রাম থামছে, এক   যুবক ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে ট্রামের পাদানিতে লাফিয়ে উঠছে | একটি গলি থেকে বিভিন্ন সময় বেরিযে তিন ভাই ট্রামে চেপে চলেছে  তাদের কর্মস্থলে - তৃতীয় ছবি | সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন ও তপন সিনহার তিনটি জনপ্রিয় ছবিতে শহর কলকাতা ও তার মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত্ব জীবনে কিভাবে ট্রাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল তা উঠে এসেছে |

    কলকাতা মহানগরীর বৃহত্তম আইকন | পঞ্চাশের দশকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এক পয়সা ট্রাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে একদিন জ্বলে গেছিলো এই শহর | ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিশারী হয়েছিল সেই জ্বলন্ত প্রতিবাদ | এই শহর দেখেছে ট্রামের চাকায় পিষ্ট হয়ে কবির মৃত্যু, যে কবি একদা লিখেছিলেন - 
    ‘‘ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি: এখন গভীর রাত
    কবেকার কোন্ সে জীবন যেন টিটকারি দিয়ে যায়
    ‘তুমি যেন রড ভাঙা ট্রাম এক— ডিপো নাই, মজুরির প্রয়োজন নাই
     কখন এমন হয়ে হায়!
     আকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে
     কবেকার কোন্ সে জীবন ডুবে যায়।’’ 

    ২০২২-এ সার্ধ-শতবর্ষে পা দেবে কলকাতার ট্রাম | ১৯৮৫-তে চলতো প্রায় ৩৫৮ টি ট্রাম | এই মুহূর্তে চলে মাত্র ২২ টি | ৪ টি রুটে | টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ, গড়িয়াহাট-ধর্মতলা, শ্যামবাজার-ধর্মতলা ও বিধাননগর-রাজাবাজার। কলকাতার ধমনী স্বরূপ ট্রামলাইনের ধারে এককালে তৈরী হয়েছিল শহর কলকাতার নাগরিক পদচিহ্ন গুলো- সিনেমা, থিয়েটার, বইপাড়া, রেঁস্তোরা, হাসপাতাল, আরো কত কি ! অনেকটা ইতিহাসের নদীভিত্তিক জনপদগুলোর মতন | এখনো তাই পুরোনো বটের মতন শহরকে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে রাখে অজস্র মরচে ধরা খাঁ খাঁ ট্রামলাইন | শহরের এই ট্রামগুলোর মতনই এক বুক অভিমান নিয়ে অনেক দিন আগেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে স্কুলের ছোটবেলার বন্ধু ইন্দ্র কারোকে কিছু না জানিয়ে | হয়তো ওর গল্প শোনাবার লোক ফুরিয়ে গেছিলো |  

    শেষ 

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০১ অক্টোবর ২০২৪ | ১৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন