এবারের একুশে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা দিবসের বিশ্লেষণ এবং আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
____________________________________
(এক)
বাংলাদেশ মানেই মুসলমানরা হিন্দুদের বাড়িঘর ভেঙে দিচ্ছে, জমি জায়গা কেড়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ মানেই হিন্দু মন্দির ধ্বংস হচ্ছে। বাংলাদেশ মানেই মুসলমান গুণ্ডারা হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করছে। বাংলাদেশ মানেই লক্ষ লক্ষ অবৈধ মুসলমান বর্ডার পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ছে প্রতিদিন। এবং তারা সব ক্রিমিনাল।
বাংলাদেশ সম্পর্কে বহুকাল ধরে এই ধারণাই সৃষ্টি করা হয়েছে ভারতের মানুষের মনে। এবং তার কোনো সক্রিয়, সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ আমরা করিনি। কংগ্রেসের আমলেও করিনি, সিপিএমের আমলেও করিনি। আর এখন তো সবকিছু হাতের বাইরে চলে গেছে।
আমার স্মৃতিকথা "ঘটিকাহিনি"তে আমি লিখেছি, কলকাতার রেডিওতে, টিভিতে আমরা কখনো বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক কথা শুনিনি। বাংলাদেশের মানুষ কেমনভাবে জীবন কাটায়, এবং সাতচল্লিশের পার্টিশনের পরে, অথবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের বাঙালিরা কেমনভাবে বসবাস করে এসেছে, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আমাদের ছিলোনা।
আমাদের আঁতেল অথবা এলিট কবি, সাহিত্যিক, বা মুষ্টিমেয় শিল্পী, চিত্র পরিচালক, নাট্যকার বাংলাদেশে গিয়ে গালভরা কিছু কথা বলে এসেছেন, এবং সে দেশের মিডিয়াতে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাতে তাঁদের বই বিক্রি হয়েছে লক্ষ লক্ষ, কারণ বাংলাদেশের মানুষ ভারতের বই অনেক বেশি পড়েন। কিন্তু দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের কোনো রাস্তা তাঁরা তৈরী করতে পারেন নি। কলকাতাকেন্দ্রিক বড় বড় মিডিয়া বাংলাদেশের বাঙালিকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার কোনো তাগিদই কখনো অনুভব করেন নি।
আমার বই "আপনি কি দেশদ্রোহী?"তেও আমি লিখেছি বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতার বাঙালিদের অবজ্ঞা ও অজ্ঞানতা কতখানি আকাশছোঁয়া। আমি নিজেও দেশ ছাড়ার আগে এরকমই ছিলাম। তার ওপর আবার আরএসএস করতাম। সেখানে বাংলাদেশ মানেই শত্রু দেশ। মুসলমানদের দেশ। সুতরাং বাই ডিফল্ট শত্রুদেশ। ওই যে বললাম, যেখানে "প্রতিদিন হিন্দু মেয়েরা ধর্ষিতা হচ্ছে, প্রতিদিন হিন্দু মন্দির ও বিগ্রহ কালিমালিপ্ত হচ্ছে।" এই শুনে এসেছি চিরকাল আরএসএস শাখায়।
তারপর আমেরিকায় আটত্রিশ বছর কাটালাম। তার মধ্যে পঁচিশ বছর নিউ ইয়র্ক শহরে।
বাংলাদেশের অসংখ্য বন্ধু বান্ধবী হলো। হিন্দু এবং মুসলমান। বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান। জৈন পারসিক হয়নি। মুসলমান বন্ধু ও সতীর্থ হয়েছে অনেক বেশি। তাদের সঙ্গে মিশলাম। তাদের বাড়ি গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিলাম। তাদের উইকএণ্ড স্কুলে বাংলা পড়ালাম। তাদের সাপ্তাহিক কাগজগুলোতে সেই এগারোই সেপ্টেম্বরের পর থেকে একটানা লিখে গেলাম। তাদের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে গান গাইলাম, আবৃত্তি করলাম।
একুশে ফেব্রুয়ারি যখন নিউ ইয়র্ক শহর বরফে ঢাকা, এবং তাপমাত্রা মাইনাস পাঁচ কি দশ, তখন মাঝরাতে জাতিসংঘের সামনে ভাষা দিবসের গান গেয়েছি বাংলাদেশের বন্ধুদের সঙ্গে। "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?" বাংলাদেশের লেখক, কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের পরিচয় হলো। আর হলো ট্যাক্সি ড্রাইভার কাম হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে মান্না দের গান গাওয়া আরজু মোমেন, শফিকদের সঙ্গে।
তারপর বাংলাদেশে গেলাম একধিক বার। ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, মৌলবীবাজার, চাঁদপুর, শ্রীমঙ্গল, বিক্রমপুর -- আরো অনেক জায়গা। পদ্মা পার হলাম নৌকোতে।
হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বললাম। হাজার মন্দির দেখলাম। শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতি-বিজড়িত তীর্থস্থান দেখে এলাম এই গত বছর।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ধ্যানধারণা আমার সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
(ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।