মাইকটা বেজে উঠতেই একটা ঘড়ঘড় শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, আর মেজাজটা সপ্তমে উঠল তার! কিন্তু তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে পারল না; হঠাৎ করে একটা গন্ধ ভেসে এসে তার মস্তিষ্কে ঘূর্ণি তুলতে লাগল। অদূরেই কয়েকটি মাটির চুলোয় রান্না হচ্ছিল। ধোঁয়ায় চোখ-নাক বুঁজে এলেও ডেকচির বিশাল মুখটা সেইরকম সুবাস বিলোচ্ছিল!
প্রথমে কিছু গগনবিদারি শ্লোগানে গা গরম করে নিয়ে মাইকটা এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল জনপ্রিয় সুরে দল ও নেতার বন্দনাগীতিতে। ইতিমধ্যেই নেতাকর্মীদের ভীড়ে জায়গাটা ভরে গেছে। ওদিকে আরো কিছু মানুষ তাদের জন্য বরাদ্দ কোণাটিতে দাঁড়িয়ে গেছে; অবশ্য নিরাপত্তারক্ষীদের হুংকারে তাদের মাঝেমধ্যে কষ্টকর দিকবদল করতে হচ্ছে! সভার প্রবেশদ্বারটা প্রশস্ত হওয়ায় কোণাগুলি একটু বেশিই বেঁকে গেছে, না হলে সামান্য লম্ফ-ঝম্ফ - এ আর কী এমন কঠিন কাজ!
হঠাৎ একটা হৈচৈ মাইকের গলাটা চেপে ধরল যেন! দূর থেকে একটা বিন্দুর মত দেখাচ্ছে নেতার এক চিলতে হাতটা, গাড়িজানালা দিয়ে বেরিয়ে আছে শত শত প্রার্থীকে একটুখানি ছুঁয়ে দিতে! কে জানে, হাতটার কি অবস্থা! যতদূর জেনেছে জামান, আজ প্রায় গোটা দশেক কাঙ্গালি ভোজ উদ্বোধনের দায়িত্ব পড়েছে নেতার উপর! নেতা শব্দটা একটা আলোড়ন তুলে দেয় জামানের বুকে! তাদের নেতা, তাদের মাটির! শুধু ইলেকশানের তরীটা পার হলেই হল, মন্ত্রীত্ব নিশ্চিত!
প্রায় শ’ দুয়েক নোংরা বেশ ও ভূষার লোক ভীড় জমিয়েছিল মাঠের সেই সরু কোণাটিতে, স্টেজ আর বাজার যাকে দু’পার থেকে ঠেসে ধরেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে দু’তিনজনের হাতে খিচুড়ির প্যাকেট তুলে দেয়ার পর নেতা যখন মসজিদ পানে ছুটলেন, বিরতিটা কাজে লাগাল জামান নেতাকে সঙ্গ দেয়া গণ্যমান্যদের গাড়িতে কয়েকখানা করে খিচুড়ির প্যাকেট প্রবেশ করিয়ে।
‘লিডার কী কন! ভোজটা কি স্টার্ট কইরা দিমু? গ্যাঞ্জাম শুরু হইয়া গেছে!’ স্বেচ্ছাসেবক বাচ্চুর আওয়াজে ধ্যান টুটে যায় জামানের। সূর্যের তাপ প্রখর হয়ে উঠেছিল, আর দরদর করে ঘাম ছুটছিল জামানের কপাল আর গন্ডদেশ বেয়ে! হাভাতেগুলোকে নিয়ে আর পারা যায় না! এই যে খিচুড়ির জন্য লাইন দিয়েছে, নিশ্চিত বিক্রি করে দেবে! কেউ কেউ তো একাধিক হাতাবে! ছল ধরতে জুড়ি নেই শালাদের!
‘’না, আরো কাজ বাকি আছে!’ রাগে গজগজ করতে বলল জামান। কিছু লোক যারা নেতার সাথে থাকতে পারেনি, কিন্তু বনেদিদের কাতারে পড়ে, তাদের বাড়িতে তখনো খিচুড়ির প্যাকেট পৌঁছে দিতে পারেনি!
হঠাৎ বড় মসজিদের খতিবকে চোখের সামনে দিয়ে যেতে দেখল জামান। আর সঙ্গে সঙ্গেই লম্বা আর জোরালো একটা স্লামালিকুম দিয়ে বলে উঠল, ‘হুজুর, কই যাইতেছেন? কইছিলাম, এইবার এট্রু টানাটানি! তয় পঁচিশটা প্যাকেট দিয়া আইবোনে …’
খতিব সাহেবের ‘আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লা’ বুলিতে ঝকঝক করতে থাকা পথটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পরিষদের সাইনবোর্ডটাতে চোখ আটকে গেল জামানের। এই রে ভুলেই তো গিয়েছিল! পরিষদের সেক্রেটারি গতকালই বলছিলেন, তার বাচ্চারা গত বছরের খিচুড়িটা খুব পছন্দ করেছিলেন। জামানরা যখন অনুমতির জন্য গিয়েছিল, একটুও দেরী করেননি পারমিশান দিয়ে দিতে। তবে সমস্যা হল, অফিসটাতে রয়েছে আরো কয়েকজন সরকারী কর্মচারি; জামান শীঘ্রই লোক পাঠাল অনেকগুলি প্যাকেট দিয়ে।
রোদের তাত একটু কমে এসেছিল, আর একটু জিরিয়ে নেয়ার অবকাশ খুঁজছিল জামান এই হাউকাউয়ের মাঝেও। কিন্তু পরিষদ ভবনে পাঠানো ছেলেটি ফিরে এসে তাতে বাঁধ সাধল। তার প্যাকেট বিলোনোর সময় নাকি কর্মসূত্রে উপস্থিত ছিলেন এলাকার একমাত্র ব্যাংকের ম্যানেজার। সুদের কারবারিগুলিকে মোটেই পছন্দ করে না জামান। কিন্তু আগামীকালই পার্টি ফান্ডের বেঁচে যাওয়া টাকাগুলি জমা করতে ঢুকতে হবে ওদের গুহায়!
অগত্যা ব্যাংকের জন্য আরো গোটা পনের প্যাকেটের অর্ডার করে যেই না মুখ ফিরিয়েছে, দেখতে পেল কালামকে। তার বাল্যকালের বন্ধু, কিন্তু এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। কালাম অবশ্য না দেখার ভান করেছিল, কিন্তু জামান তার হাতেও গোটা দশেক প্যাকেট জোর করেই তুলে দিল! শুধু দোস্ত বলে নয় - বলা যায় না- যদি ইলেকশানে কালামদের দলই জিতে যায়, একটা প্রটেকশান তো লাগেই!
হঠাৎ শোরগোলটা মাথাচড়া দিয়ে উঠল আবার! কঠিন কণ্ঠ ও চোখে বাচ্চুকে হাঁক দিল জামান, ‘লাঠিগুলান কই! তরে না কইছিলাম লাঠি যোগাড় করতে কয়ডা!’
এরপর যখন পত্পত্ লাঠির বাড়ি পড়তে লাগল কোণাটাতে, শোরগোলটা প্রথমে কিছুটা বেড়ে পরে কমেও গেল। সেই অবকাশে জামান আর কোন কোন জায়গায় খিচুড়ি বিতরণটা বাদ পড়ে গেছে, তার হিসেব করতে লাগল!
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।