ক'দিন আগে খবরে দেখলাম, রতন টাটার স্মরণে বিজেপি মিছিল বের করেছে সিঙ্গুরে। স্মৃতি সততই মেদুর। প্রায় দু'দশক আগের ঘটনা, কিন্তু ভাবলে যেন এই সেদিনের কথা বলে মনে হয়। আমার অবস্থাটা হয়েছে ভূতপতরির দেশের মনসাবুড়োর মত। সেই কোনকালে বুড়ো জলের ধারে ছিপ ফেলে বসেছিল, এখন চারদিকে বালি আর বালি। সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আমার ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ার। এ গল্পটা তার বছর দুই পরের। দুহাজার আট কি নয়। ন্যানো প্রজেক্ট হবে না ডিক্লেয়ার হয়ে গেছে।বছরখানেক হলো চাকরিতে ঢুকেছি। প্রজেক্টে কাজ কম থাকলে, কাঁকলাসে গত্তি লাগাতে বিকেলের দিকে ক'জন অফিস জিমে যেতাম। ট্রেনার মলয় দার বাড়ি সিঙ্গুরে। মলয় দা যৌবনে পাওয়ার লিফটার ছিলো। কাল্টিভেট করার মতো গুলিসমেত বডি ছিলো, তার স্মৃতি মানিব্যাগে মজুত, দেখিয়েছিলো। আমাদের সাথে যখন আলাপ ততদিনে কর্পোরেট জিম ট্রেনার, সিক্সপ্যাক আর নেই কিন্তু পেটানো চেহারা। বাড়িতে একটা ছোট জিম চালাতো, তাতে পাড়ার ছেলেছোকরা কিছু আসতো। আর এদিকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে অফিস। তখন কারখানার পরিস্থিতি কিছুটা থিতিয়ে গেছে, একদিন কথা তুললাম। যদি ফার্স্টহ্যান্ড কিছু অপ-এড পাওয়া যায়। খাস সিঙ্গুরের লোক বলে কথা।
"কিছুই ফ্যালা যায় নে"।
সিঙ্গুর সম্পর্কে এই ছিলো মলয় দার সংক্ষিপ্ত অ্যানালিসিস। মলয় দা 'নি' কে 'নে' বলতো মাঝে মাঝে। আমাদের জিমে এক ক্যাপিটালদাস পোলাপাইন দুঃখ করে বলছিলো, "অতখানি জমি, কত বড় একটা ফ্যাক্ট্রি হয়েও হলো না... কত টাকা নষ্ট…"। তাতেই ওই উদাস স্বগতোক্তি মলয়দার।
- "কি রকম?” - আমরা ততক্ষনে গল্পের গন্ধ পেয়েছি।
- "ওইসময় যদি কেউ কারখানার সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, মনে হবে কিছু একটা অফিশিয়াল কাজকারবার চলছে, বুঝলে? মানে লাইন দিয়ে ভ্যান দাঁড়ানো, দেয়ালের ইঁট খোলা হচ্ছে। ধীরেসুস্থে কাজ এগোচ্ছে, কারোর তাড়া নেই। যত্ন করে ঠুকে ঠুকে খোলা হচ্ছে, যাতে বেশিটা আস্ত থাকে, হুড়মুড় করে শাবল মারলে টুকরো হয়ে যেতে পারে। সকাল সকাল লোকজন উঠে ভ্যান নিয়ে চলে আসে, বিকেল অব্দি কাজ চলে। কে কোথায় ভাঙবে, সেসবও ভাগ করা। পাঁচিল প্রায় এক দেড় কিলোমিটার লম্বা, সবাই একেকটা জায়গা ধরে ভাঙছে। আমি ত দেখে ভেবেছি কম্পানির স্টাফটাফ হবে, কারখানা ক্যান্সেল তাই দেয়াল ভাঙছে, পরে দেখি আশপাশের লোক সব।"
- "মানে? লোকাল লোকজন দেয়ালের ইঁট ভেঙে বেচে দিচ্ছে?"
- "না, সবাই বেচছে না। ধরো কারো অনেকদিন একটা দোতলার প্ল্যান কিন্তু খর্চার জন্য হচ্ছেনে, কি কেউ উঠোনে একটা ঘর তুলবে। সেগুলোর মালমশলা এদিক থেকে যোগাড় হয়ে যাচ্ছে। তবে সেটা এলিতেলি সবাই চাইলেই করতে পারে, নাকি দেয়ালে ভ্যান লাগাতে গেলে কোনো দাদা ধরতে হবে এইগুলো ডিটেলে জানি না"।
জিমে নানা লোকে আসে। বেঞ্চপ্রেস মারতে মারতে আরেকজন গম্ভীরভাবে বলে ওঠে, "এলাকার পালস বোঝেনি, করতে গেছে অধিগ্রহণ। পাব্লিক সেন্টিমেন্ট ঘুরে গেলে এরকমই হওয়ার কথা। ওই তো কটা ইঁট। উৎপাতের ধন চিতপাতে যায়।" বলেই ফের হুশহাশ করে বেঞ্চপ্রেস।
- "আরে শুধু ইঁট না। তারপর ধরো গিয়ে লোহার রড।"
- "রড মানে? টিএমটি বার??"
- "হ্যাঁ ওই। ইঁট ত একটা দুটো মেরে লাভ নেই, বিস্তর খাটনি, তার উপর ভ্যানফ্যান যোগাড় করার হ্যাপা আছে। রড যদি দু'চারটে সাইকেলে বেঁধে আনে তাতেও লাভ। আমাদের পাড়ার দুটো ছেলে ত ধরা পড়ল।"
- "কিরকম? রড ভাঙছিলো?"
- "ভাঙচুর করবার মতো বয়স হয়নি। স্কুলের কটা বাচ্চা ছেলে, সেভেন এইটে পড়ে হবে। চাদ্দিকে দেখছে সবাই দেদারে কামাচ্ছে, তাই দেখাদেখি স্কুল কেটে দুই মক্কেল গেছে। হাতের কাছে খুচরো হাফ রড একখানা পেয়ে তাই কোনোমতে সাইকেলে চাপিয়ে যাচ্ছিলো। রডগুলোর ভালো ওজন আছে, ছেলেছোকরার কর্ম না। ফেরার সময়, যাবি তো যা, গেছে কোথায়? না পাড়ার দাদা রা ঠেকে বসছিলো, তার সামনে দিয়ে। দেখেই ওরা ক্যাচ করেচে, যে স্কুল কেটে এসব কি? তারপর হাল্কা চড়চাপাটি, রড ফড কেড়ে নিয়ে ফালতু বাওয়াল। ইতিমধ্যে রুলিং পাটির লোকজন ছেলেদুটো কে দিয়েছে ধরে থানায়। ছেলেদুটোর কথা ভাবো, বার খেয়ে ক্ষুদিরাম। এত খেটেখুটে পুরোটাই লস। রড তো দাদারা সীজ করে মালফাল খেয়েছে হবে।"
- "কি ক্যাচাল!"
- "এখনো শেষ হয়নি। লাস্টে ছেলেদুটোর মা বাবা থানায় গিয়ে ধর্ণা। কি, না ছেলে আমাদের বিপ্লবী টাইপ। ওরা রড নিয়ে যাচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু সেটা স্রেফ রড ঝেপে নিয়ে যাওয়া না। ওটা প্রতীকী প্রতিবাদ। চাষজমির উপর কারখানার বিরুদ্ধে। এ বুদ্ধিটা পাটির কেউই দিয়ে থাকবে। ব্যাস। তারপর দু’দিন এলাকায় ধুন্ধুমার, এই মিছিল কি সেই মিছিল। আরেকটু হলে ছেলেদুটোকে শহীদ করেই দিচ্ছিলো। সে যাক, ফাইনালি ছেড়েও দিলো থানা থেকে। কিন্তু মিটিং মিছিল থামার নাম নেইকো। রোজ মিছিল। এভরি ডে"
- "কারখানার বিরুদ্ধে মিছিল?"
- "দু'রকমই। আরে সেবার সরস্বতী পুজো। আমাদের জিমে ছোটো করে একটা হয়, জিমের ছেলেগুলোই করে, খিচুড়ি আলুরদম খাওয়া হয়। জিমের পাঁচিলে একটা পোস্টারও দেওয়া হয়। পাড়ার একটা ছেলে আছে, আঁকার হাত ভালো। ওই করে দেয়, কাপড়ের উপর রং দিয়ে, পঞ্চাশ একশো নেয়। সেবারেও গেছি। পত্রপাঠ বলে দিলো এবার হবেনা, বলে মরবার ফুরসৎ নেই। হাতে ম্যালা কাজ। উঁকি মেরে দেখি ভেতরের ঘরে দেদারে পোস্টার আর ফ্লেক্সের কাজ চলছে। সে প্রায় তিন-চার হাত ডাঁই করা বান্ডিল, বুঝলে। একদিকে সিপিএম, অন্যদিকে তৃণমূল। ওখানে পোস্টার ফ্লেক্স বলতে ওর দোকানটাই, এ তো আর কলকাতা না। ছেলেটা একতলা রংই করিয়ে ফেললো সেবারে, এত অর্ডার।"
- "দারুন তো? এ তো ফুল অ্যান্সিলিয়ারি!"
- "তবে? আরো আছে। বেরোনোর উঠোনে দেখি আর দুটো ছেলে মিলে আধপোড়া গ্রিলের টুকরো টাকরা বসিয়ে কিসব ওয়েল্ডিং করছে। জিজ্ঞেস করলাম, এ কি হবে রে? বললো ওটা ন্যানো।"
- "ন্যানো!!"
- "মানে ন্যানোর খাঁচা। দেখলাম লোহার পাত জুড়ে ভালোই বানিয়েছে। বললো এরপর হলুদ কাগজ দিয়ে ছাওয়া হবে, কালো কালি দিয়ে উপরে ন্যানো লেখা হবে। তারপর যারা অর্ডার দিয়েছে তারা নিয়ে যাবে। আইটেম টা নাকি হেভি হিট হয়েছে, দুই পক্ষই নিয়ে যাচ্ছে। এবেলা এরা নিয়ে গিয়ে একপক্ষ মিছিল করছে, কি না ন্যানো চাই। ওবেলা অন্য পার্টি নিয়ে গিয়ে ন্যানোর কুশপুতুল পোড়াচ্ছে, যে চাইনা ন্যানো জমি নিলো কেন? গ্রিল তো আর পোড়ে না, কাগজ ফাগজ জ্বলে গেলে এরা আবার পোড়া ন্যানোর খাঁচা তুলে এনে নতুন করে ছেয়ে দিচ্ছে। আবার ব্র্যান্ড নিউ। ওইজন্যেই বলছিলাম। কিছুই ফ্যালা যায়নে। কি বুঝলে?"
আর বোঝা! আমরা ততক্ষনে চুপ মেরে গেছি। মাইন্ডফাক। শেষবার এরকম লেগেছিলো নোলানের মেমেন্টো দেখার পর।
পুনশ্চ: তথ্য হয় দু'রকম। অ্যানেকডোটাল, আর স্ট্যাটিস্টিকাল। এ গল্পটা, বলাই বাহুল্য, প্রথমটার আওতায়। কৃষির মত ভিত্তি এর একেবারেই নেই, কথাশিল্পের ভবিষ্যতও না থাকাই শ্রেয়। যা লিখলাম তার কতটা সত্যি আর কতটা জল তা বলতে পারবো না। এর বছর দুয়েক পরে আমাদের ওই অফিস স্পেসটা অন্যত্র উঠে যায়। মলয়দার চাকরি টা পাকা ছিলো না, তাই কনট্র্যাক্ট বাড়ানো হয়নি। যেরকম হয় আর কি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।