রুচিকা গিরহোত্রার কথা হয়ত কারোর কারোর মনে থাকবে। এই চৌদ্দ বছরের লন টেনিস প্লেয়ারটি হরিয়ানার লন টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও পুলিশ অফিসার রাঠোরের দ্বারা যৌন নিগৃহীত হয় ১৯৯০ সালে। ঘটনার তিনদিন বাদে মেয়েটি নালিশ জানায়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ অফিসারের দোষও ধরা পড়ে। কিন্তু এফ আই আর হয় না। ইতিমধ্যে রাঠোরের চাপে মেয়েটি নিজের স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়। তার দাদার বিরুদ্ধে ছটি কেস রুজু করা হয়। রাঠোরের সমর্থনে রাজপুত সভার সদস্যরা রুচিকার বাড়ির সামনে দিয়ে প্রসেসন করে, তাঁকে রাস্তাঘাটে রেন্ডি বলে অভিহিত করা হয়। ক্রমাগত মানসিক নির্যাতনে মেয়েটি ১৯৯৩ সালে আত্মহত্যা করে। কত বছর বয়স তখন ওর? আর সেই পুলিশ অফিসারের কি হয়? রাজনৈতিক মদতে তার পদোন্নতি হয়েই চলে। থামে শেষে ১৯৯৯ সালে রাজ্যের ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ হয়ে। ২০০২ সালে তিনি অবসর নেন। কোর্টের হস্তক্ষেপে সেই ঘটনার এফ আই আর দাখিল হয় অবশেষে ১৯৯৯ সালে। রুচিকার বন্ধু আরাধনা একমাত্র ঘটনার সাক্ষী ছিল। সে আর তার বাবা, রুচিকার বাবা- দাদা সবাইকে ভয় দেখান হয়, বিভিন্ন ভাবে বিপর্যস্ত করা হয়। দীর্ঘ আইনি যুদ্ধের পর এই যৌন নিগ্রহ মামলার শেষ রায় বেরোয় ২০১৬ সালে। রাঠোরের মাত্র ছয় মাসের জেল। তাও ইতিমধ্যেই জেল খেটে ফেলার সুবাদে রায় বেরনোর পরে আর তাকে জেল খাটতে হয়নি। হ্যাঁ এই আমাদের নবজাগ্রত সচেতনতার “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও” দেশের যৌন নিগ্রহের অভিযোগের রায়। আরও মনে রাখার যে এই কেসে সি বি আই আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও আত্মহত্যায় মদত দেওয়ার অভিযোগ কিন্তু জোড়া হয়নি। এখনও কোর্টে এই মামলার সঙ্গে জড়িত বহু মামলা চলছে। তাহলে রুচিকা কি ন্যায় বিচার পেল?
এইখানে একটু আনকথা বলার লোভ সামলাতে পারা গেল না। রাঠোরের স্ত্রী ছিলেন অ্যাডভোকেট। তিনি আগাগোড়া স্বামীর হয়ে আইনি যুদ্ধ লড়ে গেছেন। উল্টো দিকে এও সত্য যে অত্যাচারের চোটে রুচিকার বাবা ও ভাই ময়দান ছেড়ে দিলেও নিতান্ত মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী আরাধনার বাবা ও মা কিন্তু, অনেক ক্ষতি সহ্য করেও, শেষ অবধি এই মামলা লড়ে গেছেন। তাঁদের কিন্তু বিশেষ কিছু ক্ষমতা টমতা ছিল না। শুধু অসীম ধৈর্য ছিল। এই মানবতার জয়টুকুই এই কেসের একমাত্র পাওনা।
না, আইনি পরিকাঠামোর দিক দিয়ে ১৯৯০র ভারত আর আজকের ভারত এক নয়। এখন আমাদের তূণীরে বেশ কটি বিবিধ ক্ষেত্রের নারী নির্যাতন বিশেষত যৌন নির্যাতন বিরোধী আইন। সেই সঙ্গে আইনত নির্যাতনের যে সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে, সেই সংজ্ঞা কিন্তু যথেষ্ট বিস্তৃত। কিন্তু ক্ষমতা তথা সাধারণ জনগণ কতটা সংবেদনশীল হয়েছে? কেন এদেশে নির্ভয়ার মতন ধর্ষণ ও নারকীয় হত্যা ছাড়া অন্য কিছু কলকে পায় না? জনগণ নিজেরা এই অপরাধকে কতটা “গুরুতর” অপরাধ বলে মনে করেন? কেন আজও দলিত মেয়েরা সুবিচার পায় না? আর আজকের ২০২৩ সালে ১৯৯০ র থেকে ঠিক কতটা বদল হল? ওই প্রশ্নটা মাথায় রেখে আরও একটু খতিয়ে দেখা যাক।
বৃজভূষণ শরণ সিং। এই নামটা এখন আর কারো জানতে বাকি নেই। ২০২৩ এর জানুয়ারিতে ভিনেশ ফোগত, বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক, রবি দহিয়া, দীপক পুনিয়া প্রমুখ ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিবিধ অভিযোগ আনেন। অভিযোগের দলে অর্থনৈতিক অনিয়ম, খেয়ালখুশি মতন সংস্থা চালানোর অভিযোগের পাশাপাশি যৌন নির্যাতনের অভিযোগও ছিল। ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনকে লেখা এই চিঠিতে বলা ছিল, যৌন নির্যাতনের ঘটনা অনেক অল্পবয়সী কুস্তিগিরদের থেকে তাঁরা জেনেছেন। সরকারের কাছেও তাঁরা অভিযোগ জানান। বৃজভূষণের পদত্যাগেরও দাবি জানান।
খেলার দুনিয়ায় এইসব অভিযোগ খুব নতুন কিছু না। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় ২০২০র জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে তার আগের দশ বছরে অন্তত ৪৫ টি যৌন নিগ্রহের অভিযোগ সাই এর দপ্তরে জমা পড়েছে। ২০২২ সালের মে ও জুন মাসেই আরও চারটি অভিযোগ জমা পড়েছিল। কোচ ও কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার, সমাজের সব স্তরেই বিরাজমান ঘোর পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে অভিযোগ এর কোন কিনারা না হওয়া আর মেয়েদের কেরিয়ারের ভয়ে মুখ বন্ধ করে থাকা এই ত্রহ্যস্পর্শে এই রকম ঘটনা বিভিন্ন সংস্থায় বার বার ঘটতেই থাকে। বলাই বাহুল্য বৃজভূষণের এমন হাই প্রোফাইল প্রবল রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী কর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা কতটা কঠিন।
কুস্তিগিরদের অভিযোগের উত্তরে সরকার থেকে একটি ওভারসাইট কমিটি তৈরি করা হয়। মেরি কমের নেতৃত্বাধীন এই কমিটিতে ছিলেন যোগেশ্বর যাদব, তৃপ্তি মুরগুন্ডে, রাজেশ রাজাগোপালন, রাধিকা শ্রীমান। কমিটি নিয়ে কুস্তিগিররা অসন্তোষ প্রকাশ করলে পরে ববিতা ফোগতকে কমিটিতে আনা হয়। প্রসঙ্গত মেরি কমের নিজেরই কিন্তু যৌন নিগ্রহের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি নিজেই এই বিষয়ে নিজের সন্তানদের লেখা খোলা চিঠিতে আগে সরব হয়েছেন। এই কমিটি দীর্ঘ সময় পরে, ফেব্রুয়ারি মাসে অন্ততপক্ষে ১২ জনের সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের পরে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে এপ্রিল মাসে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। সেই রিপোর্ট কখনোই জনসমক্ষে আসেনি। শোনা যায় এই রিপোর্টে শুধু কিছু কুস্তি ফেডারেশনের গঠনগত ত্রুটি ছাড়া আর কোন সমস্যার কথা নেই। ইতিমধ্যে এপ্রিল মাসের ২১ তারিখ এক নাবালিকা সহ সাতজন মহিলা কুস্তিগির পুলিশের থাকে অভিযোগ জানায়। পুলিশ অবশ্য তারপরেও নিষ্ক্রিয় থাকে। শেষে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাঁরা দুটি এফ আই আর লিখতে বাধ্য হয়। কিন্তু নাবালিকার অভিযোগ অনুসারে POCSO আইনের প্রয়োগ সম্ভব হলেও পুলিশ প্রকৃতপক্ষে কিছুই করে উঠতে পারে না। অভিযুক্তকে হেফাজতে নেওয়া তো দূরের কথা! যার ফলে কদিন পরে অত্যন্ত চাপের মুখে পড়ে নাবালিকা ও তার বাবা অভিযোগ তুলে নেয়। কার চাপ, কেন চাপ সেটা সহজেই অনুমেয়। ইতিমধ্যে মে মাসের শেষে ঘটনা এক নাটকীয় মোড় নেয়। কিন্তু সে কথায় আর যাচ্ছি না। বিশদে এই ঘটনার আংশিক কালপঞ্জি জানতে হলে এই রিপোর্ট দেখতে পারেন।
অতঃপর জুনের ১৫ তারিখে অবশেষে বৃজভূষণ শরণ সিং ও ফেডারেশনের সেক্রেটারি বিনোদ তোমর দুজনের নামে পুলিশ আক্রমণ, ভীতি প্রদর্শন, যৌন নিগ্রহ ও স্টকিং এর অভিযোগে সেকশন ৩৫৪, ৩৫৪ডি, ৩৪৫ডি ও ৫০৬(১) ধারায় চার্জশিট জমা দেয়। এদিকে কুস্তি ফেডারেশনের নির্বাচনের ডেট ক্রমশঃ পিছচ্ছে। শেষতম খবর ( ২৫ শে জুন) অনুসারে, গুয়াহাটি হাইকোর্ট ১১ তারিখের নির্বাচনে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। জায়গাটা আসাম তো, তাই বহুরকম সম্ভাবনা মাথায় ঘুরছে। অবশ্য পদচ্যুত হয়েও বৃজভূষণের বোলবোলাও কমেনি। কমেনি তার স্তাবকের সংখ্যাও। অবশ্য ছয় বারের এম পি এবং ভবিষ্যতেও আবার সাংসদ হবেন হয়ত, এমন লোকের পদলেহন করতে অনেকেই প্রস্তুত। অন্যদিকে জুলাইয়ের চার তারিখে আদালতে এই মামলার হিয়ারিং এর তারিখ। দেখা যাক কোন পথে মামলা গড়ায় আর কতদিন চলে। আপাতত সব কিছু ঝড়ের আগে থমথমে শান্ত। অবশ্য ইতিমধ্যে ইএস পি এন একটি অন্য রিপোর্টে জানান, কিভাবে বিগত মাসের পর মাস ধরে কুস্তি ফেডারেশনের বিভিন্ন কাজে ও নির্দেশে কুস্তিগিরদের ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। বিশেষত তাঁদের অনেকেই প্রতিযোগিতার খারাপ ফলের জন্য কর্তৃপক্ষের বিবিধ সিদ্ধান্তকে দায়ী করেন। ইএসপিএনের মতে, তখন থেকেই আসলে এই আন্দোলন দানা বাঁধার শুরু।
এই বিষয়ে সকল প্রতিবেদন ও পাল্টা প্রতিবেদন পড়লে কখনও কখনও মনে হতেই পারে যে আসলে হয়ত যৌন নিগ্রহকে (সে ঘটনার সত্যতা নিয়ে অবশ্য খুব সম্ভবত শুধু বৃজভূষণ আর অযোধ্যার সাধুদেরই কেবল সন্দেহ আছে) সামনে রেখে আদতে এটা বৃজভূষণের প্রতি ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিদ্বেষজাত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা। আরও বলা হয়েছে, এটা আসলে উত্তরপ্রদেশ বনাম হরিয়ানার লড়াই। সেসব বিতর্কে ঢুকে লাভ নেই। কারণ তার সত্যতা নির্ধারণের যথেষ্ট রসদ নেই হাতে। আরও একটা সমস্যার জায়গা আছে। সেটা হল রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে বিরোধিতা করা। বিজেপি সমর্থকরা যেমন এই ঘটনার প্রথম থেকেই লেগে পড়েছেন সাক্ষী ভিনেশ প্রমুখের ছবি টবি দিয়ে প্রমাণ করছে তাঁরা মোটেই আদর্শ ভারতীয় নারী না (মানে যেন তাহলেই তাদের আনা অভিযোগ খণ্ডিত হয়ে যায়) অন্যদিকে যারা প্রবল বিরোধিতা চালাচ্ছে তারাও কিন্তু নিজের শাসনকালে বা নিজের পছন্দের জনের বিরুদ্ধে এইসব কথা উঠলে চেপেই যান। তখন আর তাদের ন্যায়ের কথা মনে পড়েনা। তাই এইসব রাজনৈতিক বুদ্ধি প্রণোদিত বিরোধিতা দেখলেই কেমন সন্দেহ জাগে। বরং অন্য দিকটা দেখা যাক।
দুটি ঘটনারই বিশদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালে এই দেশে যতই আর্থিক জোয়ার আসুক, যতই পশ্চিমা সভ্যতার অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানধারণার বদল ঘটেছে বলে জনতা হায় হায় করুক, আদতে আমাদের সমাজের একটা বড় অংশের স্থবির মনোবৃত্তির এবং সামাজিক মতামতের বিশেষ বদল ঘটেনি। বিশেষত ক্ষমতার স্বরূপের প্রশ্নে এদেশে পিরামিড আকারের ক্ষমতারই প্রধানত কদর আর পিরামিডের মাথায় ওঠার জন্য মারামারি। অন্য কোন রকম ক্ষমতার কথা এদেশে কলকে পায় না। আর কে না জানে, মাথায় একজনকে উঠতে গেলে আরও অনেক জনকে নীচে ফেলে রেখে যেতে হয়। এবার নিজের জায়গা দীর্ঘকাল ধরে বজায় রাখতে হলে নিজের মানের ক্রমোন্নয়ন একটা পথ হলেও সে পথ বন্ধুর। অলস লোকের পক্ষে তার চেয়ে সহজতর উপায় হল নিচের লোককে ঠেলে ঠুলে জোর করে নীচেই আটকে থাকতে বাধ্য করা। এই মডেলটাই যখন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যবহৃত হতে থাকে, তখন আর ভাবতেও হয় না। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারটাই তখন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে যায়।
এই দুর্বল বা সবল কিন্তু কোন অ্যাবসলুউট শব্দ না। পুরোটাই আপেক্ষিক। যার নিজের কোন ক্ষমতাই থাকে না, সেও কোন না কোন গোষ্ঠীর ক্ষমতা ধার করে সেই বলে বলীয়ান হতে চায়। আর সেই সঙ্গে এই ক্ষমতার লড়াইয়ের কোন লিঙ্গ বিভাজনও হয় না। সত্যিই যদি লিঙ্গ দিয়ে আদৌ কিছু ভিন্ন ভাবনার জন্ম হত, তাহলে অন্তত আমরা কাশ্মীরি বালিকার ধর্ষণের মামলায় জম্মুর এক বিশেষ দলের মহিলাদের অপরাধীর মুক্তির দাবিতে মিছিল করতে দেখতাম না। সেই মিছিলে মায়েদের সংখ্যারও কমতি ছিল না। এমনকি সংস্কৃতির জগতের বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে প্রতিপত্তিশালী মানুষের সামনে সবাই কত দ্রুত সব ভুলে যান। এমনকি পেটোয়া মহিলারাও তাদের পুনর্বাসনের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠেন। রাঠোরের স্ত্রীও যেমন রাঠোরকে আগাগোড়া সমর্থন করে গেছেন। সাক্ষীদের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তের ভার সরকার থেকে যাঁদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল, সেই ওভারসাইট কমিটির কিন্তু অধিকাংশ ছয়জনের মধ্যে চারজন ছিলেন মেয়ে। তাতে কী হল? কমিটির সামনে যারা সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলেন, তাদের কয়েকজন প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, সাক্ষ্য দেওয়ার সময় যে পরিবেশ ছিল সেই পরিবেশ মেয়েদের নির্ভয়ে মুখ খোলার সহায়ক নয়। সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বার বার নাকি ভিডিও ‘বন্ধ হয়ে’ যাচ্ছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। খোদ কুস্তিগিরদের ঘরের লোক, বর্তমানে রাজনীতির মানুষ, ববিতা ফোগতের কমিটিতে অন্তর্ভুক্তিও কিন্তু কোন সুরাহা করেনি। কারণ মেয়ে হলেও তো এঁরা কেউই প্রচলিত উলম্ব ক্ষমতার জগতের থেকে দূরে নন। প্রত্যক্ষেই হোক বা পরোক্ষে তদ্দজনিত সুবিধার অংশভোগী। ঠিক এই একই কারণে দলিত মেয়েদের উপরে অত্যাচারে উচ্চবর্ণের মেয়েরা অতি উৎসাহী হন।
খুব সত্যি কথা বলতে, যাঁরা এই সমস্যার কথা সামনে এনেছেন, আর সেই সঙ্গে নিজেদের কষ্টার্জিত সম্মানের প্রতীক মেডেলের বিসর্জন দিতে চেয়ে সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছেন তাঁদের প্রতিবাদের দিকে, তাঁরা নিজেরাও হয়ত বিশ্বাস করেন যে গায়ের জোরে বলীয়ান হলেই হয়ত সব পাওয়া যায়। পুরোনো এক ইন্টারভিউতে এই মেয়েদেরই একজন বলেছিলেন যে তাঁর সঙ্গে কেউ “পাঙ্গা” নিতে আসে না। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, উদীয়মান কুস্তিগিরদেরই কেউ কেউ যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ তাও একদল মেয়েরা সর্বত্র সব জায়গায় বলে বেড়ান, শারীরিক ও মানসিকভাবে পাল্টা মার দেওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে। তাহলেই নির্যাতন কমবে। তাই কি? বস্তুত অপর পক্ষকে পাল্টা মার দেওয়ার আগে পরিস্থিতি নিখুঁতভাবে খতিয়ে জয়ের সম্ভাবনা কতটা সেটা না বুঝে আগেই পাল্টা মার দিলে হয়ত নিজের সান্ত্বনা থাকে যে আমি মেরে মরেছি, কিন্তু সব সময় তাতে জাগতিক লাভ হবে এমন নয়। গভীর অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে দু তিন কিলোমিটার একা একা সাইকেল চালিয়ে রোজ বাড়ি ফিরতে হয় এমন মেয়ে শহরের আলো ঝলমলে পরিসীমার বাইরে অঢেল দেখা যায়। একদিন হয়ত মেরে ধরে পালিয়ে বাঁচবে, পরের দিন? তার পরের দিন? আহত বাঘের সম্মিলিত আক্রমণ, বা চোরা গোপ্তা অ্যাসিড আক্রমণ এর থেকে বাঁচার উপায়? এমনকি শিশুদের উপরও যৌন আক্রমণ হয়। কাশ্মীরের সেই শিশুটিকেও কি আমরা এই একই পাল্টা ধোলাই দেওয়ার সমাধান দেব? বা যে মেয়ে সঙ্গীতের মগ্ন সাধিকা তাকে বলব, তুমি নিবিড় সঙ্গীতচর্চা ছেড়ে আগে মার্শাল আর্ট শেখ?
আসলে ক্ষমতার শুধু বহুতলবিন্যস্ত রূপ ছেড়ে অন্য সকল রূপ (যেমন পারস্পরিক সহযোগিতার থেকে উদ্ভূত সমবন্টিত ক্ষমতা) আমরা দেখতেই শিখিনি। আর সমাজে এর ছাপ পড়ে প্রায় জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে। সম্ভবত এর সব থেকে কদর্য চেহারাটা হল গো-বলয়ের পহেলবান সংস্কৃতি। একে নিয়ে বাঙ্গালির নাক সিটকানোর অন্ত নেই। কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায় যে বাঙ্গালির সংস্কৃতি হয়ত আর একটু পেলব, আরও একটু মিশ্র স্বভাবের কিন্তু তারও মর্ম স্থলে ধরে রাখা আছে এই উলম্ব ক্ষমতার মর্মকথা।
আর এই উলম্ব ক্ষমতারই একটা বিষাক্ত প্রকাশ হল মেয়েদের উপর বিভিন্ন রকমের নির্যাতন। রাঠোর থেকে বৃজভূষণ সেই একই সামগ্রিক ও সামুদায়িক অভ্যাসের প্রতীক। মেয়ে বললাম বটে, কিন্তু তার কারণ হল মেয়েদের উপর কিছু কিছু নির্যাতনের দেখতে পাওয়ার চোখটা মুষ্টিমেয়ের হালের অর্জন। মুষ্টিমেয়র মাত্র, সকলের এখনও সে চোখ ফোটে নি। সব রকমের নির্যাতন আবার আমাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় আসে না। ব্যক্তির চেনা গণ্ডির বাইরের যে অভ্যাস তাকে নির্যাতন বলে চিহ্নিত করার জন্য যে মানসিক অনুশীলনের প্রয়োজন, সেটা কিন্তু সকলের সর্বদা থাকে না। এই মানসিক অনুশীলনের পর্বটি জটিল। মোটেই বিনা প্রস্তুতিতে অনায়াসসাধ্য নয়। এটা সব থেকে ভাল বোঝা যায়, যখন মেয়েদের বিভিন্ন খবর অযুত মিডিয়ার অনলাইন মাধ্যমে প্রকাশ পায়, তার তলায় রাশি রাশি কমেন্ট নামক মুক্ত ‘জাজমেন্টের’ আবর্জনা দেখলে। আর সেখানে প্রায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষেরই দেখা মেলে। তবু বলব, মেয়েদের খবর যদিও বা আজকাল বাজারে বিকোয় ভাল, তাই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়, বাকি অনেক প্রকার দুর্বলের উপর অত্যাচারই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। শারীরিক বা মানসিক সক্ষমতার বিস্তৃত বর্ণালীর বিভিন্ন অবস্থানের মানুষ বা লিঙ্গ-ভাবনার বিভিন্নতার মানুষের দিকে অথবা শিশু বা বয়স্কদের প্রতি কতটা অত্যাচার ধেয়ে আসে সেটা এখনও বেশির ভাগ সময়েই আমাদের কান অবধি এসে পৌঁছায় না। কারণ আমাদের কান এখনও সেকথা শোনার জন্য তৈরি হয়নি। আর যেসব ফিল্টার চুয়ে সেইসব খবর জনগণের কানে এসে পৌঁছায়, সেই ফিলটার সকলও প্রাচীন গতানুগতিক সবলতা, সক্ষমতা, স্বাভাবিকত্বের মতবাদের ভারে জীর্ণ।
প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে দেশি ও আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থান উন্নততর বা স্থানীয় আরক্ষা দপ্তরকে আরও শক্তিমান করে হয়ত কিছুটা লাভ হবে আর সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক অন্য আরও দশটা লাভ হতে পারে, কিন্তু কোন স্থায়ী সমাধান আসবে কি? তথাকথিত শিক্ষার পথেও তো কিছুটা হেঁটে দেখা হয়েছে, তাতেও খুব বদল হয়েছে কি? মূল খোল নলচের দিকে নজর দেওয়ার সময় কি এখনও আসেনি? আমরা সাধারণতঃ বিভিন্ন ক্ষমতার দ্বন্দ্বমূলক সমস্যাকে আলাদা আলাদা ভাবে দেখে তাদের আলাদা আলাদা করে সমাধানের চেষ্টা করি। তাই আমাদের ভাষ্যে নারীদের সমস্যা আলাদা, দলিতদের সমস্যা আলাদা, সংখ্যালঘুর সমস্যা আলাদা – চেষ্টা করা হয় সেই সব আলাদা আলাদা সমস্যার আলাদা আলাদা সমাধান খুঁজতে। কিন্তু যদি একটু অন্যভাবে ভাবা যায়? আমরা যেভাবে ক্ষমতা ও তার বিন্যাসকে দেখি, সেখানেই কী আদতে সকল সমস্যার মূল কারণ নিহিত থাকতে পারে?
অথচ আমাদের দেশের ইতিহাসেই কিন্তু এমন কিছু কিছু ভিন্নতর ক্ষমতার হদিশ ছিল। যেমন পড়েছি যে কোন কোন আদিবাসী সমাজে নাকি প্রত্যেকে একমত হলে তবেই একমাত্র কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। যতক্ষণ না আলোচনার পরে আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যেকটা মানুষ সহমত হচ্ছে, ততক্ষণ অবধি আলোচনা চলতেই থাকত। এফিসিয়েন্ট প্রথা নয় সেতো সহজবোধ্য। কিন্তু এতে সব রকম ভেদাভেদ নির্বিশেষে সকলের মতামতের যে অসীম মূল্য থাকে, আর সেই সঙ্গে অপরের কথা মন দিয়ে শোনার ও যুক্তিবোধের যে অভ্যাস তৈরি হয় সেই পরিবেশই তো মানুষকে আরও দায়িত্ববান, আরও পরিণত হতে শেখায়। সন্তোষ রানার আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, এই রকম ভাবে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ হাতে কলমে প্র্যাকটিস করতেন এমন জনজীবনের অস্তিত্ব গত শতকেও ছিল, কোনও কোনও পকেটে। সমাধানের আর সব আধা-আন্তরিক চেষ্টা যখন বৃথা প্রমাণিত হয়েছে, এই রকম বা আরও উন্নততর কোন বিকল্প ক্ষমতার বণ্টনের কথা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপায় হিসেবে কি ভাবনাচিন্তা করা যায়? যার ফলে বৃহত্তর সংখ্যক মানুষকে একই তলে আনা যাবে?