কেউ কেউ থাকে না, যাকে দেখলেই মনে হয় যেন এই মাত্র সাত সমুদ্র তেরো নদী উজিয়ে এলো, পায়ে ধুলো, লম্বা দাড়ি, নির্ঘুম লাল চোখ, আলখাল্লার মতো পাঞ্জাবি আর কাঁধে একটা ময়লা ঝোলা। সিলেটি কাকু ছিলেন সেইরকম লোক। প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল এর নাম ইবন বতুতা, বা আমেরিগো ভেসপুচি না হয়েই যায় না...
সিলেটি কাকু যখন প্রথম আমাদের বাড়িতে এলেন, আমার তখন বন্ধুদের সাথে এক্কা দোক্কার ম্যাচ চলছে। টান টান উত্তেজনা, তুমুল ঝগড়া। তার মধ্যেই কে একটা যাযাবরের মতো দেখতে লোক, বাড়িতে এসে জাঁকিয়ে বসে মায়ের হাতের গরম গরম লুচি খেতে খেতে কোন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের মাঠ, নদী, খাল বিল নিয়ে, মাঝি, মাল্লা, জেলেনৌকো নিয়ে, আম চুরি আর নাড়ু কোটা নিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে দেখতে গিয়ে শুনলাম, ইনি আমার বাবার ছেলেবেলার প্রিয় বন্ধু। আমার বাবার মতোই ইনিও সেই প্রজন্মের লোক, যাদের শৈশব কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে রয়ে গেছে... স্বপ্নে যাঁদের প্রায়ই ফিরে ফিরে আসে ভিন দেশে রয়ে যাওয়া সেই বাড়ির আদল, নাটমন্দির, সুদক্ষ তুলিতে টানা দুগ্গা ঠাকুরের চোখ....
অল্প দিনের মধ্যেই আমার আর আমার খুদে বন্ধুদের মন জয় করে নিলেন এই মানুষটি। নিজেই নিজের নামকরণ করলেন, সিলেটি কাকু।
আমরা যখন ভারতের কোন রাজ্যে কত ধান চাষ হয় আর কোন অঞ্চলে কোন আকরিক পাওয়া যায় তাই মুখস্থ করছি, তখন সিলেটি কাকু ঠোঙা ভর্তি মুড়ি আর আলুর চপ নিয়ে মাটিতে আয়েশ করে বসে বলতেন - বল তো রবিন হুড কোন জঙ্গলে ডেরা বেঁধেছিলো? আমাদের যখন মুঘল সাম্রাজ্য পতনের সতেরোটি কারণ গলাধঃকরণ করতে গিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত তখন কাকু কানে কানে ফিস ফিস করে বলতেন রামায়ণের বিভীষণ কিন্তু অমর ছিল, মনে আছে তো? বিভীষণ এখন বি বি সেন নামে পরিচয় দেয়, বৌবাজারের ওদিকে থাকে। বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর ফোকাস করার জন্য বড়োরা যখন গম্ভীর উচ্চস্বরে বলতেন - "না না ওসব ভূত টুত সব বাজে কথা" ভূত বলে কিছু নেই " তখন সিলেটি কাকু গলা নামিয়ে বলতেন - কে বলে ভূত নেই? আলবাত ভূত আছে। এই তো আমার বাড়ির পাশের কবরখানার ভূত মেরি তো রোজ আমার সাথে কথা বলে... আর জানো না ভুলভুলাইয়ার গোলক ধাঁধা থেকে কে বার করে নিয়ে এসেছিলো হাসিনা খাতুন আর ক্যাপ্টেন আওকে? হাসিনা খাতুন আর ক্যাপ্টেন আও কারা কাকু?" "ক্যাপ্টেন আও একজন নাগা সৈনিক আর হাসিনা খাতুন ট্রেনে ট্রেনে গান গায়..." ঝাঁ চকচকে নতুন নতুন গল্প বেরিয়ে আসতো কাকুর ঝোলা থেকে।
আমাদের বারান্দার সামনে ভাঙা ইঁট বার করা পোড়োবাড়ি জানলার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকা আমরা যখন হুড়মুড় করে পালিয়ে আসতাম হঠাৎ কোনো কল্পিত শব্দ শুনে, বাড়ির বড়োদের ভুরু কুঁচকে উঠত। সিলেটি কাকু কিন্তু বলতেন - উঁহু, দিনের বেলা নয়, জ্যোৎস্না রাত্রে যদি তাকিয়ে দ্যাখো ওই জানলার দিকে, দেখবে সে আসবে।
এডওয়ার্ড লিয়ারের নীল মাথা আর সবুজ হাত ওয়ালা লোক গুলো ছাঁকনি চেপে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নাম কিনেছিলো। সুকুমার রায়ের হযবরলয় দেড়-হাতি বুড়োর বয়েস চল্লিশের ওপরে যেত না। Alice এর গল্পে লুই ক্যারলের চেশার ক্যাট - নিজের হাসিটিকে দৃশ্যমান রেখে নিজেকে ভ্যানিশ করে ফেলতে পারতো, যাকে দেখে Alice বলেছিল - she has often seen a cat without a grin but never a grin without a cat. বেড়াল আছে হাসি নেই, হতে পারে, কিন্তু হাসি আছে বেড়াল নেই এ আবার কি তাজ্জব ব্যাপার। এঁদের মধ্যে যে ছোট্ট ছেলেটি ছিল, যে কোনোদিন বড়ো হতে চাইতো না, সিলেটি কাকুর মধ্যেও তাকে উঁকি দিতে দেখেছি আমি বহুবার, জীবনের বহু ঘাত প্রতিঘাত, উথাল পাথালের পরেও। "মানুষ মরে গিয়ে তো ভূত হয়, ভূত মরে গিয়ে কি হয় বলতো?" কি হয় কাকু? "ভূত মরে গিয়ে হয় কিম্ভূত"। আর কিম্ভূত মরে গেলে? "কেন? অদ্ভুত"!
অপরাজিতর অপুর মতো, বৃহত্তর পৃথিবীর ডাক পেয়ে কখন কাকুর কাছ থেকে দূরে সরে গেছি খেয়াল করি নি। চোখে পড়েনি কখন এই জীবনের সব সমস্যাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো, অফুরন্ত গল্পে আর খুশিতে ভরা মানুষটি বৃদ্ধ হলেন। সাত রাজ্যের ধুলো মাখা পায়ে, যে ছেলেটি চরকির মতো ঘুরতো বহু দূরের সেই নদী নালা ভরা গ্রামের পথে পথে, যে একদিন কাঁচা বাঁশ ভর্তি নোঙর করা নৌকা খুলে দিয়ে পালিয়েছিলো, যে শত সংগ্রামের মধ্যেও বীরের মতো নিজের বালকবেলাকে কখনো হারিয়ে যেতে দেয়নি, তার চোখের জ্যোতি যে কমে এসেছে সেকথা মনে ছিল না। তাই ধাক্কা লাগলো যেদিন সিলেটি কাকু আর থাকলেন না। কত গল্প যেন বলা হলো না, কত কাহিনী শোনা বাকি থাকলো... প্ল্যানচেট এ শার্লক হোমস কে ডাকা হলো না, বিভীষণ ওরফে বি বি সেন এর ইন্টারভিউটা অসম্পূর্ণই রয়ে গেলো...
সেদিন রাত্রে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো সিলেটি কাকু যেন বলছেন - "কোথাও যাই নি রে পাগলী, মনে নেই ভূত, কিম্ভূত আর অদ্ভূতের কথা? তোর ছেলেবেলার মধ্যেই রয়ে গেছি আমি। দেখিস, ছেলেবেলাটা যেন ফুরিয়ে না যায়। ওটাই সেই সোনার কাঠি, যেটা ছুঁইয়ে দিলেই বিশ্বাস হয়, রূপকথা, ভূত, প্ল্যানচেট সব আছে, সব সত্যি। দত্যি দানো, ফাদার ব্রাউন, শার্লক হোমস, স্কারলেট পিম্পেরনেল, রবিন হুড সবাই সত্যি। আর সত্যি পিটার প্যান, যে কখনো বড়ো হতে চায় না।"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।