এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  স্মৃতিচারণ  নস্টালজিয়া

  • সিলেটি কাকু

    Amrita Ray লেখকের গ্রাহক হোন
    স্মৃতিচারণ | নস্টালজিয়া | ১৪ এপ্রিল ২০২৩ | ১৬৮৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • কেউ কেউ থাকে না, যাকে দেখলেই মনে হয় যেন এই মাত্র সাত সমুদ্র তেরো নদী উজিয়ে এলো, পায়ে ধুলো, লম্বা দাড়ি, নির্ঘুম লাল চোখ, আলখাল্লার মতো পাঞ্জাবি আর কাঁধে একটা ময়লা ঝোলা। সিলেটি কাকু ছিলেন সেইরকম লোক। প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল এর নাম ইবন বতুতা, বা আমেরিগো ভেসপুচি না হয়েই যায় না...

    সিলেটি কাকু যখন প্রথম আমাদের বাড়িতে এলেন, আমার তখন বন্ধুদের সাথে এক্কা দোক্কার ম্যাচ চলছে। টান টান উত্তেজনা, তুমুল ঝগড়া। তার মধ্যেই কে একটা যাযাবরের মতো দেখতে লোক, বাড়িতে এসে জাঁকিয়ে বসে মায়ের হাতের গরম গরম লুচি খেতে খেতে কোন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের মাঠ, নদী, খাল বিল নিয়ে, মাঝি, মাল্লা, জেলেনৌকো নিয়ে, আম চুরি আর নাড়ু কোটা নিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে দেখতে গিয়ে শুনলাম, ইনি আমার বাবার ছেলেবেলার প্রিয় বন্ধু। আমার বাবার মতোই ইনিও সেই প্রজন্মের লোক, যাদের শৈশব কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে রয়ে গেছে... স্বপ্নে যাঁদের প্রায়ই ফিরে ফিরে আসে ভিন দেশে রয়ে যাওয়া সেই বাড়ির আদল, নাটমন্দির, সুদক্ষ তুলিতে টানা দুগ্গা ঠাকুরের চোখ....
     
    অল্প দিনের মধ্যেই আমার আর আমার খুদে বন্ধুদের মন জয় করে নিলেন এই মানুষটি। নিজেই নিজের নামকরণ করলেন, সিলেটি কাকু।
     
    আমরা যখন ভারতের কোন রাজ্যে কত ধান চাষ হয় আর কোন অঞ্চলে কোন আকরিক পাওয়া যায় তাই মুখস্থ করছি, তখন সিলেটি কাকু ঠোঙা ভর্তি মুড়ি আর আলুর চপ নিয়ে মাটিতে আয়েশ করে বসে বলতেন - বল তো রবিন হুড কোন জঙ্গলে ডেরা বেঁধেছিলো? আমাদের যখন মুঘল সাম্রাজ্য পতনের সতেরোটি কারণ গলাধঃকরণ করতে গিয়ে  প্রাণ ওষ্ঠাগত তখন কাকু কানে কানে ফিস ফিস করে বলতেন রামায়ণের বিভীষণ কিন্তু অমর ছিল, মনে আছে তো? বিভীষণ এখন বি বি সেন নামে পরিচয় দেয়, বৌবাজারের ওদিকে থাকে। বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর ফোকাস করার জন্য বড়োরা যখন গম্ভীর উচ্চস্বরে বলতেন - "না না ওসব ভূত টুত সব বাজে কথা" ভূত বলে কিছু নেই " তখন সিলেটি কাকু গলা নামিয়ে বলতেন - কে বলে ভূত নেই? আলবাত ভূত আছে। এই তো আমার বাড়ির পাশের কবরখানার ভূত মেরি তো রোজ আমার সাথে কথা বলে... আর জানো না ভুলভুলাইয়ার গোলক ধাঁধা থেকে কে বার করে নিয়ে এসেছিলো হাসিনা খাতুন আর ক্যাপ্টেন আওকে? হাসিনা খাতুন আর ক্যাপ্টেন আও কারা কাকু?" "ক্যাপ্টেন আও একজন নাগা সৈনিক আর হাসিনা খাতুন ট্রেনে ট্রেনে গান গায়..."  ঝাঁ চকচকে নতুন নতুন গল্প বেরিয়ে আসতো কাকুর ঝোলা থেকে।

    আমাদের বারান্দার সামনে ভাঙা ইঁট বার করা পোড়োবাড়ি জানলার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকা আমরা যখন হুড়মুড় করে পালিয়ে আসতাম হঠাৎ কোনো কল্পিত শব্দ শুনে, বাড়ির বড়োদের  ভুরু কুঁচকে উঠত। সিলেটি কাকু কিন্তু বলতেন - উঁহু, দিনের বেলা নয়, জ্যোৎস্না রাত্রে যদি তাকিয়ে দ্যাখো ওই জানলার দিকে, দেখবে সে আসবে।
     
    এডওয়ার্ড লিয়ারের নীল মাথা আর সবুজ হাত ওয়ালা লোক গুলো ছাঁকনি চেপে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নাম কিনেছিলো। সুকুমার রায়ের হযবরলয় দেড়-হাতি  বুড়োর বয়েস  চল্লিশের ওপরে যেত না। Alice এর গল্পে লুই ক্যারলের চেশার ক্যাট - নিজের হাসিটিকে দৃশ্যমান রেখে নিজেকে ভ্যানিশ করে ফেলতে পারতো, যাকে দেখে Alice বলেছিল - she has often seen a cat without a grin but never a grin without a cat. বেড়াল আছে হাসি নেই, হতে পারে, কিন্তু হাসি আছে বেড়াল নেই এ আবার কি তাজ্জব ব্যাপার। এঁদের মধ্যে যে ছোট্ট ছেলেটি  ছিল, যে কোনোদিন বড়ো  হতে চাইতো না, সিলেটি কাকুর মধ্যেও তাকে উঁকি দিতে দেখেছি আমি বহুবার, জীবনের বহু ঘাত প্রতিঘাত, উথাল পাথালের পরেও। "মানুষ মরে গিয়ে তো ভূত হয়, ভূত মরে গিয়ে কি হয় বলতো?" কি হয় কাকু? "ভূত মরে গিয়ে হয় কিম্ভূত"। আর কিম্ভূত মরে গেলে? "কেন? অদ্ভুত"!
     
    অপরাজিতর অপুর মতো, বৃহত্তর পৃথিবীর ডাক পেয়ে কখন কাকুর কাছ থেকে দূরে সরে গেছি খেয়াল করি নি। চোখে পড়েনি কখন এই জীবনের সব সমস্যাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো, অফুরন্ত গল্পে আর খুশিতে ভরা মানুষটি বৃদ্ধ হলেন। সাত রাজ্যের ধুলো মাখা পায়ে, যে ছেলেটি চরকির মতো ঘুরতো বহু দূরের সেই নদী নালা ভরা গ্রামের পথে পথে, যে একদিন কাঁচা বাঁশ ভর্তি নোঙর করা নৌকা খুলে দিয়ে পালিয়েছিলো, যে শত সংগ্রামের মধ্যেও বীরের মতো নিজের বালকবেলাকে কখনো হারিয়ে যেতে দেয়নি, তার চোখের জ্যোতি যে কমে এসেছে সেকথা মনে ছিল না। তাই ধাক্কা লাগলো যেদিন সিলেটি কাকু আর থাকলেন না। কত গল্প যেন বলা হলো না, কত কাহিনী শোনা বাকি থাকলো... প্ল্যানচেট এ শার্লক হোমস কে ডাকা হলো না, বিভীষণ ওরফে বি বি সেন এর ইন্টারভিউটা অসম্পূর্ণই রয়ে গেলো...

    সেদিন রাত্রে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো সিলেটি কাকু যেন বলছেন - "কোথাও যাই নি রে পাগলী, মনে নেই ভূত, কিম্ভূত আর অদ্ভূতের কথা? তোর ছেলেবেলার মধ্যেই রয়ে গেছি আমি। দেখিস, ছেলেবেলাটা যেন ফুরিয়ে না যায়। ওটাই সেই সোনার কাঠি, যেটা ছুঁইয়ে দিলেই বিশ্বাস হয়, রূপকথা, ভূত, প্ল্যানচেট সব আছে, সব সত্যি। দত্যি দানো, ফাদার ব্রাউন, শার্লক হোমস, স্কারলেট পিম্পেরনেল, রবিন হুড সবাই সত্যি। আর সত্যি পিটার প্যান, যে কখনো বড়ো হতে চায় না।"
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • স্মৃতিচারণ | ১৪ এপ্রিল ২০২৩ | ১৬৮৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:২৬518629
  • মন কেমনিয়া লেখা।
  • Amrita Ray | ১৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:১২518651
  • ধন্যবাদ !
  • π | ১৫ এপ্রিল ২০২৩ ২২:৪৭518687
  • সিলেটি কাকুর গল্পগুলো আসুক... 
  • aranya | 2601:84:4600:5410:89b2:e6f5:7a7e:***:*** | ১৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:৫১518717
  • বাঃ 
  • Amrita Ray | ১৭ এপ্রিল ২০২৩ ২২:৫৪518799
  • আলাদা আলাদা করে কিভাবে উত্তর দেব মালুম হচ্ছে না। কয়েকদিন নাড়াচাড়া করলে হয়তো বুঝতে পারবো। আপাতত দুজনকে একসাথেই বলছি - খুব ভালো লাগলো জেনে যে এই লেখাটি আপনাদের ভালো লেগেছে। অনেক ধন্যবাদ বন্ধুরা।
  • Mihir Kumar Das | 160.238.***.*** | ২১ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:১৩518886
  • অদ্ভুত সুন্দর
  • অমৃতা | 45.25.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:৩৬518959
  • অজস্র ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।
  • Biswadeep Gupta | 2409:4066:dc1:300e::2a09:***:*** | ১৯ মার্চ ২০২৪ ০৫:১৫529583
  • Nostalgic.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন