মধ্যদিনে যশোর রোড ঝ্লসে যাচ্ছিল- যেন আধপোড়া ময়াল, খোলস থেকে ধোঁয়া উঠছে। পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, আর্তনাদ আর যতেক ছটফটানি চাপা পড়ে যাচ্ছিল ব্যস্ত ট্রাফিকে। দুপুরের রোদের স্বাভাবিক প্রতিসরণ ঘটছিল। ফলে পোড়া অ্যাসফল্টও ভেজা ঠেকছিল শহরের চোখে। প্রাচীন সরণিকে নিজের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারছিলাম। এয়ারপোর্টের কাছে একটা গাছতলায় অপেক্ষা করছি - কার্গোতে স্পাইয়ের বডি আসবে, খবর ছিল ; গত রাতে আমার কাছে ফোন এসেছিল- স্পাই নেই, আমি যেন এয়ারপোর্টে আসি । কে ফোন করেছিল, কোথা থেকে করেছিল জানি না- জানার চেষ্টাও করি নি- কারণ সেরকমই কথা ছিল। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও স্টাইলে স্পাই বলত, এই সব মানডেন ব্যাপারে যত মাথা ঘামাবে, তোমার লেখায় মেদ জমবে তত। কে কী করে, কোথায় থাকে -জেনে কী লাভ। লেখায় মন দাও। সবটুকু। তোমার নিজস্ব একটা শহর হোক, নদী হোক।
আমার কোনো নদী ছিল না, শহরও নয়। অথচ লেখক হতে গেলে নিজস্ব নদী ও শহর থাকা জরুরী। এসব কথা আমাকে সে বলেছিল। স্পাই। গুপ্তচর শব্দটা সে পছন্দ করত না, বড্ড ভারি আর আড়ম্বরপূর্ণ- কত বেশি বলা আছে; বলত, “স্পাই কত হালকা শব্দ- ভাওয়েল অবধি নেই- চড়াইপাখির মতো -ফুরুৎ করে এই ডালে বসল , তো ও বাড়ির কার্ণিশে কী টিভির অ্যান্টেনায়, তুমি খেয়ালও করছ না, অথচ চড়ুই সব দেখে নিচ্ছে - তোমার ঘর দোর, তোমার ডে টু ডে রুটিন। দেখো, কোন শব্দটা ভারি, কোনটা হাল্কা, কোনটা সুগন্ধি, কোন শব্দে দীপ্তি, কোনটায় মালিন্য- এসব তোমাকে চিনতে হবে। স্পাইরা যেমন চট করে চিনে নিতে পারে কে শত্রু কে মিত্র। জেমস বন্ড দেখো নি? “
আশপাশের ঢ্যাঙা ঘরদোর ছাড়িয়ে সূর্য একদম স্ট্রেট লাইনে আকাশে এখন। স্পাইয়ের বডি নিয়ে আমার কী করা উচিত ভাবছিলাম- খুব যে কান্না পাচ্ছিল তা নয়। ঘটনাটা প্রত্যাশিত কারণ, সবাই জানে স্পাইরা একদিন কোনো অজানা দেশে আচমকা মরে যায়। নো টাইম টু ডাই বলেও জেমস বণ্ড মারা গিয়েছিল সী অফ জাপান না কোথায়। অ্যাকচুয়ালি, আমি স্পাইয়ের ডেডবডি দেখতে চাইছিলাম; এই রকম একটা ডেথ হয়তো একজন স্পাইয়ের আইডেনটিটি কনফার্ম করে। আমি ঘড়ি দেখলাম। একটা পাখি উড়ে গেল খুব কাছ দিয়ে, তার ডানায় হাওয়া কাটার আওয়াজ । ফ্লাইট নামতে দেরি এখনও।
আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে প্লেন দেখতাম; নামা ওঠা বোঝা যেত বডি ল্যাঙ্গুয়েজে। মুখ মাটির দিকে, ডানা কাত হচ্ছে ক্রমশ- এ প্লেন নামবে এখন। নাক উঁচু করে উড়ে গেল মানে টেক অফ করেছে সদ্য। পুরোনো কম্পাসে দিক চিনে নিতাম। ছুটির দিনে উড়োজাহাজের এই সব নামা ওঠার হিসেব রাখতাম আমি। একটা প্যাটার্ন তৈরি হত- সকালে কুড়িটা প্লেন উত্তর দিকে গেছে, সতেরোটা পশ্চিমে, পনেরোটা দক্ষিণের দিকে, সন্ধ্যের মুখে উত্তর থেকে হয়তো পনেরোটা ফিরল , স্রেফ দশটা পশ্চিম থেকে- এইরকম আর কী। অন্ধকার হয়ে গেলে শব্দ শুনে সংখ্যার আন্দাজ পেতাম, যদিও টিভির আওয়াজ, প্রেশার কুকারের সিটি, কুকুরের ডাক, রিক্শার হর্নের দাপটে ঘরে বসে দিকের হদিশ পাওয়া টাফ ছিল; একটা অসমাপ্ত নকশা তৈরি হত ফলত বদলেও যেত প্রতিদিন- এই সব হিসেব না মেলা সংখ্যাদের জ্যান্ত দেখাতো- আলাদা রং, আলাদা শেপ- যেন একটা বোর্ড গেমের ঘুঁটি সব- খেলার নিয়ম তৈরি হওয়ার অপেক্ষা করছে; মনে হত, আমাকেই এই গেমের রুল ঠিক করতে হবে- তার আগে নকশাটা চিনে নেওয়া খুব জরুরী । নকশা বা একটা গল্প -স্পাই বলেছিল।
সেদিন আকাশে ঘন মেঘ- প্রবল বৃষ্টির পূর্বাভাষ; অঙ্ক কষতে কষতে প্লেনের আওয়াজ পেয়েই জানলায়। নিচে স্পাই দাঁড়িয়েছিল- সে তখন আমার কাছে জাস্ট একজন লোক। বলেছিল- "বেলুচিস্তান থেকে আসছি।" তারপরেই হেসে বলল- "জোকিং, জাস্ট জোকিং। পুলিশ ডেকো না যেন। আমি তোমার বাবার ছাত্র। ভিতরে আসতে পারি?"
বাড়িতে বাবা আর মা র ছাত্র ছাত্রী প্রায়ই আসত- নতুন পুরোনো। আমি বললাম, "আসুন, বাবাকে কী নাম বলব?" সে বলল- "খোকন, বলো খোকন এসেছে।" বাবা খাতাপত্র থেকে মুখ তুলে ভুরু কুঁচকেছিল," খোকন? মনে পড়ছে না কিছু। বসিয়েছিস? যাচ্ছি দাঁড়া।" বাবাকে প্রণাম করেছিল স্পাই, কোন বছর পাশ করেছে, ঐ সময়ের গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্র ছাত্রীদের নাম বলেছিল।
- তোমার ভালো নাম কী?
-খোকন, স্যার।
- ও
- আমি তেমন চোখে পড়ার মতো কিছু ছিলাম না স্যার, তাই হয়তো ...
বাবাকে বিব্রত দেখাচ্ছিল, বলছিল, ছাত্র তো বটেই নিশ্চয়ই তুমি আমার ছাত্র। বোসো। চা খাও। এখন কী করছ?
- প্রাইভেট অরগানাইজেশনে আছি। আই টি তে।
এই সময় বাবার ফোন এল। আর চা খেতে খেতে আমার সঙ্গে কথা শুরু করল স্পাই - "কী করছ? অঙ্ক? বাবার মতো হতে চাও? না মা র মতো? "
লোকটাকে খুব আপন লাগল আমার। ঐ বয়সে সব বাচ্চাই যেমন নিজেদের ড্রয়িং খাতা, খেলনা অতিথিকে দেখাতে থাকে, তার পাশে দাঁড়িয়ে অচেনা মানুষের গায়ের গন্ধ নেয়, তার জামা কাপড় , পায়ের গোড়ালি খুঁটিয়ে দেখে- আমিও তেমন প্লেনের হিসেব সম্বলিত খাতা খুব আগ্রহের সঙ্গে স্পাইকে দেখালাম। স্পাই কিছুক্ষণ খাতার হিসেব দেখল , তারপর ডাক্তার যেমন রোগী দেখে ঠিক তেমন চেয়ে রইল আমার চোখের দিকে। এই সময় রাস্তা দিয়ে হর্ন বাজিয়ে একটা রিক্সা গিয়েছিল। স্পাই বলল, " কী বলল, বলতো?"
-প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক
-পথিক তুমি পথ ছেড়ে দাও প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁকর প্যাঁকর-
-ভ্যাট, এই সব আবার কখন বলল?
- বলেছে, তুমি শুনতে পাও নি-
আমার ভয় করে উঠল-" তুমি শুনতে পেলে আর আমি পেলাম না? আমার কি অসুখ করেছে?”
-শুনতে চাইতে হয়- মন দিয়ে শুনতে চাইতে হয়- তোমার অর্ধেক মন এখন এই খাতায়, কোয়ার্টার অংশে আমার নাম, বাকিটা ভাবছে, এই লোকটা চলে গেলেই বাবাকে জিজ্ঞেস করব-হ্যাঁ বাবা, তোমার ছাত্র? সত্যি? তাই তো? তাই না?
ততদিনে অন্তর্যামী শব্দটা স্কুলে শিখে ফেলেছি। অ ন ত র অক্ষরগুলো উইপোকাদের মতো উড়তে লাগল মাথার মধ্যে। মুখে বলেছিলাম, "- আমি শুনতে চাই”
-জানি
-কী করে জানলে?
-গেস।
তারপর, চুপ করে আছি দেখে নিজেই বলল, "উড়োজাহাজের হিসেব দেখে। "
বাবা ফিরে এসেছিল এই সময়।
স্পাই যখন চলে যাচ্ছে, এ’বাড়ির নিয়মমতো , চেঁচিয়ে বললাম- "আবার এসো।" সে বলল- "আসব।"
পরদিনই এসেছিল। দুপুরে। বলেছিল, "ছাতা ফেলে গেছি।" না পেয়ে বলেছিল, "তবে বাসে ফেলে এসেছিলাম হয়তো।" ঐ যে বলল হয়তো- আমার কেমন মায়া পড়ে গেল ওর ওপর। বাবা না বলতেই জল দিলাম, মিষ্টি দিলাম । পাখার রেগুলেটর বাড়িয়ে দিলাম আরো দু পয়েন্ট। সে মাথা চুলকে বলল, " লিখছ না?"
-কী লিখব?
-উড়োজাহাজের গল্প?
এর প্রায় বছর পনেরো পরে সত্যি সত্যি এরোপ্লেনের গল্প লিখে ফেলেছিলাম- আমার দশ নম্বর গল্প। একটা পত্রিকায় ছাপা হল, প্রশংসাও শুনলাম এদিক ওদিক। সে রাতে ফোন এলো একটা- ল্যান্ডলাইনে। আমি-ই ধরেছিলাম। লাইনে ডিস্টার্ব্যান্স - শোঁশো শোঁশো ঝড়ের আওয়াজ , বাজ পড়েছিল দু’বার।
- গল্পটা লিখতে এতদিন লাগল?
- আপনি কে বলছেন?
-গেস
একটা শব্দে ফিরে এল সেই দুপুর, বাবা, আর খোকন নামের একজন লোক যাকে কেউ প্লেস করতে পারে না।
- আপনি খোকন বাবু?
বাজের শব্দের মধ্যে দিয়ে একটা হাল্কা হাসি ভেসে এসেছিল- " আমার আসল নাম খোকন নয়। নাম ধামের মতো মানডেন ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না কখনও । শুধু লিখে যাও।
-বাবাকে দিই?
-না না, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম।
-আপনি কোথা থেকে বলছেন? ঝড় হচ্ছে ওখানে?
-এই তো শুনতে শিখেছ। জায়গার নাম দিয়ে কী হবে? একটা জায়গা যেখানে এখন দুর্যোগ- সেখান থেকে ফোন এসেছে তোমার কাছে- এর বাইরে সব বাড়তি-
"আপনি আইটিতে ছিলেন তাই না? অফশোরে এখন"? স্মার্টনেস দেখাতে চাইলাম।
- আমি কখনও আইটি, কখনও বেকার, কখনও পুলিশ, কখনও চোর
লোকটা কী ইয়ার্কি করছে রে বাবা! মাতাল নাকি?
-মানে?
-তুমিও তো তাই। কখনও প্লেন, কখনও বিড়াল, কিম্বা বাঘ, কখনও নায়ক, কখনও নায়িকা-
-হ্যাঁ, সে তো গল্পে...
কথার মাঝপথেই হো হো করে হাসল সে- "আমি একজন স্পাই। লিখতে গেলে তোমাকে তাই হয়ে উঠতে হবে।"
কেটে দিল ফোনটা। র ট তে কাজ করে হয়তো। আর কিছু ভাবি নি।
একটা প্রাইজ পেলাম - ছোটো গল্পে নবীন প্রতিভাদের দেয় - মোটামুটি প্রেস্টিজিয়াস। সে রাতে আবার ফোন- আমার মোবাইলে সটান। আজ লাইন পরিষ্কার। একবার শুধু মনে হল- মালগাড়ির শান্টিংএর আওয়াজ পাচ্ছি।
- নম্বর পেলেন কোথায়?
-গেস
স্পেসিফিক কিছুই গেস করতে পারলাম না - আবছা মনে হল, পাবলিশারের থেকে জোগাড় করেছে হয়তো- চুপ করে রইলাম।
-কনগ্র্যাটস।
"থ্যাঙ্কু" বলে মনে হল, লোকটা এত খবর রাখে! র আমাকে ওয়াচ করছে নাকি রে বাবা!
- প্রাইজ পেয়ে খুশি?
- হ্যাঁ মানে তা তো একটু বটেই-
- মোটামুটি ভালই লিখছ, তবে তোমার গল্পের বড়ো খামতি কী জানো?
- কী?
-সেভাবে প্রেম থাকে না-
- থাকে তো- এই তো ...ঐ যে ….
- বড্ড সাজানো। ফ্ল্যাট। অক্ষরই শুধু। বই থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে না, হাঁটাহাঁটি করে না- জ্যান্ত নয়। তুমি প্রেম করো না? করো নি কোনদিন? ব্রেক আপ হয় নি?
আমি চুপ করে রইলাম। মাঝরাতে অচেনা লোকের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথা বলার অর্থ হয় না- লাইন কেটে দেব না কী ভাবছি-
-তোমার গল্পে চুমু আছে, সেক্স আছে, সেই সময়ের অনুভূতি নিয়ে চমৎকার সব বাক্য পর পর- কিন্তু পাঠক কিচ্ছু ফীল করে না-
আমার বিরক্ত লাগছিল।
-খারাপ লাগছে শুনতে? কিন্তু এটা ফ্যাক্ট। চুমুর শব্দ নেই, জিভে স্বাদ পাওয়া নেই, শীৎকারে তীব্রতা নেই, ঘাম, সিক্ততা টের পাওয়া যায় না- লাইফলেস। মোমেন্টগুলো ধরতেই পারো নি। তুমি কোনোদিন কাউকে ভালোবাসি বলো নি।
একটা স্টেটমেন্টের মতো শোনালো - ভোঁতা হাতুড়ি দিয়ে হৃদপিণ্ডে যেন ঘা দিল কেউ।
-প্রেম করবে আমার সঙ্গে?
-হোয়াট?
শান্টিংএর আওয়াজের মধ্যে দিয়ে যেন শুনলাম- "আই লাভ ইউ।"
ফোন রেখে দিল স্পাই। কিম্বা কেটে গিয়েছিল লাইন ।
বেশ ক' মাস লিখি নি। নিজের গল্পগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়লাম। প্রেমের জায়গাগুলো সত্যি সাজানো লাগছিল। বন্ধুদের জনে জনে জিজ্ঞেস করলাম; ওরা বলছিল- প্রাইজ পেয়ে ন্যাকামি বেড়েছে আমার। নিজেই কাটাকুটি শুরু করলাম পুরোনো গল্পে।
একবার ভাবলাম, যে নম্বর থেকে ফোন করেছিল স্পাই, সেই নম্বরে ফোন করি; দ্বিধা হল, একটু ভয়ও- 'আই লাভ ইয়ু' কেন বলেছিল ? ড্রিঙ্ক করেছিল খুব? না কী জাস্ট ভড়কালো আমাকে?
প্রেম ট্রেম এড়িয়ে কায়দা করে দুটো গল্প লিখলাম- কিঞ্চিৎ সাররিয়াল। একজন খ্যাতনামা লেখক প্রশংসা করেছেন খুব- লোকমুখে শুনতে পেলাম। সে রাতে আবার ফোন এলো- অন্য নম্বর। আজ একটা বিড়াল ডাকছে কনস্ট্যান্ট।
- এড়িয়ে যাচ্ছ?
-কী?
-প্রেমে ভয় বুঝি তোমার?
আমি চুপ।
-ভালোবাসি তোমাকে। ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি।
প্রথমে মিউ মিউ মিউ মিউ শুনলাম, তারপর অক্ষরগুলো পরপর- কেটে কেটে; আচমকাই যেন জড়িয়ে গেল শব্দগুলো- প্রথমে অবয়বহীন পিণ্ড, তারপর একটা মুখ, বাঘের গায়ের গন্ধ। শিরশির করছিল শরীর। জল খেলাম।
-জল খাচ্ছো? হুঁ? জল লেগে আছে তোমার ঠোঁটে। এই মুছো না মুছো না। চুমু খাবো।
দীর্ঘ চুম্বনের আওয়াজ হল লাইনের ওপারে।
-তোমার কণ্ঠ নালী বেয়ে জল নামছে এখন , চুমু খাচ্ছি। তোমার শরীরের মধ্যে দিয়ে জল বইছে নদীর -গলা পেরিয়ে বুকে, পেটে- আমাকে ঠোঁট ছোঁয়াতে দাও-
আমার খুলি ফুটো করে যেন আঙুল ঢুকিয়েছে কেউ- রক্ত বেরোচ্ছে অথচ খুব আরাম হচ্ছে - আরো আরো আরো। শরীর মোচড়াচ্ছিলাম - অসতর্ক মুহূর্তে আওয়াজ বেরিয়ে গেল মুখ থেকে- ডিমের খোলা ফেটে পাখির ছানা বেরোনোর আওয়াজের মত মৃদু, স্টীলের পাতে ছুরি ঘষার মত একই সঙ্গে তীক্ষ্ণ আর অস্বস্তিকর, তারপর রক্তাক্ত ক্ষত চেপে আর্তনাদের মতো তীব্র আর ঘন-
-এই শব্দগুলো লিখতে পারবে?
কেটে দিলো লাইন।
উপন্যাস বেরিয়েছিলো আমার। ফোন আসবে - জানতাম। আজ ব্যাকগ্রাউন্ডে পাখি - সকালের ডাক, যেন ভোর হচ্ছে।
- জীবন তো অনেক হল -প্রেম ভালোবাসা বিরহ, এবার মৃত্যু লেখো, এখন থেকে শুরু না করলে কব্জা করতে পারবে না আল্টিমেটলি-
-লিখেছি তো, এই উপন্যাসেও মৃত্যু আছে নানাভাবে-
-লিখেছ। কোথায় মৃত্যুর পায়ের আওয়াজ শুনতে চাইছ? তাকে দেখতে চাইছ? তাকে শুনতে চাইছ? জীবনমশায়ের মতো আকুতি কোথায়?
- চেষ্টা তো করছি।
- সেই লেখা আমি দেখে যেতে পারব?
আমার বুক কেঁপে উঠল।
-কেন এমন বলছ স্পাই? কী হয়েছে?
- ওয়ারজোনে আছি। কখন কী হয়-
- ওয়ারজোন? কোথায় গেছ? ইউক্রেন?
-কত রণক্ষেত্র পৃথিবী জুড়ে -সব কিছু খবরের কাগজে পাবে? নিজেকেই খুঁজে পেতে হবে তো- হাই টাইম নাউ।
- আমি তো পাখির ডাক শুনছি-
-যুদ্ধক্ষেত্রে পাখি ডাকবে না, এমন কোনো কথা আছে? কী গাইছে পাখি- সেটা শোনা আবশ্যক।
খুব কান্না পেলো- বালিতে ঢেউ ভেঙেই যেমন তৎক্ষণাৎ জল সরে, তেমনি কান্না গিলে বললাম, "ফিরে এসো স্পাই।"
-কোথায়? তোমার লেখায়?
দুটো পাখি ডাকল। তারপর সব চুপ।
কালকের রাতের ফোনে আমাকে বলা হয়েছিল -প্লেন ল্যাণ্ড করলে কার্গোর সামনে ডেকে নেওয়া হবে। স্পাইয়ের আত্মীয়্স্বজন বন্ধুবান্ধব নিশ্চয়ই থাকবেন, আমাকে একা হ্যান্ডল করতে হবে না ব্যাপারটা- এই রকম ভাবছিলাম। একটা কফিনে স্পাই জাস্ট কার্গো হয়ে আসবে- অবিশ্বাস্য লাগছিল আর সেজন্যই কান্না পাচ্ছিল না। বস্তুত দুঃখ , শোক, কান্না , শূন্যতা- যে কোনো একটা অনুভূতির জন্য কফিনটা জরুরী -এরকম মনে হচ্ছিল।
ডিপার্চার টার্মিনালের সামনে গাড়ির লাইন। মানুষজন দরজা খুলে নামছিল, ডিকি থেকে লাগেজ নিয়ে ঢুকে যাচ্ছিল ভিতরে, পিছন ফিরে হাত নাড়ছিল।
আমার ফোন বেজেছিল এই সময়।
- এসে গেছেন? কার্গো নয়, অ্যারাইভালের চার নম্বর গেটের সামনে আসুন।
- আপনাকে চিনব কী করে?
-আমি চিনে নেব-
অ্যারাইভালে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে মানুষজন বেরিয়ে আসছে। সবাই একরকম - ক্লান্ত আর আনন্দিত। আমার কাঁধে টোকা পড়েছিল- দাড়ি, গোঁফ, রুদ্রাক্ষ, গেরুয়া। আর সানগ্লাস।
- আপনাকে এই বাক্সটা দেওয়ার ইন্স্ট্রাকশন আছে।
-কিন্তু কফিন?
-আমি আর কিছু জানি না। বাক্সটা ধরুন। দুহাতে ধরুন।
কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এই বাক্সে কী আছে? লম্বাটে ফুট দুয়েকের বাক্স- প্রথমে হাল্কা, তারপর অবহ লাগল। একবার ভাবলাম - হয়তো চিতাভস্ম। তারপর মনে হ'ল, স্পাই কি বন্দুক পিস্তল পাঠালো? কী করব এখন? কাকে বলব? থানায় যাবো?
দগ্ধ ময়ালের শরীরের ওপর গোটা শহর ততক্ষণে যানজটে পড়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। লেখার টেবিলে বাতি জ্বেলে বাক্স খুলেছিলাম; ঘন লালচে বাদামী কাঠের পালিশ করা বেহালা, পাশে ছড়, একটি চিরকুট - তোমাকে । বাজিও।
[প্রথম প্রকাশ : চৌকাঠ ২০২২ ]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।