কায়রো থেকে ১২০ কিলো দূরে একটি দরিদ্র গ্রামে ইব্রাহিম নামে এক কৃষক ছিলেন। সৎ ও কর্মঠ এই লোকটিকে সবাই ভালবাসতো। কৃষিকাজের পাশাপাশি সে ইমামতিও করতো। এছাড়া ধর্মীয় ও বিবাহের অনুষ্ঠানগুলিতে গান গাওয়ারও বাতিক ছিল লোকটির। মুসলিমদের ঈদ উৎসবের সময় তাকে দীর্ঘ পথ পদব্রজে বা ৩য় শ্রেণীর ট্রেনে যাত্রা করতে হত। সে সময় তার সঙ্গী হতে দেখা যেত ছেলেদের পোশাক পরা একটি শিশুকে। সে আর কেউ নয়, মিশরের গায়িকা উম্মে কুলসুম, যিনি সুরের ইন্দ্রজালে বশ করে ফেলেন বিশ্বকে।
১৮৯৮ – ১৯০৪ এর মধ্যে কোন এক সময়ে জন্ম নেয়া উম্মে কুলসুম যখন কায়রোয় চলে আসেন স্থায়ীভাবে, ততদিনে তার বয়স বিশ আর কায়রো পরিণত হয়েছে প্রধান আরব শহরে, যেখানে গায়ক-গায়িকাদের বিপুল চাহিদা। একদিন এক সম্পদশালী মহিলার অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে কুলসুমের; তার সুরেলা কণ্ঠ, ও পরিষ্কার শব্দচয়ন শ্রোতাদের মন জয় করে নেয় নিমিষেই, রাতারাতি পেয়ে যান তারকা খ্যাতি। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি; প্রায় তিনশো গান রেকর্ড করে ফেলেন অল্প সময়ের ব্যবধানে। ১৯৫২ সালে মিশর আরব বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয় জামাল আব্দুল নাসেরের ক্যারিশমার উপর ভর করে। নাসেরকে দমাতে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল একজোট হয়ে মিশর আক্রমন করে ১৯৫৬ সালে। জামালও জবাব দেন ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে সংযোগকারি সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে। এই ঘটনার পর জামালের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে যায়; আরব সোশালিস্ট বাথ পার্টি ও সিরিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে জামাল গড়ে তোলেন ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক; প্যান আরবীয় ও আরব জাতীয়তাবাদের ব্যানারে পুরো আরবে উড়তে থাকে একটাই পতাকা।
এই সময়েই কণ্ঠের তেজ, সামর্থ্য ও নিঁখুত উচ্চারণের উপর ভর করে এবং শাস্ত্রীয় আরবীয় গাঁথাগুলোর সফল প্রয়োগ করে, আরব মর্যাদাকে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে থাকেন উম্মে কুলসুম। একটি উন্নততর আরব বিশ্বের স্বপ্নকে সামনে রেখে তিনিও যোগ দেন যেন বিপ্লবে, ঝড় তুলেন সুরের। জামাল নাসের এতটাই আপ্লুত হন যে কুলসুমকে আখ্যায়িত করেন ‘প্যান আরবের সাংস্কৃতিক আইকন’ হিসেবে, ভূষিত করেন ‘মিশরের কণ্ঠ’ উপাধিতে । উম্মে কুলসুমের কণ্ঠ থেকে বেয়ে পড়ে রক্তে আগুন ধরানো সংগীত, যার একটিতে ছিল নীচের লাইনগুলোঃ
‘জনতা অগ্রসর হয় আলোর গতিতে,
জনতা দাঁড়িয়ে থাকে পাহাড় ও সমুদ্র হয়ে,
ক্রোধের আগ্নেয়গিরি, ক্রোধ উদ্গীরণ হচ্ছে,
ভূমিকম্প শত্রুদলকে তাদের কবরে খনন করছে’
এরপর ১৯৬৭ এর যুদ্ধের পরাজয় আরব জাতীয়তাকে বড়সড় ধাক্কা দিলে জামাল নাসের আশার প্রদীপকে জ্বালিয়ে রাখতে গণমাধ্যমের উপর নির্ভর করেন। ৬৩ বছর বয়সী উম্মে কুলসুম এই নতুন কৌশলটির পাদপ্রদীপে থাকেন শক্ত হাতে হাল ধরে। তিনি কায়রোতে আর বসে থাকেননি, বেরিয়ে পড়েন কায়রো ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে। এক পর্যায়ে শুরু করেন বিশ্বভ্রমন, আরব বিশ্ব, এমনকি ইউরোপের ফ্রান্সেও কনসার্ট করেন তিনি। তার জনগণের দুর্দশার কথা প্রচার করতে থাকেন সর্বত্র। মানুষ তাদের বিয়ের আংট, অলংকার পর্যন্ত দান করতে থাকে। একবার একটি শিশু এক মুঠো ময়লা নিয়ে এলে সেই ময়লাকে নিলামে তোলা হয়, আর সাত হাজার ডলার সংগ্রহ করা হয়। উম্মে কুলসুম বিশ্ব-মানবকে জানান যে, ইসরায়েলকে দেয়া প্রতিটা সেন্ট এক একটি বুলেটে পরিণত হয়, যা ব্যবহার করা হয় একজন আরব নাগরিককে হত্যায়। এমনকি যারা তার গান বুঝতো না, তারাও আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়তেন তার কণ্ঠের বিষাদমাখা বীনে। ওমর খৈয়ামের পদ্যের সুতোয় কুলসুম সংযোগ গড়ে তুলতেন কুয়েতের ট্রাফিক পুলিশের সাথে প্যারিসের আলজেরিয়ান অভিবাসীর, জর্দানিয়ান বেদুইনের সাথে লিবিয়ান সুফির।
তার সব থেকে বিখ্যাত গান ‘আতলাল’ এর কিছু অংশঃ
''আমাকে আমার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দাও, আমার হাতগুলোকে মুক্ত কর,
আমি তো তোমাকে তোমার জিনিস সব দিয়ে দিয়েছি, নিজের কাছে রাখিনি কিছুই
আহা! তোমার চেইনগুলো আমার মণিবন্ধকে রক্তাক্ত করছে
আমি সেগুলো রাখিনি, আর সেগুলোও আমাকে নিষ্কৃতি দেয়নি
কেন আমি পূরণ করে যাই প্রতিশ্রুতি যার মর্যাদা তুমি রাখো না?’’
‘যুদ্ধ ময়দানের জনতার শিল্পী’ উম্মে কুলসুমের বহির্ভ্রমনকে রাষ্ট্রীয় সফর হিসেবে দেখা হতে দেখা। একজন রাষ্ট্রদূতের মত তাকে কুটনৈতিক পাসপোর্টও প্রদান করা হয়েছিল। বিনিময়ে নিজের কণ্ঠকে ব্যবহার করে যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি পোষানোর পাশাপাশি কুলসুম প্রায় দুই মিলিয়ন ডলার দিতে সক্ষম হন মিশরের সামরিক বাহিনী পুনর্গঠনে। কিছু সমালোচক অবশ্য বলেন, কুলসুমের কণ্ঠ মানুষের দৃষ্টিকে দূরে সরিয়ে রেখেছে দেশের অভ্যন্তরে ঘাঁপটি মেরে থাকা সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় সমস্যা থেকে যার জন্মদাতা খোদ দেশটির সরকার । কিন্তু তার তহবিল সংগ্রহের কনসার্টগুলি মিশর সরকারের পক্ষে ছিল না। কুলসুম নিজেই বলেছেন এর উদ্দেশ্য নিয়েঃ “আমি প্রমান করতে চাই, আমরা আরবেরা একতাবদ্ধ ইসরায়েলী সামরিক আগ্রাসনের মুখে।“ তার মতে, আরবের সংগীত শিল্প বিপ্লবের একটি বড় অস্ত্র, আর সশস্র প্যালেস্টানিয়ান বিপ্লবের আগুনে একটি নতুন আরব জনতা জন্মলাভ করবে“। ১৯৬৯ সালের লিবিয়ান সিটি ত্রিপোলি ও বেনগাজিতে যে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়, সেখান থেকে আয় হয়েছিল ৩,৪৫,০০০ ডলার, যা তুলে দেয়া হয়েছিল প্যালেস্টানিয়ান লিবারেশন আর্মির হাতে।
১৯৭৫ সালে উম্মে কুলসুম যখন মারা যান, প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষ তার শবকৃত্যে অংশ নিয়েছিল, সাথে হেঁটেছিল কবরস্থান পর্যন্ত। এমনি এক লোককে এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মিশরীয় সমাজে উম্মে কুলসুমের স্থান কোথায়?“ কায়রোর ঐ লোকটি চিৎকার করে উঠেছিল, “উম্মে কুলসুম? অবশ্যই সে অবশ্যই পিরামিডের মত!”