সকল দেশবাসীর আবেগ সুভাষচন্দ্র বসু। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে দেশ নায়ক পদে বরণ করেন। নেতাজি ভারতকে বিদেশি শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি না থাকলে আমাদের স্বাধীনতা পেতে হয়তো আরও দেরী হত। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়েছিল তাঁর কারণেই। তাঁর স্বদেশপ্রেম অনুপ্রাণিত করেছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। এমনই তাঁর প্রভাব ছিল যে তাঁর গলার মালার দাম উঠেছিল ৫ হাজার, শুধু তাই নয় সুভাষ-উন্মাদনাও এমন মাত্রায় ছিল যে তাঁর গলার মালা কেনার জন্য কোনো যুবক তাঁর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ এমনকি বসতভিটা পর্যন্ত হারাতে প্রস্তুত। বিষয়টি আমাদের কাছে নেহাত মুর্খামী মনে হলেও জনমানসে তাঁর প্রভাব বিচার করার জন্য যথেষ্ট।
ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে উচ্চপদে চাকরি করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। তাঁর এই আত্মত্যাগ জাতির প্রতি গভীর ভালোবাসার উদাহরণ। ত্রিপুরি কংগ্রেস অধিবেশন: অন্যতম প্রভাবশালী নেতৃত্ব গান্ধীজির মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিত্বের পদ অলংকৃত করেন। মাত্র ৯ মাস কলকাতা পুরসভার মেয়র থাকাকালীন পথ-উদ্যানের নামকরণ করেন প্রথিতযশা ভারতীয়দের নামে। প্রায় ২০ বছর কংগ্রেসের সাথে যুক্ত থেকেও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আরও সক্রিয় ও সরাসরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করেন, যুবসমাজকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার প্রমাণ তো গৃহবন্দী দশায় ছদ্মনামে ছদ্মবেশে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে প্রস্থান, বিষেশত গোমো জংশন থেকে সমূহ বিপদকে তুচ্ছ করে একাকী যাত্রা।
স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের অপরিহার্যতা তিনি অনুভব করেছিলেন। রাসবিহারী বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করলেও আর এক বোস-এর হাতে সেই দায়িত্ব তুলে দিয়ে যে ভুল করেন নি তার প্রমাণ তো জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ বৈষম্যকে উপেক্ষা করে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগঠন আর ইম্ফলের যুদ্ধ। তাঁর নেতৃত্ব এতটাই বলীয়ান যে অনাহার, অতিবৃষ্টি, বন্যা, বিষাক্ত পোকার অত্যাচারকে উপেক্ষা করেও ব্রহ্মদেশের অনেক খানি জয় সম্ভব হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে নেতাজির সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সরকার গঠন একটি প্রতীকী স্বাধীন সরকার, যা ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তার প্রতিবাদকে শক্তিশালী করে তোলে।
তিনি এমন ব্যক্তিত্ব যিনি ভারতের তথাকথিত স্বাধীনতার আগেই বলপূর্বক সেই স্বাধীনতা হরণ করে তেরঙ্গা উত্তোলনে সম্ভব হয়েছিলেন।
বার্লিন থেকে তাঁর বেতার মারফত ‘আমি সুভাষ বলছি’
এই জলদগম্ভীর স্বর শোনার জন্য যে দেশবাসী মুখিয়ে থাকত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির কাছ থেকে সমর্থন আদায়ে সফল হন। দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে তিনি জার্মানি থেকে জাপান ছুটে বেড়িয়েছেন, সেই সময়ে একলা সুভাষ নিজের জীবনের পরোয়া না করে সাবমেরিনে যাত্রাকালে ব্রিটিশ অস্ত্রবাহী জাহাজ ধ্বংস করতে পিছপা হননি। নেতাজি তার জীবন ও কর্মের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন যে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। তাঁর বিদেশ সফর, বিশেষত জার্মানি ও জাপানের সাহায্য নেওয়ার প্রচেষ্টা, তাঁর স্বদেশপ্রেমের এক অনন্য উদাহরণ।
নেতাজির স্বপ্ন ছিল ভারতের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা, স্বাধীনতা ভিক্ষা নয়। তাঁর নেতৃত্ব, সাহসিকতা, এবং আত্মত্যাগ ভারতীয় আবালবৃদ্ধবনিতাকে আজও উজ্জীবিত করে। তিনি সর্বকালের জাতীয়তাবাদ ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বদেশপ্রেম কেবল একটি দেশের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার উদাহরণ। তাঁর জীবনাদর্শ যুগে যুগে দেশপ্রেমিকদের প্রেরণা জোগাবে নিঃসন্দেহে।
তাঁর চরিত্রে আর একটি দিকের কথা বলি, তিনি স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ঘুম থেকে উঠে ৭-৭.৩০ প্রাতঃকালীন ইষ্ট দেবতা স্মরণ করা তাঁর দৈনিক নিয়মের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এহেন চরিত্রের হঠাৎ অন্তর্ধান আমরা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারি না। বলা হয়েছিল তিনি ফিরলে তাঁকে তলোয়ার দিয়ে স্বাগত করা হবে। তাই হয়তো লুকোচুরি খেলা। ১৮ই আগস্ট, ১৯৪৫, তাইপো: তিনি উড়োজাহাজে উঠলেন, দূর্ঘটনা ঘটল, আর সব শেষ! তাঁর সহকর্মী কর্নেল হাবিবুর রহমান বেঁচে ফিরতে পারলেন, কিন্তু তাঁকে বা অন্য জাপানী সহযাত্রীদের বাঁচানো সম্ভব হল না, সাক্ষী মাত্র তিন জন– কর্নেল হাবিবুর রহমান, জাপানী মেজর নাগাতোমো আর সুভাষ চন্দ্রের দোভাষী জুইচি নাকামুরা! সেসব বিতর্কিত বিষয়ে না হয় নাই বা গেলাম। আমাদের মনে তিনি আছেন এবং থাকবেন। নেতাজির স্বপ্ন ছিল ভারতের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা, স্বাধীনতা ভিক্ষা নয়। তাঁর নেতৃত্ব, সাহসিকতা, এবং আত্মত্যাগ ভারতীয় আবালবৃদ্ধবনিতাকে আজও উজ্জীবিত করে। তিনি সর্বকালের জাতীয়তাবাদ ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বদেশপ্রেম কেবল একটি দেশের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার উদাহরণ। তাঁর জীবনাদর্শ যুগে যুগে দেশপ্রেমিকদের প্রেরণা জোগাবে নিঃসন্দেহে।
তথ্য সূত্র
আমি সুভাষ বলছি/ শৈলেশ দে
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।