

প্রথম দর্শনে যা ভাবা গিয়েছিল, কেরলের ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর। কেরলের যে ভিজিনিজম বন্দর প্রকল্প নিয়ে হইচই, তা আজকের না। খবরের কাগজ ঘেঁটে যা পাওয়া যাচ্ছে, ২০০৮ সালে অচ্যুতানন্দন সরকার ল্যানকো ইনফ্রাটেক নামক একটি সংস্থাকে বন্দর বানানোর বরাত দিয়েছিল। জুম ডেভেলপারস নামক অন্য একটি দরপত্র প্রদানকারী সংস্থা, সেই বরাত দেবার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আঙুল তুলে আদালতে যায়। আদালত টেন্ডার প্রক্রিয়াটি খারিজ করে দেয়।(১) ল্যানকো প্রকল্প থেকে সরে যায়। জুম কেন পেলনা, জানা যাচ্ছেনা।
২০১১ সালে কেরলে সরকার বদলায়। কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। কংগ্রেস সরকারের আমলে ২০১৫ সালে এই বন্দর বানানোর বরাত দেওয়া হয় "আদানি পোর্ট অ্যান্ড এসইজেড"কে। তখন আদানির এই সংস্থাই একমাত্র দরপত্রদানকারী হিসেবে টিকে ছিল। যদিও সংবাদসূত্র আরও পাঁচটি আগ্রহী সংস্থাও ছিল।(২) তাদের মধ্যে দুটির নাম উপরেই বলা হয়েছে। তারা কী পদ্ধতিতে উবে গেল সে বিষয়ে বিশদ পাওয়া যায়নি।
বিজেপি এই প্রকল্পের পক্ষ নিয়ে প্রথম থেকেই খুবই উচ্চকিত ছিল। ২০১৫ সালে, প্রকল্প স্বাক্ষর হবার আগে থেকেই। তার একটা সম্ভাব্য কারণ হল, প্রকল্পটা আদানির। দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ, ভিজিনিজম তিরুবানন্তপুরম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, যেখানে বিজেপি খুবই শক্তিশালী। প্রসঙ্গত ২০১৯ সালে ওই লোকসভা কেন্দ্র থেকেই শশী থারুর জিতেছিলেন, দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। তৃতীয় সম্ভাব্য কারণ হল, উপকূল এলাকায় ক্রিশ্চান জনসংখ্যা এবং চার্চের প্রাধান্য। যেকোনো কারণেই হোক, ২০১৫ সাল থেকেই বিজেপি এই বন্দর নিয়ে উচ্চকিত সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলতে থাকে। বর্তমান বিজেপি এমপি সুরেশ গোপি সে সময় প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, যে, বন্দর বানাতে হিন্দুদের জেগে উঠে একতাবদ্ধ হতে হবে।(৩) কেন শুধু হিন্দুরাই জেগে উঠবে, আন্দাজ করার জন্য কোনো নম্বর নেই।
এর মধ্যে সরকার আবার বদলে যায় ২০১৬ সালে। মুখ্যমন্ত্রী হন পিনারাই বিজয়ন। বিরোধী থাকাকালীন আদানিকে দেওয়া চুক্তি নিয়ে সিপিআইএম প্রবল সমালোচনা করলেও, ক্ষমতায় আসার পর অবস্থান বদলে ফেলে (৪) । ফলে সরকার বদলালেও বন্দরের সিদ্ধান্ত অটুট থাকে। একমাত্র বিজেপির অভিমুখের কোনো বদল হয়নি। উল্টোদিকে সাম্প্রদায়িক উস্কানি সত্ত্বেও উপকূলের মৎস্যজীবীদের মধ্যে কয়েক বছর কোনো বড় প্রতিবাদ দেখা যায়নি। অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে গত বছর থেকে। গত বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে হঠাৎ একশর বেশি পরিবার, সমুদ্রের আক্রমণে (ক্ষয়ে) গৃহহীন হয়। কিন্তু সরকারি খাতায় তার কোনো হিসেব নেই। যদিও চার্চের হিসেবে আছে। কোস্টাল এরিয়া প্রোটেকশন ফোরামের সদস্য এজে বিজয়ন, জানিয়েছেন, তিনশোরও বেশি পরিবার নানা জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।(৫)এর পরই স্থানীয় জনসমষ্টির মধ্যে কাজ এবং বসতি হারানোর আশঙ্কা বাড়ে। আন্দোলন দানা বাঁধে। স্থানীয় লাতিন চার্চও সমর্থন জানায়।
মোট সাতটি দাবী কেরল সরকারের কাছে পেশ করা হয়। প্রথম দাবী হল, প্রকল্প স্থগিত রেখে একটি যথাযথ পরিবেশগত মূল্যায়নের। বাকি দাবীগুলি মৎস্যজীবীদের সাধারণ দাবী। প্রকল্প স্থগিত রেখে পরিবেশগত মূল্যায়নের দাবীটি সরকার মেনে নেয়নি।(৫)এরপর আন্দোলন তীব্রতর হয়। লাতিন ক্যাথলিক চার্চের লাল-সাদা-হলুদ পতাকা নিয়ে আন্দোলনকারীরা প্রতিবাদে নেমে পড়েন। প্রসঙ্গত চার্চ ছাড়া কোনো বড় রাজনৈতিক দল বা সংগঠন এই আন্দোলনকে সমর্থন করেনি।
রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিজেপি বরাবরই তীব্রভাবে বন্দরের পক্ষে ছিল। এবং হিন্দুজাগরণের পক্ষে। তাদের কর্মসূচি কখনই বদলায়নি। বন্দরের সপক্ষে একটি 'পিপলস অ্যাকশন কমিটি' তৈরি করা হয়। সেটি মূলত বিভিন্ন 'হিন্দু' সংগঠনের একটি ছাতা। যেমন, নায়ার সার্ভিস সোসাইটি, শ্রী নারায়ণ ধর্ম পরিপালনা যোগম, বৈকুন্দ স্বামী ধর্ম প্রচারণা ইত্যাদি(৩)। উপকূলবর্তী মৎস্যজীবীরা মূলত ক্রিশ্চান। ফলে বিজেপির দিক থেকে তাদের কাজকর্মের অভিমুখ খুবই পরিষ্কার ছিল, প্রথম থেকে এখনও পর্যন্ত। তারা কখনও সেটা গোপনও করেনি।
বিজেপির এই প্রকাশ্য অবস্থানের মধ্যেই আগস্ট মাসে, মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বিধানসভায় জানান, যে, প্রতিবাদ কোনো কোনো এলাকায় তৈরি করা হচ্ছে (orchestrated). সরকার কথা বলতেই পারে, কিন্তু প্রকল্প থামানো অসম্ভব। সেই সময় থেকেই শুরু হয়, মৎস্যজীবীদের প্রকাশ্য বিক্ষোভ, যা, এই লেখার দিন ১০৫ দিনে পড়ল। বিজেপির হিন্দু বনাম ক্রিশ্চান ন্যারেটিভও চলতে থাকে একই সঙ্গে (৩)। অবশেষে গত মঙ্গলবার, নভেম্বরের এক তারিখে, ওই পিপলস অ্যাকশন কমিটির ডাকা মিছিলে পা মেলান সিপিএমের জেলা সম্পাদক আনাভুর নাগাপ্পন এবং বিজেপির জেলা সভাপতি ভিভি রাজেশ। একই মঞ্চ থেকে বক্তব্যও রাখেন তাঁরা। (৩)
এই কর্মসুচী নিয়ে স্বভাবতই সর্বভারতীয় স্তরে আলোড়ন ওঠে। আদানির বন্দরের পক্ষে বিজেপি ও সিপিএমের যৌথমঞ্চ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। কেরলের শিক্ষমন্ত্রী সমস্ত প্রশ্নচিহ্নের উত্তরে বলেন, যে, লাতিন চার্চ ওখানে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করছিল। বাম পক্ষ থেকে 'বিদেশী অর্থসাহায্য'এর অভিযোগও ওঠে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক বলেন, বিক্ষোভকারীদের কায়েমী স্বার্থ আছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি, কে সুরেন্দ্রন বলেন, যে, যারা এখানে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সেই একই শক্তি কুদানকালামেও বিক্ষোভ সংগঠিত করেছিল (৩) । ইঙ্গিতটা অবশ্যই ক্রিশ্চান গোষ্ঠীকে নিয়ে। কারণ, কুদানকালামের বিক্ষোভও হয়েছিল একটি লাতিন চার্চের সমর্থনেই।
ক্রিশ্চান গোষ্ঠীর সঙ্গে বিজেপির সংঘাতের ইতিহাস নতুন না। গ্রাম স্টেনের কথা হয়তো অনেকেই মনে রেখেছেন। কিন্তু এখানে যে জিনিসটি নতুন, তা হল বিজেপির অ্যাজেন্ডার রাজনৈতিক সম্প্রসারণ। গোটা ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই বিজেপিকে রুখতে নরম-হিন্দুত্বের ঝোঁক দেখা যাচ্ছিল। তৃণমূলের গণেশ-পুজো থেকে শুরু করে কেজরিওয়ালের কাগজের নোটে লক্ষ্মী-গণেশের ছবি ছাপানোর প্রস্তাব পর্যন্ত। কিন্তু সংখ্যালঘুর 'দাঙ্গা' বাধানোর পরিকল্পনাকে রুখতে বিজেপি মডেলে হিন্দুত্বকে আঁকড়ে ধরা, বিজেপির গণমঞ্চের নিচে আসা, এটা বিগত কয়েক দশকে এই প্রথম দেখা গেল। এর পরে কাউকে আদৌ বিজেপি-বিরোধী কেন বলা হবে, সেটা একটা প্রশ্ন। কংগ্রেস নেতা বেনুগোপাল, একে 'অশুভ আঁতাত' বলেছেন। রাজ্যপালের চাপের সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক থাকতে পারে বলেও ইঙ্গিত করেছেন (৩)। যদিও তাঁর পার্টির অবস্থানও প্রশ্নচিহ্নের ঊর্ধ্বে না। আদানির বরাতপ্রাপ্তি কংগ্রেস জমানাতেই।
ফলে এখানে দ্বিতীয় আরেকটি প্রশ্নও উঠে আসে, যেটা আরও বড় না ছোটো বলা মুশকিল। খুব রহস্যজনকভাবে ভারতবর্ষের প্রায় সব নতুন বন্দরেরই বরাত পাচ্ছেন আদানি। পশ্চিমবঙ্গের তাজপুরের বরাতও ওই একই সংস্থার। অর্থাৎ আদানি পোর্ট অ্যান্ড এসইজেড (৬)। এবং যা দেখা যাচ্ছে, সেসব হচ্ছে পরিবেশগত মূল্যায়ন ছাড়াই। সারা পৃথিবীতেই আদানি পরিবেশ নিয়ে একটি ভয়াবহ বিতর্কিত নাম, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া কান্ডের পর। এত কিছুর পর, ভারতে কিন্তু সমস্ত বড় দলই, যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরা সকলেই আদানিপন্থী। আশ্চর্যজনকভাবে যাঁরা বিরোধী, তাঁরাও আদানির প্রকল্প নিয়ে কোনো প্রশ্নচিহ্ন অবধি তোলেননা। রহস্যটা ঠিক কোথায়? কেরলের 'ক্রিশ্চান' বিক্ষোভকারী থিওডেসিয়াস ডিক্রুজ বলেছেন, সবটাই আদানির অর্থের প্রভাব, যে কারণে দলগুলির এই অবস্থান, বা অবস্থান বদলানো। "ওরা এখন সবাই আদানির" (৩)।
কে জানে, এটাই হয়তো সঠিক ব্যাখ্যা।
সূত্রঃ
1. https://www.financialexpress.com/archive/sc-dismisses-lanco-appeal-in-vizhinjam-port-project/421842/
2. https://www.business-standard.com/article/companies/kerala-gives-nod-for-sole-adani-bid-for-vizhinjam-port-115051401598_1.html
3. https://indianexpress.com/article/political-pulse/cpim-bjp-unite-to-march-in-favour-of-adanis-vizhinjam-seaport-8245477/
4. https://indianexpress.com/article/political-pulse/parties-hedge-church-backs-fishermens-protest-against-adani-port-project-8104946/
5. https://indianexpress.com/article/explained/kerala-fishermen-vizhinjam-adani-port-protest-explained-8107064/
6. https://www.livemint.com/companies/news/tajpur-deep-sea-port-adani-highest-bidder-for-west-bengal-deep-sea-port-11648221384019.html
হজবরল | 185.243.***.*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ০০:০০513560
S | 2405:8100:8000:5ca1::1d0:***:*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ০০:০৬513561
সন্তোষ বন্দোপাধ্যায় | 2401:4900:104a:ad9a:0:6a:6701:***:*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১২:০৪513569
dc | 2401:4900:1cd0:e14a:645b:1a81:aad8:***:*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১২:২৭513576
শিল্প | 116.193.***.*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১৫:৩৭513587
গৌরব মিত্র, বেলঘরিয়া | 23.106.***.*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১৫:৫৪513589
ঝালমুড়ি | 185.243.***.*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১৬:১২513590
শিল্প | 116.193.***.*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১৭:০৮513592
শিল্পভক্ত | 2405:8100:8000:5ca1::3d:***:*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১৭:৫৩513593
dc | 2401:4900:1cd0:e14a:b0da:a029:f225:***:*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১৮:১০513594
ঘুগনি | 185.22.***.*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১৮:১৬513595
Padani | 65.49.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ১১:০৭524559
Padani | 65.49.***.*** | ১৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৫৫524660