ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার মূলত দুটি দিক আছে। সরকারি ও বেসরকারি। বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা মানেই একটি ঝাঁ চকচকে স্কুল বিল্ডিং, সুন্দর ইউনিফর্ম, রঙিন বাস ও এক ঝাঁক ঝকঝকে স্কুল পড়ুয়া এবং অবশ্যই স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চিন্তিত অভিভাবকদের দলের ছবি ভেসে ওঠে। আর কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি স্কুল মানেই প্রথমেই ভেসে ওঠে গাদাগাদি করে বসা একটা ক্লাসরুম, হেঁটে বা সাইকেলে আসা ছাত্রছাত্রী আর বারবার ডাকলে হয়তো একবার দেখা দেন এমন অভিভাবকবৃন্দ। বেসরকারি স্কুলে যেখানে পেরেন্ট টিচার মিটিং হলে অভিভাবকদের মধ্যে একটা সাজসাজ রব পড়ে যায় সরকারি স্কুলে সেটাই এক্কেবারে মিসিং। অথচ বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা সাইকেল মিড-ডে মিলের সামগ্রী নিতে আসার ক্ষেত্রগুলিতে অদ্ভুতভাবে বিপরীত ছবি ধরা পড়ে। কেন এমন হয়? বেসরকারি স্কুলগুলি এই জায়গাতেই সরকারি স্কুলের থেকে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। সেখানে কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা কিছু শেখানো হয় না বা সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের বুদ্ধি সরকারি স্কুলের থেকে বিরাট কিছু আলাদা তাও নয়। কিছু কারিকুলাম ও বইপত্র আলাদা কিন্তু মূল তফাত মানসিকতায়। এই মানসিকতা অভিভাবক থেকে ছাত্র-ছাত্রী হয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা পর্যন্ত বিস্তৃত।
বেসরকারি স্কুলের সঙ্গে সরকারি স্কুলের তুলনামূলক আলোচনা না করে আপাতত পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলের বিভিন্ন স্তরের সমস্যা, তার অন্ধকার ও আলোকিত দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করলেই বোঝা যাবে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্রটা কেমন।
বিদ্যালয় শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অভিভাবকদের অংশগ্রহণ। স্কুলে কী কী পড়ানো হচ্ছে তার খোঁজ যে অভিভাবক রাখেন তাঁর ছেলে বা মেয়েটি যাঁরা স্কুলে পড়াশোনার খোঁজ নেন না তাদের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে যাবেই। তাহলে কী স্কুলে কী কী পড়ানো হচ্ছে কোন ক্লাস হল বা হল না এই সব খোঁজ না নিলে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা হবে না? নাকি আগে কার সময়ে সব অভিভাবক খুব সচেতন ছিলেন? নাহ এমন সরলীকরণ ঠিক নয় যে খোঁজ না নিলে পড়াশোনা হবে না। কিন্তু যুগ পাল্টেছে। সময় পাল্টেছে। অভ্যাস পাল্টেছে। একটা সময় ছিল যখন স্কুলে পড়াশোনার বড়ো টিএলএম ছিল লাঠি। মাস্টারমশাইদের লাঠিকে ভয় পেয়ে বিরাট একটা অংশ পড়া করে আসত। তেমনই আপনার এই লাঠির ভয়েই স্কুল ছুট হয়ে যেত অনেক ছাত্র-ছাত্রী। পাশ-ফেল থাকার ফলেও স্কুল ছুট বাড়ত। তখনও অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া বা কারখানায়, দোকানে কাজ জুটিয়ে নেওয়ার চল ছিল। কিন্তু তখন আমাদের সেই সব চোখে পড়ত না। কারণ কোনও ডেটা ছিল না হাতে। হাতে গোণা সমীক্ষার রিপোর্ট তৈরি হত। সেখানে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের কোন ছাত্রটি কেন পড়া ছেড়ে দিল তার খোঁজ পাওয়া যেত না। মাধ্যমিক দেওয়ার বয়সে সিক্সে পড়ছে এমন ছেলেমেয়েও ছিল। কিন্তু ঐ যে যুগ বদলেছে। পাশ-ফেল নেই। লাঠি নেই। থাকার কথাও বৈজ্ঞানিক নয় মোটেও। সুতরাং ভালো স্কুল, ভালো পড়ানো আর সচেতন অভিভাবক এই তিনের স্পর্শেই সরকারি স্কুলের পড়াশোনার হাল ধরতে হবে। হাল ফেরাতে হবে বলছি না। কারণ এখনও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলের পঠন-পাঠন বেশ ভালো এবং স্কুলের পরিকাঠামো, অভিভাবকদের সচেতনতাও যথেষ্ট আছে। তার পরেও একটা দুটো তিনটে কিন্তু আছে।
সেগুলো এক এক করে বলা যাক এবং দেখা যাক তাদের জন্য কোনও স্থায়ী সমাধান আছে কিনা।
এই মুহূর্তে সরকারি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রকল্প চালু আছে। এই প্রকল্পগুলি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। ছাত্র-ছাত্রদের স্বার্থে এই রকম বিভিন্ন প্রকল্পের উপযোগিতা আছে। কিন্তু এই প্রকল্পগুলি চালু থাকায় একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় খুব সহজেই। যে সব ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে বেশিরভাগ দিনই অনুপস্থিত থাকে তারা কিন্তু এই সব প্রকল্পের সময় বিদ্যালয়ে এসে বিভিন্ন কাগজপত্র দেওয়া ও আবেদনের বিভিন্ন ধাপগুলি সুচারু রূপে করার ক্ষেত্রে কোনও ভুল করে না। সব থেকে আশ্চর্যের যে অভিভাবকরা স্কুলে কোনও মিটিং থাকলে কিছুতেই আসেন না তাঁরাও এই সব প্রকল্পের সুবিধা পেতে দেরি হলে বিদ্যালয়ে এসে খোঁজ নেন। এমনকি কোভিড পিরিয়ডে যখন কুকড মিড ডে মিলের পরিবর্তে প্যাকেট করা চাল আলু চিনি সাবান দেওয়া হচ্ছিল তখনও তাঁরা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে এসে সেই সব সামগ্রী নিয়ে গেছেন। অথচ এই অভিভাবকদের বিরাট একটা অংশ কিছুতেই স্কুলে অভিভাবক সভায় আসতে চান না। এর মানে কি এই যে তাঁরা শুধু স্কুলের প্রকল্পগুলিরই খোঁজ রাখেন এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের কী পড়াশোনা হচ্ছে তার কোনও খোঁজ রাখেন না? নাহ, বিষয়টা এতটা সহজ সরল নয়। বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনে অভিভাবকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ খুবই প্রয়োজন। কিন্তু যে অভিভাবক মিডডে মিলের চাল আলু নিতে আসেন তিনি কেন অভিভাবক সভাতে আসেন না তা একটু ভাবলেই অনুমান করা যায়। ভয়। স্রেফ ভয়ে তারা বিদ্যালয়ের ডাকা এই সাধারণ সভাগুলি এড়িয়ে যান। গ্রামবাংলার একটা বড়ো অংশের অভিভাবক এখনও নিজেদের পড়াশোনা ও পড়াশোনা সংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণে আত্মবিশ্বাসী নন। বিদ্যালয়ে পড়াশোনা সংক্রান্ত আলোচনাতে তাঁরা যে নিজেদের কথাটুকু ঠিক মতো প্রকাশ করতে পারবেন না তা তাঁরা জানেন। এবং এই মিটিং-এ এসে নিজের ছেলেমেয়েদের কেন ঠিকমতো পড়া হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন করতেও ভয় পান। হয়তো মেয়েটির বিয়ের কথা আলোচনা হচ্ছে এবং প্রায়ই তাকে দেখতে আসছে বলে তার পড়াশোনা আর ততখানি গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং যা হোক করে ‘একটা পাশ’ দিলেই বিয়ে দিয়ে দেবে-- এই সহজ স্বীকারোক্তিটুকু সে ভরা সভায় দাঁড়িয়ে করতে পারবে না। বা ছেলেটাকে নিয়মিত মাছের আড়তে বা ধান জমিতে বা খামারে কাজে ব্যস্ত রাখছে সে কথাও মুখ ফুটে বলতে পারবে না। ফলে স্কুলে এসে মিটিং-এ প্রশ্ন করার অক্ষমতার ভয় তাকে এমন চেপে ধরছে যে সে এইসব মিটিংকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। স্কুল হয়তো ভাবছে এদের নিজেদেরই আগ্রহ নেই, ডাকলে আসে না কাদের জন্য তবে মিটিং কেনই বা এই সবের আয়োজন, চাল সাইকেল দাও ওরাও খুশি এবং সরকারও খুশি। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। পড়াশোনা করে যে চাকরি পাবে না এমন ধারণাও পোষণ করেন অনেক অভিভাবক। তাই কী হবে অত স্কুলের মিটিং-এ গিয়ে বলে সব রকমের দায় সে ঝেড়ে ফেলে সরকার চাইছে না, মাস্টাররা ফাঁকিবাজ এইসব বলে ও ভেবে আসলে নিজেকেই প্রবঞ্চনার ফাঁদে জড়িয়ে ফেলছে।
আবার অভিভাবকদের স্কুলের পঠন-পাঠনের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহের যেমন অভাব তেমনই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও একটি অদ্ভুত প্রবণতা এসেছে যে স্কুল গেলেও যা হবে না গেলেও তাই হবে এবং বাইরে টিউশনি আছে সেখানে পড়ে নেব। যে স্কুলে পড়ে না বা যে বাড়িতে বই খোলে না সে যে টিউশনিতে গিয়ে শুধুই জেরক্স নোট সংগ্রহ করে ফাইলবন্দী করছে তা বলার জন্য বেশি গবেষণা করার দরকার নেই। এই ধরনের প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়ছে। কিন্তু কেন বাড়ছে এই প্রবণতা? এর সহজ কারণ হল সহজেই নম্বর পাওয়ার হাজারো ব্যবস্থা। প্রজেক্টের কাজ বেশ কঠিন কিন্তু গতানুগতিকতার ছাঁচে পড়ে তা কেবল নম্বর পেয়ে যাওয়ার একটা সহজ ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন উপায়ে বা সহজ কথায় ‘হল ম্যানেজ’ করে ছোট প্রশ্নের উত্তরের অপশনে টিক চিহ্ন দিয়ে কোনও রকমে পাশ করে যাচ্ছে বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী। তাই ১৭৫ পেয়ে মাধ্যমিক পাশ এখন তাদের কাছে খুব সহজ। আর এই কারণেই বিদ্যালয় যাওয়ার প্রতি তাদের অনীহা ক্রমশ বাড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অভিভাবকদের উদাসীনতা। কিন্তু তাই বলে কী সব ছাত্র-ছাত্রীই এমন স্কুল বিমুখ ও ১৭৫ তুলে পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার দলে রয়েছে? না, তা কখনই নয়। আগেও যেমন একটা ক্লাসে দশ থেকে পনেরো শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী নিয়মিত পড়াশোনা করত এখনও সেই সংখ্যাটা কিছুটা কমলেও খুব বেশি রকমফের হয়নি। কিন্তু এই স্কুল না যাওয়া ও তা সত্ত্বেও নম্বর পেয়ে পাশ করে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাটা মারাত্মক আকারে বেড়েছে।
আর এই স্কুল বিমুখতার আর একটি বড় কারণ আছে। একটা বিরাট অংশের ছাত্র-ছাত্রী কিছুতেই অঙ্ক করতে পারছে না। ইংরেজি পড়তে পারছে না, এমনকি এই করোনাত্তোর সময়ে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে নিজেদের নাম বা স্কুলের নামটাও লিখতে পারছে না। আর এই সমস্যাটা ক্লাস এইট পর্যন্ত বেশি। কেন তারা পারছে না এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাচ্ছে এরা উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের নকল করছে। স্কুলে না আসার প্রবণতা আগে এই এইট পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ছিল না। কিন্তু তারাও দাদা-দিদিদের দেখে শিখে গেছে। সর্বোপরি এই যে স্কুলে স্কুলে সামেটিভ টেস্ট হল সেই পরীক্ষায় এই ধরনের ছাত্র-ছাত্রীদের পারফরমেন্স খুবই হতাশাজনক। কিন্তু এর জন্য যে পুরোপুরি এরাই দায়ী তা কিন্তু নয়।পাশ-ফেল নেই, এমনিই পরের ক্লাসে উঠে যাব এই মানসিকতার পাশাপাশি একটা সরল সত্যকে কিছুতেই চাপা দেওয়া যাবে না। বিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামোর অভাব।
এখন বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর অভাব বললেই উঠে আসে সেই একই চর্বিত চর্বণ। ছোট্ট ক্লাসরুম, গাদাগাদি করে বসা ছাত্র-ছাত্রী, তীব্র গরম, লোডশেডিং ইত্যাদি। কিন্তু এই কারণগুলোর জন্যই কি ছাত্র-ছাত্রীদের এমন স্কুল বা ক্লাস বিমুখতা তৈরি হচ্ছে? নাকি হাজারো প্রকল্প রূপায়ণ করতে গিয়ে অনেক বিদ্যালয়েই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে যে নিজের বিষয়ের ক্লাসের প্রস্তুতিটুকুও ঠিক মতো নিতে পারছেন না বা ক্লাসে গিয়ে সেই আগের মতো মনোযোগ দিতে পারছেন না? এই কারণগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। সত্যিই বিভিন্ন স্কুলে অশিক্ষক কর্মীর অভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকেই এইসব প্রকল্পের কাজের দায়িত্ব নিতে হয় কিন্তু একজন ছাত্র নিজের নাম লিখতে পারবে না বা স্কুলের নাম লিখতে পারবে না বা ন্যূনতম ইংরেজিটুকুও পড়তে পারবে না এজন্য শুধু পরিকাঠামো বা প্রকল্পকে দায়ী করলে তা ভাবের ঘরে চুরি করা হয়।
এই সমস্যার মূল কারণ ক্লাসের সিলেবাস শেষ করার জন্য তৈরি রুটিন এবং বিশেষ রেমেডিয়াল ক্লাসের অভাব ও নিয়মিত ক্লাসে এই ধরনের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে একটু আলাদা যত্ন নেওয়ার মানসিকতার অভাব। এই জায়গায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আত্মসমালোচনা করার জায়গা রয়েছে। তাঁরা কী নিজেদের ক্লাসে গিয়ে এই ধরনের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিকল্প পাঠের ব্যবস্থা করছেন? ক্লাসের মধ্যেই অন্তত দুটি গ্রুপ করে একটি গ্রুপে সিলেবাসের পাঠ ও অন্য গ্রুপে অন্তত দেখে দেখে লেখা বা শুনে লেখার পাঠ দেওয়া যায়। তবে এই কাজটা এখানে লেখা যতখানি সহজ ক্লাসে প্রয়োগ করা ততখানিই কঠিন। কারণ ক্লাসে সব ধরনের ছাত্র-ছাত্রী থাকে। যারা খুব ভালো ছেলেমেয়ে তাদের এই ধরনের ক্লাসে পঠনপাঠন কিছুটা কম হবে। তাই বিদ্যালয়ের উচিত এই ধরনের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আলাদা গ্রুপে ভাগ করে রেমেডিয়াল ক্লাস করানো।
কিন্তু এখানেই এবার সব থেকে গুরুতর সমস্যাটি প্রকট হয়ে পড়ে। শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীর অভাব প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নেওয়াটুকুও বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। আর এজন্য এক ও একমাত্র দায়ী দীর্ঘদিন শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সুষম বণ্টনের অভাব। এই মুহূর্তে গ্রামবাংলার স্কুলগুলিতে ও শহরের স্কুলগুলিতে এক অদ্ভুত বিষম চিত্র ধরা পড়েছে। মুর্শিদাবাদের একটি স্কুলে ৯৪০০ পড়ুয়ার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা মাত্র ৩৭ জন। অথচ ভবানীপুরের একটি উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলে দেড়শো ছাত্র-ছাত্রীর জন্য বাইশ জন টিচার রয়েছেন। এসি ঘরে বসে থাকা কোনও আধিকারিক বা সরকারে কোনও নেতা মন্ত্রীকে যদি এই দুই স্কুলের ক্লাস রুটিন করতে দেওয়া যেত তাহলেই প্রকৃত সমস্যাটা বুঝতে পারতেন তারা। তাহলে কী ভবানীপুরের স্কুল থেকে টিচার তুলে এনে মুর্শিদাবাদের স্কুলে পাঠালেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? নাহ কারণ তাতে সমস্যা আরও বাড়বে। বাড়ির কাছের স্কুলে ট্রান্সফার যাতে পান এবং কাছাকাছি স্কুল হলে ভালো পাঠদান করতে পারবেন এই উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারের তরফে বর্তমানে উৎস্যশ্রী প্রকল্প চালু আছে। তাই যে কেউ চাইবেন তার বাড়ির কাছের স্কুলে ট্রান্সফার নিতে। কিন্তু সরকার যদি মনে করেন এই পোর্টালের পাশাপাশি সারা রাজ্যের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত দেখে যতটা সম্ভব র্যাশনালাইজেশনের মাধ্যমে সারপ্লাস ট্রান্সফার করে ঘাটতি মেটাবেন তা কিন্তু খুব অসম্ভব নয়। আর তার পর বাকি যে শূন্যপদ থাকবে সেখানে নতুন নিয়োগ দিলেই এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষক ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে এবং তখনই আলাদা করে রেমেডিয়াল ক্লাস করানো সম্ভব হবে। এখানে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে রেমেডিয়াল ক্লাসের জন্য প্যারাটিচাররা আছেন। তাদের সপ্তাহে অন্তত একদিন একটা ক্লাস করানোর কথা। কিন্তু বাস্তব কী তা সকলেই জানেন। এই মুহূর্তে প্যারাটিচাররা আর আলাদা করে রেমেডিয়াল ক্লাস নেওয়ার কোনও রুটিন পান না। কারণ যে হারে শিক্ষক ঘাটতি তাতে এই রেমেডিয়াল ক্লাস এখন বিলাসিতা মাত্র।
আর একটি সমস্যার কথা আলোচনা না করলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থাকবে। ২০০৯, ২০১০, ২০১১ তে সর্ব শিক্ষা মিশনের উদ্যোগে সারা রাজ্যে প্রায় পাঁচ হাজার নিউ সেট আপ জুনিয়ার হাইস্কুল তৈরি হয় এবং সেখানে প্রথমে তিনটি পোস্ট ও পরে আরও দুটি পোস্ট তৈরি হয়। প্রথম তিনটি পোস্ট ইংরেজি, অঙ্ক এবং ইতিহাস বা ভূগোলের এবং পরের দুটি পোস্ট বাংলা ও বয়োলজির ছিল। রোস্টার মেনে এই পাঁচটি পোস্ট তৈরি হয়। চতুর্থ পোস্টটি এস টি-দের জন্য সংরক্ষিত হয়। এইবার ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ এবং ২০১১ তে প্রথম তিনটি পোস্টে টিচার নিয়োগ হয়। এবং সৌভাগ্যবান কিছু স্কুলে ২০১৩ সালে পরের দুটি পোস্টে টিচার পায়। কিন্তু বেশিরভাগ স্কুলেই চার নম্বর পোস্ট ফাঁকা থেকে যায়। এবং এইভাবে কোনও স্কুলে পাঁচজন এবং বেশিরভাগ স্কুলে তিন জন নিয়ে স্কুলগুলি যাত্রা শুরু করে। প্রথম দিকে এই স্কুলগুলিতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তিতে বেশ উৎসাহ ছিল। আগে এসএসসিতে পাস ও অনার্স/পিজি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হত ফলে জুনিয়ার থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সব ধরনের স্কুলেই এক যোগে শিক্ষক-শিক্ষিকা আসতেন। কিন্তু তারপরে আপার/নবম-দশম/ একদশ-দ্বাদশ-এ ভাগ হয়ে যাওয়ায় ২০১৬-র এসএসসিতে মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে বা উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে টিচার নিয়োগ হলেও নিউ সেট আপ জুনিয়ার স্কুলগুলিতে টিচার নিয়োগ বন্ধই থেকে যায়। দীর্ঘ আট বছর নিয়োগ বন্ধ থাকা এবং মধ্যবর্তী সময়ে ট্রান্সফার নিয়ে স্কুলগুলি থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে চলে আসার কারণে বর্তমানে এই নিউ সেট আপ জুনিয়ার হাইস্কুলে কোথাও তিনজন বা দু’জন বা এমনকি একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা নিয়ে স্কুলগুলি চলছে। অবসর প্রাপ্ত শিক্ষককে গেস্ট টিচার রেখে কোনও মতে ঠেকা দেওয়ার কাজ চলছে। আর এর ফলে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ছুট হচ্ছে আবার কেউ কেউ পাশের মাধ্যমিক স্কুলে গিয়ে ভিড় বাড়াচ্ছে। অথচ কোয়ালিটি এডুকেশনের স্বার্থে এবং মাধ্যমিক স্কুলের ওপর চাপ কমাতেই এই জুনিয়ার হাইস্কুলগুলি তৈরি হয়। কিন্তু ফল হল উল্টো। আর বিদ্যালয় পরিদর্শকের তরফে মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তিতে নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি ছিল। সেটাও হয়নি। ফলে সেই মাধ্যমিক স্কুলে পরিকাঠামোর অভাব, গাদাগাদি ভিড়, মিড ডে মিল খেয়ে চলে যাওয়া ছাত্র (ছাত্রীদের মধ্যে টিফিনে স্কুল থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কম), অভিভাবকদের ডাকলেও না আসা এবং এলেও নিজেদের সমস্যার কথা বলতে না পারা বা ছাত্রটিকে যে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখা বা ছাত্রটি নিজেই স্কুল না গিয়ে স্রেফ ঘুরে বেড়াচ্ছে এইসব সমস্যা ও অভিযোগই ঘুরে ফিরে আসছে।
তাই সবার আগে তিনটি কাজ করা দরকার।
এক- ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত দেখে সুষম বণ্টন।
দুই- নতুন টিচার নিয়োগ।
তিন- নিউ সেট আপ জুনিয়ার হাইস্কুলগুলিকে মডেল স্কুলের মতো করে গড়ে তোলা।
এবং সর্বোপরি অভিভাবক সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া।
কুমির যদি তার ছানা মানুষ করতে দিয়ে গিয়ে পুরোপুরি ভুলে যায় তাহলে শেয়াল পণ্ডিত একটা ভালো ছানাকেই বারবার দেখিয়ে বলবে এই যে শিখিয়েছি দেখো অথচ বাকি নটা ছানা যে অক্ষর পরিচয়হীন হয়ে রয়ে গেল তা আর খোঁজ নেওয়া হল না। আর শেয়াল পণ্ডিত থেকে বনের রাজা সবাই ভাবল এই তো বেশ শান্তি বজায় আছে। এবং তরুণের স্বপ্ন বেঁচে আছে। অথচ হাতে হাতে নীল আলোয় বন্দি চোখে অন্ধকার ঠিকরে পড়ছে আমরা বুঝেও বুঝছি না বা ভাবের ঘরে চুরি করছি।