'শিহরি উঠো না শাস্ত্রবিদেরে ক’রোনা ক’ বীর ভয়
তাহারা খোদার খোদ ‘প্রাইভেট সেক্রেটারি’ তো নয়।'
-- কাজী নজরুল ইসলাম
তিনি লিখছেন, 'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী / আর হাতে রণতূর্য'। সত্যই তাই । প্রেম প্রকৃতি বিক্ষোভ বিদ্রোহ বিপ্লব এসেছে তাঁর লেখায়। আবার একই সঙ্গে এসেছে বৈপরীত্যমূলকভাবে ঈশ্বরে অনাস্থা ও আস্থা । কেউ বলতে পারেন, ঈশ্বর নয়, ঈশ্বরের নামে করে খাওয়া ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তাঁর এই জেহাদ।
'গ্রাম উঠে আসে নাগরিক স্থাপত্য নিয়ে তাঁর লেখায়। খনি অঞ্চলের মানুষ। খনন করেন মানুষের মন, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, দল—শ্রমিকের উদ্যমে, কৃষকের আবেগে, বুদ্ধিজীবীর পাণ্ডিত্যে, আবহমান বাংলা কবিতার সুরে।
তিনি নজরুল।
চাষিক সরলতার পাশে গ্রিসীয় জ্ঞানদীপ্তি, পুরাণি সংস্কৃতির তীব্র সংরাগী অনুধ্যান, ইউরোপীয় ব্যবস্থার প্রত্যাখ্যান, লেটোর গতিময়তা, ছান্দিকতা, কিছুটা মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতা, তার সঙ্গে কালী ও কবিতাকলি আনমনা প্রেম, ইসলামি গণতান্ত্রিকতা—তাঁর কাব্য জীবনধারাকে করেছে অনন্য, ব্যতিক্রমী, উদ্ভাসী ও আকাঙ্ক্ষামুখর'।
জন্ম অতি দরিদ্র পরিবারে। যদিও একদা পরিবারটি ছিল ধনী। এলাকায় সম্মান ও সম্ভ্রমের চোখে দেখা হতো কাজী পরিবারকে। অল্প বয়সেই বাবাকে হারান। ১০ বছর বয়সে নিতে হয় পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জনের দায়িত্ব। ছাত্র হয়ে উঠলেন শিক্ষক। পরে যাঁকে জীবনের জীবনের পাঠশালায় শিক্ষিত হতে হবে ম্যাক্সিম গোর্কির মতো। চায়ের দোকান, পাঁউরুটির কারখানার কর্মী থেকে হয়ে উঠতে হবে সৈনিক ও সাংবাদিক। তারপর একসময় হয়ে উঠবেন অসি ছেড়ে মসীযোদ্ধা ও কন্ঠশিল্পক। গান হয়ে উঠবে প্রেম ও প্রত্যয়ের দৃঢ অঙ্গীকার।
সব মিলিয়ে ৮৩ টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। অসংখ্য কবিতা ও গান হারিয়ে গেছে। এঁর ওঁর অনুরোধে একটা পান কিংবা এক কাপ চা খেয়ে লিখে দিয়েছেন। তাও রয়ে গেছে তিন হাজারের বেশি গান। কাজী নজরুল ইসলামের আছে ৪২ টি কাব্যগ্রন্থ এবং ৪১ টি গদ্যগ্রন্থ।
আমাদের সমাজ বিশেষ করে তথাকথিত সাহিত্য সমাজ লেবেল মেরে দিতে অতি ওস্তাদ। প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপ্ন্যাসিক, কবি, লেখক, নাট্যকার।
কবি আর লেখক কি আলাদা? কবি লেখক নন?
প্রাবন্ধিক লেখক নন?
নজরুলের গায়ে দুখানি লেবেল সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এক. বিদ্রোহী কবি।
দুই. হাবিলদার কবি।
সে দাগ এমন আজো ওঠে না। প্রগতিশীল অপ্রগতিশীল রক্ষণশীল অতি রক্ষণশীল সবাই মিলে একজোট নজরুল বিষয়ে। এক কালে তাঁর জন্মদিনে কিছু হইচই হতো। এখন প্রায় নীরবতা।
আজ মানিকতলা খালপাড়ে ১২৪ তম (১২৩ নয়) নজরুল জন্মজয়ন্তী পালন করতে গিয়ে আরেকবার টের পেলুম সে ঐক্য।
প্রথম শ্রেণিতে নজরুলের জীবনী আছে ৩১৪ নম্বর পাতায়। মোট ৩৫৭ পাতার বই। নজরুলের ছড়া বা কবিতা নেই। ৩১৪ নম্বর পাতা পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির পড়ুয়াদের পড়া পৌঁছালে খুব ভালো।
দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে অনেকে আছেন, কাজী নজরুল ইসলামের লেখা নেই। চতুর্থ শ্রেণিতে তাঁর লেখা আছে। আমি সাগর পাড়ি দেবো। আছে ৬৪ পাতায়। ছোটোরা প্রায় কেউ তাঁর নাম জানেন না দেখলাম। পঞ্চম ষষ্ঠ শ্রেণিতে আছেন কিন্তু ছোটদের উপযোগী করে নেই। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা শিশু সাহিত্য প্রণেতার লেখা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়া শিশুদের বইয়ে নেই।
পঞ্চম শ্রেণিতে 'পাতাবাহার' নামে বাংলা বইয়ের ৯০ পাতায় আছে কাজী নজরুল ইসলামের গান-- চল্ চল্ চল্। মোট ১৫২ পাতার বই।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে আছে 'সাহিত্যমেলা'। মোট ১৬৩ পাতার বই। নজরুলের কবিতা আছে ১১৯ পাতায়। কবিতার নাম -- মোরা দুই সহোদর ভাই। কবিতার বক্তব্য খুবই ভালো।
প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণিতে নজরুলের ছড়া ও কবিতা থাকা জরুরি ছিল।
'লিচু চোর', 'খুকি ও কাঠবেড়ালি' বা 'ভোর হলো দোর খোলো'-র মতো আকর্ষণীয় শিশুতোষ ছড়া না থাকাটা বেদনার। নতুন পাঠক্রমের প্রশংসা আমি করেছি বহুবার। বিশেষ করে ইতিহাস ও গণিতের। কিন্তু কাল নজরুল জন্মজয়ন্তীর দিনে আমার অভিজ্ঞতার বেদনাও বলা জরুরি।
১৯৯৭-এ নজরুলের 'সঞ্চিতা' কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়। আন্দোলন করতে হয়। 'আজকাল' পত্রিকায় আমি প্রতিবেদন লিখি। বিজেপির রাহুল সিনহা একমাত্র এই বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে মিছিল করেন। শেষে অনিল বিশ্বাসের হস্তক্ষেপে 'সঞ্চিতা' এবং রাঢ বাংলার আরেক সন্তান তারাশঙ্করের 'কালিন্দী' কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে থেকে যায়। অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলে তবে এই সুফল মেলে। কিন্তু পরীক্ষায় এমনভাবে প্রশ্ন দেওয়া হতে লাগল নজরুল না পড়লেও চলবে। এক জিনিস দেখেছি, ১৯৯২-৯৩ পর্বে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতকোত্তরে পরীক্ষায় অথবা হিসেবে নজরুলের কবিতা আসতো। আর অন্য 'অথবা'-টি ছাত্রদের জানিয়ে দেওয়া হতো। ফলে নজরুল অপঠিত-ই থেকে যেতেন।
২০০৭-এও আবার নজরুল বাদ। এবার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে-নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম। শেষে নজরুল ফিরলেন। কিন্তু ওই উন্নাসিকতা গেল না। সূক্ষ্ম সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা যাওয়ার নয় সহজে।
জনপ্রিয় মানে খারাপ --এই ধারণা যে কী করে তৈরি করে হলো?
নজরুলের লেখা বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের ৯৯ শতাংশ ভালোভাবে পড়েননি। ৯৯.৯ শতাংশের বাড়িতে নজরুল রচনাবলী পাওয়া যাবে না। অবশ্য রবীন্দ্র রচনাবলীও কজন পড়েছেন ঘোর সন্দেহ।
বঙ্কিম প্রথম লিখেছিলেন কবিতা। ললিতা/ পুরাকালিক গল্প তথা মানস। রবীন্দ্রনাথ-ও কবিতা। অভিলাষ। নজরুল প্রথম লেখেন গদ্য। বাউন্ডেলের আত্মকথা। অসাধারণ ছিল সেই গদ্য। ১৯১৯-এ প্রকাশিত হয় সেই লেখা।
নজরুল নিজে লিখেছেন--
‘আমার সুন্দর প্রথম এলেন ছোটগল্প হয়ে, তারপর এলেন কবিতা হয়ে। তারপর এলেন গান, সুর, ছন্দ ও ভাব হয়ে। উপন্যাস, নাটক, লেখা (গদ্য) হয়েও মাঝে মাঝে এসেছিলেন। ‘ধূমকেতু', ‘লাঙল', ‘গণবাণী'তে, তারপর এই ‘নবযুগে' তাঁর শক্তি-সুন্দর প্রকাশ এসেছিল; আর তা এল রুদ্র-তেজে, বিপ্লবের বাণী হয়ে। বলতে ভুলে গেছি, যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈনিকের সাজে দেশে ফিরে এলাম, তখন হক সাহেবের দৈনিক পত্র ‘নবযুগে' কি লেখাই লিখলাম, আজ তা মনে নেই; কিন্তু পনের দিনের মধ্যেই কাগজের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। এই গান লিখি ও সুর দিই যখন, তখন অজস্র অর্থ, যশ-অভিনন্দন, ফুল, মালা-বাঙলার ছেলেমেয়েদের ভালোবাসা পেতে লাগলাম। তখন আমার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ মাত্র।’
(কাজী নজরুল ইসলাম-- আমার সুন্দর)।
তাঁর গদ্য সম্পর্কে নজরুল গবেষক মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখেছেন--
কবি নজরুলের গদ্য-রচনা তাঁর কবিতারই এক সম্প্রসারিত এলাকা, এক সম্পূরক প্রবাহ। এর ভাষা মূলত কবিতারই ভাষা। ফলত তাঁর ভাষা-সম্পর্কিত আলোচনা বলতে আসলে তাঁর কাব্য ভাষার আলোচনাকে বোঝায়।’’
(মুহম্মদ নূরুল হুদা, নজরুলের ভাষা-বিদ্রোহঃ প্রস্তাবনা)।
নজরুলের প্রথম গদ্য পড়লে মনে পড়বে বিবেকানন্দকে। বিবেকানন্দকে আমি বাংলা গদ্যের অসামান্য শিল্পী মনে করি। এটাই তাঁর সেরা ক্ষেত্র। বিবেকানন্দের মতোই সহজ সুন্দর তাঁর গদ্য।
“কি ভায়া! নিতান্তই ছাড়বে না? একদম এঁটেল মাটির মতো লেগে থাকবে? আরে ছোঃ! তুমি যে দেখছি চিটে গুড়ের চেয়েও চামচিটেল! তুমি যদিও হচ্ছ আমার এক ক্লাসের ইয়ার, তবুও সত্যি বলতে কি, আমার সে সব কথাগুলো বলতে কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ হয়। কারণ খোদা আমায় পয়দা করবার সময় মস্ত একটা গলদ করে বসেছিলেন, কেননা চামড়াটা আমার করে দিলেন হাতির চেয়েও পুরু, আর প্রাণটা করে দিলেন কাদার চেয়েও নরম! আর কাজেই দু-চার জন মজুর লাগিয়ে আমার এই চামড়ায় মুগুর বসালেও আমি গোঁপে তা দিয়ে বলব, ‘কুচ্ পরওয়া নেই’, কিন্তু আমার এই ‘নাজোক’ জানটায় একটু আঁচড় লাগলেই ছোট্ট মেয়ের মতো চেঁচিয়ে উঠবে! তোমার ‘বিরাশি দশআনা’ ওজনের কিলগুলো আমার এই স্থূল চর্মে স্রেফ আরাম দেওয়া ভিন্ন আর কোনো ফলোৎপাদন করতে পারে না, কিন্তু যখনই পাকড়ে বস, ‘ভাই, তোমার সকল কথা খুলে বলতে হবে,’ তখন আমার অন্তরাত্মা ধুকধুক করে ওঠে, – পৃথিবী ঘোরার ভৌগোলিক সত্যটা তখন হাড়ে হাড়ে অনুভব করি। চক্ষেও যে সর্ষপ পুষ্প প্রস্ফুটিত হতে পারে বা জোনাক পোকা জ্বলে উঠতে পারে, তা আমার মতো এই রকম শোচনীয় অবস্থায় পড়লে তুমিও অস্বীকার করবে না।
পরের লেখাটাও পড়ুন।
‘হাঁ আমার ছোটোকালের কোনো কথা বিশেষ ইয়াদ হয় না। আর আবছায়া রকমের একটু একটু মনে পড়লেও তাতে তেমন কোনো রস বা রোমান্স (বৈচিত্র্য) নেই! – সেই সরকারি রামশ্যামের মতো পিতামাতার অত্যধিক স্নেহ, পড়ালেখায় নবডঙ্কা, ঝুলঝাপপুর ডান্ডাগুলি খেলায় ‘দ্বিতীয় নাস্তি’, ‘দুষ্টামি-নষ্টামিতে নন্দদুলাল কৃষ্ণের তদানীন্তন অবতার, আর ছেলেদের দলে অপ্রতিহত প্রভাবে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ! আমার অনুগ্রহে ও নিগ্রহে গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বিশেষ খোশ ছিলেন কিনা, তা আমি কারুর মাথায় হাত দিয়ে বলতে পারি না; তবে সকলেই আমার পরমার্থ কল্যাণের জন্য যে সকাল-সন্ধে প্রার্থনা করত সেটা আমার তীক্ষ্ণ শ্রবণেন্দ্রিয় না-ওয়াকেফ ছিল না। একটা প্রবাদ আছে, ‘উৎপাত করলেই চিৎপাত হতে হয়’।
নজরুল 'আলালের ঘরের দুলালে' টেকচাঁদ ঠাকুরের জায়গাটা সহজেই নিতে পারতেন। কিন্তু এড়িয়ে গেলেন। অবশ্য তাঁর 'খুন' শব্দ ব্যবহারেই খুনোখুনি বেঁধে যাওয়ার উপক্রম। একালে সঙ্ঘ পরিবারের মুখপত্র যে সম্পাদকের খুব বন্দনা করে সেই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে 'খুন' শব্দ নিয়ে লেখাযুদ্ধ শুরুর উদগাতা।
নজরুল সুরসিক। প্রথম লেখাতেই চিহ্ন স্পষ্ট।
একদিন পাঠশালায় বসে আমি বঙ্কিমবাবুর মুচিরাম গুড়ের অনুকরণে ছেলেদের মজলিস সরগরম করে আবৃত্তি করছিলুম, ‘মানময়ী রাধে! একবার বদন তুলে গুড়ুক খাও!’ এতে শ্রীমতী রাধার মানভঞ্জন হয়েছিল কিনা জানবার অবসর পাইনি, কারণ নেপথ্যে ভুজঙ্গপ্রয়াত ছন্দে ‘আরে রে, দুর্বৃত্ত পামর’ বলে হুংকার করে আমার ঘাড়ে এসে পড়লেন সশরীরে আমাদের আর্কমার্কা পণ্ডিতমশাই! যবনিকার অন্তরালে যে যাত্রার দলের ভীম মশাইয়ের মতো ভীষণ পণ্ডিতমশাই অবস্থান করছিলেন, এ নাবালকের একেবারেই জানা ছিল না। – তাঁর ক্রোধবহ্নি যে দুর্বাসার চেয়েও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল তা আমি বিশেষ রকম উপলব্ধি করলুম তখন, যখন তিনি একটা প্রকাণ্ড মেষের মতো এসে আমার নাতিদীর্ঘ শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি ধরে দেয়ালের সঙ্গে মাথাটার বিষম সংঘর্ষণ আরম্ভ করলেন।
নজরুলের ৪১ টি গদ্য গ্রন্থে আছে--
এক. গল্প ও উপন্যাস
দুই. নাটক
তিন. প্রবন্ধ
চার. কথিকা
পাঁচ. সম্পাদকীয়
ছয়. অভিভাষণ
সাত. পত্র-সাহিত্য।
এ-নিয়ে বিশদে লেখা যাবে। আপাতত এ-টুকুই।