এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • কোথায় তোমার দেশ গো বন্ধু ? (উপসংহার)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৫২২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • উপসংহার
    ৮ই মে, ২০৩১
    বৃহস্পতিবার

    আজ আমি ছাড়া পাচ্ছি।

    এই আবাসটি এখন প্রায় খালি। সাতদিন আগে ভবানীদার নাম জানিয়ে দিয়ে আমার রিলিজ অর্ডারের অপেক্ষায় ছিলাম। যে বলেছিল যে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হবে তার পাত্তা নেই। ওরা চলে গেছে সব ফাঁকা করে, এমনকি প্রিয়ংবদাকেও নিয়ে গেছে। রয়েছে শুধু রান্নাঘরের ইনচার্জ ভরত ও ড্রাইভার মোহিত।

    ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি। সামান্য জামা কাপড়।
    ভরত আর এখানকার ড্রাইভার অপেক্ষা করছে। আমাকে জীপে করে ছেড়ে আসবে। গড়িয়ার কাছে কোন গেস্ট হাউসে নামিয়ে দেবে। আজ আমাকে দিল্লি যাওয়ার টিকিট পাঠিয়ে দেবে। কাল রওনা দেব। সবিতা ও টুকটুকিকে ওরাই খবর দেবেন।
    কোথাও দূর থেকে হাওয়ায় ভেসে আসছে গান — এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার!
    কান পেতে শুনতে থাকি। এবার ‘চির নূতনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ’।  আরে, আজ রবীন্দ্র জয়ন্তী।
    অবশেষে গতকাল বিকেলে এল সেই বহুপ্রতীক্ষিত অর্ডার — মোহিতের হাত দিয়ে।  খেয়াল হল প্রায় পাঁচমাস এই গুলাগে আটকে ছিলাম। মাত্র পাঁচমাস আমার কেমন একবছর মনে হচ্ছিল। এখানে ঘড়ি ক্যালেন্ডার সব অচল হয়ে গেছল।
    প্যাকিং হয়ে গেল। এবার কি তাহলে? হরি হরি! জীপটা নেই, ড্রাইভার মোহিত বোধহয় গাড়িতে তেল ভরাতে গেছে। কেমন মনে হচ্ছে ওদেরও অদ্যই শেষ রজনী। দেখতে পাচ্ছি -- বারান্দায় দুটো প্যাক করা স্যুটকেস রাখা আছে। অর্থাৎ এই ‘ঘুঘু সই’ বাসা আবার আগাছা আর কাঁটালতায় ভরে যাবে। পুকুর থেকে উঠে আসবে জলঢোঁড়া, সোনাব্যাঙ, কেঁচো।
    ফের কোন তারিণীকুমার এদের শিকার হবে। তখন শুরু হবে বন কেটে বসত প্রোগ্রাম।
    জীপ এসে গেছে। ইঞ্জিন বন্ধ হয় নি, অ্যাক্সিলারেটর দিয়ে দিয়ে কালো ধোঁয়া ছাড়ছে। আমি ঘরে ঢুকে যাই ব্যাগ তুলতে। শেষবারের মত ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নিই। দেয়ালে চুণকাম হয় নি। গোটাকয় টেলিফোন নাম্বার পেন্সিল দিয়ে লেখা। আমার তো নয়, তাহলে আগে যে ছিল। বেশ, এরকম তারিণীকুমার আরও আছে। এই ঘরে চার মাস তিনসপ্তাহ কাটিয়ে গেলাম। মনে মনে গুডবাই করে বেরোতে যাব আমাকে প্রায় ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে এক মানবশরীর।
    সিরাজুল অথবা সোমেন্দ্রনাথ।
    -- দাঁড়ান মাস্টারমশায়, যাবার আগে এটা নিয়ে যান। নইলে দিল্লি যাবেন কী করে?
    ওর বাড়িয়ে দেয়া বাদামী লম্বাটে খামটি আমি বিনা বাক্যব্যয়ে নিয়ে নিই।
    -- আরে খুলে দেখুন। ঠকবেন না।
    আমার ওর সঙ্গে কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই। তবে খামটা খুলে ফেলি। ভেতরে রয়েছে রাজধানী এক্সপ্রেসের একটি টিকিট, সেকেন্ড ক্লাস এসি। আর রয়েছে পাঁচশ’ টাকার কুড়িটা নোট।
    -- এর বেশি হল না মাস্টারমশায়। কারণ আপনার খবরটা ভুল ছিল। বুড়ো চাপরাশি ভবানীদা স্লীপার সেল নয়। আসল স্লীপার সেল ধরা পড়ে গেছে, কালকে।
    আমি উত্তেজনায় কাঁপতে থাকি, ভবানীদা নয়? আমার ভুল হল?
    -- শুনলে আশ্চর্য হবেন - স্লীপারকে আপনি চিনতেন। উনি অনুপম হালদার, ডিটেনসন সেন্টার নং 1276/WB এর প্রাক্তন ইনচার্জ।
    আমি আর থাকতে পারি না।
    -- হতে পারে না। তোমরা ভুল করছ, অনুপমবাবুর মাথায় কাঁচাপাকা চুল, আদৌ ধপধপে সাদা নয়। ভবানীদাই হবে।
    -- আরে শুনুন তো! অনুপমবাবু চালাকি করে মেসেজটায় ধপধপে সাদা করে দিয়েছিল। বুদ্ধি আছে মানতে হবে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মাঝখান থেকে ভবানীদা হার্ট অ্যাটাকে চলে গেল। ওদের বাড়িতে এখনও জানানো হয় নি। মেডিক্যাল রিপোর্ট, ফটোগ্রাফ এসব তৈরি হচ্ছে,তারপর। কাস্টডিয়াল ডেথ বলে কথা। যাকগে, চলুন,  এবার রওনা হওয়া যাক। আমি গড়িয়া রেলস্টেশনের কাছে নেমে যাব। ওখান থেকে ট্রেন ধরে আগে শ্যালদা, তারপর রাণাঘাট কুপার্স ক্যাম্প।
    আমার গা ঘামতে থাকে।
    -- আমি তোমার সঙ্গে যাব না সিরাজুল।
    -- এখনও রেগে আছেন? হাই মর‍্যাল গ্রাউন্ড! ভেবে দেখুন মাস্টারমশায়—আপনি আমি খুব একটা আলাদা কিছু নই। আপনার কথায় একজন নিরপরাধ লোকের প্রাণ গেছে।
    আরে আমি তো গত মাস অব্দি ঠ্যাকা দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার বৌ খয়রুন্নিসার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে চার্জ লাগিয়ে ওকে আটকে রেখেছিল। সেদিনের পর জেল থেকে বের করে দিয়েছে, কিন্তু কুপার্স ক্যাম্পে একরকম নজরবন্দী করে রেখেছে। আপনার কপাল ভালো।

    আমি গড়িয়ার গেস্ট হাউসে গিয়ে স্নান টান করে দুটো ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। বাসে করে নাকতলা পোস্ট অফিস স্টপ পনের মিনিট। আমাকে অজগরের মত সম্মোহনে টানছে ভবানীদার বাড়ি। দরজায় টোকা দিতে একজন অল্প বয়েসি মহিলা দরজা খোলে। শংকরের বঊ? এবার শংকর বেরিয়ে আসে। আমাকে দেখে ওর মুখ উজ্বল হয়। এগিয়ে এসে পায়ের ধূলো নেয়।
    -- আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে মাস্টারমশায়? খুব ভালো।  তাহলে বাবাও শীগগির ছাড়া পেয়ে যাবে। খাওয়া হয়েছে? শুনছ, এককাপ চা দিয়ে যাও।
    স্যার, একটা দরখাস্ত লিখে দেবেন,  ইংরেজিতে? সাতদিন আগে রাত্তিরে এসে বাবাকে তুলে নিয়ে গেছে। এখনও কোন খবর পাই নি। বাবার বয়েস হয়েছে, শরীর ভালো নয়। আজ একটা সোর্স ধরেছি, শুধু ইংরেজিতে একটা আর্জি লিখে নিয়ে যেতে হবে। আপনি আগে চা খান, তারপর লিখে দেবেন।

    *************************************************************

    টালিগঞ্জের ডিসি অফিসের সামনে অনশনে বসেছেন সবিতা। দাবি একটাই — ওঁর স্বামী তারিণীকুমারের  গীতাঞ্জলি মেট্রোর লাইনে মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, হতে পারে না। কিন্তু থানা এফ আই আর করছে না।
    চ্যানেলগুলোর প্রশ্নের সামনে সবিতা শান্তভাবে বলেন — পুলিশ একটা চোথা ধরিয়ে দিয়ে বলছে মৃতের পকেটে নাকি এই চিরকুট ছিল। তাতে লেখা আছেঃ

    “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
      তারিনীকুমার দত্ত’’।
     
    এবার  আপনারা খেয়াল করে দেখুন তারিণী বানানটা—‘ণ’ নয়, দন্ত্য ‘ন’! আমার প্রশ্ন — যে লোকটা সারাজীবন মাস্টারি করে এত এত ছেলেমেয়েকে মানুষ করল সে আজ তার শেষ চিঠিতে নিজের নামের বানান ভুল করতে পারে? এটা আমায় বিশ্বাস করতে বলেন? আমিও পুলিশ অফিসারের মেয়ে।
                                                                                        
    (সমাপ্ত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৫২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২২:২০504015
  • হুম্ম। 
    এইটা ঠিকঠাক।
  • Swati Ray | 117.194.***.*** | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২২:৪৬504019
  • পড়া শেষ করে চুপ করে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ . 
     
    এই কি আমাদের ভবিষ্যৎ ? কি জানি !
  • Ranjan Roy | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২৩:৩৬504025
  • দ , স্বাতী এবং আর যাঁরা এই তেতো ধারাবাহিকটি কষ্ট করে পড়েছেন এবং সময় সময় মন্তব্য লিখে পথ দেখিয়েছেন--তাঁদের সবাইকেই ধন্যবাদ। এ'জন্যেই গুরুর পাতায় লেখা।
  • রুখসানা কাজল | 59.153.***.*** | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২২:৩৯504336
  • আজ সবগুলো পর্ব পড়ে ফেললাম।  শিউরে উঠেছি প্রতিটি পর্ব পড়ে।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন