আচ্ছা, আপনারা কেউ ‘গামছা’- সুকানকে চেনেন? বা সুকিকে? ওই যে যার মাথা এত নিরেট, যে বাপ পেটাতে পেটাতে, উঠোনে পড়ে থাকা ধান ওজন করার দাঁড়িপাল্লার কুড়ি কেজি ওজন সামলানো ডাণ্ডাটা দিয়ে মাথায় মারলে, ডাণ্ডাটাই ভেঙে যায়? চেনেন না? বেশ, ডঃ সুকান্ত ঘোষকে চেনেন তো? যিনি বিলেত থেকে ডক্টরেট, পোস্ট ডক্টরেট ইত্যাদি করে এখন সমুদ্র থেকে তেল নিষ্কাশন এবং সে’ বাবদ সম্ভাবিত দুর্ঘটনার সিকিউরিটি এক্সপার্ট? এইসব ভয়ংকর গম্ভীর গম্ভীর ব্যাপারে সে এখন হিল্লি-দিল্লি নয়, দেশ-বিদেশ – বালিদ্বীপ, বান্ডুং (এটা কি ইন্দোনেশিয়ার সেই জায়গাটা, যেখানে আমাদের শৈশবে নেহেরু-চৌ এনলাই এবং সুকার্ণ মিলে জোট নিরপেক্ষ দেশের বিখ্যাত বান্দুং সম্মেলন হয়েছিল?), ইউরোপ কোথায় না ঘুরে বেড়ায়? হয়ত হনলুলু বা কামচাটকাও যায়, আমাকে-আপনাকে বলে যায়নি আর কি!
কিন্তু গামছা-সুকানকে চিনতে হলে আপনি হাওড়া থেকে বর্ধমানের মেন লাইনের লোকালে চেপে বসুন। মেমারির গায়ে গায়ে একটি ছোট স্টেশন নিমো। আগে ছিল দুটো লাইন – আপ-ডাউন প্ল্যাটফর্ম, ইদানীং মাঝে একটা তিন নম্বর শুরু হয়ে লোকের ভোগান্তি বেড়েছে। কারণ, পুরুষানুক্রমে যে স্টেশন মাস্টারের দায়িত্ব সামলায়, সে হরদম অন্যমনস্ক হয়ে ভুল প্ল্যাটফর্মের ঘোষণা করে। আর শেষ মুহুর্তে তার কোর্স-কারেকশনের পাল্লায় পড়ে বুড়োবুড়ি-মেয়েমদ্দ সবার হেনস্থা, দৌড়োদৌড়ি। তাই দৌড়তে দৌড়তে বাউরি বউ চেঁচিয়ে ঘোষণা করে – এবার গোপালকে ক্যাল দিতে হবে।
আপনি এবার স্টেশনের কাছে নারান জামাইয়ের চায়ের দোকানে চা খেয়ে নিন, জানিয়ে দিন আপনি গামছা-সুকানের বন্ধু, ব্যস্, আপনার চায়ের দাম লাগবে না। উলটে চায়ের সঙ্গে কিছু ‘টা’ জুটে যেতে পারে। ওদের বাড়ি? স্টেশন থেকে আধমাইল হন্টন। তাতে কি? আপনি জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে যান, কোন দীঘির পাড় ছাড়িয়ে গায়ে গায়ে বাড়ির ফাঁকে একজন বৌ একটি দেয়ালে ঘুঁটে দিচ্ছে, এবার আপনি নিশ্চিন্ত, পৌঁছে গেছেন সুকানের বাড়ি।
ও হরি হরি ! এটা তো ওদের তিনপুরুষ আগের বাড়ি, সাত পুরুষের ভিটে। ওদের নতুন ঘর উঠেছে পুকুরের ওপারে ওদের বাগান আর গোয়াল ঘরের পাশে। কিন্তু নতুন বাড়ি, অথচ কোলকাতা বা বর্ধমানের নতুন ওঠা বাড়িগুলোর থেকে কেতায় আলাদা। তার দুটো কারণ:
এক, সুকানের বাবা নতুন বাড়ি বানানোর সময়, ওর বন্ধুস্থানীয় তিনজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে হাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তারা কেউ বিঘে, কাঠা – এসব মাপ জানে না। বরং কীসব স্কোয়ার ফিট-টিট নিয়ে আজগুবি মাপজোকের কথা বলছিল। তারা নকশা বানাতে একটা কাগজ পেনসিল চাইলে, ওর পিতৃদেব নাক কুঁচকে একটা যাত্রাপালার লিফলেটের কাগজ ধরিয়ে ওর পেছনে এঁকে দিতে আদেশ করেছিলেন। তারা আদেশ পালন করেছিল, কিন্তু সেই কাগজটা সুকানের মা সম্ভবত ঝাঁট দিয়ে বিদেয় করেছিলেন। কারণ বাবার দৃঢ় বিশ্বাস – এইসব কেতাবী অজ্ঞদের নকশামত বাড়ি বানালে সেটা দশ বছরও টিকবে না। অতএব, এল পুরোনো রাজমিস্ত্রি এবং এই গাঁয়েরই কাঠের মিস্ত্রি। তবে দরজার কাঠ সেগুন, ও যে সুকানের ছোটবেলার বন্ধু।
দুই, এই বাড়ির ইন্টেরিয়র ডিজাইন বানিয়েছেন সুকান্তের অর্ধাঙ্গিনী অমৃতা – অনেক যত্নে, অনেক ভালোবাসায়।
কিন্তু সুকানের দেখা বাড়িতে না-ও পেতে পারেন। বিদেশ থেকে পুজোর আগে বা জয়েন্ট ফ্যামিলির কারও বিয়ে দিতে অল্প ক’দিনের জন্য এসেছে। তাই ভর দুপুরে দিবানিদ্রা ত্যাগ করে সে হয়তো গুলতানি করছে সেই স্টেশনের কাছে খোকনদার সেলুনে, বা ‘নিমো ভারত সেবক সমাজ’ অথবা ‘নিমো সোনার বাংলা’ ক্লাবঘরে। এখন গরম কমে গেছে বলে ওর গায়ে গামছা নেই বটে, কিন্তু পায়ে রয়েছে খাদিমের চটি, গায়ে একটা পাঞ্জাবি – যার কাপড় বিদেশি, কিন্তু কাটিং ও সেলাই নিমো গ্রামের বিখ্যাত বড়ভাইয়ের দর্জি দোকানের।
একটা কথা বলি। আপনি বোধহয় জেনেছেন যে সুকান ওদের গাঁয়ের সরকারি স্কুল থেকে প্রথমবার বোর্ডে মেরিটে আসা মেধাবী ছাত্র? এবং ও শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং মেরিটে পাশ দিয়ে বিলেতে গিয়ে ‘মেটাল ইরোশন’ বা ‘ধাতুক্ষয়’ নিয়ে ডক্টরেট করেছে? তাহলে চুপিচুপি একটা কথা বলি। স্টেশনে যদি বিকেলের মুখে দেখা হয় রেললাইনের ওপার থেকে ধেনো গিলে টলতে টলতে আসা একজনের সঙ্গে, যে নাকি সুকানের বাড়ি ছোটবেলা থেকেই কাজ করার সুবাদে ওর নাড়ি-নক্ষত্র জানে, সে আপনাকে জোর দিয়ে বলবে, যে সুকান না ডাক্তার, না ইঞ্জিনিয়ার। ওর বাবা আগে বলত ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, এখন ছেলে বলছে ও নাকি ডাক্তার। ওরা বাপ-ছেলে মিলে আলাদা আলাদা গল্প বলছে, তাতেই ধরা পড়ে গেছে। আসলে ও কলকাতায় লোহা কেনাবেচার ব্যবসা করে কিছু পয়সা করেছে। এখন কোনটা বিশ্বাস করবেন সেটা আপনার উপর।
তবে মোদো-মাতালদের ছেড়ে বুড়োশিবতলায় বটগাছের নীচে তাস খেলতে থাকা বুড়োদের আড্ডায় যদি জিজ্ঞেস করেন, তো তারা আপনাকে আশ্বস্ত করবে – ঘোষ বাড়ির গামছা-সুকান বিলেত-ফেরত ডাক্তার বটে। ওখান থেকে ‘ধাতুক্ষয়’ প্রতিরোধ শিখে এসে বিদেশেই চিকিৎসা করে। যদি গাঁয়ে বসে করত, তাহলে আজকের ছেলে-ছোকরাদের আর কাশেম ডাক্তারের কাছে ছুটতে হত না।
ডঃ সুকান্ত ঘোষ বা সুকানের লেখা ‘নিমো গ্রামের গল্প’ বইটি এমন সব আনকাট ডায়মণ্ডে ভর্তি। বইটি যদি না পড়ে থাকেন, তো বলব “আপনি জানেন না কী হারাইতেছেন”। আর পড়লে কী পাইবেন? এই লেখার শেষ প্যারায় যান।
বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অসংখ্য ভাষা-কোলাজ। আপনি চলে যাবেন অন্য এক দুনিয়ায়, যেখানে সময় থমকে গেছে। সেখানে ব্যস্তসমস্ত কাঠের কারবারি থেকে দোকানদার সবাই মাত্র এক বেলা কাজ করে, বাকি সময় গাঁয়ের কাজে লাগে এবং জমিয়ে গল্পগাছা করে। অনায়াসে খদ্দেরদের ভাগিয়ে দেয় – এত দিন পরে সুকান এয়েচে বিদেশ থেকে, এখন দুটো কথা কইব না? পরে এস।
হ্যাঁ, কত কথা জমে রয়েছে! সুকান যে সেই ছাত্রবয়েস থেকে গাঁয়ের নতুন প্রেমে পড়া ছেলেপুলেদের প্রেমপত্র লিখে দিত পাইকিরি হারে। ওর কোটেশনের খেরোর খাতায় শ্রেণীবিভাগ করা থাকত – ক্লাস এইট অবধি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজে পড়া।
যেমন কলেজের জন্যে “ডানদিকে বসে আছে বর্তমান, বুকের বাঁদিকে তুমি”।
এর একধাপ নীচে – “তুমি যেখানেই হাত রাখো, সেখানেই আমি”। কিন্তু এই কোটেশনের ভুল ব্যবহারে ছেলেটি মেয়েটার বাপ-দাদার হাতে উদোম ক্যাল খেল। ছেলেটা পরে বলল, সুকানেরই দোষ, “আরে প্রথম চিঠিতেই কেউ যেখানে সেখানে হাত রাখার কথা লেখে?”
প্রেমের অনেক গল্প আছে। এক বাপ সক্কাল বেলায় বিড়ি ফুঁকে পায়খানা যাওয়ার সময় দরজা খুলে দেখে – দোরগোড়ায় এক কলেজে পড়া মেয়ে, সে আবার ম্যাথস্ অনার্স, সেকেন্ড ইয়ার। সে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে এই পরিবারের বৌ হবে বলে, নইলে আজই আত্মহত্যা করবে। মুরুব্বিরা শুধোন – তুমি যাকে বিয়ে করতে চাইছ, ও তোমাকে কদ্দূর পড়েছে বলে জানিয়েছে? মেয়েটি অনায়াসে বলে – বলেছে ও মাধ্যমিক ফেল!
সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেলে, যাক হাড়পাজি ছোঁড়া জীবনে প্রথমবার সত্যি কথা বলেছে; এরপর ক্রাউড ফাণ্ডিং করে বিয়েটা বুড়ো শিবতলায় হয়ে যায়।
নিমোগ্রামের ব্যাপার স্যাপার আলাদা। কয়েক পুরুষের নাপিত বাড়িতে এসে বাচ্চাদের হাঁটুর মধ্যে মাথা চেপে ধরে খানিকটা চুল কেটে মাঝখানে চা খেতে বসে পড়ে। তারপর যে কলকাতার ট্রেন ধরবে, তার দাড়ি আগে কাটে, ফের চা খায়। বাচ্চা ছেলেটা?
নাঃ, আর স্পয়লার দেব না। তাহলে এই লেখা শেষ হবে না। হিন্দি বলয়ের প্রবাদ – হরি অনন্ত, হরি কথা অনন্ত। পাতা উলটে যান, দেখতে পাবেন কনেকে ফুলশয্যার রাতে বরের সলাজ প্রশ্ন: তুমি ছাগলের দুধ দুইতে পার? গাঁয়ের চাষিবাসি মানুষজন স্কুলে মাস্টারদের ধমকাচ্ছে – তোমরা আজকাল ফাঁকি দিচ্ছ মাস্টার! ছাত্রদের ক্যালাচ্ছ না কেন? রোজ নিয়ম করে সবকটাকে ক্যালাও! আরও আছে – ক্রিকেট খেলায় টস জেতার ডার্ক আর্ট শিখতে তান্ত্রিকের কাছে যাওয়া। জানেন কি, ধোনির আগে নিমো গ্রামের কেউ আবিষ্কার করে হেলিকপটার শট; নিমো গ্রামের ভাষায় “পাখা মার’! রাঁচি থেকে নিমো গ্রামে ট্রেনে আসা অসম্ভব নয়, আর ধোনি প্রথমজীবনে ট্রেনের টিকিট চেক করতেন।
বুঝতেই পারছেন, ধাতুক্ষয়-বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরের বিশেষজ্ঞ ডক্টর সুকান্ত ঘোষের বুকের ভেতরে রয়েছে নিমো গ্রাম। তার চেতনায় রয়েছে সিপিএম দলের দোর্দন্ড প্রতাপ। তখন চারদিকে কালচার কালচার! সবাই মিছিল করে নাটক বা যাত্রা দেখতে যেত। এক ছাত্র ইতিহাসের ক্লাসে মিছিল করে মহম্মদ বিন তুঘলককে দেখতে যাওয়ার কথা বলে শাস্তি পেয়েছিল। তাই আমস্টার্ডামে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিংয়ে যখন সবাইকে নিজের জীবনে ঘটা সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনার কথা বলতে বলা হয়, উনি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলেন – মেমারিতে সিপিএমের পরাজয়।
আসলে আমাদের সবার অবচেতনে রয়েছে একটি নিমো গ্রাম। আমরা একটা বয়সে সবাই ফিরতে চাই আমাদের নিজস্ব নিমো গ্রামে; ফিরতে পারি না। সাহস পাই না যে! কিন্তু উনি ব্যতিক্রম, তাই প্রতিবছর নিজের ছেলেকে নিয়ে ফিরে যান নিমো গ্রামে; ভাইয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে রাতের অন্ধকারে পাঞ্জাবি পরা বরকর্তা উঠে পড়েন আমড়া পাড়তে মগডালে।
সময় থেমে থাকে না। মেমারিতেও থেমে নেই। তার ছবিও রয়েছে বইটির শেষভাগে। আর হ্যাঁ, নিমো গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে আপনার ভিক্টোরীয় রুচিকে খানিকক্ষণের জন্য বিদেয় করতে হবে। ব’কারান্ত দুই ও চার অক্ষরের প্রাকৃত সম্বোধনের ছড়াছড়ি, কিন্তু কোথাও বেখাপ্পা লাগে না। আর সম্বিৎ বসুর একটি অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে, যা আমি প্রথমেই পড়ে ফেলি। কারণ গোটা বইটা পড়তে হবে তারিয়ে তারিয়ে।
পড়ার পরে? আপনি অনুভব করবেন, যে জীবনে সুখী হতে খুব বেশি কিছু চাইনা; ইঁদুর দৌড়, ছোটাছুটি, মারপিট – এসব অনর্থক। চাই শুধু ভালবাসা – মানুষের জন্যে, চারপাশের সবার জন্য। তারা হতে পারে বাউরি বৌ বা রবি বা মুস্তাক, তাতে কিস্যু এসে যায় না। আমরা হয়তো নিমো গ্রাম থেকে কিছু শিখতে পারি।
গুরুচণ্ডা৯ কর্তৃপক্ষ এমন একটি বই প্রকাশ করে আমার মত অগণিত পাঠকের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন।