এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  পরিবেশ

  • ভারতবর্ষের বামপন্থা ও পরিবেশচিন্তা

    Sandipan Majumder লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | পরিবেশ | ০১ জুলাই ২০২১ | ৩৪৫০ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • আর ভালো লাগে না। করোনা নিয়ে ভাবতে গিয়ে পরিবেশ, পরিবেশ নিয়ে ভাবতে গিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, এত ভাবাভাবি কি পোষায়? ভেবে যদি বা পৌঁছোলাম সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ছাড়া গত্যন্তর নেই, তখনই প্রশ্ন উঠবে তার রূপায়নটা করবে কে? ভারতবর্ষের বামপন্থী দলগুলো পরিবেশ নিয়ে কতটা ভাবছে? সেই ভাবনা কী নয়া-উদারবাদী ধারণার গোড়া উৎপাটনের কথা ভেবেছে কখনো? নাকি নিজেরাই বিকল্পহীনতার সমস্যায় ভুগেছে? পরিবেশকে কি সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা ছাড়া বাঁচানো যায়? সেই এজেন্ডা উন্নয়ন, আর্থিক বৃদ্ধি প্রভৃতির ধারণাকে প্রত্যাখান না করে কি বিকল্প অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে? এতসব ভাবনায় জারিত হয়ে শেষে একটু খতিয়ে দেখাই ঠিক করলাম। এবার বলার ভারতের বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে মূলত কম্যুনিস্ট পার্টিগুলি নিয়েই আমরা আলোচনা করবো। এখানে সিপিআই এবং সিপিআইএম বলে যে দুটি দল বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতায় ছিলো তারা এবং তার বাইরে যে দলগুলি কখনো শাসনক্ষমতায় যায়নি যেমন সিপিআইএমএল (লিবারেশন) বা অন্যান্য বাম দল তাদের প্রত্যেককে নিয়ে আলাদা আলোচনা করার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রভাবে, সংগঠনে এবং সদস্য সমর্থকের সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিপিআইএম দলকে নিয়ে একটা প্রতিনিধিত্বমূলক আলোচনা করা যেতে পারে। উল্লেখযোগ্য যে পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালায় এই দলের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত যথাক্রমে ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’ এবং ‘শস্ত্র সাহিত্য পরিষদ’ আছে যারা বিজ্ঞান,পরিবেশ এবং গণসংস্কৃতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিয়েওছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের পাকাপোক্ত অবস্থান না থাকলে অগ্রবর্তী সংগঠনগুলির ভূমিকাও দোদুল্যমান হয়ে পড়ে, এ আমাদের অভিজ্ঞতা। আমাদের মূল্যায়ন বাস্তবতার নিরপেক্ষতার খাতিরে সমালোচনামূলক হবে। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা কোথায় সেটা আমরা শেষে বলবো।

    ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্য সিপিআইএম দলের নির্বাচনী ইস্তাহারের দিকে নজর ফেরানো যাক। দেখা যাচ্ছে সেখানে পরিবেশ নিয়ে আলাদা একটা অনুচ্ছেদ আছে। সেখানে কার্বন গ্যাস নিঃসরণ, বিকল্প শক্তির ব্যবহার, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন ইত্যাদি বিষয়গুলি যথার্থ ভাবে আছে। কৃষকদের দাবীর ক্ষেত্রে প্রথাগত বীজ এবং জৈববৈচিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে কৃষকদের অধিকার রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। তপসীলি উপজাতি এবং আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ২০০৬ সালের অরণ্য আইনকে পূর্ণতার সাথে প্রয়োগ করে আদিবাসীদের অধিকারকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও বৃদ্ধির বিকল্প পথ অংশে স্বল্পভোগ্য বিলাসদ্রব্যের উৎপাদনের বদলে গণপ্রয়োজনের দ্রব্যের উৎপাদনে গুরুত্ব দেবার কথা বলা আছে। এসবকিছুই পরিবেশভাবনার কাম্য নির্দেশনার অভিমুখী। সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপাত্র ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’র বিভিন্ন সংখ্যায় পরিবেশ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে লেখা আছে। আছে সদ্য ১০ই মে সংখ্যায় ইকো-ফ্যাসিস্ট কেন্দ্রীয় সরকারের ইআইএ (এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) কে পাল্টানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু সিপিআইএম যেখানে ক্ষমতায় থেকেছে যেমন পশ্চিমবঙ্গ সেখানে এই পরিবেশ চেতনাকে বজায় রাখতে পেরেছে কি? শুধু নয়া উদারবাদী ভাবনা নয়, কৃষি থেকে শিল্প, গ্রাম থেকে শহর, সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদ উন্নততর – এমন ভাবনা কি শেষ পর্যন্ত যাবতীয় বিকল্পর সম্ভাবনাকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খাইয়ে ছাড়ে না? একটু ভেবে দেখবো আমরা।

    ট্মাস পিকেটি তাঁর ‘ক্যাপিটাল অ্যাণ্ড ইডিওলজি’ বইতে একটি অধ্যায়ে ইওরোপের বামপন্থীদের (উনি অবশ্য তার মধ্যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, লেবার পার্টি, আমেরিকার ডেমোক্র্যাট সবাইকে ধরেছেন) ‘ব্রাহ্মণ বাম’ বলে অভিহিত করেছেন। তার কারণ অবশ্য এই যে গত চল্লিশ বছরের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে ইওরোপ আমেরিকার উচ্চশিক্ষিতরা এই বামদের বেশি ভোট দিচ্ছেন আর অল্প শিক্ষিতরা তাঁদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণপন্থীদের। এই প্রবণতা তার আগে ঠিক উলটো ছিলো অর্থাৎ বামেরা অল্পশিক্ষিতদের ভোট বেশি পেত। আমাদের এখানে আবার বামদের ব্রাহ্মণ্যবাদী বলে গাল পাড়েন দলিত রাজনীতি ও অতিবাম নীতির প্রবক্তারা। যেমন, সিপিআইএম প্রসঙ্গে তাঁদের একটা সাধারণ অভিযোগ হল যে তাঁদের পলিটব্যুরোতে কোনো দলিত নেতা নেই কেন? এই যুক্তির অনেক ফাঁক আছে। কারণ সংখ্যাগত প্রতিনিধিত্ব একটা ব্যাপার বটে কিন্তু সেটাই একমাত্র বিচার্য নয়। কারণ দলিতদের নিজস্ব দলকে ব্রাহ্মণ্যবাদী দলের পায়ে আত্মসমর্পণ করতে আমরা বহুবার দেখেছি (বহু নারীকে যেমন দেখি পিতৃতন্ত্রের ধ্বজাকে ভক্তিভরে বহন করে তার প্রতিনিধিত্ব করতে)। কিন্তু বামদের আরো জোরালো, আরো রাডিক্যাল সমালোচনা তাঁদের নীতির বিরুদ্ধেই করা চলে যে তাঁরা এই ব্যবস্থার বিকল্প বা বাহির দেখতে এবং দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যবস্থা যে একটা মিথ্যা ‘মেরিটোক্রেসি’ কে স্বাভাবিক হিসেবে দেখায়, বামেরা তার অন্যতম শরিকে নিজেরাই পরিণত হয়েছেন। এই মেরিটোক্রেসি মানে পরীক্ষায় বেশি নম্বর তোলা নয়, এর মানে আরো ব্যাপক – সমাজে যে যেটা পেয়েছে সে যেন খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটা ডিজার্ভ করে এই ছলনাকে মান্যতা দেওয়া। যারা পায়নি তারাও না পাওয়ারই যোগ্য, এই অবহেলাকেও স্বাভাবিকতার মোড়কে দেখা। ফলে সেই না পাওয়ার দল, শুধু না পাওয়ার ক্ষোভে নয়, সেই না পাওয়ার অস্বীকৃতিতে দূরত্ব অনুভব করে সেই দলের সঙ্গে। এই এলিটিজমকে, এই আত্মবিস্মরণকে একমাত্র কাটাতে পারত শ্রেণীচেতনায় নিরন্তর শান দেওয়ার অভ্যেস। সেটা কিভাবে অবহেলিত হয়েছে এবং কেন সেটা অন্যত্র অনেকে আলোচনা করেছেন। আমি সেসব বিশ্লেষণের মধ্যে যাচ্ছি না।
    সবাই জানেন, গত শতকের আটের দশকের মধ্যভাগ থেকে পশ্চিমবঙ্গে কৃষি স্থিতাবস্থার কবলে পড়ে। তারপর কৃষি থেকে মাথাপিছু আয় কমতে থাকে । ভূমিসংস্কারের পরের ধাপ কী সেই প্রশ্নের সামনে দিশাহারার মত দাঁড়িয়ে থাকে বামফ্রণ্ট সরকার। ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক উদারনীতি প্রবর্তনের পর লাইসেন্স প্রথার অবসান হয় এবং পুঁজি ও শিল্প আকর্ষণের জন্য রাজ্যে রাজ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার চালিয়ে বামফ্রন্ট এর বাইরে থাকার ঝুঁকি নিতে পারে না। ১৯৯৪ সালে চতুর্থ বামফ্রণ্ট সরকার গ্রহণ করে প্রথম শিল্পনীতি। ততদিনে সোভিয়েট ভেঙ্গে গেছে, পূর্ব ইওরোপে সমাজতন্ত্রের নামে যে ব্যবস্থা চালু ছিলো তার পতন হয়েছে। চীন আর্থিক উদারনীতির পথে বেশ কিছুটা হেঁটে গেছে। বিকল্পহীনতার বিবর ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছিলো বোধহয়। এই শিল্পনীতিতে দেশী বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উদাত্ত আহ্বান রাখা হোলো। ‘অঙ্গরাজ্যে সরকার চালানোর বাধ্যবাধকতার’ পাশাপাশি তখন থেকেই শুরু হয়েছিলো ‘সামন্ততন্ত্র থেকে উন্নততর পুঁজিবাদে উত্তরণ’ এর আখ্যান, বিশেষত শ্রমিক ও কর্মচারী ফ্রন্টে। এই আহ্বান ২০০১ সালের পর তীব্রতা পাবে, আর ২০০৬-০৭ সালের পর মুখ থুবড়ে পড়বে। মাঝে ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রীত্ব হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল শেষ সুযোগ বামপন্থীদের কাছে। যদি কিছুদিনের জন্যও সরকার চালানো যেত আর কিছু জনমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার করা যেত তাহলে সরকার পড়ে গেলেও হয়তো সিস্টেমের একটা বাইরের দিক মানুষের চোখে পড়তো। অন্তত অঙ্গরাজ্যে সরকার চালানোর সীমাবদ্ধতা অনেকটাই কমানো যেত।

    ‘চাষীর ছেলে কি চাষী হয়েই থাকবে’, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর মুখে তাঁর রাজ্যশাসনের দ্বিতীয় পর্বে অর্থাৎ ২০০৬ সালের পর খুব বেশি করে শোনা যেত। এটা তিনি বলতেন তার শিল্পায়ন প্রচেষ্টার সাফাই হিসেবে। ততদিনে ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি আর শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ এই শ্লোগান চলে এসেছে। তত্বগতভাবে এই প্রচেষ্টার যাথার্থ্যকে ব্যখ্যা করার দায়িত্বে ছিলেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। বর্তমান যুগে শিল্পায়নে কর্মসংস্থানের পরিমাণ যে খুব কম সেটা তিনি জানতেন, জানতেন যে বর্তমানে যে বৃদ্ধির হার সেটাকে ‘জবলেস গ্রোথ’ বলে । কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষি থেকে শিল্পে উত্তরণকে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রের অগ্রবর্তী স্তর হিসেবে কাম্য বলে ব্যখ্যা করতেন। মানে এটাই ধ্রুপদী মার্কসবাদ বলে ভাবতেন। এই তত্ব অনুসারে শিল্পায়ন ও নগরায়ন হয়ে দাঁড়ায় সভ্যতার উন্নততর স্তর। আমি এখানে মার্কসবাদীদের কথা বলছি বটে কিন্তু অন্যান্য ধারার রাজনীতিবিদরাও মূলত এটাই ভেবে এসেছেন। এমনকি, ভারতের দলিতরা যাকে মসীহার আসনে বসিয়েছেন সেই কোট প্যান্ট পরা আম্বেদকরও গ্রামীণ সমাজকে মনে করতেন ‘জাতবৈষম্য আর কুসংস্কারের বদ্ধ ডোবা’। ভারী শিল্প আর নগরায়নের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। অবশ্য এদের আর দোষ কী, মার্কস নিজেই তো তাঁর ১৮৫৩ সালে লেখা ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধে অন্যান্য ইওরোপীয় পণ্ডিতদের মত ভারতীয় সমাজকে স্থাণু ও অনড় হিসেবেই দেখেছিলেন। তাই ব্রিটিশ শাসনের অনেক সমালোচনা করলেও ভারতীয় সমাজের ক্রমবিকাশকে এই শাসন নিজের অজান্তেই গতিশীল করবে, এই ছিলো তার বিশ্বাস। ভারতের মার্কসবাদীরা তো বটেই আরো অনেক চিন্তাশীল মানুষ এই মতেরই শরিক। কিন্তু মার্কস ঐতিহাসিক বিবর্তনের যে কালজয়ী গ্রন্থ কম্যুনিস্ট ইস্তাহার লিখেছিলেন ১৮৪৮ সালে সেটাই যে স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে ঐতিহাসিকতার চাবিকাঠি নয়, এশীয় উৎপাদনব্যবস্থা নিয়ে পরবর্তীকালে আমৃত্যু মার্কস ভেবে এসেছেন এবং সেই ভাবনার ফলে তার চিন্তার অক্ষরেখাও অনেকটা পালটে গেছে সে হিসেব রাখা দরকার। যেমন মৃত্যুর ঠিক আগের বছর ১৮৮১ সালে রাশিয়ার বিপ্লবী নেত্রী এবং তাত্বিক ভেরা জাসুলিচকে (পরে মেনশেভিক দলে যোগ দেন) লেখা চিঠি এবং তার তিনটি খসড়ায় (নেটে সহজলভ্য, এছাড়াও বাংলায় আলিবাবার গুপ্তভাণ্ডার, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়) মার্কস স্পষ্ট জানান পশ্চিম ইওরোপের বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ যেভাবে হয়েছে রাশিয়াকেও যে সেই একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে তার মানে নেই। এই প্রক্রিয়ার ‘ঐতিহাসিক অনিবার্যতা’র তত্বটি পশ্চিম ইওরোপের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। জাসুলিচ মার্কসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন রাশিয়ায় বিপ্লবপূর্ব কালে কৃষিতে একধরনের সমবায় ব্যবস্থা (Obshchina) যে চালু ছিলো সেগুলির মূল্যায়ন নিয়ে। মার্কস বলেছিলেন ইওরোপে কৃষি উৎপাদকের যেমন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ স্বত্বচ্যুতি (Expropriation) ঘটেছে বা ঘটছে সেটা সর্বত্র ঘটবে এমন নয়। বরং বিপ্লবের সাহায্যে রাশিয়ার কমিঊনগুলি সমাজতান্ত্রিক মালিকানায় সরাসরি পৌঁছে যেতে পারে। মার্কস তাই ভারতবর্ষ সম্পর্কে ওই প্রবন্ধেই শেষ কথা বলে গেছেন এমন নয়। বরং ১৮৮০ থেকে ১৮৮২ পর্যন্ত তাঁর নোটবই দেখলে (যেটা এথনোলজিকাল নোটবই নামে প্রথম ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত, দ্রঃ ইতিহাসের উত্তরাধিকার, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ) বোঝা যায় ইংরেজ শাসন বা আইন ভারতের কৃষিতে কোনো বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছে এই ধারণা থেকে মার্কস অনেকটাই সরে এসেছেন। তাই ইওরোপের বাইরে সর্বত্র সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র — এই পথেই ইতিহাসের ক্রমমুক্তি হবে, সেই বিঘোষণার পথ থেকে মার্কস অনেকটাই সরে এসেছেন। মার্কস নিজেই ইতিহাসের Master Key ধারণার বিরোধিতা করেছেন কারণ এই ধারণাটাই তাঁর ভাষায় ‘অতি-ঐতিহাসিক’ (Supra Historical)।

    প্রশ্ন উঠবে যে এত তত্ব কপচাচ্ছি কেন? কথা তো হচ্ছিলো পরিবেশ নিয়ে। আসলে কথা বলতে গেলেই মুশকিল। একটার টানে আরেকটা চলে আসে বলেছিলাম না। নয়া উদারবাদী আর্থিক ব্যবস্থা পরিবেশের ক্ষতি করে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই কিন্তু সাধারণভাবে পুঁজিবাদ, নগরায়ণ, শিল্পায়ন—এ সমস্ত কিছুই ক্ষতি করে মতাদর্শ নিরপেক্ষ ভাবেই। রাষ্ট্রের মালিকানায় ভারী বাঁধ বা ভারী শিল্প হলে সেখানেও পরিবেশগত ঝুঁকি থাকে। তার মানে ভারী শিল্পই করা যাবে না তা নয়। দরকার হোলো এ ব্যাপারে প্রগতির গর্ব টর্ব শিকেয় তুলে রেখে ন্যূনতম প্রয়োজনভিত্তিক কাজ করা। ঐ ‘চাষীর ছেলে কি চিরদিনই চাষীই হবে’ কথাটায় কৃষি থেকে শিল্পে, গ্রাম থেকে নগরে অভিবাসনের একটা প্রণোদনা আছে। ভারত বা চীনের মত দেশে, যেখানে একটা বিরাট অংশের মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত সেখানে তাদের কি শিল্পায়িত নগরে রিলোকেট করা সম্ভব যেমনটি করা গিয়েছিলো ইউরোপে? ইওরোপের ক্ষেত্রে এই চাপের অনেকটা নিয়ে নিয়েছিলো তাদের কলোনির শহরগুলি। এছাড়াও আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতেও, বিশেষত আমেরিকায় ব্যাপক অভিবাসন ঘটেছিলো। এইটে আজকের দুনিয়ায় সম্ভব নয়। এতদসত্ত্বেও যেটুকু নগরায়ণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ঘটছে তাতে শুধু বস্তি এলাকার বৃদ্ধি ঘটছে। পৃথিবীর বড় শহরগুলোর এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী এখন বস্তিতে থাকে। মুম্বাই শহরে এই হার এখন ৫৩ শতাংশ। এই বস্তিগুলিতে জীবনযাপনের যা মান তা সুস্থ পরিবেশচেতনার পরিপন্থী। মার্কস ১৮৪৪ সালে লিখিত তাঁর ‘অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’ তে লিখেছিলেন বড় শহরের এই দূষণের কথা। মার্কসের ভাষায় ‘মানুষ যেন আবার গুহাবাসী হয়েছে। তফাতের মধ্যে এই গুহা সভ্যতার নিঃশ্বাসজাত দুর্গন্ধ আর সংক্রমণে পরিপূর্ণ’। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিচ্ছেদ এখানে সম্পূর্ণ যে বিচ্ছেদ অতিক্রম করাই মার্কসবাদের লক্ষ্য। এঙ্গেলস তাঁর ১৮৭০ সালে লিখিত ‘প্রকৃতির দ্বন্দ্ব’ বইতে তাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘প্রকৃতির ওপর মানুষের বিজয়ের কারণে আমরা যেন নিজেদের বেশি বেশি পিঠ চাপড়াতে শুরু না করি। এইরকম প্রতিটা বিজয়ের জন্য প্রকৃতি কিন্তু তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। প্রতি পদক্ষেপে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা যেন বিদেশী মানুষদের জয় করা বিজয়ীর মত প্রকৃতির ওপর রাজত্ব করতে না যাই। আমরা আমাদের রক্ত, মাংস এবং মস্তিষ্ক নিয়ে এই প্রকৃতির অন্তর্গত এবং আমাদের এর ওপর যেটুকু কেরদানি এবং অন্য প্রাণীদের তুলনায় সুবিধা যে আমরা প্রাকৃতিক নিয়মগুলো বুঝতে পারি এবং সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারি’।

    বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং নিরুপম সেন ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সৎ রাজনীতিবিদ। কোনো ব্যক্তিগত লাভের জন্য তাঁরা শিল্পায়ন এবং পুঁজির আরাধনায় মেতেছিলেন এমনটা নয়। হয়তো এটাই ছিলো তাঁদের উন্নয়ন ভাবনা আর তাতে ১৯৯৪ সাল থেকে গৃহীত শিল্পনীতির প্রশ্রয় ছিলো। আমি শুধু দেখাতে চাইলাম যে এই উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে মার্ক্সবাদের কোনো সময়োচিত উদ্ভাবন জড়িত ছিলো না। যদি মার্কসবাদী পরিবেশ চিন্তা দিয়ে বিচার করা যায় সে ক্ষেত্রেও এই ভাবনার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সেক্ষেত্রে আজকের পরিবেশ আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা কী হবে? বামপন্থী মানে শুধু সিপিআইএম নয়। অনেক প্রাক্তন বিপ্লবী বামপন্থী আত্মসমালোচনার পথ বেয়ে (কারণ পুরোনো বিপ্লবী রাজনীতিতেও পরিবেশ নিয়ে কোনো ভাবনা ছিলো না) পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। আমাদের রাজ্যে জয়া মিত্রর নাম সর্বাগ্রে মনে আসে। সিপিআইএম এবং সিপিআইএর মতো দল ও তার অনেক সমর্থক কিন্তু অনেক জায়গায় পরিবেশ আন্দোলনে সামিল হন। যেমন সম্প্রতি অন্ধ্রে আরাকু উপত্যকায় বক্সাইট খননের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে তাঁরা সামিল হয়েছিলেন। আসলে ক্ষমতায় থাকা আর না থাকাটা বোধহয় অনেক তফাৎ গড়ে দেয়। আর তফাত গড়ে দেয় বিকল্প মনন, সৃজন আর উদ্ভাবনের তফাত। যাতে ক্ষমতায় থাকাটা না থাকার প্রতিপক্ষ হয়ে না দাঁড়ায় তার জন্যই এর প্রয়োজন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ সংক্রান্ত যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন তাতে পরিবেশ আন্দোলনের মঞ্চে আরো ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ দরকার। আমাদের রাজ্যেও বীরভূমের দেওরা পাচামিতে কয়লা খনি তৈরীর জন্য ১১০০ একর বনাঞ্চল ধ্বংস করে মারাত্মক মারণযজ্ঞ শুরু হতে চলেছে। জয়া মিত্র এর বিরুদ্ধে একটি অসাধারণ উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছিলেন আনন্দবাজারে। কায়েমী স্বার্থের বাইরে বিভিন্ন দলের (বামপন্থী শুধু নয়) সাধারণ সমর্থক ও ভোটাররা পরিবেশ ধ্বংসের সহজ বিষয়গুলো, যেমন বিশ্ব উষ্ণায়নের কুফল, রাসায়নিক সারের অপব্যবহার, এসব বুঝবেন না এমন নয়। উন্নয়নের বা কর্মসংস্থানের ফাঁপানো গল্প তাঁদের মস্তিষ্ককে অধিকার করে না নিলে তাঁদেরকেও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে পাওয়া যেতে পারে এই বিশ্বাস থাকা উচিত। পরিবেশ নিয়ে ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন করতে নেমে সেটা যে বিকল্প রাজনীতি ও জীবনধারার শিক্ষা দিতে পারে তার তাৎপর্য আমরা নিজেরাই ঠিকমত বুঝে উঠি নি। বিশেষ দলীয় লাইনের আধিপত্য নয়, সাধারণ ইস্যুতে মানুষের গণফ্রণ্ট এখন সময়ের দাবি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০১ জুলাই ২০২১ | ৩৪৫০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ০১ জুলাই ২০২১ ১১:৫৪495506
  • ভাবাচ্ছে।

  • Sandipan Majumder | ০১ জুলাই ২০২১ ১২:১৬495507
  • @Ranjan Roy ধন্যবাদ। 

  • স্বপন সেনগুপ্ত | 43.252.***.*** | ০১ জুলাই ২০২১ ১৪:০৬495509
  • আরও আলোচনা চাইছি, খুব ভাল লাগলো, তাই!!  ৯১ টি অরণ্য কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, মুনাফার স্বার্থে!!!! তারপর? 

  • Dhrub Banerjee | 42.***.*** | ০১ জুলাই ২০২১ ২৩:০৩495519
  • এককথায় সাবাশ!

  • Sandipan Majumder | ০১ জুলাই ২০২১ ২৩:৫২495520
  • যাঁরা  মন্তব্য  করে  উৎসাহিত করলেন  প্রত্যেককে অসংখ্য  ধন্যবাদ। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন