অরুণ নাগ মহাশয়ের প্রবন্ধের পাঠগ্রহণ আদতে অভিজ্ঞতার পরিমলের মধ্যে প্রহরযাপন। অনুষ্টুপ প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহ পাঁচমিশালি-তে সংকলিত হয়েছে ১৬টি প্রবন্ধ। এদের মধ্যে সময়ের বিচারে যে জ্যেষ্ঠ, ‘চিত্রবিচার’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে, সেই নিরিখেই নবীন প্রবন্ধ তিনটি, যাদের প্রকাশকাল ২০১৬। সুতরাং পাটিগণিতের মাপে ৩২ বছর সময়কালের ১৬ টি প্রবন্ধ নিয়ে এই পাঁচমিশালি নয়, চারমিশালি গদ্যসংকলন।
আসলে গদ্যকার সংকলিত ১৬ টি প্রবন্ধকে বিন্যস্ত করেছেন চারটি বিভাগে: সাহিত্য, ইতিহাস, শিল্প, সমাজ। তিনি নিজেই বলে রেখেছেন, লেখক হিসাবে তিনি ‘বহুপ্রজ’ নন। সেও পাটিগণিতেরই মাপজোখ। বরং তাঁর অন্য আর এক কবুলিয়তের দিকেই আমাদের টান: ‘গোটা কর্মজীবন বিদ্যাজগতে কাটালেও বিদ্যাচর্চার যে প্রশস্ত রাজমার্গ তার পথিক হওয়া দূরে থাক, তার প্রতি বিশেষ অনুরাগ বোধ করিনি। পার্শ্ববর্তী সরু রাস্তা, অকুলীন মার্গেই আমার স্বচ্ছন্দ বিহার।’ এ কবুলিয়ত আমাদের প্রফুল্ল করে বটে, তবে পুরোপুরি সহমত হতেও বাধে। আমরা বিলক্ষণ জানি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে তিনি মান্য অধিকারী। তবে হুতোমের গদ্য, শান্তিনিকেতনের মুরাল, কথাসাহিত্যের বিবিধ পথে যখন তাঁর বিভাবনা বিচরণ করে অম্লান মনোযোগে, সে মার্গগুলিকে তিনি ‘অকুলীন’ বলবেন কেন?
এহ বাহ্য। আমরা বরং এটুকুই বলে নিই, তাঁর বীক্ষণের বৈদগ্ধ্য ও রসবোধের সদাউপস্থিতি ওই মার্গগুলিতে পাঠককে ডেকে নেয় অনায়াসে।
এহ অপিচ বাহ্য। এই বিচিত্র পথে যাত্রার অভিজ্ঞতা ও আনন্দ কোনো এক বিশেষ পথে যাত্রাকালেও রচে রাখে এক পরিপৃক্ত মাধুকরী, তাঁর নিজের জন্য তো বটেই, আমরা বলি, অবশ্যই আমাদের মতো পাঠকসাধারণের জন্য।
তাঁর বিদ্যায়তনিক বিদ্যাচর্চার যে ‘রাজমার্গ’, সে মার্গে তাঁর বিচরণের সঞ্চয় এখানে পাওয়া যাবে মূলত তিনটি নিবন্ধে: ‘ইতিহাসের অনুসরণ’, ‘প্রত্নতত্ত্ব ও প্রতিক্রিয়া’, ‘প্রত্নতত্ত্বের বিপক্ষে’। এই তিনটির মধ্যে দুটি নিবন্ধেরই বয়নে তাঁর অবলম্বন সাহিত্য, বিশেষত আখ্যানের সোনালি সুতো। ‘প্রত্নতত্ত্বের বিপক্ষে’-র প্রথম দুটি শব্দ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ-নিবন্ধ শুরুই হচ্ছে অপুর চোখে দেখা তার বাড়ির বর্ণনা দিয়ে, যে বাড়িটাকে সে ২৪ বছর পর দেখছে। এ পরিগ্রহণ দেখে আপ্লুতিতে শিহরিত হতে হয়, এ সেই অব্যর্থ গ্রহণ যখন সাহিত্যই দিল প্রত্নতত্ত্বের লক্ষ্য ও সংজ্ঞার সমীপবর্তী হওয়ার সুযোগ। এবং এ-নিবন্ধের সমাপন ঘটছে আর-একটি আখ্যান দিয়ে যা প্রবন্ধকারের নিজেরই নির্মাণ, তাঁর ক্ষেত্র-অভিজ্ঞতারই প্রাপ্তি। তিনি বলছেন প্রত্নক্ষেত্রের সংলগ্ন গ্রামে দেখা মজদুর পরিবারের শিশুদের ‘একসক্যাভেশন খেলা’। প্রত্নপারাবারের তীরে শিশুদের সেই খেলায় বিম্বিত হয় ‘লেয়ার মার্কিং’, ‘লেয়ার লেভেল’, কল্লোলিত হয় ‘হুঁশিয়ারি সে খোদনা’, ‘বহোত পুরানা চীজ’। আখ্যান দিয়েই সূচনা, আখ্যানেই সংহার।
অরুণ নাগের সাহিত্যপাঠের বিস্তার এত বহুকৌণিক, এত বিচিত্র সরণিগামী আমাদের হঠাৎ মনে হচ্ছিল, এই বুঝি তিনি বিভূতিভূষণের ‘প্রত্নতত্ত্ব’-র সঙ্গে ‘আরক’ গল্পটিকেও বাড়িয়ে দিলেন নিখুঁত টানে। সে হয়নি বটে, কিন্তু ইতিহাসের এই ফলিতবিদ্যা প্রসঙ্গেই অনায়াসে সমাবেশ ঘটে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাষাণের কথা, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মৃৎপ্রদীপ’, সতীনাথভাদুড়ী-র ‘অনাবশ্যক’ কিংবা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বেনের মেয়ে’, এমনকি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের স্বল্পখ্যাত শিশুপাঠ্য কবিতা ‘আবিষ্কার’-এর অনুষঙ্গ।
কিন্তু কেন এ পথে সাহিত্যের এমন নিয়ত ও নিবিড় সমাবেশ? এ প্রশ্ন তিনি নিজেই তুলেছেন বেশ কয়েকবার। ব্যঙ্গ কিংবা পরিহাসের অভিপ্রায়ে? পরিহাস শব্দটি তিনি ব্যবহার করছেন অন্তত দু-বার। আসলে ইতিহাসের মতো সমাজবিজ্ঞান বা সেই বিজ্ঞানের অন্যতম উপাদান হিসাবে প্রত্নতত্ত্বের মতো একটি ফলিত প্রক্রিয়া—এসবের পাশে সাহিত্যকে সমাবিষ্ট করে এক সংঘর্ষ ঘটানোই যেন তাঁর অভিপ্রায়। যে-কোনো প্রচলিত ও মান্য ধারণার শিলা ও সৌধগুলিকে ঝাঁকিয়ে দেওয়া, বিজ্ঞানগণ্য বা ব্যাবহারিক প্রক্রিয়া নিয়েও আমাদের চেতনায় যদি কোনো অভ্রান্তি বোধ থাকে, তার বনেদটাকেও নাড়িয়ে দেওয়াই তাঁর জ্ঞানচর্চা ও গদ্যের অনিবার্য আকাঙ্ক্ষা।
এখন বুঝি, কেন তিনি সাহিত্য শিল্প ইত্যাদি বিচিত্র সরণি-বিচরণকে অকৌলীন্য দিয়ে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাজগতের যে প্রশস্ত ও পাকা সড়ক ধরে তিনি হেঁটে গেছেন, সেটা যে আদতে কত ভঙ্গুর তা প্রমাণ করার নাশকতাই তিনি ঘটিয়ে গেছেন নিয়ত। এবং যে-কোনো নাশকতা ঘটানোই তো প্রান্তজনের কাজ, ব্রাত্যজনের কাজ। এবং ভাবনার জগতে নাশকতা ঘটানো ছাড়া ভাবুকের, লেখকের অন্য কী দায় থাকতে পারে!
ফলত নাগ মহাশয়ের অকৌলীন্যকে প্রণতি জানাই।
সমাজবিজ্ঞানের এলাকায় সাহিত্যের এই প্রবেশ এবং ক্রমশ দলভারী হওয়া, দল-পাকানো গদ্যশরীরে তৈরি করে এক আশ্চর্য আঘ্রাণ, সেখানে যেন অনুধাবন আবিষ্কার আস্বাদনের সহাবস্থান, নিষ্পেষণ ও সংঘর্ষ। পিষ্ট উপাদান ও অনুষঙ্গগুলির আঘ্রাণই পরিমল, যা পাঠকের পরমপ্রাপ্তি পুরো বইয়ের জমিন জুড়ে চলাচলে।
প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক ইতিহাস নিয়েও যে নিবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে পাঁচমিশালি-তে, সেখানেও তিনি উদ্ধৃতির জন্য অনেকখানি জমি ছেড়ে দেন। ‘দুটি প্রজাবিদ্রোহের উপাখ্যান’ বা ‘দীন মুহম্মদের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত’-র মতো প্রবন্ধগুলিতে উদ্ধৃতির ভূমিপ্রসার পাঠককে মাধ্যমিক সুবিধা দেয়।
ফকীরমোহন সেনাপতির আত্মকথন বা দীন মুহম্মদের প্রবাস-কথনের মূল উৎসে যে পাঠকের যাওয়ার কথা ছিল না, বা কথন দুটি যখন ভাষান্তরে খুব সহজলভ্যও নয়, অরুণ নাগের নিবন্ধের প্রদেশে সেগুলির বড়ো এলাকা দেখতে পাওয়া পাঠকের পাওনাগন্ডাকে বেশ ভারী করে তোলে। নানাদিগন্তে পাঠকের আগ্রহকেও প্রলুব্ধ করে, সাহসী করে। ‘দীন মুহম্মদের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত’-র বেলায় পাওনার ঝুলিটা বেশ দামিই হয়, কারণ অরুণবাবু জানিয়েছেন ‘The Travels of Dean Mahomet...’ ছোটো আকারের একটি বই। সারা পৃথিবীতে এ বইয়ের কয়েকটি মাত্র কপির সন্ধান পাওয়া গেছে। ইদানীং অবশ্য বইটি ইন্টারনেটে সহজলভ্য। সমগ্র বইটির একটি সংক্ষিপ্ত বঙ্গানুবাদ সওগাত দিয়েছেন প্রবন্ধকার যা ডিমাই আকারে ৪২ পৃষ্ঠা। অরুণবাবুর এই বঙ্গানুবাদ সহ উপক্রমণিকা গদ্য নিয়ে নিবন্ধ ১৯৯৫ সালের প্রকাশনা। বিলাতে ভারতীয়দের ভ্রমণ ও অভিবাসন নিয়ে সাম্প্রতিক কালের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা মাইকেল এইচ ফিশারের Counterflows to Colonialism (Permanent Black) প্রকাশিত হয়েছে ২০০৪ সালে, গোলাম মুরশিদের বই ‘কালাপানির হাতছানি: বিলাতে বাঙালির ইতিহাস’ (অবসর) ২০০৮ সালে। পাঁচমিশালি হাতে নিয়েই আমরা লক্ষ করলাম, এই পথে খোঁজ শুরু করেছিলেন অরুণ নাগ বিশ শতকের শেষ দশকেই।
ফকীরমোহন সেনাপতির আত্মচরিত অত দুষ্প্রাপ্য নয়। এ বইয়ের প্রকাশনা, ভাষান্তর নিয়ে হদিস দিয়েছেন প্রবন্ধকার বিস্তারিত ভাবেই। এ-বই থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতির কারণ, লেখক জানিয়েছেন, অন্যতর। সমস্ত প্রজাবিদ্রোহকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরোধ বলে ভাবার পন্থাকে মূর্খতার প্রমাণ বলে জানতে বলেছিলেন গদ্যকার। ভাবনার এমন একরৈখিক পন্থা সামাজিক অবস্থান ও সামাজিক সম্পর্কের জটিলতাকে গ্রাহ্য করতে চায় না, পর্যবেক্ষণ করতে শেখায় না। ইতিহাসচর্চার এই একমাত্রিক অর্থনীতিক কৌণিকতা নিয়ে কত আগে সতর্ক করেছিলেন, অন্য কেউ নন স্বয়ং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। প্রয়োজনে তিনি আঙুল তুলেছিলেন তাঁর নিজের এবং তাঁর অনন্য সেই সখা-সহযোদ্ধার দিকে। ফকীরমোহন থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি পাঠককে স্বাবলম্বী করে তোলে উপনিবেশকৃত একটি দেশের এক আঞ্চলিক রাজ্যের রাজা-রাজপরিবারের বিবদমানবর্গ-আদিবাসী রায়ত প্রজা এবং সমগ্র অস্থিরতার অভ্যন্তরীণ অন্যতম প্রধান চরিত্র ও একই সঙ্গে কথক এক আলোকিত রাজকর্মচারী, এই বহুকৌণিক অবস্থান ও সম্পর্কগুলি প্রকম্পন বুঝে নিতে। অরুণ নাগ মহাশয় তাঁর পাঠকের জন্য স্বাধিকার ও স্ব-শাসনের এই পরিসর তৈরি করে দেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে কোনো সহজ ছক, মান্য ‘গল্প’ থাকতে পারে না। সে যত প্রত্যয়িত ও শংসিত হোক না কেন এবং এমন একটি প্রত্যয়িত ও বহুশংসিত রুচি ও ভাবনাবর্গকে ভাঙতে তিনি কতটা সাহসী হতে পারেন তার তপ্ত চিহ্ন রয়ে গেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস-নির্ভর গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রের পর্যালোচনায় (‘ধন্য ধন্য বলি তারে’)। এই উপন্যাস এবং এই চলচ্চিত্রের প্রশংসায় মুখর হন প্রখ্যাত দুই ইতিহাসগুরু রণজিৎ গুহ এবং তপন রায়চৌধুরী। আর তখনই যেন অরুণ নাগের সেই ভাঙন-বাসনা একেবারে পরশুরাম হয়ে ওঠে। কালপ্রগতির দাগগুলি নির্দিষ্ট করে করে তিনি দেখিয়ে দেন ইতিহাস-নির্ভর একটি উপন্যাস এবং তার চিত্রনাট্য ইতিহাসের বিচারে কতখানি ফোঁপরা ও কাণ্ডজ্ঞানহীন হতে পারে। ভাঙনেরই এই জাড্যে তিনি এগিয়ে যান চলচ্চিত্রায়নেরও অন্দরে। হয়তো তাঁর মনে পড়েছিল অভিনয়কেন্দ্রের প্রতি তপন রায়চৌধুরীর প্রশংসার কথা। সেটাও ভেঙে তিনি দর্শিয়ে দেন প্রধান চরিত্রের ‘কুতিয়ে কুতিয়ে’ বলা সংলাপ সিনেমার দৈর্ঘ্যকে অন্তত আধঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়।
সাহিত্য, ইতিহাস, শিল্প, সমাজ—এই চার মিশেলের সমাহার পাঁচমিশালি। সাহিত্য ও শিল্প বিভাগের প্রবন্ধগুলি নিয়ে আমরা স্বতন্ত্র ভাবে কোনো কথা তুলিনি। আসলে এই ‘মিশালি’ শব্দটা শুধু এই সংকলনের জন্য নয়, অরুণ নাগের সমস্ত লেখালিখি ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেই চাবিকাঠির মতো। তাঁর সজীব আগ্রহ ও বিচরণের দুরন্ত প্লাবনে এই সীমানাগুলি কখন ভেঙে ভেসে যায়!
অন্যতর কয়েকটি কথা। নিবন্ধগুলির প্রথম প্রকাশকালের সঙ্গে প্রথম প্রকাশক্ষেত্রের উল্লেখ থাকলে ভালো হত। প্রথম নিবন্ধ ‘গল্প ও তার গোরু’-তে হঠাৎ হঠাৎ অক্ষরের মাপ কেন ছোটো হয়ে গেল, বোঝা গেল না। অথচ দীর্ঘউদ্ধৃতির ক্ষেত্রে যেখানে অক্ষরের মাপ ছোটো হওয়াই সংগত ও স্বাভাবিক ছিল, তেমনটা কিন্তু ঘটল না। ঘটলে দৃষ্টির ছন্দের সঙ্গে বইয়ের দৈর্ঘ্যও খানিক কমত।
গ্রন্থনির্মাণের ক্ষেত্রে শেষ একটি কথা, যথাযথ এ-বইয়ের প্রচ্ছদ। সত্যজিৎ রায়, খালেদ চৌধুরী, পূর্ণেন্দু পত্রী, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়দের পরের প্রজন্মে দেবব্রত ঘোষ, সোমনাথ ঘোষরা বাংলা বর্ণমালায় লিপিচিত্রের যে ঐতিহ্য তৈরি করেছেন সেই পরম্পরায় অসামান্য সংযোজন রাতুল চন্দ রায়ের বর্তমান বইয়ের নামাঙ্কন। নবীন এই কবি-শিল্পীকে অভিবাদন জানাই।
কত পাতার বই?