পুরোনো দিনের কাঠের টেবিলগুলো যেমন হয়। অনেকটা উঁচু। নিচে পা-রাখার জায়গা। যাকে ইংরেজিতে বলে— ফুট রেস্ট। এটা অবশ্য অনেক পরে জেনেছিলাম। টেবিলের দু’দিকের কোনায় দু’টো ড্রয়ার। তার মধ্যে লুকিয়ে রাখা এক জাদুকরের জগৎ। আগলে রাখা ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। টেবিলটা ছিল বাবার। পরে বড় হয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে সেটি দখল করলাম। নব্বইয়ের একেবারে শুরুর দিকে বাসাবদলের পর টেবিলটি আমার জিম্মায় এল। তাতে জমে উঠল লিটল্ ম্যাগাজিন। ফুটপাথ থেকে খুঁজে বের করা সব আশ্চর্য উজ্জ্বল উদ্ধার। তখনও লেখালেখি নিয়ে সেভাবে কিছু ভাবিনি। কলেজ স্ট্রিটে যাওয়া হচ্ছে নিয়মিত। প্রেসিডেন্সি কলেজের পোর্টিকোও ধোঁয়া উদযাপন চলছে। কফিহৌসের সুড়ঙ্গ দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে উপরে উঠছি। আবার রাতের অন্ধকারে সাঁতার কাটতে কাটতে মিলিয়ে যাচ্ছি শিয়ালদা স্টেশন, ওয়েলিংটন, নিমতলা, শ্যামবাজার কিংবা যাদবপুর এইট-বি মোড়ের দিকে। টেবিলের ড্রয়ারে জমা হচ্ছে— না লেখা চিঠি। জমা হচ্ছে বাসের টিকিটের পিছনে লেখা কথোপকথন। চকোলেটের মোড়ক। পাথরের টুকরো। বেশি রাতে ট্রেনের শান্টিং। সেতুর মাথায় ঝুঁকে পড়া বহুতল মেঘ। একটা গোটা জুন মাস সূর্যাস্ত-হলুদ রঙের ওষুধের স্ট্রিপ সমেত ঢুকে পড়ছে শিরা-উপশিরায়, স্নায়ুতে। আর টেবিলের নিচে জড়ো হচ্ছে, জমায়েত হচ্ছে, রক্তবর্ণ কাপড়, লাল-সালু।
বাবার ছিল সরকারি অডিটের চাকরি। কাজের সূত্রে বাংলার প্রায় সমস্ত জেলা-সদরেই যেতে হত। সিউড়ি। মালদা। বালুরঘাট। জলপাইগুড়ি। একবার গরমের ছুটিতে আমাদের ডেকে নিলেন উত্তরবঙ্গ। রাতের দার্জিলিং মেল ধরে সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। মেঘলা দিন। ওভারব্রিজের উপর থেকে অনেকটা দূর দেখা যাচ্ছে। ট্রেন লাইন বেঁকে গেছে। নিচে প্ল্যাটফর্মে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দাঁড়িয়ে। হুইসল বাজিয়ে ছেড়ে দিয়ে আরও উত্তরের দিকে চলতে শুরু করল। শিলিগুড়ি শহরটা তখন জলরঙে আঁকা কবিতার মতো। সেই ছোট ছোট বাড়ি। টিনের চাল। সামনে একটু বাগান। সুপুরির সারি। হিলকার্ট রোড। সেবক রোড। ভেনাস মোড়ে সাইকেল রিকশ’র কনসার্ট, সম্মেলন। দার্জিলিং মোড়, মাটিগাড়া, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে জিপ ছুটল নকশালবাড়ি। এক পাশে ন্যারোগেজ লাইন। আর ডানদিকে চা-বাগান আর চা-বাগান পেরিয়ে দার্জিলিং পাহাড়।
ছোটবেলা থেকেই কিছু কিছু শব্দ মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। এ’দেশ আমাদের হলেও আসলে আমাদের নয়। আমরা রিফিউজি। উদ্বাস্তু। দেশভাগের কারণে একদিন রাতারাতি ভিটেমাটি সব ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। এই স্বাধীনতা টেবিলের তলায় হয়েছে। নেতাজী থাকলে দেশের এই হাল হত না। কলোনির ছেলেমেয়েরা অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা শিখেছে। কংগ্রেসি গুন্ডারা ভোট দিতে দেয়নি। আর নকশাল আমলে পুলিশ খুব অত্যাচার করেছে। কত ভাল ভাল ছেলেকে গুলি করে মেরেছে।
কাক উড়ে গেলে কখনও তাল পড়ে। হয়ত বা কাকতালীয়। তবু লিখি— আমার জন্মের ঠিক আগের দিন ৭ ফেব্রুয়ারি দ্রোণাচার্য ঘোষকে জেলের মধ্যে গুলি করা হয়। খুন হন তিনি।দ্রোণাচার্য ছিলেন কবি। বিপ্লবী। হুগলির মগরার মানুষ। অত্যাচারী জোতদার খুনের দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের হেফাজতে চরম শারীরিক অত্যাচার চলে। দ্রোণাচার্যকে ইমামবাড়া হাসপাতালে ভরতি করা হয়। সেখান থেকেও পালিয়ে যান তিনি। আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু ফের পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান। দিনলিপিতে দ্রোণাচার্য লিখেছিলেন— কবিতা এবং রাজনীতি দুই-ই আমার কাছে সমান প্রিয়, তবে কবিতা কিছু পরিমাণে বেশি। অবশ্য দুটোই পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, কেউ কাউকে বাদ দিয়ে নয়, তবু শেষ অবধি আমি কবিই।... এটা স্পষ্ট বুঝেছি এই সমাজকে পাল্টাতে হবে। এই শোষণের সাম্রাজ্যকে পাল্টাতে রাজনীতি হচ্ছে পথ। আর কবিতাও এই পাল্টানোর জন্য আমার অন্যতম হাতিয়ার। আর তাছাড়া রাজনীতিকে বাদ দিয়ে ‘মানুষের কবিতা’ লেখা যায় না। মানুষের কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন দ্রোণাচার্যের মত অনেকেই। যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র তিমিরবরণ সিংহ। শঙ্খ ঘোষ ছিলেন তিমিরের মাস্টারমশাই। ‘আদিমলতা গুল্মময়’ ও ‘বাবরের প্রার্থনা’র কবিতায় এই সব দিনের আভাস আছে। 'কবিতার মুহূর্ত'। সেখানেও শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন— আটষট্টিতে তিমিরের মুখের রেখায় অনেক বদল হয়ে গেছে। শুধু তিমির নয়, অনেক যুবকেরই তখন পাল্টে গেছে আদল, অনেকেরই তখন মনে হচ্ছে নকশালবাড়ির পথ দেশের মুক্তির পথ, সে-পথে মেতে উঠেছে অনেকের মতো তিমিরও। তারপর একদিন গ্রামে চলে গেছে সে... যাদবপুরের বসতি এলাকার শ্রমিকদের মধ্যে নকশালবাড়ি রাজনীতির আগুন মশালের মতো করে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিমির। তারপর একদিন মালদার গ্রামে চলে যান ভূমিহীন গরিব কৃষকদের কাছে।
১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্য়াল উইকলি’ হাতে এসেছিল। তাতে কল্যাণ চৌধুরীর একটি প্রবন্ধ ছিল ‘ল অ্যান্ড অর্ডার কিলিংস’। নথিতে দেখা যাচ্ছে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে তিমিরবরণকে খুন করা হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। তিমিরের সঙ্গেই নাম রয়েছে বিপ্লব ভট্টাচার্য, মৃদুল সরকার, আশিস ভট্টাচার্য, গোরা দাশগুপ্ত, নজরুল ইসলাম, কানাইলাল বঙ্গ, প্রভাত ব্যানার্জি — এঁদের। বিশে ফেব্রুয়ারিতেও একজন বিপ্লবী খুন হন। তাঁর নাম নথিভুক্ত নেই। আননোন।
ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির তিমির
তিমির বিষয়ে দু’টুকরো।। শঙ্খ ঘোষ
লেখার টেবিলের নিচে তাই ভারী হয়ে জমতে শুরু করে লাল সালু। ফ্লাইওভারের উপর হুটারের লিম্ফোসাইট ধ্বনি। আর তার নিচে গণ কনভেনশনের পোস্টার। আর তার নিচে ফুটপাথ শিশুদের ছন্দজ্ঞান। আর তার নিচে উন্মাদের হস্তমৈথুন...একটা গোটা জুন মাস সূর্যাস্ত-হলুদ রঙের ওষুধের স্ট্রিপ সমেত ঢুকে পড়ে শিরা-উপশিরায়, স্নায়ুতে...
সেই চাঁদমণি চা-বাগান, মাটিগাড়ার দিগন্ত পার করে আমাদের জিপ এসে পৌঁছল নকশালবাড়ি হাসপাতালের সামনে।
ক্রমশ...
পড়ছি।
ভালো লাগছে
খুব ভালো লাগছে । এই উদ্যোগ সফলতা পাক।
বেশ লাগল
পড়ছি, চলুক...
ভালো লাগছে
বেশ ভালো লাগলো।
ভালো লাগছে ! অতীত কে নাড়ী ভুঁড়ি সুদ্ধ টেনে বার করুন দাদা !!
ঐ টেবিলে ওয়াহিদা রহমান এর ছবি কি এখনো আছে?
খুব , খুব ভাল লাগছে, সেই ঐতিহাসিক সময়ের উপস্থাপনা, অন্য স্টাইল, অন্য লিখন শৈলী !!