দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে ট্যাংরা বসতি। ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠছে। কলকাতার আকাশে প্রকাণ্ড এক চিলের মত ভয় ডানা ঝাপটাচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় কারফিউ। একশো চুয়াল্লিশ ধারা। মিলিটারির সাঁজোয়া গাড়ি। সশস্ত্র টহল। ভারী বুটের শব্দ। গাছেদের আলোড়নেও যেন এক দমবন্ধ করা উৎকণ্ঠা। ঘরে থেকে বেরোনো নিষেধ।
দুপুরের দিকে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল। মাথার উপর হাত তুলে রাস্তায় হাঁটার নিয়ম শিখলাম। বন্ধুরা কে কোথায় কেমন রয়েছে খোঁজ নিতে হবে। কেননা কারফিউয়ের সেই দিনগুলোতে আমার শহরকে অন্যভাবে চিনতে শেখাচ্ছে এক নতুন ধরনের গান। সুমনের ‘তোমাকে চাই’। ‘পাগল সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে।’ গুজব ছড়াচ্ছে দাবানলের থেকেও দ্রুত। মসজিদের রাস্তায় ধুলো উড়ছে। অসম্ভব থমথমে চারদিক। সেনাবাহিনীর একটা দল ঘিরে রেখেছে এলাকা। কার্বাইনের চকিত নল। তার পাশ দিয়ে চলেছি। লম্বা হয়ে আসছে ছায়া। রাস্তা খননের কাজ চলছিল। এখন সে সব বন্ধ। গর্তের মধ্যে জল জমে। পাশেই টাইম কল। শীতের কনকনে বাতাস দিচ্ছে। একটা বাচ্চা খালি গায়ে হাত মুড়ে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে। মাথার মধ্যে লেখা তৈরি হচ্ছে—
‘দিদি আমার চুল আঁচড়ে দে। খালি গায়ে হাত মুড়ে দাঁড়িয়ে আছি। হু হু বাতাসে এখন কারফিউ শিথিল। আর শীতের কাচকাটা রোদ্দুর। রাস্তা খোঁড়া জল আমাদের বাথটাব। আমি আর দিদি এই ফুটপাথে মানুষ হয়েছি।’ সেই লেখা পড়ে শোনাচ্ছি। কলকাতা
বইমেলায়।
জিন্না সাহেবের দ্বিজাতি তত্ত্বের যে বিষ, তাকে গ্রহণ না করে আমার, আমাদের দেশ ভারত জন্ম নিয়েছিল ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। ১৯৯২, ৬ ডিসেম্বর সেই নিরপেক্ষতার মূলে আঘাত করল। নিয়ে এল দাঙ্গা, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতার অহিফেন। ভুখা ভারতবাসী, গরিব মানুষ, পিছিয়ে পড়া নিরন্ন সম্প্রদায়ের পাতে পড়ল ধর্মের আফিম। যেন বা খিদে ভুলে গেল মানুষ। প্রতিদিনই তখন হানাহানির খবর, রক্তাক্ত দাঙ্গা, খুনের খবর। প্রার্থনাগৃহ, উপাসনালয় ভেঙে দেওয়ার খবর। বয়স্ক মানুষেদের চোখে যেন ফের সেই দেশভাগের সময়কার দেজাভু। ১৯৪৬-এর রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার স্মৃতি।
‘—বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতীয় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।’ জীবনানন্দ দাশ। ১৯৪৬-৪৭।
জয়দেব বসু লিখেছিলেন— ‘ক্ষুধার্তের বিচারের ক্ষমতা থাকে না। তাই বাঁ হাতে তার নলী মুঠো করে যখন আমি ডান হাত তুলছি শূন্যে, গর্জন করে বলতে গেছি: হাইল আডবাণী... তখন তুমি এসে থামতে বলছ। বেশ করেছি ভেঙেছি, মাইন ফ্যুয়েরর আডবাণী বলেছেন ওটা আগে মন্দিরই ছিল... বেশ করেছি ভেঙেছি, হিন্দুর দেশ হলে মন্ত্রী হব আমি। বেশ করেছি। কিস্যু তুমি করতে পারোনি। পাঁচ ঘণ্টা ধরে ভেঙেছি, আর লা-পতা চুহার মতো গর্তে সেঁদিয়ে থেকেছ পাক্কা ন-ঘণ্টা। কিস্যু ছিঁড়তে পারোনি, একটা চুলও না..’
নেকড়ে: জয়দেব বসু।
সত্যিই তো কী করতে পেরেছিল সরকার! ১৯৮৩-৮৪, উত্তর প্রদেশে রামযাত্রার মিছিল বেরোতে শুরু করে। যেখানে রামকে দেখানো হয় এক জন জেলবন্দি হিসেবে। কারাগারের ভিতরে রাম। লালকৃষ্ণ আডবাণী পরিচালিত রথযাত্রার জমি প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্য সেই সময় থেকেই মাটি কামড়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। প্রচারক মোরোপন্ত পিঙ্গল। একজন সঙ্ঘী। যিনি হিন্দু ভাবাবেগের গা-ভাসানো স্রোতে সঙ্গে টানতে পেরেছিলেন বহু হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসি নেতাদেরও। যেমন করণ সিং। যেমন গুলজারি লাল নন্দ। উত্তর প্রদেশের কংগ্রেস নেতা দাউ দয়াল খন্না।
‘গলি গলি মে শোর হ্যায় রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়।’— দেওয়াল লিখনে ভরে গেল। কার্টুনে বোফর্স কামানের মুখ রাজীবের মতো। ঘুষ কেলেঙ্কারির স্লোগান তখন বাচ্চারাও ছড়ার মতো করে বলছে। কংগ্রেস বিরোধী হাওয়ার আঁচে ভোটের চাটু তপ্ত হয়ে উঠল। তার আগেই রাজীবের গায়ে সংখ্যালঘু তোষণের তকমা সেঁটে দিয়েছে হিন্দুত্বপন্থীরা। কেন্দ্র এবং উত্তর প্রদেশ দুই সিংহাসনেই তখন কংগ্রেস। সেশন কোর্ট নির্দেশ দিল উত্তর প্রদেশ সরকারকে, খুলে দিতে হবে বাবরি মসজিদের তালা হিন্দুদের জন্য। যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মসজিদের ভিতরে ঢুকে প্রার্থনা করতে পারেন। না কেন্দ্র, না রাজ্য, কোনও সরকারই সেদিন সেশন কোর্টের এই রায়ের বিরোধিতা করে, স্থগিতাদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেনি। এই নরম হিন্দুত্বের লাইন কংগ্রেসের পক্ষে যায়নি। বরং কংগ্রেসের উপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা পরবর্তী যে আস্থা, যে বিশ্বাস, তার ভিত টলে গিয়েছিল। সঙ্গে বোফর্স কামানের ধাক্কা। ১৯৮৯-এর লোকসভা ভোটে ২৫ আসন এবং এগারো শতাংশেরও বেশি ভোট ব্যালটে পুরে ভারতের সংসদীয় রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন শক্তি হিসেবে উঠে এল ভারতীয় জনতা পার্টি । বিজেপি।
মাইন ফ্যুয়েরর আডবাণী বললেন, আগে ওটা মন্দিরই ছিল। আর আমি ভেঙে ফেললাম। পর পর তিনটে গম্বুজ। আমার হাতে লোহার রড। আমাদের হাতে কুঠার। হাতুড়ি। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলাম ষোলশো শতকের ঐতিহাসিক সৌধ। আমাদের গলায় তখন শিরা ফোলানো রণহুংকার। ‘জয় শ্রী রাম।’ হ্যাঁ, হ্যাঁ এখানেই, ঠিক এখানেই ৯ লক্ষ বছর আগে রামের জন্ম হয়েছিল।
আমার, আমাদের এই উন্মত্ত তাণ্ডব, এই সংগঠিত অপরাধ, বর্বর আক্রমণ তাকিয়ে দেখল দেশ। কলঙ্কিত অধ্যায়ের সাক্ষী থাকল তামাম ভারতবাসী। কিন্তু কার, কাদের নির্দেশে চলল এই ধ্বংসলীলা? প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেন, রাম মন্দিরের এক সময়ের প্রধান পুরোহিত মোহন্তলাল দাস। যাঁকে আমরা দেখলাম ১৯৯০ সালে। আনন্দ পটবর্ধনের ‘রাম কে নাম তথ্যচিত্রে।’ লাল দাস বলেছিলেন, অযোধ্যাকে নিয়ে চলছে নোংরা রাজনীতি। যার নেপথ্যে ভারতীয় জনতা পার্টি। যে রাজনীতির সঙ্গে রামের জন্মস্থান বা ধর্মীয় চেতনার কোনও যোগাযোগ নেই। বলেছিলেন, রাম মন্দির নির্মাণের নামে সংগৃহীত বিপুল টাকা তছরুপ করেছে সঙ্ঘ পরিবার। ১৯৯১। উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় এসেই প্রধান পুরোহিতের পদ থেকে লাল দাসকে সরিয়ে দিল বিজেপি। ৬ ডিসেম্বর করসেবকদের হামলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই টেলিগ্রামে এসওএস অ্যালার্ট পাঠিয়েছিলেন মোহন্তলাল দাস। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল, এবং রাজ্য পুলিসের প্রধানকে। কিন্তু ওই যে, ‘লা-পতা চুহার মতো গর্তে সেঁদিয়ে থেকেছ পাক্কা ন-ঘণ্টা। কিস্যু ছিঁড়তে পারোনি, একটা চুলও না।’
লাল দাস ছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্য। মৃত্যুর সপ্তাহ দু’এক আগে মুম্বইয়ের এক সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন, তাঁর আশঙ্কা কিছু দিনের মধ্যেই খুন হয়ে যাবেন। কেননা তিনি জানেন, কার নির্দেশে মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে।
আর হলও তাই।
ওই তো !!ওই মার্গ দর্শক করা লোকটা ।..আদবানি আর মুরলী ধারী জোশি ।..আর সাধ্যি সাধু রা ..সঙ্গে আজকের হিটলার মোদী ।..আরো কত নেতা নেত্রী যারা এখন খেয়ে পেট মোটা করে সুখ নিদ্রা দিচ্ছেন সরকারি পাহারায় !!বাজপেয়ী কে দিয়ে নাটক করিয়ে নিলেন , যেন আরএসএস অনেক প্রগতি শীল আর পেছন থেকে বাঁশ ঢোকাল হিন্দুত্ত্ব বাদী দস্যু রা !!আর আমাদের প্রধান মন্ত্রী নর সিম্হা জি নির্বাক দর্শক !!এই সেই কংগ্রেস যারা আবার নতুন মুখ নিয়ে আসছে আমাদের মন ভোলাতে !!!