এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • কাক

    মাণিক চন্দ্র দাস
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ১৩৬১ বার পঠিত


  • ০১

    আব্দুর রহমান সাহেব তীব্র বিরক্তি নিয়ে বসে আছেন। হাতে অফিসের ফাইল। ফাইলে গুরুত্বপূরনো হিসেব আছে। হিসেব মিলছেনা। কিন্তু মিলতেই হবে। মেলাটা জরুরি। মাল্টিন্যাশনাল একটি কোম্পানির একটি দেশের হেড হবার কিছু ঝামেলা আছে। সেই ঝামেলা এখন রহমান সাহেবের উপর দিয়ে যাচ্ছে। হিসেবের কারনে এক রাত রহমান সাহেবের ঘুম হয়নি। যে হিসেব নিয়ে তিনি যন্ত্রনাতে আছেন, তা তার সামলানোর কথা না, অধীনস্থদের সামলানোর কথা। হিসেবের গোলমাল এর পরিমান বেশি, তাই রহমান সাহেব ফাইল বাড়িতে নিয়ে এসছেন। রাতে ঘুম না হবার কারনে মাথায় ঝিমঝিমে একটা অনুভুতি হচ্ছে। বিরক্তির কারনে তার দুই ভ্রু কুঁচকে একসাথে লেগে আছে। বিশ পাতার ফাইল রাতে খুব কম করে হলেও পঞ্চাশ বার পড়া হয়েছে। প্রতিটি ফিগার চেক, রিচেক করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা ঠিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

    সকাল ৬টা বাজে। রহমান সাহেব বসে আছেন তাঁর স্টাডিতে। কিছুক্ষন আগে তাঁর স্ত্রী কুমকুম এসে কফি দিয়ে গেছে। স্বামীর ভ্রু কুঁচকে আছে দেখে তিনি আর কিছু বলেননি। স্বামীকে কফি দিয়ে তাকে হাঁটতে বেরুতে হবে। কুমকুম এর ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস। রহমান সাহেবের স্টাডি সাউন্ডপ্রুফ। বাড়ী ডুপ্লেক্স। বাড়ীর দোতলার বাইরের দিকে একটা বারান্দা এবং তার সাথেই স্টাডি। স্টাডিতে ঢুকলে বাইরের দুনিয়া পুরো আলাদা হয়ে যায়। চারদিকে শুনশান নীরবতা। নৈ:শব্দ রহমান সাহেবের খুবই পছন্দ। তার অফিসের রুমটিও সাউন্ডপ্রুফ। রহমান সাহেব কফি শেষ করে নতুন করে ফাইল পড়া শুরু করলেন। হঠাত করেই তার বিরক্তি আরো বাড়লো। কোথায় যেন শোঁ শোঁ ধরনের শব্দ হচ্ছে। তার মাঝে আবার কটকট ধরনের শব্দ ও আছে। রহমান সাহেব খুব অবাক হলেন। স্টাডিতে কি করে শব্দ হয়? কুমকুম কি দরজা ঠিকমতো লাগাতে ভুলে গেছে? ফাইল রেখে রহমান সাহেব ভেতরের দরজার লক দেখলেন। নাহ, দরজা ঠিকমত লাগানো আছে। কুমকুমের অবশ্য ভুল হবার কথা না। এরপর তিনি দেখলেন বারান্দার দরজা। বারান্দা তে একটা ইজি চেয়ার রাখা।অএখানে রাতের বেলায় মাঝে মাঝে তিনি বসেন। রহমান সাহেব খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে তার ইজিচেয়ারের দুই হাতল এ দুটো বড়সড় কাক বসা। বোধ হয় দাঁড় কাক।
    মানুষ দেখার সাথে সাথে কাকের উড়ে যাবার কথা। এই কাক দুটোর মাঝে সেই রকম কোন ইচ্ছা দেখা যাচ্ছেনা। আচ্ছা, কাক দুটো এখানে বসে আছে কেন? দুনিয়া তে কি জায়গার অভাব? রহমান সাহেব কাকগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঠিক কি কারনে কে জানে, কাক দুটো ডানা ঝাপটে আবার বসেই রইলো। বিষয়টাতে রহমান সাহেবের অবাক হবার কথা কিন্তু তিনি অবাক হলেন না। তিনি তীব্র বিরক্ত ছিলেন। সেই বিরক্তির জায়গায় হলো রাগ। রাগে তার গা জ্বলতে লাগলো। তিনি কাকগুলোকে আবারো তাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কোন লাভ হলোনা। রহমান সাহেব রাগে মোটামুটি অন্ধ হয়ে গেলেন। স্টাডিতে তার শখের এয়ারগান থাকে। তিনি বারান্দা থেকে ছুটে গেলেন স্টাডিতে। এয়ারগান নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কাক দুটো তখনো বসে আছে। মানুষের যাওয়া-আসাতে তাদের কোন ভাবান্তর নেই। হাত তিনেক দূর থেকে রহমান সাহেব একটা কাককে গুলি করে দিলেন।

    এতো কাছ থেকে গুলি ফসকাবার কোন কারন নেই। কুচকুচে কালো রঙ এর কাক এক গুলিতেই শেষ। ঝপ করে মেঝেতে পড়লো মৃত কাক। বাকি কাকটা গিয়ে বসলো বারান্দার গ্রীলে। সাথীর মৃত্যুতে তার ভেতর কোন ভীতির সঞ্চার হয়নি। সে তীব্র দৃষ্টিতে রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলো। রহমান সাহেবও তাকিয়ে রইলেন কাকের দিকে। তিনি খেয়াল করলেন গ্রীলে বসে থাকা কাকটির রঙ একেবারে কালো না। এর গলার কাছে ছোট ছোট সাদা ফুটকি আছে। কাকটি এবার গিয়ে বসলো সামনের কারেন্টের তারে। সেখান থেকেও সে রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলো।

    কাকের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রহমান সাহেব তাকালেন মেঝের দিকে। পা কুকড়ে পড়ে আছে মৃত কাক। মেঝেতে অল্প রক্ত ও দেখা যাচ্ছে। মেঝে রহমান সাহেব নিজেই পরিস্কার করে ফেললেন। মরা কাক তিনি বারান্দা দিয়ে ফেলে দিলেন বাইরে । নিচে কুকুর দের এখনো বাঁধা হয়নি। রাতে বাড়ির কম্পাউন্ডে এদের ছেড়ে রাখা হয়। কাকের শরীর নিচে পড়া মাত্র কুকুরদের হুটোপুটি শোনা গেল।

    এখন মনে হচ্ছে রাগ একটু কমেছে। রহমান সাহেব স্টাডিতে ঢুকে গেলেন। কাকের কথা তার মনে রইলোনা। ফাইল এর সমস্যাটা বের করা জরুরি।

    ০২

    সকাল নটার দিকে রহমান সাহেব ফাইল দেখা বাদ দিলেন। সমস্যা তিনি খুঁজে পাননি। সমস্যা অবশ্যই আছে। পরে আবার চেষ্টা করা যাবে। একবার না পারিলে দেখ শতবার। ব্যর্থতায় তার বিরক্তি আরো বাড়লো। টেবিল থেকে উঠে রহমান সাহেব নিজের অজান্তেই গেলেন বারান্দায়। দরজা খুলে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। বারান্দার রেলিং, বাইরে কারেন্টের তারে সারি সারি কাক বসা। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। সবাই চুপচাপ বসে একদিকে তাকিয়ে আছে। চারপাশেও কেন যেন কোন শব্দ নেই। সাউন্ডপ্রুফ এলাকা থেকে বাইরে বের হলে অনেক শব্দ পাওয়া যায়। এখন তেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। যেন বারান্দাটাও সাউন্ডপ্রুফ। অন্যদিন গাড়ির হর্ন, রিক্সার টুংটাং শব্দ থাকে। আজ কিছুই নেই। হঠাৎ রহমান সাহেবের মনে হলো কাকগুলো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু অস্বস্তি বোধ করলেন রহমান সাহেব।
    বারান্দা থেকে তিনি ভেতরে ঢুকে গেলেন। অস্বস্তিটাও কেটে গেল। কাকের ঘটনা তার মাথায় রইলোনা। অফিস যেতে হবে। ফাইলটার সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে। আচ্ছা, কোম্পানিতে টাকা-পয়সা নিয়ে এত সমস্যা হয় কেন? টাকা কি মানুষের হাতে পড়লেই প্রাণ পায়? স্থির থাকে না কেন?

    ০৩

    সকাল ১০টায় রহমান সাহেব অফিসে ঢুকলেন। রুমে ঢোকার আগে প্রতিদিন নিজের দরজার সামনে দাঁড়ানো তার অভ্যাস। এই সময়টায় তিনি নিজের নেমপ্লেট পড়েন। নেমপ্লেট দেখলে তার কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে। জীবনে কি এটাই লক্ষ্য ছিল? মাঝে মাঝে তিনি জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ভাবেন। কিন্তু লক্ষ্য বিষয়টা তার কাছে পরিস্কার না।
    রুমে ঢুকেই রহমান সাহেব তার পিয়ন সুলতানকে ডাকলেন।
    "কেমন আছো সুলতান?"
    "ভাল আছি স্যার।"
    "চেয়ারের হাতল এ ইদানিং ধুলা দেখা যাচ্ছে । ব্যপার কি? চেয়ারের হাতল কি পরিস্কার করা হয়না?"

    চুপ করে দাড়িয়ে রইলো সুলতান। এ জাতীয় কথাবার্তা চুপচাপ শুনতে হয়। বড় সাহেব যদি রেগে গিয়ে গায়ে হাত-ও তোলে সেটাও হজম করে ফেলতে হবে। অবশ্য আব্দুর রহমান সাহেব কখনো অধীনস্থদের উপর চোটপাট করেন না। কেউ ভুল করলে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। চিৎকার চেঁচামেচির চাইতে নীরবতা এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে। ভুল করে ফেলা মানুষটির ভেতর তৈরি হয় অস্থিরতা। একদিকে ভয়, একদিকে অস্থিরতা, সব মিলিয়ে মানুষটি কেমন যেন হয়ে যায়। বিষয়টি আব্দুর রহমান সাহেব উপভোগ করেন।

    "শোন, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আনো। ওতে বরফ কুঁচি দেবে। আর এক মগ এসপ্রেসো। যাবার সময় জহিরকে ভেতরে আসতে বলবে।"

    সুলতান মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল। এসপ্রেসোটা ঠিক মতো বানাতে হবে। এই জিনিষ ঠিকঠাক না হলে বড় সাহেব খুব রাগ করেন। এসপ্রেসোতে আবার দুই চামচ ব্র্যান্ডি মেশাতে হয়। রহমান সাহেবের তাই পছন্দ। তার ভাষাতে বিষয়টি স্বাস্থ্যপান। স্বাস্থ্যপান করে দিনের কাজ শুরু করেন রহমান সাহেব ।

    "স্যার, আসবো?"
    "আসুন, জহির সাহেব।"

    জহিরুল হক বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে ভালবাসে। স্যারের সামনে কাজটি কেন যেন সে করতে পারেনা। উল্টে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

    "জহির সাহেব, আপনাকে ফাইল ইন্ডিকেটর বসাতে বলেছিলাম। বসিয়েছেন?"
    "জ্বী না স্যার, বসানো হয়নি। আজ আসার সময় ইন্ডিকেটর নিয়ে এসেছি।"
    "দেখি, কি এনেছেন?"
    মোটা মোটা বইতে কতটুকু পড়া হলো সেটা বোঝার জন্য বই বাধাই এর সময় লাল, নীল ফিতে জুড়ে দেয়া হয়। রহমান সাহেবও সেই ব্যাবস্থা করতে বলেছেন। তবে অবশ্যই ফিতে বসালে চলবে না। অন্য কিছু বসাতে বলেছেন তিনি। জিনিষটা হতে হবে আলাদা ধরনের কিছু।
    জহির হাতে করে একটা খাম নিয়ে এসেছে। খামটা সে রহমান সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিল।
    খাম খুলে রহমান সাহেব বললেন, "এগুলো কি? মুরগীর পালক নাকি? মুরগীর পালক দিয়ে ইন্ডিকেটর বানানোর বুদ্ধি করেছেন?"
    "স্যার, পালক গুলো মুরগির না, কাকের।"
    "কাকের?"
    "জ্বি স্যার।"
    "এজন্য কটা কাক মারতে হয়েছে?"
    "মারা হয়নি স্যার। কাকের বাসা থেকে সংগ্রহ করানো হয়েছে।"
    জহির কি মিথ্যা বলছে নাকি ভুল বলছে তা বুঝতে পারছেন না রহমান সাহেব, পালকগুলো টেনে ছেঁড়া হয়েছে। পালকগুলোর গোড়ার দিকে ছোট, খুবই ছোট আঁশের মতো মাংস লেগে আছে। তাতে রক্তের ছিটে ও দেখা যাচ্ছে। রহমান সাহেবের মুখ থমথমে হয়ে গেল।
    "জহির সাহেব,এগুলো আপনি নিজে জোগাড় করেছেন? না অন্য কেউ জোগাড় করেছে?"
    "আরেকজন কে দিয়ে জোগাড় করিয়েছি, স্যার।"
    "লোকটি কে?"
    "এক ওঝা স্যার। তার কাছে ধনেশ পাখির ঠোঁট, স্যালাম্যান্ডার, শজারুর কাঁটা,বানরের থাবা, কাকের পালক এইসব হাবিজাবি আছে। ওর কাছ থেকেই নিয়েছি।"
    "পালক কাকের বাসা থেকে জোগাড় করা, এই বক্তব্য কি ওঝার?"
    "জ্বী স্যার।"
    "ওঝা ব্যাটা বিরাট ভণ্ড। কাক মেরে পালক টেনে ছেঁড়া হয়েছে। আপনাকে বলেছে কাকের বাসা থেকে নেয়া। এই যে দেখুন, পালকের গোড়ায় মাংসের আঁশ লেগে আছে।"
    জহির পালক গুলো হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। ঘটনা সত্যি। পালকের গোড়ায় মাংসের আঁশ দেখা যাচ্ছে। সে পালক গুলো খামের ভেতর ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।
    "জহির সাহেব, আপনাকে অন্য রকম কিছু আনতে বলেছিলাম। আপনি আনলেন কাকের পালক। কারনটা কি? এতে অন্যরকম কি আছে?"
    "অন্য সব পাখির পালক স্যার খুব সহজেই পাওয়া যায়। কাকের পালক পাওয়া যায়না। কিন্তু স্যার দেখুন, ওরা সবসময় আমাদের আশেপাশেই থাকে। আবার স্যার, এরা সারাদিন ময়লা আবর্জনা ঘাটে কিন্তু এদের গা থাকে চকচকে। ময়লা গায়ে লাগেনা। বিষয়টা অস্বাভাবিক, তাই না স্যার?"
    "না, অস্বাভাবিক না। এরা শরীর দিয়ে ময়লা ঘাটেনা, ঘাটে পা আর ঠোঁট দিয়ে। ময়লা গায়ে লাগার কোন কারন নেই। আর কাকের পালক পাওয়া যায়না, কে বললো? আপনার ভণ্ড ওঝাই তো কত সহজে পেয়ে গেছে। যাক গে, এ সম্পর্কে আমি আর কথা বলতে চাচ্ছিনা। ইন্ডিকেটর হিসেবে পালকের ব্যবস্থা করেছেন, ভালো করেছেন। কিন্তু বিষয়টা আমার পছন্দ হয়নি। এখন আপাতত পালকগুলো এখানে রেখে যান। আরও ভাল কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখুন। আমার সুন্দর এবং অন্যরকম ডিজাইনের কিছু ইন্ডিকেটর প্রয়োজন। ক্লিয়ার?"
    "জ্বী স্যার।"
    "এখন আসুন।"
    "জ্বী স্যার।"
    এই সময় সুলতান পানি আর কফি নিয়ে উপস্থিত।
    "তোমার মেয়ের খবর কি সুলতান?"
    "ভালো না স্যার। পড়তেই চায়না। খালি টিভি দেখে। ধইরা মারি, তাও পড়েনা।"
    "বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলা ঠিক না সুলতান । কালাম সাহেব কে সালাম জানাবে।"
    কালাম সাহেব অফিসের হেড একাউন্টেন্ট। ফাইল সমস্যা নিয়ে তিনি নিজেও যন্ত্রণার মাঝে আছেন। হিসেবে দেড় কোটি টাকার গড়মিল।

    রহমান সাহেবের অফিস রুমে একপাশে একসেট সোফা রাখা। সোফার মুখোমুখি করে রাখা হয়েছে একটা ডিভান। কালাম সাহেব কে সোফায় বসিয়ে রহমান সাহেব ডিভানে হেলান দিয়ে বসলেন। চুকচুক করে কফির মগে চুমুক দিচ্ছেন। কফি খাবার সময় তার মেজাজ হালকা তরল অবস্থায় থাকে। ব্রান্ডির কারনে কিনা কে জানে?
    "কালাম সাহেব, শরীর ভাল?"
    "জ্বী স্যার, আলহামদুলিল্লাহ। শুধু চোখের সমস্যাটা ভোগাচ্ছে।"
    "চোখের ডাক্তার দেখিয়ে নিন। আচ্ছা, আপনার স্ত্রীর অফিসের ঝামেলাটা মিটেছে?"
    "জ্বী না স্যার। সুফিয়া বিষয়টা নিয়ে খুবই পেরেশান। আর এদিকে আমার ফাইলের হিসেব মিলছেনা।"
    "কালাম সাহেব, এই অফিসে কিছু অস্‌ৎ কর্মচারী আছে। আপনি কি তা জানেন?"
    কালাম সাহেব হতভম্ব হয়ে রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই লোক বলে কী? আর এই কথা তাকে বলারই বা অর্থ কী? কালাম সাহেবের চোয়াল আক্ষরিক অর্থেই ঝুলে গেল।
    "মুখ বন্ধ করুন কালাম সাহেব। এত অবাক হবার কিছু নেই"
    কালাম সাহেব মুখ বন্ধ করলেন।
    "অফিসের এইসব প্রতারকদের আমি চিনি। তাদের পেছনে সবসময় লোক লেগে থাকে। তাদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট, সম্পদের পরিমান, সবই এই অফিসের জানা আছে। এদের কারো একাউন্টে হটাৎ করে বেশি পরিমান টাকা জমা হলে অফিস তা জেনে যায়। কেউ হটাৎ কোথাও বেশী পরিমান টাকা খরচ করলে তার উৎস সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হয়। লোক আসলে প্রথম দিকে সবার পেছনেই থাকে। অস্‌ৎ লোকজন সহজেই ধরা পড়ে। এদের উপর তখন আলাদা করে চোখ রাখা হয়। বুদ্ধিটা ভাল, তাই না কালাম সাহেব?"
    "জ্বী স্যার, ভাল।"
    "গতমাসে আপনার স্ত্রীর একাউন্টে বেশ কিছু টাকা জমা পড়েছে। সাইত্রিশ লাখ টাকার মতো। তাই না?"
    "জ্বী স্যার। গ্রামের বাড়ীর জমি বিক্রি করেছি স্যার। বিশ্বাস করুন স্যার।" হড়বড় করে কথা বলা শুরু করলেন কালাম সাহেব।
    "জানি কালাম সাহেব। টাকা কোথায় পেয়েছেন তা আমি জানি। আপনি যাতে আমার কথা বিশ্বাস করেন তাই টাকার কথাটা বললাম। অন্য কিছু না। তো, এই মাসে আবার লাখ তিনেক তুলেছেন। কারন কি?"
    "সুফিয়ার অফিসের বদলি ঠেকানোর জন্য ঘুষ দিতে হবে স্যার।"
    "ঘুষ একবার দিলে আরো দিতে হবে। যে বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পায় তার মুখে কিন্তু অন্য কিছু রোচেনা। কি, ঠিক না?"
    "জ্বী স্যার।"
    "আমাকে বললেই পারতেন। আমি ফোনে বলে দিতাম। টাকাটা কি দিয়ে ফেলেছেন?"
    "জ্বী না স্যার।"
    "দেয়ার দরকার নেই। আমি ফোন করে দেব। আপনার স্ত্রীর বসের নাম্বারটা লিখে টেবিলের উপর রেখে যাবেন। আর হিসেবের দেড় কোটি টাকার কোন খোঁজ পাওয়া গেল?"
    "জ্বী না স্যার।"
    "ঠিকমত খোঁজ করুন। আগামী হপ্তার মিটিং এ সব সাবমিট করতে হবে। মন দিয়ে কাজ করুন কালাম সাহেব। দুষ্ট গরুর চেয়ে মাঝে মাঝে শূন্য গোয়াল ভাল।"
    তীব্র আতঙ্ক নিয়ে বেরিয়ে গেলেন কালাম সাহেব। তাকে শক্ত একধরনের ঝাঁকুনি দেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে অধীনস্থদের এ রকম ঝাঁকুনি দিতে পছন্দ করেন রহমান সাহেব। তার ধারনা এতে অফিসে কাজের গতি আসে। গতি জিনিষটা তার খুবই পছন্দ।
    ডিভান থেকে উঠে এসে নিজের চেয়ারে বসলেন রহমান সাহেব । খাকি খামটার দিকে তাকিয়ে রইলেন দীর্ঘ সময়। খামের ভেতর পালক। মানুষের গায়ে লোমের জায়গায় যদি পালক থাকতো তাহলে কেমন হতো? মানুষের কি তাহলে পোষাকের প্রয়োজন হতো? কে জানে! হতো হয়ত। মানুষ অতি বিচিত্র প্রানী। এরা কখন যে কি করে, কিছুই বোঝা যায়না।
    এসব ভাবতে ভাবতে রহমান সাহেব চেয়ারে হেলান দিলেন। রাত জাগার কারনেই কিনা কে জানে, তার তন্দ্রার মত হলো। তন্দ্রার মাঝে রহমান সাহেব অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখলেন।

    তিনি কথা বলছেন একটি কাকের সাথে। সেই কাকের আকার আয়তন মানুষের সমান। সে আবার মানুষের মত স্যুট পড়ে বসে আছে তারই অফিসে।
    "স্যার, কাজটা কি ঠিক হলো?"
    "কোন কাজ? আর আপনি অফিসে ঢুকলেন কি করে? আপনার কি এপয়েন্টমেন্ট আছে?"
    "আমার এপয়েন্টমেন্ট লাগেনা। যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবার ক্ষমতা আমার আছে। যাকগে সেসব। কাজটা কি ঠিক হল স্যার?"
    "কোন কাজের কথা বলছেন?"
    "আমার পরিবারের সামনে আমাকে গুলি করে মেরে ফেললেন। তারপর আমার লাশটা কুকুর দিয়ে খাইয়ে দিলেন। আমি কি স্যার আপনার কোন ক্ষতি করেছিলাম? আমার পরিবারটা এখন কেমন করে বাঁচবে?"
    "আপনার আবার পরিবারও আছে নাকি?"
    "কেন থাকবেনা স্যার? আমার পরিবার থাকতে কি কোন বাধা আছে? মানুষেরই খালি পরিবার থাকবে? আমাদের পরিবার থাকবেনা? আমার বাচ্চাগুলোর এখন কি হবে স্যার?"
    "আপনার বাচ্চাদের তো সমস্যা হবার কথা না। খাবার কি আপনাদের কিনে খেতে হয়? হয়না। তাছাড়া আপনার স্ত্রী তো আছেনই।"
    "কথাটা তো স্যার ঠিক বললেন না। বাবার কাজ কি মা দিয়ে হয়? ওদের এখন কে উড়তে শেখাবে?"
    "কেন, আপনার স্ত্রী শেখাবে। এ নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।"
    "স্যার আবারো ভুল করলেন। সব যদি আমার স্ত্রীই করবে তাহলে পরিবারে আমার ভুমিকা কি? একবার ভাবুন তো, আপনি যা করেন তাতো আপনার স্ত্রীর পক্ষেই করা সম্ভব। তাহলে পরিবারে আপনার কাজটা কি? আপনি কি একছালা গাব?"
    "একছালা গাব? এর মানে কি?"
    "এর মানে ফক্কা। শূন্য। আপনার তো তাহলে পরিবারে কোন ভুমিকা নেই। আপনাকে যদি এখন আমি গুলি করে মেরে ফেলি, কেমন হবে?"

    হঠাৎ করেই কাকটার পাখার জায়গায় মানুষের হাতের মত হাত দেখা গেলো। হাতে একটা এয়ারগান। সেই এয়ারগান রহমান সাহেবের দিকে তাক করা। এয়ারগান থেকে পুঁ পুঁ শব্দে গুলিও বের হল। রহমান সাহেবের তন্দ্রা ভেঙ্গে গেলো।

    ইন্টারকমে পুঁ পুঁ শব্দ হচ্ছে।
    রহমান সাহেব ইন্টারকমে সাড়া দিলেন।
    "কি ব্যাপার জহির সাহেব?"
    "স্যার, ম্যাডাম লাঞ্চ পাঠিয়েছেন। ভেতরে পাঠিয়ে দেবো?"
    "দাও।"
    টেবিলের দিকে তাকালেন রহমান সাহেব। টেবিলময় কাকের পালক ছড়ানো। তিনি পালক গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। পালক খামের ভেতর ছিলনা? এগুলো টেবিলে ছড়ানো কেন? কাকটাকে তার মারাটা বোধহয় আসলেই ঠিক হয়নি। আচ্ছা, তিনি মারা গেলে তার পরিবারের কি হবে? সব কি কুমকুমের পক্ষে সামলানো সম্ভব? কাকটার পরিবারে এখন কি হবে?

    একসময় জহিরকে তিনি পালক নিয়ে যেতে বললেন। সোফার সামনের টেবিলে লাঞ্চ রাখা হয়েছে। শরীরটা ভালো লাগছেনা। চিন্তা ভাবনাও কিছুটা বিভ্রান্ত। দীর্ঘদিন পর রহমান সাহেব এক ধরনের অবসাদে ডুবে গেলেন। খেতে ইচ্ছে করছেনা। কিছু করতেও ইচ্ছে করছেনা। আকাশ দেখলে কেমন হয়? কতদিন আকাশ দেখা হয়না। অথচ একটা সময় ছিলো যখন মন খারাপ হলেই চোখ চলে যেত আকাশে। কেটে যেত ঘন্টার পর ঘন্টা। ব্যস্ততা, বয়স আর বাস্তবতা জীবন থেকে কতো অসাধারন সব মুহুর্ত কেড়ে নেয়।

    রহমান সাহেব রুমের বাইরে লাল বাতি জ্বালিয়ে দিলেন। রুমের ভেতর ঢোকার জন্য এখন আর কেউ নক করবেনা। এরপর তিনি হাতে নিলেন জীবনানন্দের কবিতার বই। অফিসের শেলফে থরে থরে কবিতার বই সাজানো। বিশাল শেলফ। কবিতা আগে নিয়মিত পড়া হত। এখন আর সময়টাই হয়না। দীর্ঘদিন পর আকাশ দেখতে যখন ইচ্ছে হচ্ছে তখন কবিতাও পড়া হোক।

    রহমান সাহেব এক পেগ ব্র্যান্ডি নিলেন। অফিস রুমেই ছোট্ট একটা ফ্রীজ আছে। তাতে নানারকম পানীয় রাখা। ডেলিগেটরা এলে এই জিনিষের প্রয়োজন হয়। ব্র্যান্ডির উপর দুটো বরফের কিউব ছেড়ে দিলেন তিনি। ব্র্যান্ডি উইথ রকস। শরীর থেকে অবসাদ দূর করতে হবে। হাতে অনেক কাজ। রহমান সাহেব নিজেই রিভলভিং চেয়ার টেনে জানালার কাছে নিয়ে এলেন। দীর্ঘদিন পর জানালার মোটা পর্দা সরানো হলো। বাইরে ঝকঝকে রোদ বোঝা যাচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন রহমান সাহেব। বই খুলে ডুবে গেলেন কবিতায়। মাঝে মধ্যে গ্লাসে চুমুক চলছে। গলা দিয়ে নেমে যাচ্ছে ঠান্ডা, তরল আগুন। অবসাদ যাবো যাবো করছে।

    অইখানে কিছু আগে-বিরাট প্রাসাদে-এক কোনে
    জ্বলে যেতেছিল ধীরে এক্সটেনশন লেকচারের আলো।
    এখন দেয়ালে রাত-তেমন ততটা কিছু নয়;
    পথে পথে গ্যাসলাইটে রয়েছে ঝাঁঝালো
    এখনো সুর্যের তেজ উপসংহারের মতো জেগে।
    এখনও টঙ্গে চড়ে উপরের শেলফের থেকে
    বই কি বিবর্ন কীট-ধুলো-মাকড়সা বার হবে
    দোকানের সেলসম্যান চুপে ভেবে দেখে
    এখনো নামেনি সেই নির্জন রিক্সাগুলো-নিয়ন্তার মতো
    সমুহ ভীড়ের চাপে রয়েছে হারায়ে।
    অজস্র গলির পথে একটা মানুষ
    যুগপত রয়েছে দাড়ায়ে;
    পৃথিবীর সকল হৃদয়ের প্রতীকের মতো;
    এই রাত থেকে আরো গভীরতর রাতে
    কলুটোলা- পাথুরিয়াঘাটা-মীর্জাপুরে
    এসপ্লানেডের ফুটপাতে
    মালাঙ্গা লেনের পথে- ক্রিক রো তে
    ককবার্ন লেনের ভিতর
    একজোড়া শিং যদি দেখা দেয় লোকটার টাকে-
    পরচুলা চুরি করে নিয়ে গেছে তবে যাদুকর।
    এখানে রাত্রির পারে তোমার নিকট থেকে আমি
    চলে গেলে
    চলে যাবো;
    পৃথিবীর কাছ থেকে নয়;
    রাত্রি এই সারা রাত জীবনের সকল বিষয়
    হয়ে আছে।
    তিত্তিরাজ গাছ থেকে শিশির নীরবে
    ঝরে যায়;-
    ডানার আঘাত যায় কাকদম্পতির;

    জ্ঞকাকদম্পতিঞ্চ শব্দটিতে এসে থমকে গেলেন রহমান সাহেব। কাকদম্পতি? মানে কি? কাকদের কি তাহলে আসলেই পরিবার আছে? না থাকলে জীবনবাবু লিখবেন কেন? বিষয়টা কি কবির নিছক কল্পনা? রহমান সাহেব জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আকাশ দেখছেন তিনি। আকাশ থেকে চোখ ধীরে ধীরে নীচে নামছে। কারেন্টের তারে কাক বসে আছে। শত শত কাক। কারো মাঝে কেন যেন কোন অস্থিরতা নেই। একটা কাকও নড়াচড়া করছে না।

    চেয়ার থেকে উঠে জানালার কাঁচে মুখ ঠেকালেন রহমান সাহেব। এরা এইরকম স্থির হয়ে বসে আছে কেন? কাক তো স্থির হয়ে বসে থাকার কথা না। এরা ক্রমাগত মাথা এদিক ওদিক ঘোরায়। দুটি বস্তুর অবস্থানগত দুরত্ব বোঝার জন্য তারা একাজ করে। তাছাড়া খাবার খোঁজাও একটা বিষয়। এর মাঝেই এরা ডাকাডাকি করে। স্থিরতা বিষয়টা এই পাখির মাঝে নেই। কোন কাক কি আশেপাশে মারা গেছে? এরা কি দেখছে? রহমান সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে কাকগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এক সময় তার মনে হলো কাকগুলো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মাঝখানে একটা কাকের যেন কি হলো। সে উড়ে এসে বসলো তারই জানালার কার্নিশে। জানালা থেকে কার্নিশ দেখা যায়। খুব কাছ থেকে কাকটা এখন রহমান সাহেবের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। কাকটা একটু কেমন যেন। এর শরীর পুরো কালো না। গলার কাছটাতে সাদা ফুটকি আছে। কাকটাকে রহমান সাহেবের খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। ঢাকা শহরে শত শত কাক,এর মাঝে এই কাকটাকে পরিচিত মনে হবার কোন কারন কি আছে?

    এই কাক সকালের মৃত সেই কাকের স্ত্রী নয়তো? ধুর, তা হতে যাবে কেন? যত্তসব আজেবাজে ভাবনা। এই কাকগুলো কি ডাকাডাকি করছে? একসাথে এতো কাক ডাকাডাকি করলে কেমন শোনাবে? কেমন শোনাবে সেটা বোঝার উপায় অবশ্য রহমান সাহেবের নেই। তার রুম সাউন্ডপ্রুফ।

    "কেমন আছেন স্যার?"
    "ভালো আছি।"

    উত্তর দিয়ে রহমান সাহেবের মনে হলো প্রশ্ন কে করলো? রুমে তো কেউ নেই। বাইরে লাল বাতি জ্বলছে। কেউ ভেতরে ঢুকবেনা। রহমান সাহেব রুমের চারপাশে একবার চোখ বোলালেন। কেউ নেই। তাহলে কথা বললো কে? রহমান সাহেব আবারো জানালার বাইরে তাকালেন। কাকটা এখনো বসে আছে। ঘাড়টাও আগের মতই তার দিকে ঘোরানো। কারেন্টের তারে কাকের সংখ্যা কি আরো বেড়েছে? কাকগুলো আগের মতই স্থির। নড়াচড়া নেই।
    "প্রশ্ন টা স্যার আমি করেছি।"
    নিজের মনেই হা হা করে হেসে ফেললেন রহমান সাহেব। একটা কাক তার সাথে কথা বলছে। কি হাস্যকর একটা বিষয়! তিনিও সেই কাকের কথার উত্তর দিচ্ছেন। হা হা হা। এইসব ছেলেমানুষী ভার্সিটি বা কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের মানায়। সেই বয়সটাই তো তরল হবার। তার এখন সেই বয়স নেই। রহমান সাহেব জানালার কাছ থেকে সরে এলেন। গ্লাসে নিলেন আরেক পেগ। পর্দা ঠিক করে চেয়ার নিয়ে এলেন আগের জায়গায়। এরপর কবিতার বই শেলফে রাখলেন। চেয়ারে বসেই তার অস্বস্তি লাগতে লাগলো। এরপর লাল বাতি বন্ধ করে বেল টিপে ডাকলেন সুলতানকে।

    "সুলতান কাক চেনো?"
    "জ্বী স্যার, চিনি।" সুলতান রহমান সাহেবের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। কাক না চেনার কি আছে? বাচ্চারাও তো কাক চেনে।
    "স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ?"
    "না তো। কেন?"
    "এমনি স্যার।"
    "বাইরে ইলেকট্রিক কেবলে অনেক কাক বসা। দেখে এসো এরা ডাকাডাকি করছে কি না। রুমের ভেতরে শব্দ ঢোকেনা। কোন শব্দ পাচ্ছিনা।" কথা গুলো বলার পরই রহমান সাহেব একটু অবাক হলেন। সুলতানের কাছে তিনি কেন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন? সমস্যা কি?
    "যাও, শুনে এসো। এসে জানাবে।"

    সুলতান বেরিয়ে গেলো। রহমান সাহেব হাতের গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছেন। টেবিলে ফাইল খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। তার দৃষ্টি সিলিং এর দিকে। সিলিং ঝকঝকে সাদা। চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। মাকড়সার বাসা থাকলে বোধহয় ভালো হতো। মিনিট পাঁচেক পরই ফিরে এলো সুলতান।

    "স্যার, বাইরে কোন কাক নাই।"
    রহমান সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেল। মিনিট কয়েকের ভেতরই সব কাক উড়ে চলে গেল? এমন তো হবার কথা না।
    চেয়ার থেকে উঠে রহমান সাহেব নিজেই জানালার পর্দা সরালেন। তারে শত শত কাক বসে আছে। সংখ্যাটা বোধহয় বেড়েছে।
    "এদিকে এসো সুলতান।"
    সুলতান জানালার কাছে এগিয়ে গেল।
    "বাইরে দেখো। ঠিকমত দেখো।"
    রহমান সাহেব ঠিক কি দেখতে বলছেন তা সুলতান বুঝতে পারলোনা।
    "কাক দেখতে পাচ্ছো?"
    বাইরে কোথাও কাক দেখতে পেলোনা সুলতান। কারেন্টের তারও ফাঁকা।
    "জ্বী স্যার দেখতেছি। দুইটা কাক বইসা আছে। একটা মা কাক, আরেকটা বাচ্চা। মা কাক বাচ্চা রে খাবার দিতেছে।"

    রহমান সাহেবের কোঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে গেলো। তারে বসা শত শত কাক। সুলতান বলছে দুইটা। সুলতান মিথ্যা কথা বলছে। সে কোন কাকই দেখতে পাচ্ছেনা। তাহলে কি তিনিই ভুল দেখছেন? ব্‌র্‌যান্ডি কি বেশি খাওয়া হয়ে গেলো? ব্র্যান্ডিতে তো কিছু হবার কথা না। মাত্র দুই পেগ গেছে। দুই পেগে তার কিছু হবার কথা না। তাহলে কি শরীর খারাপ করেছে? নাহ, রাত জাগাটা ঠিক হয়নি। কাকটাকেও মারা ঠিক হয়নি।

    ০৪

    রহমান সাহেবের রুম থেকে বেরিয়ে সুলতান সোজা নিচে চলে গেল। স্যার এখন তাকে ডাকবেন না বলে মনে হচ্ছে। কারন স্যারের হাতে ব্র্যান্ডির গ্লাস দেখা গেছে এবং স্যারের এখন গভীর মনোযোগে কাজ করার কথা। অনেকক্ষণ ধরে সুলতানের চা খাওয়া হচ্ছেনা। অফিসের ভেতরেই চা খাবার ব্যাবস্থা আছে। কিন্তু সবসময় চা জিনিষটা নিজে বানিয়ে খেতে ইচ্ছে করেনা। এই কারনে মাঝে মাঝে সুলতান দোকানের চা খায়। দোকানের চা-টা ভালই হয়, তারপর কথা হচ্ছে চাটা বানায় মর্জিনা। বেদম কড়া মানুষ। মর্জিনা যদি লিকার ছাড়া গরম পানিও ধরিয়ে দিয়ে বলে, চা খান, সুলতান তাই হাসিমুখে খেয়ে নেবে। এই মানুষটাকে সুলতান খুবই পছন্দ করে। বিষয়টা অবশ্য গোপন। মর্জিনাকে জানানোর মত সাহস সুলতানের হয়নি। না জানানোর প্রথম কারন হচ্ছে মর্জিনার স্বামী-সন্তান আছে, দ্বিতীয় কারন হলো মর্জিনার সামনে গেলেই সুলতানের পেটের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তাই চা দেন এবং চা নেন তা ছাড়া তাদের মধ্যে তেমন কোন বাক্যালাপ হয়নি।

    দোকানের কাছে গিয়ে কি মনে করে সুলতান কারেন্টের তারের দিকে তাকালো। শত শত কাক তারের উপর বসে আছে। ঘটনা কি? কিছুক্ষণ আগেও তো এখানে কোন কাক ছিলোনা। এই কয়েক মিনিটের ভেতর এতো কাক এলো কোথা থেকে?

    সবকটা কাক একইদিকে মুখ করে বসে আছে। চুপচাপ, স্থির। গোটা দৃশ্যটার মাঝে বিচিত্র একধরনের অস্বাভাবিকত্ব আছে। সুলতান তা খেয়াল করলো না। চুপচাপ সে চা খেতে লাগলো। চা টা খেতে কি অসাধারন হয়েছে! কাকের কথা তার মাথায় রইলো না।

    ০৫

    রাত নয়টায় রহমান সাহেবের ফাইল দেখা শেষ হলো। অফিসের ডেটাবেইজে যে হিসেব তার সাথে টাকার রসিদে মিল পাওয়া যাচ্ছেনা। ফাইলে বেশ কয়েকটি রসিদ নেই। এসব রসিদ বেশ কয়েকজনের হাতে। এদের মাঝে কেউ ভুল করেছে বা ইচ্ছে করে সরিয়েছে। মোট আট জনের হাতে বিভিন্ন খাতের রসিদ থাকে। তারাই রসিদ সাজিয়ে রাখে, বিল তোলে। বিল পরিশোধের বিষয়টি অবশ্য শুধুই কালাম সাহেবের হাতে। ঝামেলা কে করলো?

    রাত সাড়ে নয়টায় রহমান সাহেব অফিস থেকে বাসায় রওনা দিলেন। অফিস ফাঁকা। সব কর্মচারী চলে গেছে। আছেন শুধু কালাম সাহেব আর রহমান সাহেব। দুজনে চারতলা থেকে লিফটে নিচে নেমে এলেন।

    রিসেপশন ডেস্ক ফাঁকা। ডেস্কের উপর একটা কাক বসে আছে। অফিসের ভেতর কাক দেখে রহমান সাহেব খুবই বিরক্ত হলেন।

    "কালাম সাহেব, রিসেপশন ডেস্কে ওটা কি?"
    "কাক, স্যার।" অফিসের ভেতর কাক দেখে কালাম সাহেব নিজেও খুব অবাক হলেন। এত রাতে অফিসের ভেতর কাক এল কোথা থেকে? ইদানিং কাকেরা রাতের বেলাতেও ঘুরে বেড়ায় নাকি?
    "দারোয়ানকে ডেকে কাক তাড়াতে বলুন। অফিসে লোকজন বোধহয় জানালা ঠিকঠাক মতো আটকায় না। দারোয়ান কে বলবেন সব জানালা ঠিক মতো লাগানো হয়েছে কিনা চেক করতে।" কথাগুলো বলেই রহমান সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
    দারোয়ান ডেকে এনে কালাম সাহেব নিজেও কাক খুঁজলেন। কোথাও কাকের নাম-নিশানা নেই।
    "ভুল দেখলাম নাকি? ধুত্তরিকা।" বলে কালাম সাহেব নিজেও বেরিয়ে গেলেন।

    দারোয়ান সব জানালা টেনেটুনে পরীক্ষা করে দেখলো। সব ঠিকমতৈ লাগানো হয়েছে। কি যে বলে এইসব ভদ্র লোকজন! একটা কাক নাকি অফিসে ঢুকে বসে আছে। কাক কি এই অফিসে চাকরি করে? চাকরি না করলে তার অফিসের টেবিলে বসার দরকার কি? কাক বসে থাকে আবর্জনার উপর। এই অফিস কি ডাষ্টবিন? সারাদিন কাগজ-কলম নিয়ে বসে থেকে এদের মাথাই গেছে নষ্ট হয়ে। যত্তসব!

    দরজায় তালা লাগিয়ে দারোয়ান বেরিয়ে গেলো অফিস থেকে।

    ঠিক ঐসময় কাকটি চুপচাপ বসে আছে রহমান সাহেবের নেমপ্লেটের উপর। তার দৃষ্টি রহমান সাহেবের পাশের রুমটিতে। রুমটি সামাদ সাহেবের। তিনি রহমান সাহেবের জুনিয়র। কাকটি খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে

    ০৬

    রহমান সাহেব প্রচন্ড ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফিরলেন। রাতের খাবারটা তিনি স্ত্রীর সাথে খেতে পছন্দ করেন। কোন পার্টি থাকলেও বাসায় তাকে স্ত্রীর সাথে ডাইনিং টেবিলে দেখা যায়। রহমান সাহেবের এই অভ্যাসটা কুমকুমের খুব পছন্দের। খেতে বসে তাদের মাঝে টুকটাক কথা হয়। টেবিলে ছেলে-মেয়েরাও থাকে। ছেলে রাকিব আর মেয়ে আনিকা। দুজনেই স্কুলে পড়ে।

    "ফাইলের সমস্যা মিটেছে?" প্রশ্ন করে কুমকুম।
    "উঁ? কিসের সমস্যা?" রহমান সাহেব একটু অন্যমনস্ক ।
    "কাল রাতে যে সমস্যার কারনে ঘুমাওনি। সেই সমস্যার কথা বলছি।"
    "নাহ, ধরতে পারছিনা ঝামেলাটা কোথায়। এতো ঝামেলা ভালো লাগেনা। পরশু ডেলিগেটদের সামনে সব কাগজপত্র দেখাতে হবে। মিটিং এ এই সমস্যা নিয়ে যাওয়া যাবেনা। তার আগেই সমাধান চাই।"
    "সমস্যা থাকলে তার সমাধানও আছে। এতো দুশ্চিন্তা করতে হবেনা। ঠিকমত খাচ্ছ না। রান্না ভালো হয়নি ?"
    "নাতো, রান্না ঠিক আছে, খেতে ইচ্ছে করছে না।"
    "কিছু খেয়ে এসেছো নাকি ?"
    "নাহ, দুপুরেও খাইনি। খেতে ইচ্ছে করছিলো না।"
    "একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও। না খেলে শরীর খারাপ করবে। যে ফাইল নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা, সেই ফাইল নিয়ে শেষে বসতেই পারবেনা।"

    টেবিলে রাকিব আনিকা দুজনেই গম্ভীর হয়ে বসে আছে। প্রতিদিন রুটিন করে স্কুলের ঘটনা বাবাকে শোনানো তাদের অভ্যাস। আজ তারা গম্ভীর।

    "কি ব্যাপার তোরা খাচ্ছিস না কেন?" রহমান সাহেব প্রশ্ন করলেন।
    রাকিব গম্ভীর গলায় বললো,"বাবা, আমাদের রন্টি-মন্টির শরীর খুব খারাপ।"
    "কি ব্যাপার কুমকুম? রন্টি-মন্টির কি হয়েছে?"
    "ঠিক জানিনা। দুটোই খুব অসুস্থ। সোবহান বললো, ওরা সারাদিন নাকি বমি করেছে। বিকেলে সোবহান ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। ডাক্তার বলেছে তেমন কিছু না। ঔষধপত্র দিয়েছে, খাওয়ানো হয়েছে। বমি নাকি বন্ধ হয়েছে। অবশ্য গায়ে নাকি খুব জ্বর। খালি ঘড়ঘড় করছে।"
    "তুমি দেখতে যাওনি ?"
    "দেখে কি করবো? চিকিৎসা তো হচ্ছে।"
    "যারা আমাদের বাড়ি সারারাত পাহারা দেয়, তাদের শরীর খারাপ। আর তুমি দেখতে যাবে না?"
    "কুকুর পোষা হয় বাড়ি পাহারা দেবার জন্য। তাদের কাজ পাহারা দেয়া। একে এতো বড় করে দেখার কিছু নেই। চুপ করে খাওতো।"

    রহমান সাহেব স্ত্রীর কথায় খুব আহত হলেন। অর্ধেক খেয়েই টেবিল থেকে উঠে গেলেন।
    কুকুর দুটোকে দেখতে যেতে হবে। সারারাত জেগে যারা পাহারা দেয় তাদের প্রতি রহমান সাহেবের যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা আছে, ভালোবাসাও আছে।

    ০৭

    "সোবহান, এদিকে এসো।"

    গেইট থেকে ছুটে এলো সোবহান। বড় সাহেব সাধারনত নিচে নামেন না। রাতে মাঝে মাঝে তিনি হাঁটাহাঁটি করেন। সেটাও ছাদে, নিচে না।

    "দরজা খোলো। রন্টি-মন্টিকে দেখবো।"
    "স্যার, এইগুলার শরীল খারাপ। খালি ঘড়ঘড় করতাছে। চক্ষু লাল। আমারে দেইখা দাঁত বাইর কইরা খিঁচা দিছে। খুব ডরাইছি স্যার। এর লাইগা দরজা বন কইরা রাখছি, ছাড়ি নাই।"
    "তুমি বেশি কথা বলো সোবহান। দরজা খুলতে বলেছি, দরজা খোল।"

    সোবহান দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই নাকে এসে ধাক্কা দিলো বিশ্রী একটা গন্ধ। রহমান সাহেব এবং সোবহান, দুজনেই দরজা থেকে পেছনে সরে এলেন। রন্টি-মন্টি বিচিত্র ভংগীতে বসে আছে। কুকুরের ঘরের ভেতর বাতি আছে। সেই বাতি জ্বালানো। বাতিটা কুকুরগুলোর পেছনে। তাই চোখ কেমন তা বোঝা যাচ্ছেনা। তাদের ঘাড়ের লোম সব খাড়া হয়ে আছে। থাবা বাড়ানো সামনে। পেছনের দিকটা শক্ত হয়ে গেছে। লেজ নিচু, লাফ দেবার পূর্বাবস্থা। তাদের মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছে নিচে। এদের পায়ের কাছে কালো কিছু পালক দেখা যাচ্ছে।

    দুটো কুকুরই বড় হয়েছে সোবহানের হাতে। সোবহানকে দেখে অন্তত তাদের অমন ভংগীতে থাকার কথা না। সোবহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুকুরগুলোর দিকে। মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে শব্দ বের হচ্ছে। রহমান সাহেব একচুলও নড়াচড়া করার সাহস পাচ্ছেন না। তিনি মনে মনে নিজেকে সাহস দেবার চেষ্টা করছেন। ডোন্ট প্যানিক...ডোন্ট প্যানিক...। ভয় পেলে চলবেনা।

    বাছুর সাইজের দুই এলশেসিয়ান রন্টি-মন্টি। এদের চোয়ালে জোরও অসম্ভব। শিকারকে এরা নিমেষের মধ্যে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। রহমান সাহেব কুকুরদের এই ক্ষমতা সম্পর্কে ভালো করেই জানেন।

    আস্তে বাপ...আস্তে...আস্তে...! হিসহিসিয়ে বলছে সোবহান। তাতে অবশ্য কুকুরদের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা যাচ্ছেনা। সময় যেন থমকে গেছে। কারও কোন নড়াচড়া নেই। সোবহানের কথাও বন্ধ। খালি ঘড়ঘড় শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শব্দটাকে মনে হচ্ছে অপার্থিব, কালো কুৎসিত কোন গহবর থেকে উঠে আসা শব্দ।

    দরজা আটকানোর জন্য সোবহান হাত বাড়াতেই কুকুরদুটো ঝাঁপ দিলো। একই সাথে তারা লাফিয়ে পড়লো সোবহানের উপর। মাটিতে চিৎ হয়ে পড়লো সোবহান। দুটো কুকুরই সোবহানের বুকের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ সোবহানের মুখের কাছাকাছি। জ্ঞান হারালো সোবহান। জ্ঞান হারাবার আগ মুহুর্তে সে দেখলো কুকুরদের ঝকঝকে দাঁত তার গলার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মুখের তীব্র দুর্গন্ধও নাকে লাগলো সোবহানের ।

    রহমান সাহেব স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন। নড়াচড়ার জন্য তার পায়ে কোন শক্তি নেই।

    কুকুরদুটো সোবহানকে কিছুই করলোনা। শরীর থেকে নেমে এসে তারা তাকিয়ে রইলো রহমান সাহেবের দিকে। চোখের দৃষ্টি স্থির, তাদের শরীরে কোনরকম নড়াচড়া নেই। রহমান সাহেব ও তাকিয়ে আছেন। ভয় পাওয়া যাবেনা, একদম না।
    এভাবে কতক্ষন কাটলো রহমান সাহেব জানেন না। কুকুরদুটো একসময় ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো। রহমান সাহেব হাত বাড়িয়ে দরজা আটকে দিলেন। ছিটকিনি ঠিকমতো লেগেছে কিনা দেখলেন। তার সারা শরীর ঘামছে। হাত-পা কাঁপছে। শ্বাস নিতে মনে হয় কষ্ট হচ্ছে। চারপাশে বাতাশ এতো কম কেন?
    কুকুরদুটো আবারো ঘড়ঘড় শুরু করলো।

    ০৮

    "কি বললো ডাক্তার? সোবহান কেমন আছে?" প্রশ্ন করলেন কুমকুম।
    "কিছু বলেনি। তেমন কিছু হয়নি ওর। তারপরেও ডাক্তার টিটেনাসের ই®"কশন দিয়ে দিয়েছে। খুব ভয় পেয়েছিলো সোবহান। আর কিছু না। ভয় আমিও পেয়েছি। অনেকদিন পর এতো ভয় পেলাম। ভেবেছিলাম কুকুরগুলো খেয়েই ফেলবে।"
    "এইসব কুকুর বাড়িতে রাখতে হবেনা। বাচ্চা-কাচ্চা আছে। কখন কি হয় বলা যায়না। আচ্ছা, এগুলো কি পাগল হয়ে গেছে?"
    "জানিনা। বোধহয় পাগলই হয়েছে। ওদের ভ্যাক্সিন দেয়া হয়েছিলো না?"
    "হ্যাঁ। আমি নিজে দিয়ে নিয়ে এসেছি।"
    "তাহলে সমস্যা কোথায়? ভ্যাক্সিন দেয়া কুকুর কখনো পাগল হয়েছে বলে তো শুনিনি। বাদ দাও তো। ঘুমাও। গতরাতেও ঘুমাতে পারোনি। শরীর খারাপ করবে।"
    "হিসেব মিলছেনা কুমকুম। খুব দুশ্চিন্তায় আছি।"
    "হিসেব এখন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।"
    "এখন আবার জুটেছে কুকুর। অসহ্য। এক গ্লাস পানি দাও তো। ঠান্ডা পানি।"

    কুমকুম পানি নিয়ে এলো। পানিতে দুটুকরো বরফ ভাসছে। রহমান সাহেব এক চুমুকে পানি শেষ করলেন।

    "আর আনবো?"
    "নাহ, লাগবেনা। একটু পাশে বসবে?"

    বিছানার কিনারায় বসলো কুমকুম। কুমকুমের হাত ধরলেন রহমান সাহেব। অনেক দিন পর তিনি শরীরের আকর্ষণ বোধ করছেন। তীব্র আকর্ষণ।

    ০৯

    সেদিন রাতে রহমান সাহেব আবারও স্বপ্ন দেখলেন। আবারো সেই কাক। এবার কাক দেখতে কাকের মতৈ। তবে আকারে মানুষের সমান। মানুষের মতই কথা বলছে তার সাথে।

    "স্যার কি খুব সমস্যায় আছেন?"
    "আপনি কে?"
    "আমি স্যার কর্ভাস সে্‌প্‌লনডেন্স। কাক। কাকের বৈজ্ঞানিক নাম কর্ভাস সে্‌প্‌লনডেন্স।"
    "আমার অফিসে কি করছেন? ঢোকার অনুমতি পেলেন কোথায়? সোবহান...এই সোবহান..."
    "চিৎকার করছেন কেন স্যার? সোবহান কে ডেকে কোন লাভ নেই। সোবহান নেই এখানে। আর আমি আপনার অফিসে ঢুকিনি। এটা আপনার অফিস না। আপনিই আমার এলাকায় এসেছেন।"

    রহমান সাহেব তার চারপাশে তাকালেন। আশেপাশে প্রচুর ময়লা দেখা যাচ্ছে। ময়লার মাঝখানে তার চেয়ার টেবিল বসানো। স্বপ্নে দৃশ্যটিকে রহমান সাহেবের কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো না। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন।

    "বলুন কি বলবেন।"
    "স্যার কি খুব সমস্যায় আছেন?"
    "হ্যাঁ আছি।"
    "কি ঝামেলা স্যার?"
    "বললে আপনি কি সমাধান করতে পারবেন?"
    "বলেই দেখুন স্যার। পারতেও পারি।"
    "কাক করবে আমার অফিসের সমস্যার সমাধান। ভালো বলেছেন। এখন আসুন। অন্য কোন সময় কথা বলা যাবে। হাতে অনেক কাজ।"
    "স্যার আপনার হাতে তো কোন কাজ নেই। আপনি আছেন আমার সাথে। ডাষ্টবিনে বসে আছেন।"
    "তাইতো। মনে ছিলোনা।"
    "স্যার সমস্যাটা বলুন।"
    "ফাইলের একটা হিসেব মিলছেনা। আসলে ঠিক হিসেব না। ডেটাবেইজে সবই আছে, কিন্তু হার্ড কপি নেই। কয়েকটা রসিদ পাওয়া যাচ্ছেনা। আমাদের হেড একাউন্টেন্ট কালাম সাহেব বিষয়টি নিয়ে অনেক খাটাখাটুনি করছেন। আমিও বের করার চেষ্টা করছি।"
    "কেন পারছেন না স্যার? অফিসের কর্মচারীদের পেছনে আপনি না লোক লাগিয়ে রেখেছেন? তারা কিছু খুঁজে পাচ্ছেনা?"
    "লোক লেগে থাকে অফিসের বাইরে। ভেতরের কাজ তো আর তারা দেখেনা। এখানে টাকার অঙ্কটা অনেক। টাকাটা কেউ সরায়নি। স্রেফ একটা রিসিপ্ট পাওয়া যাচ্ছেনা। ওটা ছাড়া ফাইলের প্রেজেন্টেশনে যাওয়া যাবেনা। রিসিপ্ট এর মূল কপি প্রয়োজন। কে যে সরিয়েছে সেটাই বুঝতে পারছিনা।"
    "স্যার, মূল কপিটা আপনার অফিসেই আছে। এই রিসিপ্ট নিশ্চয়ই এক পাতার কিছু না। হারানোর সম্ভাবনাও তাই খুবই কম। কেউ না সরালে তো এই জিনিষ গায়েব হয়ে যাবেনা। তাই না স্যার?"
    "তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন।"
    "এমন কি হতে পারেনা যে কয়েকজন মিলে বুদ্ধি করে রিসিপ্টটা উধাও করে ফেললো। আপনাকে ঝামেলায় ফেলার ইচ্ছে তো কারো না কারো থাকতেই পারে, তাই না?"
    "তা পারে। আমার চেয়ারের দিকে অনেকেরই চোখ আছে। আমার জুনিয়রের চোখ সবচে বেশি। আপনি কি সামাদ সাহেবের কথা বলছেন?"
    "জ্বী স্যার। আপনি ধরতে পেরেছেন। সমস্যা নিয়ে আপনি শুধু কালাম সাহেবের সাথে কথা বললেন। সামাদ সাহেব কে কিছু বললেন না। উনি তো আপনার জুনিয়র। অফিসে আপনার সব কথা জুনিয়র হিসেবে তারই জানার কথা,তাই না? এটা তো একরকম উদাসীনতা। এই উদাসীনতা আপনি অনেকদিন ধরেই দেখাচ্ছেন। তাই না? "
    "ঠিক উদাসীনতা..."
    "জ্বী স্যার, উদাসীনতা। আপনি অস্বীকার করবেন না । সামাদ সাহেব আপনার পোষ্টের জুনিয়র। তার বুদ্ধি , বিবেচনা কি আপনার কাছাকাছি হবার কথা না?"
    "তা ঠিক। উনি ধীরে ধীরে এই পোষ্টে উঠে এসেছেন। যোগ্যতা তার অবশ্যই আছে।"
    "তারপরেও আপনি তাকে উপেক্ষা করেছেন স্বেচ্ছায়। কারনটা কি স্যার? সামাদ সাহেবের সাথে একসময় আপনার স্ত্রীর একটা সম্পর্ক ছিলো। কারনটা কি তাই?"
    "চুপ করুন। আপনার অনেক সাহস কর্ভাস সাহেব। আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রীর নামে বাজে কথা বলছেন।"
    "স্যার, আমরা কেউ কারো সামনে দাঁড়িয়ে নেই। আমরা দুজনেই বসে আছি ডাষ্টবিনে। আর একটা মানুষের সাথে আর একটা মানুষের সম্পর্ক থাকতেই পারে। সেটা বলার মধ্যে বাজে বিষয় কী আছে?"
    "চুপ, একদম চুপ।"
    "স্যার, রসিদটা কোথায় আছে জানতে চাইলেন না?"
    "চুপ করুন। আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিনা।"
    "রসিদটা আছে সামাদ সাহেবের কমোড ফ্লাশের ভেতর। তার ফ্লাশ নষ্ট হয়েছে গত মাসে। সেটা আর ঠিক করা হয়নি। আপনাদের মতো ঝকঝকে একটা অফিসে একজন অফিসারের কমোড ফ্লাশ এক মাস ধরে নষ্ট কিন্তু তা ঠিক করা হয়নি, বিষয়টা কেমন না?"
    "এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব ষ্টোর কীপারের আর কেয়ারটেকারের। আমার না।"
    "তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন।"

    স্বপ্নের এই পর্যায়ে রহমান সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কুমকুম তাকে ধাক্কা দিচ্ছে।

    "সকাল নয়টা বাজে। উঠবেনা?"

    চোখ মেলে প্রথমে রহমান সাহেব কিছু বুঝতে পারলেন না। এক দৃষ্টিতে সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মানুষটা কে? পরিচিত মনে হচ্ছে কি? মুখ এরকম ধবধবে সাদা কেন? মানুষ তো নাকি? রহমান সাহেব আরো কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন।

    "কি চিনতে পারছোনা নাকি? মুখে উপটান মাখা তাই ভুতের মতো লাগছে। ওঠো তো বাবা।"

    খুব দ্রুত তৈরি হয়ে নিলেন রহমান সাহেব। মাথায় স্বপ্নের কথাবার্তা ঘুরছে।



    ১০

    রহমান সাহেব ঠিক সকাল দশটায় অফিসে ঢুকলেন। রুমে ঢুকেই ডেকে পাঠালেন সামাদ সাহেবকে।

    "কেমন আছেন সামাদ সাহেব?"
    "ভালো আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন?"
    "যেমন রেখেছেন।"
    "ঠিক বুঝলাম না স্যার।" সামাদ সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেলো।
    "মানুষের শরীরে মাথাটাকেই সবচে বড় ধরা হয়, তাই না?"
    "জ্বী স্যার।"
    "শরীরে অন্যকোথাও সমস্যা হলে মাথাটুকু কি আলাদা করে ভালো থাকে?"
    "না স্যার।" সামাদ সাহেবের কোঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে গেলো। রহমান সাহেব ঠিক কি বলতে চাইছেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
    "সামাদ সাহেব, অফিস অনেকটা মানুষের শরীরের মত। সবার উপরে যে থাকে সে হচ্ছে অফিসের মাথা। আর বাকী ষ্টাফরা হচ্ছে শরীরের বাকী অংশ। ষ্টাফরা যদি কেউ ভালো না থাকে তাহলে কি অফিসের মাথার ভালো থাকা সম্ভব?"
    "বোধহয় না স্যার।"
    "কয়েকদিন ধরে আপনার টয়লেটের ফ্লাশ নষ্ট । কেয়ারটেকার কে খবর দেননি ?"
    "দিয়েছি স্যার। এখনো নাকি ষ্টোর থেকে টুলস ডিসপ্যাচ হয়নি। তাই ফ্লাশ ঠিক করা হয়নি।"
    "পরে আর খোঁজ নিয়েছিলেন ?"
    "না স্যার।"
    "চলুন ষ্টোরে খোঁজ নিয়ে আসি।"
    "না না স্যার, ঠিক আছে। আমিই খোঁজ নেবো।"
    "অসুবিধা নেই। আমার জুনিয়রের একটা সমস্যা হয়েছে আর আমি দেখবোনা? অবশ্যই দেখবো। চলুন।"

    অফিসের ষ্টোর থেকে টুলস সহ মিস্ত্রীকে নিয়ে সামাদ সাহেবের রুমে গেলেন রহমান সাহেব। সাথে সামাদ সাহেব।

    ১১

    ফ্লাশের পাশে সামাদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আব্দুর রহমান সাহেব তার পাশে। মিস্ত্রী কানাইলাল ফ্লাশের কভার খুললো।
    রহমান সাহেব ঘামছেন। স্বপ্নের কথায় তিনি সামাদ সাহেবের ফ্লাশের সামনে দাঁড়িয়ে। অবশ্য এই কথা কেউ জানেনা। তাই আলাদা করে কারো কিছু ভাবার অবকাশ নেই। কিছু পাওয়া না গেলেও কোন সমস্যা নেই। বড় স্যারের যে সব কিছুতেই খুব তীক্ষ্ম নজর আছে , তাই সবাই ধরে নেবে।
    কিছু কি পাওয়া যাবে? রসিদটা পাবার আশা নিয়েই কি তিনি এখানে এসেছেন? কাক সম্পর্কিত অদ্ভুত স্বপ্নটিকে তিনি কেন বিশ্বাস করছেন? ঘটনাটা কি? মনে মনে রহমান সাহেব ভাবছেন ।

    সামাদ সাহেবও ঘামছেন। বেশ কয়েকবার রুমাল বের করে তিনি মুখের ঘাম মুছেছেন।

    ফ্লাশের ভেতর পানি নেই। চেইনে মরিচা পড়ে মাঝখান থেকে ছিঁড়ে গেছে। পানির লাইন বন্ধ করা । কানাইলাল ভেতর থেকে পলিথিন মোড়ানো একটা প্যাকেট বের করে নিয়ে এলো।

    কানাইলালের চোখে বিস্ময়। রুমে এতো জায়গা থাকতে এই প্যাকেট ফ্লাশের ভেতর কেন? সবাই কি একসাথে পাগল হয়ে যাচ্ছে? বড় সাহেব এসেছেন ফ্লাশ ঠিক করা দেখতে, সামাদ সাহেব কাগজ রেখেছেন ফ্লাশের ভেতর।

    "প্যাকেটটা দাও কানাই।" রহমান সাহেব হাত বাড়িয়ে প্যাকেট নিলেন। বুকের উপর একটা অনিশ্চয়তার পাথর ছিলো। সেটা নেমে গেছে। তার বদলে হচ্ছে অস্বস্তি। এই অস্বস্তির কারন আপাতত তিনি ধরতে পারছেন না। সামাদ সাহেবের মুখ থেকে রক্ত নেমে গেছে। তার হাত-পা কাঁপছে। রহমান সাহেব প্যাকেট খুলে বেশ মনোযোগ দিয়ে প্রথম পাতা পড়লেন।

    "কাজ শেষ কানাই ?"
    "হ স্যার। শ্যাষ।"
    "ঠিক আছে। তুমি যাও।"

    রহমান সাহেব ও সামাদ সাহেবের রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। সোজা ঢুকলেন নিজের রুমে। কিছুক্ষন পরেই সামাদ সাহেবকে তিনি নিজের রুমে ডেকে নিলেন।

    "সামাদ সাহেব,বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের একটা হিসেবে গরমিল হচ্ছিলো। বিষয়টি কি আপনি জানেন?"
    "জানি স্যার।"
    "বসুন সামাদ সাহেব। আমরা বসে বসে কথা বলি।"
    "জ্বী স্যার।"

    সামাদ সাহেবের হাত-পায়ের কাঁপুনি বেড়েছে। এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে বসেও তিনি ঘামছেন। এক একবার মনে হচ্ছে মাথা ঘোরাচ্ছে। মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। মাথা ঘুরে পড়ে গেলে কেমন হয়? তাতে অন্তত সব কিছু আরো পরে ঘটতো। একটু সময় অন্তত সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ডাক্তার এসে তাকে দেখে যেতো অথবা তাকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হতো।

    "সামাদ সাহেব আপনার কমোড ফ্লাশে যে কাগজ পাওয়া গেছে তাতে আমাদের এখানকার বাৎসরিক মোট খরচের একটা অংশের তথ্য আছে। পড়ে দেখবেন?"
    "নাহ।" সামাদ সাহেবের গলা খুব ক্লান্ত শোনালো।
    "কাগজে কি আছে তাতো আপনি জানেন তাইনা?"

    চুপ করে রইলেন সামাদ সাহেব। কথা বলে আসলে কোন লাভ নেই। যা ঘটেছে তা তিনি খুব ঠান্ডা মাথাতেই করেছেন। কাগজগুলো অফিসে রাখাটাই ভুলটা হয়েছে । শুধু ভুল না, বিরাট ভুল।

    "আপনাকে পুলিশে দেবো। অফিসের কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর শাস্তি আপনি পাবেন। তবে আপনার শাস্তি যেন কম হয় সেই ব্যবস্থা আমি করতে পারি। আগে বলুন আপনার সাথে কে কে ছিলো?"

    প্রানখোলা হাসি দিলেন সামাদ সাহেব। তিনি বললেন, "রহমান সাহেব, আপনি কর্মচারীদের পেছনে লোক লাগানোর ব্যবস্থা করেছেন। আবার আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন আমার সাথে কে কে ছিলো। কেমন হাস্যকর হয়ে গেলো না কথাটা?" এতক্ষণ সামাদ সাহেবের ভেতর অনিশ্চয়তার আতঙ্ক ছিলো। অনিশ্চয়তাটুকু কেটে গেছে। তিনি জানেন, তার গন্তব্য থানা। এখন তার আর সামনে বসে থাকা মানুষটিকে পরোয়া করার দরকার নেই।

    "প্রশ্নটা হাস্যকর নাকি? হবে হয়তো। যাকগে, বলুন কে কে ছিলো আপনার সাথে?"
    "কেউ ছিলোনা।"
    "সত্যি বলছেন সামাদ সাহেব?"
    "সত্যি-মিথ্যে এই মুহুর্তে অবান্তর একটা বিষয় রহমান সাহেব।"
    "আপনার এই অবস্থার জন্য আপনিই দায়ী থাকলেন সামাদ সাহেব। একটা সুযোগ আপনার হাতে ছিলো। ব্যবহার করলেন না।"
    "প্রত্যেক মানুষই তার অবস্থার জন্য দায়ী । এটা নতুন কিছু না। সুযোগ দেবার জন্য ধন্যবাদ।"

    ১২

    বিচিত্র একটা অনুভূতি নিয়ে রহমান সাহেব বাসায় ফিরলেন। মনের ভেতর কিসের যেন খচখচানি। সামাদকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মামলা হবার কথা। সামাদ নিজের পক্ষে উকিল দেবে তো ?

    খাবার টেবিলে কুমকুম গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে আছে। বাচ্চারা কেউ টেবিলে নেই। সন্ধ্যা বেলাতেই ঘুম। তারা সারাদিন স্কুলের পিকনিকে ছিলো।

    "সামাদের খবর শুনেছো?"
    "হুমম।"
    "কে বললো?"
    "সামাদই ফোন করেছিলো থানা থেকে।"
    "ওর সাথে তোমার যোগাযোগ আছে?"
    "ছিলোনা। আজ অনেকদিন পর হলো।"
    "কি বললো সামাদ? "
    "তেমন কিছু না।"

    কুমকুম এরপর একদম চুপ। রহমান সাহেবও কথা বাড়ালেন না। চাপাচাপি করে কুমকুমের কাছ থেকে কোন কথা বের করা যাবেনা। এই তথ্য রহমান সাহেব খুব ভালো কররে জানেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিল থেকে ঊঠে গেলেন তিনি। খাওয়া পড়ে রইলো টেবিলে।

    তার মন খুব খারাপ হলো। আচ্ছা, সামাদ কুমকুমকে কেন ফোন করলো? কাজটা করে তার কোন লাভ কি হয়েছে?

    ১৩

    সে রাতে অনেকটা সময় রহমান সাহেবের ঘুম এলোনা। রাত দুটোর দিকে ঘুমের ঔষধ খেয়ে তিনি ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। ঘুমটা তার খুবই জরুরি। ঔষধ খাবার পর তিনি ঘুমালেন। ঘুমের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে আবারো কাক উপস্থিত।

    "স্যার, কাজটা কি ঠিক হলো?"
    "কোন কাজের কথা বলছেন?"
    "এই যে সামাদ সাহেবকে পুলিশে দিয়ে দিলেন।"
    "ঠিক হবেনা কেন? অন্যায় করেছে, তার শাস্তি সে পাবে। এইতো।"
    "অন্যায়ের শাস্তি দেবার স্যার আপনি কে?"
    "কে মানে? আমি অফিসের মাথা। এই দায়িত্ব আমার উপরেই তো পড়ে।"
    "সামাদ সাহেব একবার আপনার একটা বিরাট উপকার করেছিলেন। সেই উপকারের প্রতিদান আপনি দেননি। তার বদলে তাকে জেলে ঢুকিয়ে দিলেন।"
    "এখানে উপকারের কথা কেন আসছে? অপরাধ করেছে, শাস্তি পাবে। এইতো। এর সাথে উপকারের কোন সম্পর্ক নেই। আর সে আমার কি উপকার করেছে?"
    "এরই মাঝে ভুলে গেলেন স্যার?"
    "কি ভুলে গেছি?"
    "মানুষ বড় বিস্মৃতিপরায়ন প্রজাতি স্যার। এদের হিংসাও বেশী। আপনাদের হিংসা এতো বেশী কেন স্যার? সামাদ সাহেবকে যে কোন সুযোগ দিলেন না, তার পেছনে কি আপনার তীব্র হিংসা আর ঈর্ষা ছিলোনা?"
    "বাজে কথা বলবেন না তো। আপনি এখান থেকে যান। আমার অনেক কাজ। আর শুনুন, আমার ভেতর কোন হিংসা টিংসা কাজ করেনি। অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছি। ব্যাস। আর কিছু না। আপনি এখন যান।"
    "স্যার, আমি এখান থেকে যাবোনা। আপনি যাবেন। এলাকাটা আমার। আপনি বোধহয় খেয়াল করেননি।"

    রহমান সাহেব চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন। তিনি বসে আছেন ডাষ্টবিনে। সেখানেই তার টেবিল চেয়ার বসানো। রহমান সাহেব খুবই হতাশ হলেন। একসময় বললেন, "আপনার আর কি কিছু বলার আছে? আমি যাবো। আমার কাজ আছে।"

    "আপনি তো স্যার যেতেও পারবেন না। আপনার পা নেই স্যার।"

    রহমান সাহেব পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তার নিজের পায়ের জায়গায় কাকের পায়ের মতো কাঠি কাঠি দুটো পা। এই পা দিয়ে মানুষের পক্ষে হাঁটা সম্ভব না। পায়ে আবার আঙ্গুল দেখা যাচ্ছে। আঙ্গুলগুলো পাখির আঙ্গুলের মতো।

    "স্যার, এবার কি আমি কথা বলতে পারি?"
    "বলুন।"
    "আপনাদের, মানুষের মাঝে এতো হিংসা কেন?"
    "ক্রমাগত বাজে কথা বলেই যাচ্ছেন। কারনটা কি বলুনতো? মানুষ মোটেই হিংসাপ্রবন প্রানী না। মহামতি বুদ্ধের নাম শুনেছেন? তিনি অহিংসের নীতি প্রচার করেছেন। শুধু মানুষই পারে অহিংস হতে।"
    "ভুল বললেন স্যার। মানুষ অহিংস না। তাই যদি হতো তাহলে আলাদা করে অহিংসের নীতি প্রচার করার প্রয়োজন ছিলোনা।।"
    "আপনি তো দেখি বেশ জ্ঞান কপচাচ্ছেন। চুপ করুন । আমি আপনার জ্ঞান শুনতে চাচ্ছিনা।"
    "কী শুনবেন স্যার? তাহলে অন্য কথা বলি?"
    "চুপ। একদম চুপ। হারামজাদা কাক। দূরে যা।"
    "স্যার, তুই তোকারি করছেন। গালাগালিও করছেন। কারন কী স্যার?"
    "তোকে সন্মান দিয়ে কথা বলতে হবে? অনেক সন্মান দিয়েছি। আর না। তুই যা।"
    "কেন স্যার? আমাদের সন্মান দেয়া যায়না? আমরা কি স্যার মানুষের চেয়ে কম জ্ঞানী ভেবেছেন?"
    "কাকের জ্ঞান, শিয়ালের শিং। যত্তোসব।"
    "আমরা স্যার আপনাদের চেয়ে অনেক জ্ঞানী।"
    "শালা একদম চুপ। কোন কথা না। "
    "আমাকে তো স্যার চুপ করলে হবেনা। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। আমরা আসলেই মানুষের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। আমরা একজনের জ্ঞান আরেকজনকে অস্রাসরি দিয়ে দিতে পারি। মাঝখানে কোন মাধ্যমের প্রয়োজন হয়না। আর আপনাদের মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। কাগজ কলম লাগে। এই জ্ঞান আবার হারিয়েও যায়। আগের দিনের মানুষ তো বেদম বোকা ছিলো। পাথরে খোদাই করে লিখতো। কাহ কাহ কাহ..."
    "এমন বিশ্রী শব্দ করছো কেন?"
    "হাসছি স্যার। মানুষের বোকামীতে হাসছি। আপনি স্যার তুই থেকে তুমিতে চলে এসেছেন। শুনে ভালো লাগছে। বোধহয় আমার কথা আপনার বিশ্বাস হওয়া শুরু হয়েছে। কাহ কাহ কাহ... সেই আদিম দুনিয়া থেকে আমাদের জ্ঞানার্জন শুরু হয়েছে, এখনো চলছে। আপনাদের মতই। পার্থক্য হলো আপনারা অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছেন। ভুলে গেছেন। আমাদের সবই মনে আছে। আগের দিনগুলোর কথা আপনারা কতো কষ্ট করে এখন জানার চেষ্টা করেন। কাহ কাহ কাহ... আমরা স্যার একজন আরেকজনকে জ্ঞান দিয়ে দেই। হিংসা করিনা। আর আপনারা? জ্ঞান দেয়া তো দূরের কথা , কেউ কিছু দিলে সেটা স্বীকার পর্যন্ত করেন না। এই জ্ঞান দিয়ে তৈরি করেন স্বজাতি মারার যন্ত্রপাতি। "
    "তোমরা মোটেই জ্ঞানী কোন প্রজাতি না। বোকা, খুব বোকা একটা প্রজাতি। নিজের ডিম মনে করে কোকিলের ডিম ফোটাও। সেই বাচ্চাকে আবার ঊড়তেও শেখাও।"
    "ভুল বললেন স্যার। আমরা কিন্তু টের পাই কোনটা কার ডিম। আসলে স্যার, কোকিল খুব অস্থির প্রকৃতির। এরা বাসা বানাতে পারেনা। ডিমে তা দেবার ধৈর্য এদের নেই। তাই আমাদের স্ত্রী কাকেরা ওদের ডিমে তা দেয়। নাহলে তো স্যার ওদের পুরো প্রজাতিটাই উধাও হয়ে যাবে। চোখের সামনে কি তাই হতে দেয়া যায় স্যার?"
    "চুপ করোতো। তোমার কথা শুনে মাথা ধরে যাচ্ছে। বেশি বেশি জ্ঞানের কথা হয়ে যাচ্ছে। ফালতু জ্ঞানের কথা। এবার আমি যাবো।"
    "জ্ঞান হলো জ্ঞান। এর মধ্যে আবার ফালতু কি? আর আপনি এখন যাবেন না। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।"
    "আরো কথা আছে? তোমার কথা তো কথা না। বাজে কথা।"
    "যা আপনি ভাবেন স্যার। আপনি স্যার সামাদ সাহেবের প্রতি কোন কৃতজ্ঞতা দেখালেন না। খুব বড় একটা অন্যায় করেছেন। আর ওদিকে আমার বাচ্চারাও খুব সমস্যায় আছে স্যার। আশেপাশে বিশাল বিশাল চিল উড়ে বেড়ায়। খুব ভয়ে আছি স্যার। কখন চিল ধরে বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলে। ওদের মা ওদের ছেড়ে বেশীদূর যেতে পারেনা। আমার বাচ্চাদের নিরাপত্তার দিকটা স্যার আপনাকেই দেখতে হবে।"
    "কাকের বাচ্চার নিরাপত্তা দেবো আমি? হা হাহ হা হা। ভালো বলেছো। এসব উদ্ভট কথা বলতে খারাপ লাগেনা?"
    "স্যার, একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমার পরিবারের সামনে এখন সমূহ বিপদ। আপনি চাইলেই ওদের বাঁচাতে পারেন।"
    "উলটাপালটা কথা বন্ধ। ড়বয়ঢ় য়স."
    "স্যার, প্লীজ স্যার।"
    "যাহ। হুস...হুসস...যাহ...।"

    প্রচন্ড ধাক্কায় রহমান সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কুমকুম ধাক্কা দিচ্ছে ।

    "কি হয়েছে তোমার? হুস হুস করছো কেন?"

    রহমান সাহেব প্রথমে কিছু বুঝতে পারলেন না। ধাতস্থ হতে তার কিছু সময় প্রয়োজন। পাশেই কুমকুম দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে রহমান সাহেবের দিকে। দৃষ্টিতে বিস্ময়। মানুষটাকে সে ঘুমের ঘোরে কখনো কথা বলতে দেখেনি।

    "কি ব্যাপার, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?"
    "এমনি। হুস হুস করছিলে কেন?"
    "ও কিছু না। বোধহয় দু:স্বপ্ন দেখছিলাম।"

    কুমকুম বেডরুম থেকে বেরিয়ে গেলো । রহমান সাহেব বিছানার উপর উঠে বসলেন। জানালার পর্দা সরানো হয়েছে। একটুকরো রোদ জানালা দিয়ে ভেতরে এসে ঢুকেছে। জানালার গ্রীলে রহমান সাহেবের চোখ পড়লো। একটা কাক জানালায় বসে আছে, স্থির। কোনরকম নড়াচড়া করছেনা। গলার কাছে সাদা ফুটকি। এই কাকটিকে তিনি চেনেন।

    খুব অস্বস্তি বোধ করা শুরু করলেন রহমান সাহেব। একসময় সেই অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়লো তার সারা শরীরে।

    ১৪

    অফিসে আজ তিনজন বিদেশী কর্মকর্তা এসেছেন। তাদের সামনেই প্রেজেন্টেশনে যেতে হবে। বিদেশী তিনজনের মধ্যে দুজনকে রহমান সাহেব চেনেন। একজন সাউথ ঈষ্ট এশিয়ান চিফ স্যামুয়েল এন্ডারসন, দ্বিতীয়জন এশিয়া জোনের সুপারভাইজার জন ম্যাকেরনি। তৃতীয়জন এক কৃষ্ণাংগ ভদ্রমহিলা। এই ভদ্রমহিলাকে রহমান সাহেব কখনৈ দেখেননি। মহিলার পরনের কাপড়ের রঙ ও কালো। গলায় মুক্তোর মালা। মুক্তোগুলো বেশ বড় বড়। স্যামুয়েল এখনো ভদ্রমহিলা পরিচয় দেননি। আশা করা যাচ্ছে প্রেজেন্টেশন শেষে মহিলার পরিচয় পাওয়া যাবে।

    প্রেজেন্টেশনে রহমান সাহেব চম্‌ৎকার বক্তব্য রাখলেন। সমস্ত হিসেব ঠিকঠাক মতো কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দিলেন। কোথাও কোন সমস্যা হলোনা। শেষে সামাদ সাহেবের ঘটনা এলো।অরহমান সাহেব সেটাও ভালৈ সামলে নিলেন।

    সবশেষে রহমান সাহেবের অফিসরুমে ছোট মতো আড্ডার আয়োজন করা হলো। তখন মি. স্যামুয়েল রহমান সাহেবের সাথে ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

    "রহমান, ইনি হচ্ছেন জিমি ক্রো। নতুন রিজিওনাল সুপারভাইজার। ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের সমস্ত হিসেবপত্র প্রথমে তার কাছেই যাবে। মিসেস ক্রো আপাতত বাংলাদেশে থাকতে চাইছেন। বাচ্চাদের নিয়ে তিনি আপাতত একটা হোটেলে আছেন।"
    রহমান সাহেব বললেন,"মিসেস ক্রো, আপনার থাকার জায়গা কি ঠিক করা হয়েছে?"
    "নাহ। এই দেশ তো আমার কাছে নতুন। একটু নিরিবিলি এলাকায় থাকতে চাচ্ছি। তোমাদের ঢাকায় এরকম জায়গা কোথায় আছে,বলতো?"
    "নিরিবিলি চাইলে গুলশান এলাকাটা বেশ।"
    "বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে থাকবো। নিরাপত্তার দিকটাও দেখতে হবে। আসলে নিরাপত্তার দিকটাই আমাকে বেশী ভাবাচ্ছে।"

    ঠিক এই পর্যায়ে রহমান সাহেবের সকালের অস্বস্তিটা ফিরে এলো। মহিলা নামটা যেন কি? জিমি ক্রো। ক্রো মানে হচ্ছে কাক। কাক?! এই মহিলার মুখটা অমন বেঢপ চোখা কেন? ঠোঁট গুলো এতো কালো ! কথা বলার সময় শুধু ঠোঁট নড়ছে পুতুলের মতো, মুখের বাকি কোথাও নড়াচড়া নেই। উনি কি কথা আসলে পুতুলের মতো বলছেন নাকি পাখির মতো? গলায় সাদা মুক্তোর মালা। কালো ত্বকের উপ মালাটাকে কেমন সাদা ফুটকির মতো লাগছে। গায়ে কুচকুচে কালো ড্রেস, পায়ের জুতূ কালো, চকচকে কালো।

    রহমান সাহেবের কাছে মহিলাকে হঠাৎ করেই কেমন বড়সড় কাক মনে হলো। তিনি তীব্র দৃষ্টিতে জিমি ক্রোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্বপ্নের কাকটি তার বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে চিন্তিত। এই ক্রো নামের ভদ্রমহিলাও তাই। রহমান সাহেবের দৃষ্টি আরো তীব্র হলো। ভদ্রমহিলার চোখের পাতা এতো কম পড়ে কেন? তিনি কি ভুল দেখছেন?

    "কি ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমি কি খুব সুন্দরী? কাহ কাহ কাহ কাহ..."

    মহিলার হাসির শব্দে ভবহ চমকে গেলেন রহমান সাহেব। হাত থেকে গ্লাস পড়ে গেলো। হাসির এই শব্দ তার খুব পরিচিত।
    বাকী সময়টা কিভাবে কেটে গেলো ঠিকঠাক বুঝতে পারলেন না রহমান সাহেব।

    ১৫

    রহমান সাহেব বাসায় ফিরলেন হালকা জ্বর নিয়ে। হালকা জ্বরেই তার অস্থির লাগছে। মুখ শুকিয়ে আসছে। স্ত্রীর সাথে ডাইনিং টেবিলে বসার দীর্ঘদিনের অভ্যাসে ব্যতিক্রম ঘটলো। খতে ইচ্ছে করছেনা। শরীর কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। মাথাতেও ব্যাথা আছে। রহমান সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে সোজা বিছানায় চলে গেলেন।

    "কি ব্যাপার, খাবেনা? শুয়ে পড়লে নাকি?"
    "খেতে ইচ্ছে করছে না।"
    "দেখি তো, জ্বর বাধালে নাকি?" বলেই কুমকুম রহমান সাহেবের কপালে হাত রাখলো।
    "কই, গা তো তেমন গরম না। দুটো রুটি করে দেই? খায়ে শুয়ে পড়।"
    "আচ্ছা।"
    "তোমাকে জানানো হয়নি। কুকুরদুটো আজকে মারা গেছে।"
    "কি বলছ এসব?"
    "হুমম। এতো অবাক হচ্ছো কেন? অসুস্থ্য ছিলো, মারা গেছে। বিকেলে সোবহান খাবার দিতে গিয়ে দেখে মরে পড়ে আছে।"
    "ও, আচ্ছা।"
    "বিকেলেই দুটোকে ডাষ্টবিনে ফেলে আসা হয়েছে। ঘরটা ফিনাইল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে বলেছি। কিসে মরলো কে জানে ! বাড়িতে ছেলেপুলে আছে। সাবধানে থাকাই ভালো।"

    কুমকুম রুটি বানাতে চলে গেলো। কিছুক্ষন পর খাবার জন্য ডাকতে এসে সে দেখলো রহমান সাহেব হাত পা কুঁকড়ে বাচ্চাদের মতো শুয়ে আছেন। ঘুমাচ্ছেন। নিয়মিত শ্বাষ-প্রশ্বাষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রহমান সাহেবের চেহারায় কেমন যেন ভয়ের একটা ছাপ। বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। কুমকুম কথা শোনার চেষ্টা করলো। কিছুই বোঝা গেলোনা। রহমান সাহেবের গায়ে পাতলা একটা চাদর টেনে দিয়ে জানালা বন্ধ করতে গেলো কুমকুম। জানালার গ্রীলে বেশ বড়সড় একটা কাক বসা।
    হুস বলতেই কাকটা উড়ে চলে গেলো। জানালা আটকাতে গিয়ে কুমকুমের দৃষ্টি চলে গেলো বাইরের ইলেক্ট্রিক কেবলের দিকে। শত শত কাক বসে আছে। কি ব্যাপার? রাতের বেলায় এতো কাক? কাকেরা কি তারের উপর বসেই ঘুমায় নাকি? শহরে কি গাছপালার সংখ্যা কমে গেছে নাকি কাকেদের জনসংখ্যা বিস্ফোরন? নিজের মনে হাসতে হাসতে জানালা বন্ধ করে, বাতি নিভিয়ে কুমকুম চলে গেলো ড্রইংরুমে।

    ১৬

    "স্যার, ঘুমুচ্ছেন তো আরাম করেই।"
    "খুব ক্লান্ত। ঘুমুতে তো হবেই। কাল আবার অফিস।"
    "আপনার ম্যাডামের বাড়ি কি ঠিক হয়েছে?"
    "এক দিনেতো আর ঠিক হবেনা। সময় লাগবে। ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ঠিক করতে হবে। সে কাজের জন্য লোক লাগানো হয়েছে।"
    "কি রকম বাড়ি প্রয়োজন স্যার?"
    "যেসব বাড়িতে নিরাপত্তা ব্যাবস্থা ভালো সেইরকম একটা বাড়ি দরকার। ম্যাডাম তার বাচ্চাদের নিয়ে থাকবেন। নিরাপত্তার বিষয়টাই তাই আগে।"
    "স্যার, আমার বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিয়ে একটু ভাবতে বলেছিলাম। ভেবেছিলেন?"
    "তোমার বাচ্চার কথা তুমি ভাবো।অআমি কেন ভাবতে যাবো?"
    "আমাকে তো স্যার ভাবার সুযোগ দিলেন না। তার আগেই মেরে ফেললেন। ফাইল সমস্যাটার সমাধান করে দিলাম, তাও আমার বাচ্চাদের কথা একটু ভাবতে পারলেননা? এতো অকৃতজ্ঞ কেন আপনি?"
    "আচ্ছা ঠিক আছে। দেখা যাক।"
    "আপনার আর না দেখলেও চলবে স্যার। ওরা আজ মারা গেছে। চিলে নিয়ে গেছে। ওর মা একা বাঁচাতে পারেনি। বেচারির পাখায় জখম হয়েছে। অন্যরা আসার আগেই সব শেষ। এবার স্যার আপনার শাস্তি পেতে হবে। আপনার কুকুরগুলো মরেছে না স্যার?"
    "হ্যাঁ মরেছে।"
    "আমার শরীরটা খেয়েছে, তাই ওদের মারা হয়েছে। বুঝতে পারছেন? এবার স্যার আপনার শাস্তি হবে। কঠিন শাস্তি।"
    "যাহ ব্যাটা হুস...হুস...।"

    শব্দের চোটে রহমান সাহেবের নিজেরই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘর এতো অন্ধকার কেন? তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। পাশেই কুমকুম ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্ত মানুষের মত। খুব পানি পিপাসা পেয়েছে রহমান সাহেবের। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কেন যেন তার খুব ভয় লাগছে।
    হাতড়ে হাতড়ে রুমের বাতি জ্বালালেন। আলোতে কুমকুমের সমস্যা হয়না। রহমান সাহেবের খুব খিদে পেয়েছে। ফ্রিজে কিছু কি পাওয়া যাবে? থাকার কথা।

    রহমান সাহেব বিছানা থেকে নেমে সোজা ডাইনিং রুমে চলে গেলেন। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমানৈ স্বাভাবিক। রাত তো আর কম হয়নি।
    ফ্রীজে পুডিং আছে। পুডিং বের করে তিনি খাওয়া শুরু করলেন। গপ গপ করে খাচ্ছেন। কারন পুডিং তার পছন্দের খাবার। কুমকুম রাঁধেও ভাল।

    "স্যার, আমারো খিদে পেয়েছে। আমাকেও একটু দিন।"

    হঠাৎ শব্দ পেয়ে চমকে উঠলেন রহমান সাহেব। পাশের চেয়ারে চোখ পড়তেই তিনি নিজে চেয়ার থেকে ছিটকে পড়লেন।
    চেয়ারে কাক বসে আছে। বিশাল এক কাক। রহমান সাহেব চিৎকার করতে চাইছেন, পারছেন না। গলা যেন আটকে গেছে।

    "এতো ভয় পাচ্ছেন কেন স্যার? আপনাকে ভয় দেখানোর মতো সাধারন শাস্তি দেয়া হবেনা। আপনার শাস্তি হবে খুব কঠিন। খিদে পেয়েছিলো, তাই এসেছি।"

    কাকটা নির্বিকার ভঙ্গিতে রহমান সাহেবের প্লেটের পুডিং খাওয়া শুরু করলো।
    রহমান সাহেব চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সেই চিৎকারে বাসার সবার ঘুম ভাঙ্গলো।

    ১৭

    "কি হয়েছে তোমার?" কুমকুমের গলায় উদ্বেগ পরিস্কার টের পাওয়া যাচ্ছে।
    রহমান সাবের জ্ঞান ফিরে এসেছে। তিনি মেঝেতেই বসে আছেন। খুব অস্থির লাগছে তার। তিনি কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন? পুরো বিষয়টা কি কুমকুমকে বলা যায়? বললে আবার পাগল ঠাওরাবে নাতো? এতো সব ভেবে রহমান সাহেব কুমকুমকে প্রশ্ন করলেন, "এঘরে কোন কাক বসে থাকতে দেখেছ?"

    কুমকুম প্রশ্ন শুনে খুবই অবাক হলো। রাতদুপুরে একটা মানুষ খেতে বসে অজ্ঞান হয়ে গেলো। জ্ঞান ফেরার পর সেই মানুষটির প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে রুমে কি কোন কাক ছিলো? এইরকম উদ্ভট প্রশ্ন মানুষ করে?

    "কাক? এতো রাতে? বাড়ির ভেতর এতো রাতে কাক ঢুকবে কেমন করে? দরজা-জানালা সবই বন্ধ।"
    "দেখেছো কিনা তাই বলো। এতো কথা বলতে বলেছি?"
    "নাহ, কোন কাক টাক ছিলোনা।"

    মেঝে থেকে উঠে রহমান সাহেব চুপচাপ বেড রুমে চলে গেলেন। কিছুক্ষন ঘুমাবার চেষ্টা করলেন। কিছুতেই ঘুম এলোনা। ঘুমুবার ওষুধ খেয়ে ঘুমানো যায়। কিন্তু তিনি শুনেছেন এই জাতীয় ওষুধের কিছু ঝামেলা আছে। টানা খেলে, পরে নাকি ওষুধ না খেলে আর ঘুম আসেনা। এইরকম পরিস্থিতিতে তিনি পড়তে চাইছেন না।

    বিছানা থেকে উঠে তিনি বারান্দায় গিয়ে বসে রইলেন। কুমকুম বেশ কয়েকবার ঘুমানোর জন্য ডাকলো। তিনি ঘুমাতে গেলেন না। কুমকুম ডাক্তার আনার কথা বললো। তাতেও রহমান সাহেব রাজী নন। ডাক্তার শ্রেনীটার উপর তার তীব্র একটা ক্ষোভ আছে।

    সারা রাত বারান্দায় বসে বসে রহমান সাহেব ভাবলেন।

    মানুষ কি সত্যি অন্য প্রানীর চেয়ে কম বুদ্ধিমান? বুদ্ধি কম হলে অন্য প্রানীর জায়গায় মানুষ কেমন করে সভ্যতা গড়ে তুললো? বাজে কথা। আরে, আশ্চর্য তো, তিনি নিজেও দেখি কাকের কথা বিশ্বাস করে বসে আছেন। ওগুলো স্রেফ স্বপ্ন। অন্য কিছু না।

    আচ্ছা, তার কি কোন ধরনের হ্যালুসিনেসন হচ্ছে? হ্যালুসিনেসন এক ধরনের মানসিক সমস্যা। হঠাৎ করে কি কারো মানসিক সমস্যা হতে পারে? নাকি এই ধরনের সমস্যা বংশগতির সাথে সম্পর্কিত। বংশগত হবার কথা না। কারন তার পরিবারে এই জাতীয় সমস্যা কারো ছিলো শুনেছেন বলে মনে পড়ছেনা। আচ্ছা ঐ কাক ব্যাটা ফাইলের কথা বললো কেমন করে? কাকের কি সত্যি কোন ক্ষমতা আছে? ব্যাখ্যাতীত কোন ক্ষমতা? ধুর, তা কেমন করে হয়?

    ভোর বেলার দিকে রহমান সাহেবের দুচোখের পাতা লেগে এলো। স্বপ্নে দেখলেন তিনি হাত-পা কুকড়ে ডাষ্টবিনে বসে আছেন। মুখ দিয়ে তিনি ময়লা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছেন। সারা শরীরে কালো কালো পালক। ঐ তো এক টুকরো পুডিং পাওয়া গেছে। পঁচা পুডিং। তাও পুডিং তো। খারাপ কি? তিনি মনের আনন্দে পুডিং খাওয়া শুরু করলেন। পাশেই দুটো মড়া কুকুর পড়ে আছে। ওগুলো কি রন্টি-মন্টি? মড়া কুকুরদুটো হঠাৎ করেই জ্যান্ত হয়ে উঠলো। তারা তার ঘাড় কামড়ে ধরলো। এদের কামড়ে তো ব্যাথা পাবার কথা। কিন্তু ব্যাথা তো পাওয়া যাচ্ছেনা। কেমন যেন শীতল একটা অনুভূতি। ভেজা ভেজা। রহমান সাহেবের তন্দ্রা ভেঙ্গে গেলো।

    কুমকুম ঘাড়ে হাত দিয়ে তার মাথা ঠিক করে দিচ্ছে। মাথা এক পাশে হেলে গিয়েছিলো। কুমকুমের হাত ভেজা, ঠান্ডা।

    "কুমকুম, কুকুরদুটো কোথায়?"
    "আবার কোথায়? সোবহান ডাষ্টবিনে ফেলে এসেছে। বললাম না তখন? এই সাতসকালে এই প্রশ্ন কেন?"
    "নাহ, এমনি।"

    ১৮

    রহমান সাহেব প্রতিদিন সকালে শেইভ করেন। ক্লীন শেইভড হয়ে অফিসে যাওয়াটা তার পছন্দ। আর দশ জনের মতো রহমান সাহেব শেইভ করার জন্যে ব্লেইড বা রেজর ব্যবহার করেন না। তিনি জীবনে প্রথম শেইভ করিয়েছিলেন সেলুনে। সেখানে নরসুন্দর ভদ্রলোক ব্যবহার করেছিলেন ক্ষুর। সেদিন থেকেই রহমান সাহেব ক্ষুর জিনিসটাকে পছন্দ করে ফেলেছেন। তাই তিনি শেইভের জন্যে ক্ষুর ব্যবহার করেন। ক্ষুর ধার দেবার জন্যে একটা লম্বা চামড়ার ফিতে বাথরুমের দেয়ালে ঝোলানো আছে। চামড়ায় ঘষে ক্ষুরে ধার দিতে হয়। ধার দেবার সময় মিহি ধরনের শব্দ হয়। শব্দটা রহমান সাহেবের বেশ ভালো লাগে।

    আজকে রহমান সাহেবের হাত কাঁপছে। ভোরের তন্দ্রায় দেখা দু:স্বপ্ন এর কারন। রহমান সাহেব মুখে ফেনা লাগিয়ে শেভ করা শুরু করলেন। শেইভ করার কাজটি তিনি খুব মনোযোগ সহকারে করেন। গালের একপাশের দাড়ি কাটা শেষ। তিনি এবার আরেক পাশের দাড়ি কাটা শুরু করলেন। ঠিক এই সময় কে যেন বলে উঠলো, "স্যার, খুব সাবধান। পালক গুলো খুব শক্ত।"

    রহমান সাহেব চমকে উঠলেন। হাতের ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেলো। গালের বেশ খানিকটা কেটে গেলো। প্রথমে বিষয়টা তিনি টের পেলেন না। পেছনে কেউ আছে কিনা দেখে নিলেন। বাথরুম ফাঁকা। কেউ নেই। এবার তিনি তাকালেন বেসিনের দিকে। বেসিন ভর্তি পালক। রহমান সাহেব নিজেকে শান্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন। বেসিনে পালক কেন? একি! রক্ত কিসের? রহমান সাহেব এবার তাকালেন আয়নায়। তার নিজের চেহারার জায়গায় বিশাল এক কাকের মাথা। মাথার একপাশে পালক নেই। পালকের জায়গায় গোলাপী ত্বক দেখা যাচ্ছে। ত্বক থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বিব্‌হ্‌ৎস এক দৃশ্য।
    চিৎকার করে তিনি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। কুমকুম সাথে সাথে ছুটে এলো। সাথে রাকিব- আনিকা।

    "খোদা! এতোটা কাটলো কিভাবে?"

    রহমান সাহেবের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছেনা। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কুমকুম রহমান সাহেবের গালে কাপড় চেপে ধরলেন। রক্ত পড়া বন্ধ করা দরকার। রক্ত বেরুচ্ছে প্রচুর। কাপড় ভিজে গেলো রক্তে। বরফ দিয়ে কাটা জায়গা চেপে ধরা হলো। লাভ হলোনা। ভয় পেয়ে গেলো কুমকুম। এতো রক্ত মানুষের শরীরে থাকে?

    ১৯

    ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এলেন রহমান সাহেব। গালে তিনটা সেলাই পড়েছে। রক্ত বেরিয়েছে প্রচুর। শরীর দুর্বল লাগছে। বাইরে বেশ কড়া রোদ। বাইরে বের হবার সাথে সাথে রহমান সাহেবার মাথা ধরে গেলো। রোদ মনে হচ্ছে একেবার মগজের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। মাথা চিড়বড় করে উঠলো।

    "গাড়ি কোথায় কুমকুম?"
    "আছে বোধহয় আশেপাশে। রমিজকে তো আশেপাশেই থাকতে বলেছি।"

    রমিজ হচ্ছে রহমান সাহেবের ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার। স্যারকে সে বের হতে দেখেছে। দ্রুত গাড়ি নিয়ে সে গেইটে চলে এলো । গাড়ি দেখেই রহমান সাহেবের মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেলো। চকোলেট রঙের একটা ঝাঁ চকচকে গাড়ি। তার সারা শরীরে সাদা সাদা কাকের বিষ্ঠা। দূর থেকে গাড়িটাকে হরিনের মতো লাগছে।

    "রমিজ মিয়া, গাড়ি পরিস্কার করোনি কেন? সারা গাড়িতে কাকের গু। ডাষ্টবিনে নিয়ে গিয়েছিলে গাড়িটাকে ? "

    রমিজ খুবই অবাক হয়ে গেলো। কুমকুমেরও একই অবস্থা। গাড়ি পুরো ঝকঝক করছে। কোথাও কাকের বিষ্ঠার চিহ্‌ণও নেই।

    "গু কই স্যার? পুরা গাড়িতো পরিস্কার।"
    "আবারো মুখে মুখে কথা বলে! " বলেই রহমান সাহেব দড়াম করে রমিজের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। এই সামান্য নড়াচড়াতেই রহমান সাহেব বড্ড ক্লান্তি বোধ করলেন। তিনি হাত-পা এলিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। রমিজ মিয়া রহমান সাহেবকে জাপ্টে ধরলো।

    রহমান সাহেবকে আবারো ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো। কুমকুম পড়ে গেলো দুশ্চিন্তায়। ঘটনা কী? এইরকম একটা ভদ্র মানুষ এতো তুচ্ছ কারণে এরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো কেন? আর কারনটাও তো সত্যি না। গাড়ির কোথাও কাকের বিষ্ঠা ছিলোনা। কুমকুমের মনে হচ্ছে কোথাও বিশাল একতা সমস্যা হয়েছে।

    রহমান সাহেবকে কেবিনে রাখা হয়েছে। স্যালাইন চলছে। সাথে সিডেটিভও দেয়া হয়েছে। তিনি এখন ঘুমুচ্ছেন। কুমকুম কেবিনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। কেবিন চার তলায়। ক্লিনিক চাতালে একটা ঝাকড়া জাম গাছ দেখা যাচ্ছে। গাছ ভর্তি কাক।

    সবকটা কাক স্থির হয়ে বসে আছে। সব কেমন যেন থমথমে। এতো কাক কেন চারদিকে? এরই মাঝে একটা কাক এসে বসলো বারান্দার গ্রীলে। তার গলায় সাদা ফুটকির মতো দেখা যাচ্ছে। এই কাকটার উড়তে একটু কষ্ট হচ্ছে। ডানায় জখম আছে মনে হচ্ছে। কুমকুমের খুব কাছেই বসে আছে কাকটা। কুমকুমকে সে যেন গ্রাহ্যই করছেনা। অদ্ভুত তো!

    ২০

    বিকেলের দিকে রহমান সাহেবের কেবিনে ডাক্তার এলেন।
    "আসসালামুয়ালাইকুম। ভালো আছেন? "
    "জ্বী ভালো আছি। ওয়ালাইকুমসসালাম।" রহমান সাহেব খুব বিরক্ত হলেন প্রশ্ন শুনে। ভালো থাকলে কেউ ক্লিনিকে পড়ে থাকে নাকি? যত্তোসব আদিখ্যেতা। ডাক্তার সম্প্রদায়টাকে রহমান সাহেব একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। ঠিক কি কারনে তাদের এতো অসহ্য লাগে সেই বিষয়টা অবশ্য রহমান সাহেবের জানা নেই।
    ডাক্তার সাহেবের নাম ফজলুল করিম। পড়নে নীল ফতুয়া টাইপের জামা। নীচেও নীল রঙের পাজামা। বুকের উপর তার নাম লেখা। মানুষটা ছোটখাট ধরনের। চোখের চারপাশে পুরু প্যাড জমেছে। কুতকতে দৃষ্টি নিয়ে তিনি এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। তার হাত কিছুক্ষন পর পর বুকে নিজের নাম লেখা অংশের কাছে চলে যাচ্ছে। তার পেছনে তিনজন দাঁড়িয়ে। তাদের পড়নেও একই পোষাক। তবে তাদের বয়স কম। কিন্তু তিনজনই মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের ফজলুল করিম সাহেব হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
    "কি হয়েছিলো আপনার?"
    "গাল কেটেছে।"
    "কিভাবে কাটলো?"
    "শেইভ করতে গিয়ে কেটেছে।"
    "শেইভ করতে তো এতোটা কাটেনা।"
    রহমান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,"আমি ক্ষুর দিয়ে শেভ করি।"
    ডাক্তার সাহেব খুবই অবাক হলেন। এই ওয়ান টাইম রেজরের যুগে কেউ যে ক্ষুর দিয়ে শেভ করে তা তিনি ভাবতে পারছেন না। তার চেহারায় অবশ্য অবাক হবার কোন লক্ষন দেখা গেলোনা। অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো তার মুখ এখন নির্বিকার। মুখের হাসি উধাও। রোগীর ব্যাপারটা তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন।
    "রহমান সাহেব, এখন বাজারে কত চম্‌ৎকার সব রেজর পাওয়া যায়। আপনি কেন ক্ষুর ব্যবহার করেন?"
    " আমার দাড়ির গোড়া খুবই শক্ত। ক্ষুর ছাড়া কাটা যায়না। এই হচ্ছে কারন।"
    " আচ্ছা। যাই হোক, বেশ খানিকটা রক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে আপনার। এইজন্যে আপনার শরীর বেশ দূর্বল। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আপনাকে রক্ত দেবার ব্যবস্থা করা হবে। আপনার ঘুম কেমন হয়? "
    " গত কয়েকদিন ঠিকমতো ঘুম হচ্ছেনা। এমনিতে ঘুম ভালৈ হতো।"
    " হুমম, চোখের নিচে কালি দেখা যাচ্ছে। অবশ্য ঘুম না হলেই যে চোখের নিচে কালি পড়বে তেমন কোন কথা নেই। আপনাকে হালকা মাত্রার একটা সিডেটিভ দেয়া হয়েছে। আশা করি তাতে আপনার ঘুমটা ভালো হবে। বাকী যেসব ঔষধপত্র দেয়া হয়েছে সেগুলো নিয়মিত খাবেন। আরেকদিন এখানে থাকুন। আপনার দূর্বলতাটা একটু কাটুক। আপনার অবস্থাটা একটু দেখতে চাচ্ছি।"
    রহমান সাহেব চুপ করে রইলেন।
    ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। পেছনে গম্ভীরমুখো তিনজন। কেবিনে ঢুকলো কুমকুম।
    " এখন কেমন আছো?"
    " ভালো।"
    " তোমার কি হয়েছে বলতো?"
    " কি আবার হবে? কিছু হয়নি।"
    " গত কয়েকদিন তুমি খুব অস্থির হয়ে আছো। কি হয়েছে?"
    " কি হবে? আরে ঐ যে অফিসের সমস্যা। রকিব-আনিকা কেমন আছে?"
    " ভালো। ওদের হাসপাতালে আসতে বারন করেছি। হাসপাতাল জায়গাটা আমার পছন্দ না। আনিকা তোমার জন্য ছবি এঁকে পাঠিয়েছে। "
    "কোথায়? দেখি তো।"
    কুমকুম ব্যাগ থেকে ছবি বের করে দিলো। দুটো ছবি। একটাতে বাবা-মা আর দুই ভাই বোন। সবাই হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। ছবির নীচে লেখা , আমার আব্বু-আম্মু আর ভাইয়া। ছবিটা হাতে নিয়ে রহমান সাহেবের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। বাচ্চাগুলোকে ঠিকমতো সময় দেয়া হচ্ছেনা। নাহ এখন থেকে সময় দিতে হবে। বাচ্চাদের জীবনে বাবার একটা বিশাল ভূমিকা আছে।
    দ্বিতীয় ছবিটা নিয়ে রহমান সাহেব চমকে উঠলেন। কুচকুচে কালো একটা কাকের ছবি। কাকের ঠোঁট লাল। বোধহয় কাকটাকে লিপষ্টিক পড়ানোর চেষ্টা করেছে আনিকা। কাকের গলায় সাদা পুঁতির মালা দেখা যাচ্ছে। ছবির নিচে লেখা, "আমার নাম কাক। আমার অনেক বুদ্ধি।"
    রহমান সাহেবের হাত-পায়ে কেমন যেন কাঁপুনি শুরু হলো।
    "কাকের ছবি কেন কুমকুম?"
    "বাচ্চাদের খেয়ালের কি ঠিক আছে? যখন যা ইচ্ছে তাই আঁকে। একি? তোমার শরীর তো কাঁপছে। ঘামাচ্ছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে?"
    কুমকুম উত্তরের অপেক্ষা না করেই ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে গেলো। রহমান সাহেব কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে পড়লেন। তার দম বন্ধ লাগছে। চারপাশে মনে হচ্ছে বাতাসের প্রচন্ড অভাব। এতো আলো আসছে কোথা থেকে? রহমান সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকালেন।
    জানালায় একটা কাক বসে আছে। স্থির। গলায় সাদা ফুটকি।
    "কি স্যার? কেমন আছেন?"
    রহমান সাহেব অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

    ২১

    সে রাতে রহমান সাহেবের খুব জ্বর এলো। জ্বরের জন্য ডাক্তার এলো কয়েক বার। ঔষধ দেয়া হলো। জ্বর নামতেই চাইছেনা। জ্বরের ভেতর রহমান সাহেব মোটামুটি ঘোরের মাঝে চলে গেলেন। একসময় প্রলাপ বকা শুরু হলো। প্রলাপের প্রতিটি শব্দ পরিস্কার বোঝা যায়। কুমকুম সারারাত জেগে রইলো। প্রলাপের কথাবার্তা শুনে কুমকুম রীতিমতো ধাক্কা খেলো। বেশীর ভাগ কথাই কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে। মাঝে বেশ কিছু গালিগালাজ ও আছে। গালি গুলো কোন এক কাককে উদ্দেশ্য করে। একি অবস্থা ? কাককে রহমান কেন গালি দেবে?
    ভোরের দিকে রহমান সাহেবের জ্বর পড়ে গেলো। কুমকুমের সারা শরীর ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। আবার প্রচন্ড দু:শ্চিন্তায় তার চিন্তা ভাবনা হয়ে যাচ্ছে এলোমেলো। তার মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভবহ সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা কোথায়? ভাবতে ভাবতে একসময় বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো কুমকুম।
    সকালে স্বাভাবিক হলেন রহমান সাহেব। আটটার দিকে ঘুম ভাঙ্গলো কুমকুমের। ধড়মড় করে উঠে বসলো সে। রহমান সাহেব বিছানায় বসে আছেন। তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো কুমকুম। চোখ লাল। চোখ এতো লাল হবে কেন? চোখের তারা কেমন যেন ঝকঝক করছে। ভাবলেশহীন মুখে তিনি বসে আছেন। শরীর স্থির। কুমকুমের নড়াচড়া তার চোখে পড়ছেনা। এক দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন জানালার দিকে। জানালার গ্রীলে একটা কাক বসে আছে। কুমকুম উঠে গিয়ে কাক তাড়ালো। তারপর সে আটকে দিলো জানালা।
    "এখন কেমন আছো?"
    রহমান সাহেব কেমন এক ঘোরে ছিলেন। ঘোর কেটে গেলো কুমকুমের কথায়।
    "ভালো আছি। আমি বাসায় যাবো।"
    "ডাক্তার না বলা পর্যন্ত বাসায় যাওয়া যাবেনা। তোমাকে সম্ভবত আরো দুয়েক দিন এখানে থাকতে হবে।"
    "আমি এখানে থাকবোনা।"
    "তোমার ইচ্ছের উপর কিছু নির্ভর করছেনা। ডাক্তার যেদিন বলবে, সেদিন যাবে। ব্যাস কথা শেষ। "
    "আমি যাবো।"
    বলেই রহমান সাহেব বিছানা থেকে নামলেন। হাঁটা শুরু করলেন অনেকটা অপ্রকৃতিস্থের মতো। টলতে টলতে এগুচ্ছেন। হাঁটতে তার একটু কষ্টই হচ্ছে।
    কুমকুম বুঝলো এই লোককে কিছুতেই আটকানো যাবেনা। এখানে রাখাও যাবেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চলে এলো রহমান সাহেবের পাশে। মানুষটা যেকোন সময় হুড়মুড়িয়ে পড়ে যেতে পারে। পড়তে দেয়া যাবেনা।

    ২২

    বাসায় গিয়ে রহমান সাহেব মড়ার মতো ঘুমালেন। সেই ঘুম ভাঙ্গলো রাত আটটায়। তখন তার কুমকুমের সাথে কথাবার্তা হলো।
    "কুমকুম, কাক তোমার কেমন লাগে?"
    "কেমন আবার লাগবে? কখনো ভেবে দেখিনি তো। সারাদিন ময়লা ঘাঁটার একটা পাখি। এইতো।"
    "কাক খুবই বুদ্ধিমান একটা পাখী। এরা ময়লা খায় আমাদের বাঁচানোর জন্য। ওরা কিন্তু ফল-পাকুড় ও খায়। তবে বেশী খায় ময়লা। কারনটা হচ্ছে মানুষ জতো বাড়ছে ময়লাও ততো বাড়ছে। এই ময়লা দিয়া মানুষ কি করবে? এই যন্ত্রনার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতেই অরা ময়লা খায়।"
    "আগে মানুষ কম ছিলো, গাছপালা বেশী ছিলো। কাকেরা তখন ফলপাকুড় পেতো। এখন মানুষ বেড়েছে, গাছ কমেছে, ফলপাকুড় পায়না। তাই ওরা ময়লা খায়। ওদের কাজই এখন ময়লা খাওয়া। তাই খেয়ে ওরা বেঁচে আছে। এখানে মানুষকে বাঁচানোর প্রশ্ন আসছে কেন? "
    "ওদের কাজ ময়লা খাওয়া না। ওরা মানুষকে বাঁচানোর জন্য কাজটা করে। ওদের সবার প্রতি ভালোবাসা আছে।"
    "এসব কথা তোমাকে কে বলেছে? তুমি নিজে চিন্তা করে বের করেছো?"
    "কে আবার? কাক বলেছে।"
    একটা ধাক্কা খেলো কুমকুম। কাক বলেছে? এই কথার কী অর্থ ? কাক কথা বলবে কেমন করে?
    "তোমাকে কাক বলেছে এই কথা?"
    "হ্যাঁ। কেন? কাক কি কথা বলতে পারেনা? পারে, পারে। তবে ওরা সবার সাথে কথা বলেনা।"
    "তোমার সাথে কথা বলে?"
    "হ্যাঁ, বলে।"
    "আর কি বলেছে তোমাকে?"
    "ওদের জ্ঞান মানুষের জ্ঞানের চাইতে অনেক বেশী। মানুষের চেতনা হচ্ছে আলাদা আলাদা। একজনের চেতনা আরেকজনের চেতনার সাথে যুক্ত করা যায়না। কিন্তু ওদের তা না। ওদের চেতনা আলাদা হলেও সেই চেতনা একজনেরটা আরেকজনের সাথে জুড়ে দেয়া যায়। চাইলেই ওরা কাজটা করতে পারে। সেই যুক্ত চেতনার ক্ষমতা অনেক। তা দিয়ে ওরা সহজেই মানুষের চেতনার উপর দখল নিতে পারে। মানুষের চেতনা খুবই দূর্বল। হিংসা, ঈর্ষা, ক্রোধ এসব থাকার কারনে মানুষের চেতনা দূর্বল। দূর্বল চেতনা ছিন্নভিন্ন করে দেয়া ওদের জন্য কোন ব্যাপারই না। নেহায়েৎ করুণা করে ওরা কাজটা করেনা। তবে মানুষের বোকামী দেখে ওরা কিন্তু ঠিকই হাসাহাসি করে।"
    "তোমাকে এইসব কথা কাক বলেছে ?"
    "হ্যাঁ। আরে আমার অফিসের ফাইলের ঝামেলাটা তো ওরাই সমাধান করেছে।"
    "তোমার সমস্যার সমাধানও কাক করে দিয়েছে?"
    "হ্যাঁ। আর আমি কি করেছি জানো? ওদের একজনকে মেরে ফেলেছি। আমার জন্য আএই কাকটার পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন আমার শাস্তি হবে। ভয়ঙ্কর শাস্তি। যে কাকটাকে মেরেছি তার শরীরটা খেয়েছে রন্টি-মন্টি। দেখলে তো ওদের অবস্থা। হঠাৎ করেই কুকুর দুটো মরে গেল। স্বাস্থ্যবান দুটো কুকুর। ওদের কি এভাবে মরার কথা? কথানা। শাস্তি দিচ্ছে ওরা। যদি চায় তাহলে ওরা তোমাকেও মেরে ফেলতে পারে। "
    "তোমাকে ওরা কি শাস্তি দেবে?"
    "সেটাতো আমাকে ওরা বলেনি। সত্যি বলেনি।"
    "তুমি যে অবাস্তব ধরনের সব কথাবার্তা বলছো, তা কি তুমি বুঝতে পারছো?"
    "অবাস্তব কথা না। ওরা প্রায়ই আমার চেতনা দখল করে ফেলে। নানা রকম কথা বলে। স্বপ্নে দেখি। ওদের এক প্রতিনিধি এখন আমার অফিসেও আছে। উনি আবার আমার বস। নাম জিমি ক্রো। তারপরেও তোমার বিশ্বাস হচ্ছেনা? "
    "তোমাকে কি শাস্তি দেয়া হবে তা তুমি জানোনা? ওরা বলেনি?"
    "না বলেনি। শুধু বলেছে কঠিন শাস্তি।"
    "তুমি এমন করছো কেন? আমার খুব ভয় লাগছে।"
    "কুমকুম, আমি কি করছি? সত্যি কথা বলেছি। সত্য কথা বলা কি কেমন করা হলো? সত্য কথা বলা কি অন্যায়?"
    "নাহ, অন্যায় না। "
    দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুমকুম উঠে গেলো। কি যন্ত্রনায় পড়া গেলো! সুস্থ , স্বাভাবিক একজন মানুষ এগুলো কি বলছে? কথাগুলো কি সুস্থ্য মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব? সম্ভব না। এই সমস্যা সামাল দিতে হবে। সামলে নিতে হবে ঠান্ডা মাথায়। কুমকুম ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করছে। যদিও কাজটা খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। রহমান সাহেব কে কি কোন সাইকিয়াট্রিষ্ট এর কাছে নেয়া যায়? সমস্যাটা মনে হচ্ছে শরীরের না। মাথার।
    রাত এগারোটার দিকে একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের ফোন নাম্বার পাওয়া গেলো। ঠিকানাও পাওয়া গেলো। ডাক্তারের নাম প্রফেসর নিশিত কান্তি দে।
    নামটা কিরকম যেন! নিশিত শব্দের অর্থ কি? নিশীথ মানে রাত। নিশিত মানেও কি ঐরকম কিছু? এতো রাতে ভদ্রলোককে ফোন দেয়াটা কি ঠিক হবে? রহমান কি আসলেই মানসিক রোগী? কে জানে!
    দ্বিধায় পড়ে গেলো কুমকুম। দ্বিধা নিয়েই সে ঢুকলো বেডরুমে। দেখা গেলো, রহমান সাহেব শিশুদের মতো হাত-পা কুঁকড়ে ঘুম। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন। মুখ থেকে বিড়বিড় শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। লোকটা ভাত খায়নি। খাবার জন্য ডাকাটা কি ঠিক হবে? নাহ, ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। ভাত খেয়ে কুমকুম, রহমান সাহেবের পাশেই শুয়ে পড়লো। সামনে কেমন দিন কে জানে! অজানা আশঙ্কায় মাঝে মাঝে তার বুক কাঁপছে। একসময় ঘুম নেমে এলো চোখে।
    সে রাতে কিছুই হলোনা। রহমান সাহেব শান্তিমতো ঘুমালেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কুমকুম দেখলো রহমান সাহেব তখনো ঘুমিয়ে। রহমান সাহেবের মুখের দিকে তাকালো কুমকুম। চুলগুলো চোখের উপর এসে পড়েছে। সে রহমান সাহেবের চুলগুলো চোখের উপর থেকে সরিয়ে দিলো। আহারে বেচারা! ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। কুমকুম জানালার পর্দা সরিয়ে হাঁটতে গেলো । হাঁটা শেষ করে , বাচ্চাদের নাস্তা খাইয়ে একবার বেডরুমে ঘুরে গেলো সে। রহমান সাহেব তখনো ঘুমিয়ে।
    সকাল নয়টার দিকে রহমান সাহেবের স্বপ্নে আবারো কাক দেখা দিলো। তিনি এবার দেখলেন একটা ডাষ্টবিনের মাঝখানে তিনি কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। সারা শরীরে কাক বসে আছে। কাকতাড়ুয়া থাকে ক্ষেতে, ডাষ্টবিনের মাঝে তো থাকেনা। তিনি ডাষ্টবিনের মাঝে কাকতাড়ুয়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? শুধু দাঁড়িয়ে থাকলে একটা কথা ছিলো, তার সারা শরীরে কাক বসে আছে। সবকটার মুখে ময়লা। কয়েকটা তার উপরে বসেই ময়লা খাচ্ছে। কোনটার মুখে মুরগীর নাড়িভূড়ি, কোনটার মুখে মড়া ইঁদুর। কোনটা তার শরীরে ঠোঁট ঘষছে। একটা একেবারে তার ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছে। একটা কাক তার বুকে ঠোকর বসাচ্ছে। কাকটার গলায় সাদা ফুটকি। কি অসম্ভব দুর্গন্ধ চারপাশে। স্বপ্নের মাঝেও রহমান সাহেব প্রবল দুর্গন্ধ টের পেলেন।
    মাথা ঘোরাতেই দুটো কুকুরের শরীর দেখা গেলো। কুকুরগুলোর শরীর ঠোকড়াচ্ছে কতগুলো কাক। একসময় কুকুরের শরীরে বসে থাকা কাকগুলো উড়ে এসে বসলো তার শরীরে। আর তার শরীরে বসে থাকা কাকগুলো উড়ে গিয়ে বসলো কুকুরগুলোর শরীরে। ডিউটি বদল করার মতো তারাও ঠোকড়ানোর ডিউটি দিচ্ছে পালাক্রমে। দুর্গন্ধের পরিমান বাড়ছে। এইপর্যায়ে কুকুরদুটো মাথা উঠালো। তাদের চেহারায় কালো কালো গর্ত। চোখ উধাও। কাক ঠুকরে চোখ তুলে ফেলেছে। ফাঁকা জায়গায় কিলবিলে পোকা দেখা গেলো। সাদা সাদা পোকা। রহমান সাহেব পোকাদেরও পরিস্কার দেখতে পেলেন। তাদের সাদা গায়ে চোখটুকু কালো। সেই কালো অংশটুকু আবার ঝকঝক করছে। রহমান সাহেব অবাক হলেন। পোকাদের চোখ ঝকঝক করে নাকি?
    কুকুরদুটো মাথা তুলে বাতাস শুঁকলো। একপর্যায়ে তারা বললো, "স্যার, এতোদিন আমরা আপনার বাসা পাহারা দিলাম, এবার আমাদের জন্য কিছু একটা করুন। আমাদের বাঁচান স্যার। এরাতো আমাদের খেয়ে ফেলছে।"
    রহমান সাহেব তীব্র চেষ্টা করছেন হাত পা নাড়াতে। তিনি কুকুরদুটোর কাছে যেতে চাইছেন। তার পা ময়লায় ডুবে আছে। টেনেও পা উঠানো যাচ্ছেনা। এবার কাকেরা তার শরীর থেকে উড়ে গিয়ে কুকুরদের উপর প্রবল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো ।
    তিনি কুকুরদুটোকে বাঁচানোর জন্য উঠে আসার তীব্র চেষ্টা করছেন। তার এই প্রচেষ্টা দেখে কাকগুলো একযোগে হেসে উঠলো। কাহ...কাহ...কাহ...
    এই পর্যায়ে রহমান সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। স্বপ্নের আতঙ্ক তার মাঝে পুরোপুরি রয়ে গেছে। চোখ মেলতেই তিনি দেখলেন জানালার গ্রীলে একটা কাক বসে আছে। মুখে মড়া ইঁদুর। রুমের ভেতর ভবহ দুর্গন্ধ। কি সমস্যা, রুমে এতো দুর্গন্ধ কেন? রহমান সাহেবের মাথা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেলো।
    কিছুক্ষন পর কুমকুম রুমে ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। রহমান সাহেব বিছানার চাদর সারা শরীরে জড়িয়ে নিয়ে জ্ঞদঞ্চ এর মতো বসে আছেন। চাদরের রঙ কালো। হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে উড়ার মতো ভঙ্গি করছেন। মুখে বিশাল একটা মড়া ইঁদুর। ইদুরের রক্ত তার দাঁতে, ঠোটে লেগে আছে। কুমকুম কে দেখে রহমান সাহেব মুখের ইঁদুর খুব যত্ন করে বিছানার উপর রাখলেন। হাত দুটো পেছনে ভাঁজ করা। ইঁদুর রাখলেন বিছানায় উঁবু হয়ে। তারপর তিনি বড় বড় চোখ করে কুমকুমের দিকে তাকালেন । একসময় জোরে জোরে কা কা করে উঠলেন। ঘরের ভেতর প্রচন্ড দুর্গন্ধ। এই দুর্গন্ধে শরীর গুলিয়ে উঠে। কুমকুম দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। হড়হড় করে বমি করে বেসিন ভাসিয়ে দিলো। মনে হচ্ছে পেটের ভেতরের সব কিছু বেরিয়ে আসবে। শরীর ভেঙ্গে আসতে চাইছে। বেসিন ধরে কোনমতে নিজেকে সামলে নিলো সে। একসময় বমির বেগ কমে এলো। কুমকুম বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো ।
    "কি কুমকুম ভয় পেয়েছ ?"
    কুমকুমের মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুলোনা। তার বিস্ময় এবং বিবমিষা কোনটাই কাটেনি।
    "আমি কাক । কাককে কেন ভয় পাচ্ছো ? ভয় পাবার কিছু নেই। কা কা কা...।"
    কুমকুম দৌড় দিয়ে বেরিয়ে এলো বেডরুম থেকে। বেরিয়েই সে দরজা আটকে দিলো। এক্ষুনি নিশিত বাবুকে ফোন করতে হবে। এক্ষুনি।

    ২৩

    কুমকুম নিশিতবাবুকে ফোন করলো। একবার, দুবার, তিনবারের সময় ওপ্রান্ত থেকে ফোন উঠানোর শব্দ পাওয়া গেলো।
    "হ্যালো, স্লামালাইকুম।"
    "কাকে চাচ্ছেন?"
    ভদ্রলোকের গলা ভারী। একটা খসখসে ভাবও আছে।
    "আমি নিশিতবাবুর সাথে কথা বলতে চাইছি। তিনি কি আছেন?"
    "বলছি।"
    "আমি খুব সমস্যায় পড়ে আপনাকে ফোন করেছি।"
    "হুমম।"
    কি সমস্যা, জাতীয় প্রশ্ন করলেননা নিশিতবাবু। তার গলায় কোন আগ্রহ আছে বলেও কুমকুমের মনে হচ্ছেনা। কেমন যেন অন্যমনস্ক তার গলা।
    "সমস্যাটা আমার হাজবেন্ডকে নিয়ে।"
    "আমিতো এখন রোগী দেখা ছেড়ে দিয়েছি। রিটায়ার্ড করেছি। "
    "নিশিতবাবু, রিয়া নামে আপনার এক রোগী ছিলো। তার কাছ থেকে আপনার নাম, ঠিকানা যোগাড় করেছি।"
    "হুমম।"
    নিশিতবাবুর কথা শুনে মনে হলোনা তিনি রিয়া নামের কোন রোগীকে চিনতে পারছেন। কুমকুম তাও হাল ছাড়লোনা।
    "নিশিতবাবু, আমি আমার স্বামীকে কোন হাসপাতালে নিতে চাইছিনা। এজন্যেই আপনার সাথে যোগাযোগ করলাম। দু-তিনদিন আগেও মানুষটা সুস্থ্য ছিলো। হঠাৎ করে আজ সে বলছে সে নাকি কাক।"
    "আচ্ছা। আপনার স্বামী কবে থেকে অসুস্থ্য ?"
    কুমকুম খুবই হতাশ হলো। এই লোক ঠিকমতো কথা শুনছেনা। শুনলে এই প্রশ্ন তার করার কথা না। আর ফোন কে করেছে এই প্রশ্নটাও তিনি করেননি।
    "আমার স্বামী দু-তিনদিন আগেও সুস্থ্য ছিলো। আর নিশিতবাবু, আপনি আমার নামটাও জানতে চাননি। আপনি কি ব্যস্ত ?"
    "নাতো। ও আচ্ছা। আপনার নামটা যেন কি?"
    "নার্গিস সুলতানা।"
    "তো, মিসেস নার্গিস, আপনার স্বামী কাক হয়ে গেছে ?"
    "কাক হয়ে যায়নি। তার বক্তব্য সে কাক।"
    "আচ্ছা। মিসেস নার্গিস, মানুষ, বিশেষত পুরুষ মানুষ জীবনে নানা সময় নিজেকে নানারকম প্রাণী মনে করে। কেউ মনে করে সে সিংহ। তখন সে ঘাড় ছাপানো চুল রাখে। চেয়ারে হেলান দিয়ে পা সামনে ছড়িয়ে বসে। মাথা আস্তে আস্তে এদিক ওদিক ঘোরায়। পুরুষদের এরকম কিছু সমস্যা হয়। এটা কোন বিষয় না।"
    "পুরুষেরা নিজেকে যখন সিংহ ভাবে তখন কি হরিন ধরে ধরে খায়? খায়না। আমার স্বামী নিজেকে শুধু কাক ভাবলে আমি আপনাকে ফোন করতাম না। তার মুখে আজ মড়া ইঁদুরও দেখেছি। তাই আপনাকে ফোন দিলাম। আচ্ছা আমি রাখি। স্লামালেকুম।"
    "শুনুন শুনুন। রাখবেননা।"
    কুমকুম কিছু শুনলোনা। তার আগেই ফোন রেখে দিলো। লোকটা আচ্ছা পাগল তো। পুরুষেরা একসময় নিজেকে নাকি সিংহ ভাবে। যত্তোসব। বেডরুমে গিয়ে একবার অবস্থাটা দেখে আসলে কেমন হয় ? কি করছে ও? এখনো কি মড়া ইঁদুর মুখে? সে কি ইঁদুর খাচ্ছিলো? কুমকুমের সমস্ত শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো।

    ২৪

    নিশিত কান্তি দে, ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির একজন প্রফেসর। বেশ কিছু ডিগ্রী তার আছে। আগে নিয়মিত রোগী দেখতেন। হাসপাতাল থেকে রিটায়ার্ড করার পর আর রোগী দেখেন না। স্ত্রী পরমা পেশায় শিক্ষক। বাংলার অধ্যাপক। দুজনে মিলে টোনাটুনির সংসার। ছেলে বিলেতে পড়ছে। স্ত্রী পরমা ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন আজ বেশ কয়েকদিন । এই কয়েকদিনে নিশিত বাবুর সিগারেট খাবার মাত্রা বেড়ে গেছে। সারাদিন এবং রাতে তিনি বাড়িতেই থাকেন। ক্রমাগত সিগারেট খান। ঘুমান আর বই পড়েন। বই পড়তে পড়তে ঘুম, ঘুম থেকে উঠে আবার বই। মাঝে মাঝে সিগারেটের তৃষ্ণায় ঘুম ভাঙ্গে। রাতে একঘন্টা তিনি নিয়ম করে টিভি দেখেন। তখন ঘরের সমস্ত বাতি বন্ধ থাকে। টিভিতে শব্দ থাকেনা। আরামেই কাটছে দিন। মাঝে মাঝে অবশ্য খেতে বাইরে যান। না যেতে ইচ্ছা করলে নিজেই রান্না করে নেন।
    এখন তাকে বাড়িতে সংগ দেবার মতো মানুষ কেউ নেই। শুধু পোষা বিড়ালটা আছে। বিড়ালের নাম রাখা হয়েছে অনামিকা। নাম রাখার কাজটা করেছে পরমা। বাংলার অধ্যাপক বলেই হয়তো তার মাথায় সহজ কোন নাম আসেনি। বিড়ালের নাম হয়ে গেছে অনামিকা। তাতে অবশ্য বিড়ালের কোন সমস্যা হয়নি। সে ডাক বোঝে এবং সবসময় আশেপাশেই থাকে। আপাতত সে নিশিতবাবুর গায়ে গায়ে লেগে থেকে সময় পার করে।
    আজ যখন ফোন এলো তখন নিশিতবাবুর বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। তার হাতে তখন টেনিদা সমগ্র। কি অসাধারন লেখা! নারায়ন বাবুর হিউমার সেন্সটাও অসাধারন। ফোন উঠাতেই শোনা গেলো রোগীর কথা। এখন ছাত্ররা ডাকলে তিনি রোগী দেখতে যান। ছাত্রদেরও বলা আছে যে খুব বিচিত্র কোন কেইস না হলে তাকে ডাকা যাবেনা। মানুষের মনের বিচিত্রতা তার খুবই পছন্দের বিষয়। বিচিত্র অংশটুকু ছকের মাঝে ফেলে দেয়া আনন্দের বিষয়। শেষ বয়সে এসে এই আনন্দটুকু তিনি পেতে চান।
    ফোন পাবার পর থেকে তিনি বইতে মন বসাতে পারছেন না। কেমন যেন অস্থির লাগছে। ভদ্রমহিলা বোধহয় খুব রেগে গেছেন। হঠাৎ করেই ফোন রেখে দিয়েছেন। ঠিকানাটাও জানা হয়নি। অবশ্য ফোন নাম্বার থেকেও ভদ্রমহিলার ঠিকানা বের করে ফেলা যাবে। সমস্যা হবেনা।
    পরবর্তী এক ঘন্টা নিশিতবাবু কুমকুমের ঠিকানা যোগাড় করতে ব্যস্ত রইলেন। একটা মানুষ নিজেকে কাক ভাবছে। মড়া ইদুর খাচ্ছে, বিষয়টা দেখা দরকার। মাঝখান থেকে নিশিতবাবুর টেনিদা পড়া মাথায় উঠলো।



    ২৫

    বিকেল চারটার দিকে নিশিতবাবু কুমকুমদের বাড়ি খুঁজে পেলেন। এর আগে এদিক ওদিক দীর্ঘ সময় হাঁটতে হয়েছে। লোকজন উলটাপালটা দিক দেখিয়ে দিয়েছে। মাথার উপর তীব্র রোদ নিয়ে তিনি হাঁটাহাটি করেছেন।
    বাড়ির গেইটে তার পরিচয় দিতে হলো। সোবহান বাড়ির ভেতরে গিয়ে অনুমতি পাবার পর দরজা খুলেছে।
    কুমকুমদের বসার ঘর বেশ সাজানো। ঘরের ভেতর প্রকৃতির একটা অংশ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। জানালার পাশে চম্‌ৎকার দুটো বনসাই রাখা। সোফাসেট গাছের ডাল দিয়ে বানানো। কি গাছের ডাল এতো শক্ত হতে পারে তা নিশিতবাবু বুঝতে পারলেন না। সোফার পাশে মানিপ্ল্যান্ট জাতীয় গাছ লাগানো। রুমের উপরে ফলস সিলিং লাগানো। সিলিং এ নির্দিষ্ট দুরত্ব পরপর বাতি লাগানো। এ ধরনের জিনিষ দোকানে দেখা যায়। তবে এই রুমটাতেও দেখতে খারাপ লাগছেনা। দেয়ালে দুটো ওয়াটারকালার ঝুলছে। পেইণ্টিং এর বিষয়বস্তু বৃষ্টি। একপাশে ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ।
    নিশিতবাবু সোফায় বসে পুরো রুমটাতে চোখ বুলিয়ে ফেললেন। পায়ের নিচে কার্পেট। তার উপরে পাটি বিছানো। একটু পরেই কুমকুম এসে ড্রইং রুমে ঢুকলো।
    "আপনি নিশ্চয়ই মিসেস নার্গিস ?"
    "জ্বী। আপনি বসুন। দাঁড়াতে হবেনা। এতো ঘেমেছেন কিকরে? "
    "অনেকক্ষন হাঁটতে হলো। বাড়ি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কয়েকজনকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলাম। একেকজন একেকদিকে দেখিয়ে দেয়। খুব খারাপ অবস্থা।"
    "ঠিকানা পেলেন কোথায়?"
    "আপনি রিয়া নামের এক রোগীর কথা বলেছিলেন। আমার দেখা রোগীর সমস্ত তথ্য আমার কাছে লেখা আছে। অনেক গুলো ডায়েরী। তাতে রিয়া নামের রোগী আগে খুঁজে বের করলাম। চারজন রিয়া পাওয়া গেলো। তাদের সবার কন্টাক্ট নাম্বারে ফোন করলাম। একজনকে পাওয়া গেলো যার বান্ধবী হচ্ছে কুমকুম। তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি। তারপর আপনার ফোন নাম্বার থেকে টিএন্ডটি তে খবর নিলাম। প্রথমে তো ওরা ঠিকানা বলতেই চায়না। পরে ম্যানেজ করে ফেলেছি। রিয়ার দেয়া ঠিকানা আর টিএন্ডটি থেকে পাওয়া ঠিকানা মিলিয়ে দেখলাম। একই ঠিকানা। তারপর চলে এলাম।"
    "আপনার ফোনে কলার আইডি ওঠেনা?"
    "হ্যাঁ, উঠে। কেন?"
    "ঐ নাম্বারে কলব্যাক করলেই তো আমাকে পেতেন। এতো যন্ত্রনা করে ঠিকানা যোগাড় করতে হতোনা।"
    "তাইতো ! কথাটা আমার মাথাতেই আসেনি। আমাকে এক গ্লাস জল দিতে পারেন? হাঁটতে হাঁটতে জান শেষ। "
    "আনছি। আপনি আরাম করে বসুন।"
    পানির সাথে কুমকুম নাস্তাও নিয়ে এলো। বুড়ো মতন একটা মানুষ রোদে ঘেমে একসা হয়ে এসেছে। তাকে কি শুধু পানি দেয়া যায়?
    নিশিতবাবু খাবার খেলেন খুব যত্ন করে। বোঝা যাচ্ছে তার খুব খিদে পেয়েছিলো। খাওয়া শেষ করে তিনি বললেন,"আপনার ছেলেমেয়েরা কোথায়?"
    কুমকুম প্রথমে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর বললো, "ওদের ছোট বোনের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।"
    "হুমম। আপনার স্বামীর নাম কি?"
    "আব্দুর রহমান।"
    "কি করেন?"
    "চাকরী।"
    "এই বাড়ি আপনাদের?"
    "জ্বী। আমার শ্বশুরের কেনা বাড়ী।"
    "আচ্ছা। আচ্ছা। রহমান সাহেব এখন কোথায়?"
    "বেডরুমে। দরজা আটকে রেখেছি।"
    "চলুন দেখে আসি।"
    দুজনেই বেডরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। রহমান সাহেব বিছানার মাঝখানে পা ভাঁজ করে বসে আছেন। হাত দুটো বিচিত্রভাবে পেছনে ভাঁজ করে রাখা। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। জানালা খোলা। রুমের ভেতর বিশ্রী গন্ধ।
    রুমের গন্ধে নিশিতবাবু ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলেন। এই গন্ধের সাথে তিনি পরিচিত। মাংশ পঁচা গন্ধ। রুমের ভেতর মাংশ পঁচা গন্ধ কেন? যে বাড়ির ড্রইংরুম এতো গোছানো, সেই বাড়ির বেডরুমে এইরকম গন্ধ থাকার যুক্তিসংগত কোন কারন নেই। কুমকুম শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক চাপা দিয়েছে। নিশিতবাবু শান্তভাবে ধাক্কাটা সামলে নিলেন। রুমের চারদিকে একবার চোখ বোলালেন। জানালার প্রতিটি পাল্লা খোলা। মেঝেতে কালো একটা কাপড় পড়ে আছে। বিছানার ম্যাট্রেস দেখা যাচ্ছে। এই কাপড় খুব সম্ভবত বিছানার কভার। মেঝেতে বেশ কয়েকটা পালক পড়ে আছে। পালকের পাশে বেশ কয়েক ফোঁটা রক্ত। শুকিয়ে কালচে মেরে গেছে। রহমান সাহেবের মুখের চারপাশেও রক্ত শুকিয়ে আছে। রক্ত কি তার ব্যান্ডেজ থেকে এসেছে? তার মুখে ব্যান্ডেজও আছে। ব্যান্ডেজটা কিসের? ব্যান্ডেজ লাল হয়ে আছে। মেঝের রক্ত কি ব্যান্ডেজ থেকে এসেছে? ভদ্রলোক জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন।
    রহমান সাহেব নিশিতবাবুর দিকে তাকালেন। তারপর ভবহ কর্কশ গলায় বললেন, "কেমন আছেন নিশিতবাবু?"
    "ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? "
    "ভালো। এখানে কি জন্যে এসেছেন? "
    "এমনি। দেখতে এলাম আপনাকে।"
    "আমিতো আপনার পরিচিত কেউ না।"
    "পরিচিত কেউ ছিলেন না। কিন্তু এখন পরিচিত।অআপনি তো আমার নামও জানেন। "
    "জ্বী জানি। আমরা সবই জানি। আপনি ছোট বেলায় আমাদের দুজনকে পুষতেন। তখন আপনি বোধহয় ক্লাস থ্রীতে পড়েন। রাতে খাঁচাটা নিচে রেখেছিলেন কেন? নিচে না রাখলেই ওরা বেঁচে যেতো। বেজীতে খেতে পারতোনা।"
    নিশিতবাবু খুবই অবাক হলেন। এইলোক এসব জানলেন কি করে? তিনি বললেন," আমরা অর্থ কি রহমান সাহেব? আপনার সাথে কে কে আছে?"
    "আমরা মানে কাক। আমরা কাকেরা। আপনি ছোট বেলায় দুটো কাক পুষতেন। ঠিকনা?"
    "হুমম ঠিক। "
    "ঠিকমতো যত্ন করতে না পারলে পুষতে গেলেন কেন?"
    "রাতে খাঁচা ঝুলিয়ে রাখতে মনে ছিলোনা।"
    "যাদের আকাশে উড়ে বেড়ানোর কথা তাদের আপনি খাঁচায় আটকে রাখলেন। এটা হলো একটা অন্যায়। তারপর আপনার মনে না থাকায় ওরা মারা গেলো, এটা আরেকটা অন্যায়। আপনার শাস্তি হওয়া উচিৎ ছিলো।"
    "কিসের শাস্তি?"
    "অন্যায়ের শাস্তি।"
    "বেজীরা কাক খেলো আর শাস্তি পাবো আমি?"
    "দোষ করেছেন আপনি। বেজীতো তার খাবার পেয়েছে, তাই খেয়েছে। তাদের কোন দোষ নেই। প্রাণীজগতে খাদ্যশৃঙ্খল বলে একটা বিষয় আছে। নিয়মটা প্রকৃতির তৈরি করা। সে নিয়ম আমরা সবাই মেনে চলি। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে এই নিয়মের বাইরে পা দেয়। কারন তাকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। মানুষ সেই ক্ষমতা ব্যবহার না করে করছে অপব্যবহার। আপনিও করেছেন। তাই আপনার শাস্তি হওয়া উচিৎ ছিলো। বাচ্চা ছেলে বলে শাস্তি দেয়া হয়নি।"
    "আচ্ছা। আচ্ছা।"
    "আপনি এখানে আমার চিকিৎসা করতে এসেছেন। তাইনা ?"
    "নাতো। কুমকুম আমার মেয়ের মতো। ওর সাথে দেখা করতে এলাম।"
    "নিশিতবাবু, কেন অযথা মিথ্যা বলেন? মিথ্যা বলা ঠিকনা। মানুষের এই এক সমস্যা। এরা অকারনে মিথ্যা বলে। আপনারা এতো মিথ্যা বলেন কেন?"
    "মানুষ প্রয়োজনে মিথ্যা বলে। মিথ্যা বলতে যে মেধার প্রয়োজন হয় তা অন্য কোন প্রাণীর নেই। তাই অন্য কোন প্রাণী মিথ্যা বলতে পারেনা। মানুষ পারে। "
    "ভুল বললেন নিশিতবাবু। মানুষ অযথাই মিথ্যা বলে। আপনি যানতো নিশিতবাবু। আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।"
    নিশিতবাবু চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার মাথায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা ঢুকে গেছে। পেছন পেছন কুমকুম ও বেরিয়ে এলো।
    "মিসেস নার্গিস, আপনার সাথে একটু কথা বলা প্রয়োজন।"
    "চাচা, একটু আগে আপনি বললেন আমি আপনার মেয়ের মতো। আর এখন বলছেন মিসেস নার্গিস। কথাটা কি ঠিক হলো? আপনি আমাকে কুমকুম বলে ডাকবেন এবং অবশ্যই তুমি করে বলবেন। আমি আপনাকে চাচা বলেই ডাকবো। "
    নিশিতবাবুর মুখে হালকা হাসির রেখা দেখা গেলো। এই মেয়েটা এতো আবেগপ্রবন কেন? নাকি স্বামীর এই অসুস্থ্যতা তাকে এইরকম আবেগপ্রবন করে তুলেছে? তিনি বললেন, "আচ্ছা, ঠিক আছে।"
    "আপনি কি বলবেন চাচা? আচ্ছা আপনি দুপুরে খেয়েছেন? বাসায় অবশ্য রান্নাই করা হয়নি। এই অবস্থায় কি রান্না করা যায়? আমার মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে আছে চাচা। আচ্ছা ও সুস্থ্য হবেতো?"
    "দেখা যাক কি হয়। দুশ্চিন্তা করোনা। মাথাটা ঠান্ডা করো, তারপর আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও। "

    ২৬

    "আমি আসবো, তা কি তোমার স্বামী জানতো?"
    "নাতো চাচা। এ বিষয়ে ওর সাথে আমার কোন কথাই হয়নি।"
    নিশিতবাবুর দুই ভ্রু কুঁচকে গেলো। তার ফর্সা মুখে রক্ত জমছে। তিনি প্রথমে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। এরপর সামনে ঝুঁকে এলেন। কেমন যেন অস্থির লাগছে। অস্থির লাগছে কেন? খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে? চোখের সামনে যে জিনিষ থাকে সেই জিনিষটাই সহজে চোখে পড়েনা। এখানেও কি তাই হচ্ছে?
    "তোমাদের টেলিফোন ড্রইং রুমে। এর এক্সটেনশন কি বেডরুমেও আছে?"
    "জ্বী চাচা আছে। "
    "তুমি আমাকে ফোন কোন ফোন থেকে করেছো? ড্রইং রুমেরটা থেকে নাকি বেডরুমেরটার থেকে?"
    "ড্রইংরুম থেকে করেছি।"
    "তখন রহমান সাহেব কোথায় ছিলেন?"
    "বেডরুমে।"
    "হুমম। আমার নাম কি তোমার স্বামী আগে থেকে জানতো?"
    "জানার তো কথা না চাচা। আমি ওকে আপনার বিষয়ে কিছুই বলিনি।"
    "তুমি যখন ফোনে কথা বলেছো তখন কি বেডরুমের ফোন তোলা হয়েছিলো? টের পেয়েছো কিছু?"
    "আমার মাথা তখন এলোমেলো হয়ে ছিলো। তুললেও টের পাইনি।"
    "রহমান সাহেবের গালে একটা ব্যান্ডেজ। কিসের জন্যে বলতো?"
    "শেইভ করতে গিয়ে গাল কেটেছে। সেলাই দিতে হয়েছে। এজন্যই ওকে ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে বেরুবার সময় সে কি অবস্থা! খোদা!"
    "কি অবস্থা? খুলে বলো।"
    কুমকুম পুরো ঘটনা খুলে বললো।
    "স্রেফ কাকের বিষ্ঠা নিয়ে এতো হুলস্থুল?"
    "জ্বী চাচা। কিন্তু বিষয় হচ্ছে আমাদের ড্রাইভার কিংবা আমি, কেউই গাড়িতে কোন কাকের বিষ্ঠা দেখিনি। ছিলোনা।"
    "হুমম। কাক নিয়ে তোমার সাথে রহমান সাহেবের কোন কথা হয়েছে?"
    "হয়েছে।"
    "বলতো শুনি।"
    পুরো ঘটনা এবং কথোপকথন কুমকুম সময় নিয়ে বর্ননা করলো। নিশিতবাবু যথারীতি চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কোন প্রশ্ন বা মন্তব্য করলেন না। সব শুনে তিনি সম্পুর্ন আলাদা একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলেন।
    "তোমার স্বামীর বাম হাতের কব্জিতে একটা কাটা দাগ। দাগটা বেশ গাঢ়। দাগটা কিভাবে হয়েছে?"
    "কেটে গিয়েছিলো।"
    "আচ্ছা তোমার স্বামীর পুরো নাম আব্দুর রহমান, তাইতো? "
    "জ্বী।"
    "তিনি আগে কখনো দীর্ঘদিন কোন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন?"
    "কোন সাইকিয়াট্রির ডাক্তারের কাছে যাননি। তবে ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন।"
    "সেই কাগজগুলো দেখানো যাবে?"
    "কাল দেখাই চাচা? সব কাগজ বেড রুমে। রুমটাতে ঢুকতে আমার ভয় লাগছে। আম্মাকে ফোন করে আসতে বলবো। বাড়িতে আমার খুব ভয় লাগছে চাচা। "
    "ভয় লাগাটা স্বাভাবিক। আচ্ছা আমি কাল আবার আসবো। বিকেলের দিকে আসার সম্ভাবনাই বেশি। কালকে দেখি রহমান সাহেবের সাথে কথা বলে। তখনই সিদ্ধান্তে আসা যাবে যে ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে কিনা।"
    "চাচা, আমি ওকে হাসপাতালে নিতে চাইছিনা। বোঝেনই তো, মানুষের মুখ।"
    "আচ্ছা দেখা যাক, কতদূর কি হয়।"

    ২৭

    বাড়িতে ফিরে নিশিতবাবু একটা নতুন কেইস ফাইল ওপেন করলেন। কাজটা তিনি করছেন দীর্ঘদিন পর। ফাইলে তিনি যা লিখলেন তা হলো:
    নাম: আব্দুর রহমান
    পেশা: চাকুরী (বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, পেশাগত দিক থেকে তিনি একজন সফল মানুষ)
    শারিরিক গঠন: স্বাস্থ্যবান
    বয়স: ৪৫(আনুমানিক)
    অর্থনৈতিক অবস্থান: উচ্চবিত্ত
    বৈবাহিক অবস্থা: বিবাহিত
    সমস্যা (স্ত্রীর ভাষ্যনুযায়ী)
    আব্দুর রহমান সাহেবের ধারনা তিনি পাপের শাস্তি পাচ্ছেন। পাপ হচ্ছে তিনি একটি কাক মেরেছেন। সেই কাকের মৃত্যুর কারনে তার পরিবার নিশ্চিনহ হয়ে গেছে(?)। তাই তার শাস্তি হচ্ছে। শাস্তিদাতা কাক। শাস্তিদাতা একটি কাক নয় পুরো কাকগোষ্ঠী।
    রহমান সাহেবের বক্তব্য হচ্ছে প্রতিটি কাকের স্বতন্ত্র চেতনা আছে। সেই চেতনা তারা প্রয়োজনে একজন আরেকজনের সাথে যুক্ত করে দিতে পারে। সংযুক্ত চেতনার ক্ষমতা অসাধারন। কাকসংখ্যা যত বেশী হবে চেতনার শক্তি হবে তত বেশী। সংযুক্ত চেতনা মানুষের চেতনার উপর দখল নিতে পারে। কাকদের চেতনা এখন প্রায়ই রহমান সাহেবের চেতনা দখল করে নিচ্ছে। তবে চেতনা দখল পর্যন্তই কাকদের শাস্তি সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা তা জানেন না রহমান সাহেব।
    ঞ্ঝ কাকেরা রহমান সাহেবের সাথে কথা বলে।
    ঞ্ঝ মানুষের বোকামিতে তারা হাসাহাসি করে।
    ঞ্ঝ কাক তার অফিসের সমস্যা সমাধান করেছে।

    অতীব জরুরি
    ১. রহমান সাহেবের রুমে মাংস পঁচা গন্ধ ছিলো। কারন কি? কুমকুমের ভাষ্য মতে সে রুমে মরা ইঁদুর দেখেছে। একটা ইঁদুরে এত দুর্গন্ধ হবার কথা না। দুর্গন্ধের কারন কি?
    ২. মেঝেতে বড় বড় পালক ছিল। এই পালক কিসের? কাকের? পালক আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। কাকের পালক রহমান সাহেবের রুমে আসলো কোত্থেকে?
    ৩. রহমান সাহেব বলেছেন কুকুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী কাক। (তারা দুটো কুকুর পুষতেন। নাম রণ্টি-মণ্টি। জাত হচ্ছে অ্যালসেসিয়ান)এর কারন কি? কুকুর দুটোর ভাক্সিন দেয়া ছিল। তারপরে ও তারা কিসে মারা গেল? এদের ডেড বডি কি পাওয়া সম্ভব? বোধহয় সম্ভব না। পাওয়া গেলে পোস্টমর্টেম করানো যেত। কুকুরের ঘরটা দেখতে হবে।
    ৪. বাড়ির চারপাশে কি কাকদের অনেক বাসা আছে? খুঁজে দেখতে হবে। কুমকুম বলেছে সে নিজে কারেণ্টের তারে শতশত কাক বসে থাকতে দেখেছে। বিষয়টাতে কি অস্বাভাবিক কিছু আছে? থাকার কথা না। কাক কারেণ্টের তারে বসে থাকতেই পারে। বাড়ীর চারপাশ ঘুরে দেখতে হবে।
    ৫. শেইভ করতে গিয়ে মানুষের গাল এতোটা কাটে কি করে? সেলাই পর্যন্ত যেতে হয়েছে সেই কাটা সামলাতে। গাল কাটার কারন কি?
    ৬. রহমান সাহেব আগে ডাক্তারের চিকিৎসাধিন ছিলেন। সেই চিকি্‌ৎসা কি বিষয়ক? নার্ভ সম্পর্কিত কিছু?(অতীব জরুরি)
    ৭. বর্তমান সমস্যার আগে রহমান সাহেব অফিসের কোন একটি বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। সেই সমস্যার সমাধান কাক দিয়েছে। (?) সমাধানের রাস্তাটি কি ছিলো?
    ৮. কুমকুমকে রহমান সাহেবের অফিস সম্পর্কিত কথার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। অনীহার কারন কি?
    ৯. কুমকুম ও রহমান সাহেব, দুজনেই শ্যামলা। তাদের বাচ্চারা বেশ ফর্সা (ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ তাই বলে)। বাচ্চাদুটোর চেহারার সাথে বাবা-মায়ের চেহারার বিন্দুমাত্র মিল নেই। কারন কি? এমনটা তো হবার কথা না। এতে কি কোন রহস্য আছে, নাকি পুরো বিষয়টি প্রকৃতির খেয়াল?
    ১০. কুমকুম আমার নাম রহমান সাহেবকে বলেনি। আমার নাম রহমান সাহেব কি করে জানলেন? আমার ছেলেবেলার কাক পোষার ঘটনা তিনি কি করে জানলেন? আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এই ঘটনা জানেনা। আমি নিজেই প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। এটা কি কোন রহস্য নাকি ব্যাখ্যা আছে? ব্যাখ্যা থাকার কথা।

    ২৮

    রাত এগারোটার দিকে রহমান সাহেবের রুম থেকে ডাক এলো।
    "কুমকুম...। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ কেন? কুমকুম...এই কুমকুম।"
    কুমকুম তার মা আর ছোট ভাই এর সাথে ড্রইংরুমে বসেছিলো। সমস্যা নিয়ে তারা কথা বলছিলো। এই সমস্যায় শুধু নিশিতবাবুর উপরেই ভরসা করা ঠিক হবে কিনা, এই হচ্ছে আলোচনার বিষয়বস্তু।
    কুমকুম দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। রহমান সাহেব পুরোপুরি স্বাভাবিক।
    "কি ব্যাপার? দরজা বন্ধ কেন?"
    "আমরা কথা বলছিলাম, কথায় যেন তোমার ঘুমে কোন সমস্যা না হয়, এইজন্য দরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম।"
    "কি যে বলনা! কথায় আবার ঘুমে কি সমস্যা? যত্তোসব আজেবাজে কথা। কেমন আছেন আম্মা? কখন এলেন?"
    "এইতো বাবা আছি। ভালো আছি। তুমি কেমন?"
    "জ্বী আম্মা ভালো আছি। তো শালাবাবু, কি খবর?"
    "ভালো ভাইয়া।"
    কুমকুম দূরে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনলো। একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিজের অজান্তেই। কে বলবে এই মানুষটি দুপুরেই কি অদ্ভুত কাজ কারবার করেছে? রাতের খাবার সবাই একসাথেই খেলো। খাবারের আয়োজন খুবই সামান্য। কুমকুম রান্না করার সময় পায়নি। এই মুহুর্তে রহমান সাহেবের আচরনে কোন অস্বাভাবিকতা নেই। রাতেও তিনি ঘুমুতে গেলেন স্বাভাবিক মানুষের মতৈ। রাতে কুমকুমের মা থেকে গেলেন। কুমকুম মায়ের সাথে ঘুমুতে গেলো। আজকের রাতটা মায়ের সাথে ঘুমুতে ইচ্ছে করছে নাকি তার ভয় লাগছে তা অবশ্য বোঝা গেলোনা।

    রাতে রহমান সাহেবের স্বপ্নে আবারো কাক দেখা দিলো।
    "কেমন আছেন রহমান সাহেব?"
    "কেমন আছি, বুঝতে পারছিনা।"
    "আপনার যে শাস্তি চলছে, তা আপনি বুঝতে পারছেন?"
    "আচ্ছা আমাকে কেন আপনারা শাস্তি দিচ্ছেন? শাস্তি পাবার মতো ভবহ কিছুতো আমি করিনি।"
    "করেছেন, অবশ্যই করেছেন। আপনার শাস্তি আরো বাকি আছে। সবে তো শুরু। এতো অস্থির হচ্ছেন কেন?"
    "আপনারা অযথা শাস্তি দেবেন আর আমি অস্থির হবোনা?"
    "না হবেন না। আপনার প্রাপ্য শাস্তি আপনি পাচ্ছেন অস্থিরতার কি আছে?"
    "এরপর আর কি শাস্তি দেবেন?"
    "আবারো অস্থির হচ্ছেন। সে যাকগে, সময় হলেই দেখবেন কি শাস্তি দেয়া হবে। সময় হোক। আপনার আসল সমস্যা কোথায় জানেন রহমান সাহেব?"
    জ্ঞনা জানিনা। বলে কৃতার্থ করুন।"
    "সমস্যা আপনার দৃষ্টিভঙ্গীতে। আপনার চোখদুটো পাশাপাশি না রেখে ধরুন কপালের দুপাশে নিয়ে গেলে কেমন হয়?"
    "দৃষ্টিভঙ্গী কি চোখে থাকে? চোখ দুপাশে নিয়ে কি হবে? বিষয়টা মানসিকতার ব্যাপার, চোখের অবস্থানে না।"
    "চোখজোড়া দুপাশে নিলে হয়তো আপনার মানসিকতা বদলাতেও পারে। কে জানে! আসুন আপনার চোখগুলো দুপাশে নিয়ে যাই।"
    কাকটা এতোক্ষন রহমান সাহেবের সামনে বসা ছিলো। চোখ দুপাশে নেবার কথা বলে সে নির্বিকারভাবে জায়গা ছেড়ে উঠে এলো। রহমান সাহেব এতোক্ষনে খেয়াল করলেন তার হাত পা চেয়ারের সাথে শক্ত করে বাঁধা। অজানা আশংকায় রহমান সাহেব কেঁপে উঠলেন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন হাত-পায়ের বাঁধন ছোটাতে। পারছেন না। কাকটা এসে রহমান সাহেবের চোখের চারপাশে খোঁচাতে শুরু করলো। চোখের পুরোটা সে কোটর থেকে বের করে নেবে। রহমান সাহেব চেষ্টা করছেন বাঁধন ছিঁড়তে, কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। কাকটাও খুব মনোযোগ দিয়ে চঞ্চু দিয়ে খুঁচিয়ে চলেছে। রহমান সাহেব এখন শুধু ব্যাথা অনুভব করছেন। তার সমস্ত অনুভূতি কেন্দ্রীভুত হলো চোখের চারপাশে। ব্যাথা...এই ব্যাথা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে হিলহিলে সর্পিল গতিতে।
    ব্যাথায় রহমান সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখে অসম্ভব ব্যাথা। চিৎকার করে তিনি কুমকুমকে ডাকলেন। রাতে কুমকুমের চোখে ঘুম ছিলোনা। এক চিৎকার শুনেই সে দৌড়ে এলো বেডরুমে। বাতি জ্বালিয়ে কুমকুম হতভম্ব হয়ে গেলো । রহমান সাহেবের চেহারা রক্তে মাখামাখি। মুখের ব্যান্ডেজ জায়গা মতৈ আছে। রক্ত কি ওখান থেকে বেরিয়েছে? ভালো করে খেয়াল করে কুমকুমের বিস্ময়ের পরিমান বাড়লো। রহমান সাহেবের চোখ ফুলে ঢোল। চোখের চারপাশ থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। এখান থেকে কেন রক্ত বেরুবে? এসব কি হচ্ছে? সে রাতেই রহমান সাহেবকে আবারো ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো।

    ২৯

    রহমান সাহেবের ক্লিনিকে ভর্তি হবার খবর নিশিতবাবু পেলেন অনেক পরে। রাতে তাকে খবর দেয়া হয়নি। সারাদিন তিনি ছিলেন বাড়ির বাইরে। বিকেলে তার রহমান সাহেবের বাড়িতে যাবার কথা। সারাদিন নিশিতবাবু কাটিয়েছেন রহমান সাহেবের অফিসে। রহমান সাহেবের অফিসে ঢুকে নিশিতবাবুর কথা হলো পিয়ন সুলতানের সাথে, কালাম সাহেব এবং জহির সাহেবের সাথে।
    জহির সাহেবের সাথে যে কথাবার্তা হলো তা মোটামুটি এইরকম:
    "জহির সাহেব কেমন আছেন?"
    "জ্বী, ভালো আছি। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলামনা।"
    "আমার নাম নিশিত কান্তি দে। রহমান সাহেব..."
    "স্যার অফিসে আসেননি আজ।"
    "জানি। আমি আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।"
    "বলুন, কি বলবেন।"
    "আমার কয়েকটি প্রশ্ন ছিলো। আপনার শুধু প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিলেই চলবে।"
    "আপনি কে বলুনতো? আপনার পরিচয় কি?"
    "আমার না নিশিত কান্তি দে। আমি ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির একজন প্রফেসর এবং আপনার স্যারের শুভাকাঙ্খী। প্রশ্ন গুলোর উত্তর আমার জানা দরকার। আপনার কোন ক্ষতি হবেনা, নিশ্চয়তা দিচ্ছি।"
    "স্যার কি অসুস্থ?"
    "নাতো। তিনি সুস্থ্যই আছেন।"
    "আচ্ছা। আপনার প্রশ্ন করুন।"
    "আপনার স্যারের কি ইদানিং কোন সমস্যা হচ্ছিলো?"
    "কি ধরনের সমস্যা?"
    জ্ঞতার আচরনে কোন পরিবর্তন কিংবা সমস্যা?"
    "দেখুন, আমি স্যারের পিএ। স্যারের কাজটাজ, এপয়েন্টমেন্ট এইসব ঠিকঠাক রাখা আমার দায়িত্ব। এর বাইরে কিছু দেখ আমার দায়িত্বের এখতিয়ারে পড়েনা।"
    "তা অবশ্য ঠিক। তারপরেও আপনার স্যারের আচরনে কি পরিবর্তন খেয়াল করেছিলেন?"
    "নাহ, ঠিক খেয়াল করিনি।"
    "একটা ফাইল নিয়ে সমস্যা চলছিলো..."
    "দেখুন, এটা অফিসের ভেতরের বিষয়। এটা নিয়ে আমি কোন কথা বলতে চাচ্ছিনা।"
    "সমস্যার সমাধান কি করে হলো তা জানেন?"
    "আমি জানিনা। "
    "হুমম। ইদানিং আপনার স্যারের সাথে কাক বিষয়ে কোন কথা হয়েছে?"
    "কি বিষয়ে?"
    "কাক। এই যেমন ধরুন, কাক কি খায়, কাক কেমন ধরনের পাখি, এইসব আরকি।"
    "আপনি কি ফাজলেমি করছেন? স্যার আমার সাথে কাক নিয়ে কেন কথা বলবেন?"
    "তা ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তারপরেও একটু ভেবে দেখুন। কাক বা অন্য কোন পাখি নিয়ে কথা হয়েছে?"
    "নাহ, পাখপাখালি নিয়ে কোন কথা হয়নি। তবে স্যার মোটা মোটা ফাইলের জন্য নতুন ধরনের কিছু ইন্ডিকেটর চেয়েছিলেন। তার জন্যে আমি কাকের পালক নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যার প্রথমে রাখলেন তারপর সব ফেলে দিতে বললেন।"
    "কিসের পালক? কাকের?"
    "জ্বী, কাকের পালক।"
    "ঘটনাটা একটু বলবেন?"
    এরপর জহির সাহেব পুরো ঘটনা খুলে বললেন। নিশিতবাবু পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বললেন, "আচ্ছা ফাইলের সমস্যা কিভাবে সমাধান হলো?"
    "নিশিতবাবু, আপনি বরং এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের হেড একাউন্টেন্ট সাহেবের সাথে কথা বলুন। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবোনা। দু:খিত।"

    এরপর নিশিতবাবু হেড একাউন্টেন্ট কালাম সাহেবের সাথে কথা বলতে গেলেন।
    "আচ্ছা, কালাম সাহেব, আপনাদের অফিসে ফাইলের একটা সমস্যা হয়েছিলো। সমস্যাটা কোথায় ছিলো?"
    "এই খবর আপনাকে কে দিলো? জহির?"
    "জ্বী না। জহির সাহেব আমাকে কিছুই বলেনি।অমনে হচ্ছে ভদ্রলোক খুব ফেইথফুল ধরনের মানুষ। আপনাদের স ষ্টাফই কি ফেইথফুল এইরকম? সবাই ফেইথফুল?"
    "নিশিতবাবু, হাতের পাঁচ আঙ্গুল কি সমান? সবাই কি একইরকম হয়? হয়না।"
    "আপনাদের অফিসে হাতের সেই ছোট আঙ্গুলটি কে? আপনি কি তাকে চেনেন?"
    "চিনি। সামাদ সাহেব। তার জন্যেই যতো সমস্যা। ফাইলে ঝামেলা তিনিই পাকিয়েছিলেন।"
    "কি সমস্যা?"
    "সেটা স্যার জানেন। আপনাকে বলবোনা। সামাদ সাহেব যে এইধরনের মানুষ তা কোনদিন বুঝতেও পারিনি। এতো ভালো একটা মানুষ যে কেন এইরকম কাজ করলেন, কে জানে!"
    "কি কাজ একটু বললে ভালো হতো।"
    "দু:খিত। আমি বলতে পারবোনা।"
    "আচ্ছা কি ঘটনা বলুন তো? আপনারা কেউ মুখ খুলছেন না কেন? আমি পুলিশের লোক হলে মুখ খুলতেন না?"
    "আপনিতো পুলিশের লোক না।"
    "এজন্যেই তো আপনাদের মন খুলে কথা বলা উচিৎ। আপনাদের কোন কথাই পরে কোন ঝামেলা পাকাবেনা।"
    "নিশিতবাবু, আপনি সামাদ সাহেবের সাথে কথা বলুন। পুরো ঘটনা তার হাত দিয়ে ঘটেছে। তার কাছেই সব শুনে নেবে। অফিসের আইন আমি ভাঙ্গতে পারবোনা।"
    "সামাদ সাহেব কোথায়? কোন রুমে বসেন?"
    জ্ঞউনি পুলিশের কাছে। ফাইলের কারনে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।"
    "আচ্ছা,আচ্ছা।"

    অফিস থেকে বেরিয়ে নিশিতবাবুর মনে হলো সামাদ সাহেবের সাথে অবশ্যই কথা বলতে হবে। তার মনে হচ্ছে রহমান সাহেবের সমস্যার কিছু সূতো সামাদ সাহেবের হাতে।
    সামাদ সাহেবের সস্থে কথা বলার জন্যে নিশিতবাবুকে যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হলো। শেষমেষ সামাদ সাহেবের সাথে দেখা হলো, কথাও হলো। তাদের মধ্যে যে কথাবার্তা হলো তা মোটামুটি এরকম:
    "কেমন আছেন সামাদ সাহেব?"
    "ভালো আছি। কে আপনি?"
    "আমি নিশিত কান্তি দে। সাইকিয়াট্রিষ্ট।"
    "আমার মাথায় কোন সমস্যা নেই। এখানে এসেছেন কেন? কে পাঠিয়েছে আপনাকে? রহমান সাহেব?"
    "নাহ। রহমান সাহেব পাঠাননি। আমি নিজেই এসেছি। তবে কারনটা রহমান সাহেব সংশ্লিষ্ট।"
    "কি কারন বলুন?"
    "রহমান সাহেবের ইদানিং কিছু সমস্যা হচ্ছে।"
    "আপনাকে কুমকুম পাঠিয়েছে। ঠিক না?"
    "না, কুমকুম পাঠায়নি। আপনি রহমান সাহেবের স্ত্রীকে চেনেন?"
    সামাদ সাহেব চুপ করে রইলেন। তিনি সোজা নিশিতবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিচের ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।
    নিশিতবাবু বললেন, "রহমান সাহেবের স্ত্রীর নাম নার্গিস আক্তার। ডাক নাম কুমকুম আপনি ডাক নামটি বলেছেন। আপনার সাথে কি কুমকুমের পরিচয় আছে?"
    সামাদ সাহেব প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তার বদলে তিনি বললেন, "রহমান সাহেবের কি হয়েছে নিশিতবাবু?"
    "তার একটু মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিষয়টা নিয়ে কুমকুম খুবই চিন্তিত।"
    সামাদ সাহেব এখনো নিশিতবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখদুটো এখন জ্বলছে। তিনি বললেন, "কুমকুম কেমন আছে নিশিতবাবু?"
    "ভালো না অবশ্যই। স্বামী অসুস্থ্য থাকলে কি স্ত্রী আলাদা করে ভালো থাকে? থাকার কথা না।"
    স্লেষের গলায় সামাদ সাহেব বললেন, "রহমান সাহেব কবে সুস্থ্য ছিলেন নিশিতবাবু? কুমকুমই বা কবে ভালো ছিলো?"
    "সামাদ সাহেব, এগুলো কি বলছেন?"
    "ঠিকই বলছি। হ্যাঁ, কুমকুমকে আমি চিনি। ওর সাথে আমার একসময় একটা সম্পর্ক ছিলো।"
    এরপর সামাদ সাহেবের বক্তব্যে নিশিতবাবু ধাক্কার মতো খেলেন। তার সাথে দীর্ঘ সময় কথা হলো। কুমকুমের সাথে এখন আর আলাদা করে কথা বলার প্রয়োজন নেই। রহমান সাহেবের সমস্যা এখন নিশিতবাবুর কাছে পরিস্কার হতে শুরু করেছে। নিশিতবাবু নিজের মনেই রহমান সাহেবের সমস্যার সমাধান সাজানো শুরু করলেন। সামাদ সাহেবের সাথে কথা বলার পর তিনি গেলেন রহমান সাহেবের বাড়িতে। তার আগে তিনি বাড়ির চারপাশে রাস্তায় ঘুরলেন। তারপর ঢুকলেন বাড়িতে।
    বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে সোবহান রহমান সাহেবের খবর জানালো। তাতে নিশিতবাবু একটু অবাক। তারপরেও তিনি বাড়ির ভেতর ঘোরাঘুরি করলেন। কুকুরদের ঘরও একবার দেখতে হলো। বাড়ি ফাঁকা। কুমকুম রহমান সাহেবের সাথে ক্লিনিকে আছে। নিশিতবাবু এবার ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। একদিনে অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। শরীর ক্লান্ত লাগছে। তারপরেও ক্লিনিকে যেতে হবে। একদিনে রহমান সাহেবের কি এমন হলো যে একেবারে ক্লিনিকে ভর্তি করতে হয়েছে?
    ক্লিনিকে ঢুকতেই কুমকুমের সাথে দেখা হলো। সে ক্লিনিকের নিচে রিসেপসন থেকে কোথায় যেন ফোন করছে।
    "চাচা, আপনি সারাদিন কোথায় ছিলেন? আমি যে কতবার আপনাকে ফোন দিয়েছি, খোদা মালুম। ফোন বেজেছে ঠিকই, কেউ ধরেনা।"
    "সারাদিন বাইরে ছিলাম গো মা। বাড়িতে কেউ নেই। ফোন কে ধরবে?"
    "আপনি খবর পেলেন কোথায় চাচা?"
    "তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সোবহান খবর দিলো। রোগীর কি অবস্থা?"
    "এখন ঘুমুচ্ছে মড়ার মতো।"
    “এরপর কুমকুম নিশিতবাবুকে পুরো ঘটনা খুলে বললো।“
    সব শুনে নিশিতবাবুর ভ্রু কুঁচকে গেলো। তিনি বললেন, “চোখের বিষয়ে তোমাকে কিছু বলেছে?”
    “বলেছে চাচা। কাক নাকি ওর চোখ উঠিয়ে মাথার দুপাশে বসাতে চেয়েছে।“
    “আশ্চর্য্য তো! ওকে এখন দেখা যাবে? ক্লিনিকে এখন ভিজিটিং আওয়ার চলছে না?”
    “তা যাবে। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন ঘুম ভাঙ্গানো যাবেনা। জেগে থাকলেই খালি উলটো পালটা কথা বলে। ওকে ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছে।“
    “ঘুম ভাঙ্গাবোনা। শুধু চোখের অবস্থাটা দেখবো।“
    নিশিতবাবু দীর্ঘসময় রহমান সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখের চারপাশে কিছু একটা দিয়ে খোঁচানো হয়েছে। ছোট ছোট কাটা দাগ দেখা যাচ্ছে। দাগগুলো অর্ধচন্দ্রাকৃতির। নখের দাগ কি? রহমান সাহেবের হাতের নখ দেখলেন নিশিতবাবু। রহমান সাহেবের ডান হাতের কনিষ্ঠার নখ বড়। বাকী নখগুলো বেশ সুন্দর গোল করে কাটা। শুধু একটা নখই বড়। বেশ বড়। বঝা যাচ্ছে এই নখ বেশ আয়োজন করে রাখা। বাকী নখগুলোর চেয়ে এই নখ চকচকে। একটা নখ বড় রাখার কোন যুক্তি খুঁজে পেলেন না নিশিতবাবু। সাধারনত টেইলরদের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখ বড় রাখার অভ্যাস থাকে। এটা তাদের কাজের সময় কাজে লাগে। কিশোরেরাও মাঝে মাঝে নখ বড় রাখে। যেসব কিশোরের চরিত্রে মেয়েলি ভাব প্রবল, তাদের ক্ষেত্রে এই অভ্যাস বেশী দেখা যায়। বিহারীদের মধ্যেও এই অভ্যাস আছে। রহমান সাহেব এর কোনটার মাঝেই পড়েন না। তার এই নখ বড় রাখার অভ্যাস কেন? কারন যাই হোক, রহমান সাহেবের চোখের ঘটনার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। সবশেষে নিশিতবাবু কেবিন থেকে চুপচাপ বেরিয়ে এলেন। তিনি কুমকুমকে বললেন, “আচ্ছা কুমকুম, রহমান সাহেবের হাতের একটা নখ বড়। তুমি কি কখনো খেয়াল করেছো?”
    “জ্বি চাচা দেখেছি। ওটা দিয়ে ও নাকি স্টেপলারের পিন খোলে। কোন মানে হয় বলুনতো? পিন খোলার জন্যে কিছু না থাকলে একটা কথা ছিলো।“
    নিশিতবাবু শুধু মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন, “আজ তাহলে যাই মা। আমি কাল তোমার স্বামীর সাথে কথা বলবো। দেখি কি করা যায়।“
    “ঠিক আছে চাচা।“
    নিশিতবাবু ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এলেন। রহমান সাহেবের মতো একজন মানুষ হাতের একটি নখ আয়োজন করে রেখেছেন স্টেপলারের পিন খোলার জন্যে। মানুষের যে কত বিচিত্র খেয়াল থাকে!

    ৩০

    বাড়ি ফিরে নিশিতবাবু রহমান সাহেবের ফাইল খুলে বসলেন। যেখানে তার খটকা ছিলো সেখানে তিনি ব্যাখ্যা লেখা শুরু করলেন।
    ১। রহমান সাহেবের বাড়ির দুইদিকে বড় বড় ডাষ্টবিন আছে। একটা তার বেডরুমের জানালার উল্টোদিকের রাস্তার পাশে। সেই ডাষ্টবিন নিয়মিত পরিস্কার করা হয়না। তবে পরিস্কার করা হয়। ডাষ্টবিনের পাশে রাস্তা। রাস্তার ওপাশে একটা চায়ের দোকান আছে। চায়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গত পরশুদিন সকালে অনেকদিন পর ডাষ্টবিন পরিস্কার করা হয়েছে। খুব সম্ভবত ডাষ্টবিনের গন্ধই বাতাসে ভেসে রহমান সাহেবের বেডরুমে গেছে। বেডরুমের জানালা খোলা ছিল। (মড়া ইঁদুর এই ডাষ্টবিন থেকে আসতে পারতো। সেক্ষেত্রে রহমান সাহেবকে নিচে নামতে হতো। তা তিনি নামেননি। নামলেও মড়া ইঁদুর তার কামড়ে নিয়ে বেডরুমের ভেতর নিয়ে যাবার কোন কারন দেখিনা। )
    ২। জহির নামের ভদ্রলোক রহমান সাহেবের অফিসে কাজ করেন। তাকে রহমান সাহেব ফাইলের ইন্ডিকেটর হিসেবে নতুন ধরনের কিছু আনতে বলেছিলেন। জহির সাহেব এনেছিলেন কাকের পালক (কারন কি জানিনা। জানার খুব বেশী প্রয়োজন ও দেখছিনা।)। সেই পালক ফেলেও দেয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই দুটো পালক রহমান সাহেব নিজের অজান্তেই বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। কাজটা করেছিলো তার অবচেতন মন। সেই আনা পালকই রহমান সাহেবের রুমের ভেতর পাওয়া গেছে। কিন্তু পালকের পাশে যে রক্তের ফোঁটা পাওয়া গেছে তা কিসের? রহমান সাহেবের ব্যান্ডেজ অক্ষত ছিলো। তাহলে রক্ত কি ইঁদুরের? কুমকুমের ইঁদুর দেখার ঘটনা তাহলে কি সত্যি? সত্যি হতেও পারে। কারন বাড়ির লনে আমি প্রচুর ইঁদুরের গর্ত দেখেছি। সেখানকার ইঁদুর কি তাহলে দোতলার উপরে উঠে এসেছিলো? উঠে আসা অস্বাভাবিক কোন বিষয় না। তাহলেই ইদুর কাহিনীর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
    ৩। কুকুরের মৃত্যুর কারন খুব সম্ভবত র‌্যাবিস। র‌্যাবিস রোগটা কুকুর কিংবা শেয়ালের শরীরে আসে ইঁদুরের কামড় থেকে। রহমান সাহেবের বাড়ির লনে প্রচুর ইদুরের গর্ত দেখেছি। ইদুরের কামড়ে কুকুরদের শরীরে র‌্যাবিস হয়েছিলো। অবশ্য কুকুরদুটোকে ভ্যাক্সিন দেয়া ছিলো। তাতে কিছু যায় আসেনা। ভ্যাক্সিন এর ফেইলিউর রেট আছে। এই কুকুর গুলোতে ভ্যাক্সিন কাজ করেনি।
    ৪। বাড়ির দুপাশে ডাষ্টবিন। তাই আশেপাশে কাকের সংখ্যা বেশী হওয়া খুব স্বাভাবিক। তবে আশেপাশে গাছের সংখ্যা খুবই কম। তাই কাকের বাসা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
    ৫। রহমান সাহেব একসময় হাতের ধমনী কেটে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। তখন তিনি ব্যাবহার করেছিলেন ক্ষুর। ক্ষুরের জায়গায় সাধারন ব্লেড ব্যাবহার করলেই চলতো। ক্ষুর ব্যাবহার করে তিনি খুব সম্ভবত পুরো ঘটনাটিকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন। পরে এই ক্ষুরটি তার কাছেই থেকে যায়। যারা একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে তাদের একটা অংশ আত্মহত্যার চেষ্টায় ব্যাবহার করা জিনিষটি নিজের কাছে রেখে দেয়। পরে যদি আবারো প্রয়োজন হয়, এই ভেবে তারা রাখে। রহমান সাহেবও রেখেছেন। ক্ষুর ব্যাবহার না করলে ভোতা হয়ে যায়। তাই তিনি ক্ষুর ব্যাবহার করতেন শেইভের জন্যে। এর জন্যেই গাল বেশী কেটেছে।
    ৬। রহমান সাহেবের মেডিকেল ফাইল দেখার প্রয়োজন নেই। কারন সমস্যার বিষয় কি ছিলো তা সামাদ সাহেবের কাছ থেকেই জানা গেছে।
    ৭। ফাইল সমস্যার সমাধান করেছে রহমান সাহেবের অবচেতন মন। মানুষ যখন একটা বিষয় নিয়ে খুব বেশী ভাবে তখন তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে অবচেতন মন। অবচেতন মনের কি ক্ষমতা আছে তা আমরা এখনো জানিনা। যাই হোক কাক টাক সব ফালতু কথা।
    ৮। কুমকুমের রহমান সাহেবের অফিস সম্পর্কিত সমস্ত অনীহার মূল কারন সামাদ সাহেব।
    ৯। রহমান সাহেবের বাচ্চা দুটো দত্তক সন্তান।
    ১০। রহমান সাহেব এক্সটেনশন লাইন দিয়ে আমার নাম জেনেছেন। বিষয়টাতে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিনা।
    কিন্তু আমার ছোটবেলার ঘটনা সে কি করে জানলো? তিনি কি থট রিডিং পারেন। সাইকিক ডিজার্ডার রোগীদের কখনো কখনো ব্যাখ্যাতীত কিছু ক্ষমতা দেখা যায়। রহমান সাহেবেরও কি তাই হয়েছে?
    এরপর নিশিতবাবু দীর্ঘ এক ব্যাখ্যা লিখলেন। রোগী এবং রোগ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যাটাই রহমান সাহেবকে বোঝাতে হবে।

    ৩১

    পরদিন সকালে নিশিতবাবু রহমান সাহেবকে দেখতে গেলেন। অবস্থা ভালো হলে কথাও বলা যাবে।

    ক্লিনিকে গিয়ে দেখা গেলো কুমকুম কেবিনেই বসে আছে। রহমান সাহেব বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন। চোখ দুটো বোজা। মাঝে মাঝে তিনি চোখ খুলে আবার বন্ধ করে রাখছেন। চোখ খুলে রহমান সাহেব যে নির্দিষ্ট কিছু দেখছেন, বিষয়টা তেমন না। তার চোখ অবশ্য খুব একটা বেশী খোলাও যাচ্ছেনা। চোখের ফোলা কমেনি।
    নিশিতবাবু ইংগিতে কুমকুমকে রুমের বাইরে যেতে বললেন। তিনি রহমান সাহেবের সাথে একা কথা বলতে চান।
    “রহমান সাহেব, কেমন আছেন?”
    “আছি। ভালো আছি।”
    “আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
    “জ্বী চিনেছি। না চেনার কি আছে? আপনি কি কোন বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত?”
    “হ্যাঁ। আপনার চোখের এই অবস্থা হলো কি করে?”
    “রহমান সাহেবকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।”
    “মানেটা বুঝলাম না। আপনি নিজে কেন নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন?”
    “রহমান সাহেব নিজে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন না। আমরা তাকে শাস্তি দিচ্ছি।”
    রহমান সাহেবের শ্বাষ-প্রশ্বাষ আগের চেয়ে দ্রুত হয়েছে। তার এক চোখ পুরোটা খোলা। বাকীটা বন্ধ। খোলা চোখটা লালচে কিন্তু জ্বলজ্বল করছে। চোখ জ্বলজ্বল করে সাধারনত যক্ষা রোগীদের। রহমান সাহেবের রক্তের রিপোর্টে তেমন কোন কিছু আসেনি। তাও মানুষটার চোখ জ্বলজ্বলে। নিশিতবাবু খুব মনোযোগ দিয়ে রোগীর পুরো পরিবর্তনটুকু খেয়াল করছেন।
    “আমরা মানে কি, রহমান সাহেব?”
    “আমরা কাক। সংখ্যায় বেশী বলে বলছি আমরা। আমরা রহমান সাহেবকে শাস্তি দিচ্ছি।”
    “একটু আগে আমি আপনাকে রহমান সাহেব বললাম, আপনি উত্তর দিয়েছেন। এখন বলছেন আপনি কাক। কথাটা কেমন হয়ে গেলোনা?”
    “শুরুতেই আপনাকে ধাক্কা দিতে ইচ্ছে করলোনা।অতাই ঐ সম্বোধনেই সাড়া দিয়েছি। একটু আগেও এই শরীরে রহমান সাহেবের চেতনাই ছিলো। এখন তা আমাদের দখলে।”
    “ভালো যুক্তি দিয়েছেন। তবে আমি তাতে বিভ্রান্ত হচ্ছিনা। তো, রহমান সাহেব, আপনি এখন কাক, এইকথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?”
    “বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনার বিষয় নিশিতবাবু। তাতে আমাদের কিছু যায় আসেনা।”
    “রহমান সাহেব, কাকের কোন চেতনা নেই। মানুষের মস্তিষ্কে চেতনার জন্যে, সেই চেতনা নিয়ন্ত্রনের জন্যে আলাদা একটা অংশ আছে। তাই মানুষের চেতনা আছে। সেই আলাদা অংশটুকু আর অন্য কোন প্রানীর মাঝে নেই। কাকেরও নেই। তাই কাকের চেতনা নেই। যার চেতনাই নেই, সে বা তারা কি করে আপনার চেতনা দখল করবে? মানুষের চেতনা দখল করা সম্ভব না। আর যদি তা সম্ভব হয়েই থাকে তাহলে একজন মানুষের চেতনা দখল করা আরেকজন মানুষের পক্ষেই সম্ভব। অন্যকিছুর পক্ষে এই কাজটি করা সম্ভব না।”
    “নিশিতবাবু,আপনার ভুল হচ্ছে। তার প্রমান আপনার সামনেই বসা।”
    “আমার কোন ভুল হচ্ছেনা। আমি ঠিকই বলছি।অভুল হচ্ছে আপনার।”
    “বুঝতে পারছি নিশিতবাবু, আপনি যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন। নিজে কিছু ব্যাখ্যাও দাড় করিয়েছেন। কিন্তু নিশিতবাবু, এই পৃথিবীর সবই কি ব্যাখ্যা করা যায়?”
    “হ্যাঁ যায়। ঠিক রাস্তাটা ধরতে পারলে সব কিছুরই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেসব রহস্য এখনো ব্যাখ্যা করা যায়নি, সেসবের জন্য এখনো মানুষ ঠিকঠিক রাস্তাটা খুঁজে পায়নি। তাই ব্যখ্যা হয়নি।অহিসেব খুব সহজ। খুব সহজ। আমাদের বিজ্ঞান একসময় সব কিছুরই ব্যাখ্যা দেবে। সেই দিন আর খুব বেশী দূরে নেই। তাই চিন্তারও কিছু নেই।”
    “পুরোপুরি ঠিক বলেননি নিশিতবাবু। আপনি যে বিজ্ঞান নিয়ে এতো গর্ব করছেন, তাতেও পরস্পর বিরোধী নানারকম মতবাদ থাকে, তঙ্কÄ থাকে। নানারকম দল তৈরী হয়। বিভিন্ন দল বিভিন্ন মতবাদ বিশ্বাস করে। এই বিজ্ঞানও অনেক কিছুর একেবারে নিরেট কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। ব্যাখ্যা দিলেও তাতে অনেক কিছু ধরে নেয়া হয়। কি, ঠিক না?”
    “আপনি যা বলছেন রহমান সাহেব, তা আংশিক ঠিক। বিজ্ঞান একটা প্রবহমান ধারার মতো। এই ধারা চলমান অবস্থায় নানারকম মতবাদ আসে। রহস্য ব্যাখ্যা কিংবা কোন ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য এইসব মতবাদের অবতারনা হয়। এরপর এইসব মতবাদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কোনকিছুই আপনার ভাষ্যমতে বিশ্বাস করা হয়না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মতবাদ বা ব্যাখ্যা সঠিক কিনা তা বলা হয়। রহমান সাহেব, মানুষ সবসময়ই ব্যাখ্যা চায়। রহস্য কিছু মানুষের পছন্দ কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেরই অপছন্দ। তারপরেও বেশিরভাগ মানুষই রহস্যের পেছনে ছোটে। কারন তাতে উত্তেজনা আছে। উত্তেজনা শেষ হবার পর মানুষ তার ব্যাখ্যা চায়। কারন খুব সহজ। কারনটা হচ্ছে মানুষ সবশেষে চায় জ্ঞান। আপনি বলছেন ,আপনি কাক। কথাটা খুবই অবাস্তব। কখনো হতে পারেনা। অবশ্য আপনার নিজেকে কাক মনে করার পেছনে কারনও আছে। এবং তার ব্যাখ্যাও আছে।”
    “নিশিতবাবু, আপনিতো সেই ব্যাখ্যা ঠিক করেই এসেছেন, ঠিক না? তবে একটা কথা, আপনার ব্যাখ্যার বাইরেও তো কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তাই না? অন্তত আপনার বিজ্ঞানের পথ হিসেবে তো তাই হবার কথা।”
    “হ্যাঁ পারে। অন্য ব্যাখ্যা থাকতেই পারে। সম্ভাবনা আমি উড়িয়ে দিচ্ছিনা তবে আপনার আমার ব্যাখ্যাটা শুনতে হবে। সেটা বিশ্বাসও করতে হবে। কাজটা করতে হবে আপনার নিজেরই স্বার্থে।”
    “শুনি। বিশ্বাস করতে পারবোনা। সত্যিটা আমি জানি। আপনি জানেন না। যাকগে, আপনার ব্যাখ্যাটা শোনা যাক।“
    “রহমান সাহেব, আপনার শারীরিক একটা সমস্যা ছিলো এবং আছে। সেই সমস্যার দায়টুকু অবশ্য আপনার নাও হতে পারে।”
    “ঠিকই বলেছেন নিশিতবাবু। রহমান সাহেবের শারীরিক সমস্যা আছে। তার বাবা হবার ক্ষমতা নেই। মাম্পস নামের একটা রোগ আছে। রহমান সাহেব ছেলেবেলায় বেশ কয়েকবার এই রোগে ভুগেছেন।”
    “এই সমস্যার কারনে আপনার স্ত্রী, কুমকুম আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলো। আপনি আপনার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন এবং হয়তো আরো বাসবেন। কিন্তু তার এই চলে যাবার বিষয়টি আপনি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। মাম্পস এর বিষয়টি আপনার কাছে খুব বেশী গুরুত্ব পায়নি। আপনার মনে হয়েছিলো আপনিই কুমকুমকে ধরে রাখতে পারেননি। অক্ষমতার ভাবনা আপনাকে নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী করে তুলেছে। একসময় এই অপরাধবোধ হয়েছে তীব্র। শাস্তি দিয়েছেন নিজেকেই। আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। পারেননি। তারপর কুমকুম আবারো ফিরে আসে। আপনার তীব্র অপরাধবোধ চলে গেছে আপনার ভেতরের গহীন কোন জায়গায়। কারন আপনার ভালোবাসা ফিরে এসেছে। যে বোধ তীব্র ক্ষমতার তা সবসময় গহীনে থাকেনা। মাঝে মধ্যেই উপরে উঠে আসে। আপনার অপরাধবোধও মাঝে মধ্যেই উঠে আসতো তবে তা আর বিধ্বংসী চেহারায় আসতো না। এরপর একটা সময় আপনি ব্যক্তিগত সাফল্যে সেই অপরাধবোধ কিংবা সেই অপরাধীসঙ্কÄ¡টাকে ঢাকতে চেয়েছেন। সেই পথে আপনি অনেকদূর এগিয়েও গিয়েছিলেন। অফিসে নতুন একটা সমস্যা তৈরী হয়। সমস্যার সমাধান না হলে আপনার ব্যক্তিগত সাফল্যের চাদর পুরোপুরি নিখুঁত হতোনা। কিন্তু অপরাধবোধ ঢাকার জন্যে চাই পুরো নিখুঁত চাদর।অআপনি আতংকিত হয়ে গেলেন। তীব্র আতংকে আপনার সময় কাটছিলো। ”
    “নিশিতবাবু, ব্যার্থতা ব্যার্থতাই। সাফল্য দিয়ে কি ব্যার্থতার ক্ষত মুছে দেয়া যায়?”
    “তা হয়তো পুরোপুরি যায়না। তবে মানুষ সেই চেষ্টা সবসময়ই করে। ব্যার্থতা ঢেকে রাখতে চায়। যাই হোক, আপনার তীব্র আতংকিত থাকার সময়টায় একটা কাকের মৃত্যু হয় আপনার হাতে। আপনার ভেতর তৈরী হয় একটু অপরাধবোধ। ছোট্ট এই ছিদ্র দিয়ে আপনার পুরোনো সেই তীব্র বোধ বেরিয়ে এসেছে। মানুষ আতংকে থাকতে চায়না। আতংকের জায়গায় আপনি এবার আক্রান্ত হলেন অপরাধবোধে। এই বোধ দীর্ঘদিন গহীনে থেকে শক্তি সঞ্চয় করে বেরিয়ে এসেছে। এবার বোধটুকু আপনার ভেতর গোটা একটা সত্বা তৈরী করে ফেললো। এই নতুন সত্বার নাম কাক। এই সত্বা আপনাকে শাস্তি দিতে চায়। সত্বা তৈরীতে অবশ্য আরো কিছু ব্যাপার কাজ করেছে।”
    “নিশিতবাবু, আপনার ব্যাখ্যা কি শেষ হয়েছে?”
    “নাহ, শেষ হয়নি। অনেকটা বাকী আছে।”
    “আচ্ছা নিশিতবাবু, অপরাধবোধ থেকে কাক নামের আলাদা সত্বা কেন তৈরী হবে? অন্য কিছু কি হতে পারতোনা?”
    “আতংক তীব্র অবস্থায় যখন পৌঁছেছে তখন আপনি একটা কাক মেরেছেন। প্রানী হত্যার বিষয়টা আপনার চরিত্রের সাথে যায়না। আপনার কুকুরগুলো যখন অসুস্থ ছিলো তখন আপনি নিজে সেই কুকুরদের দেখতে গিয়েছিলেন। প্রানীদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আপনি কাজটা করেছিলেন। তাই বললাম প্রানী হত্যার বিষয়টা আপনার চরিত্রের সাথে যায়না। চরিত্রবিরোধী এই কাজ, কাক মেরে বিষয়টাকে আপনি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। ভেবেছেন, কাকের যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে আপনাকে তার হত্যার শাস্তি দিতো। কিন্তু মৃত কোন কিছুরই কিছু করার ক্ষমতা থাকেনা। তখন আপনি পুরো কাক সম্প্রদায়ের কথা ভেবেছেন। পুরো সম্প্রদায় এখন আপনাকে শাস্তি দিচ্ছে। আর তাছাড়া আপনার নিজের সাংসারিক জীবনটা কাকের জীবনযাত্রার সাথে মেলে। কাক কোকিলের বাচ্চা লালন পালন করে। নিজের বাচ্চার মতো অপরের বাচ্চাকে ভালোবাসে। আপনার নিজের সন্তান নেই। দুটো বাচ্চা আপনি দত্তক নিয়েছেন। আরেকজনের সন্তানকে ভালোবাসছেন নিজের সন্তানের মতো করে। কাকের সাথে এই জায়গায় আপনার নিজের তুলনা এসেছে। এইসব কারনে আপনার নিজেকে কাক মনে হতে পারে।”
    “চম্‌ৎকার নিশিতবাবু ! সবকিছু কেমন ছকে ফেলা শুরু করেছেন। ছক জিনিষটা আপনার পছন্দ, আমরা জানি। বলতে থাকুন, শুনি। ”
    “সামাদ সাহেবের সাথে আপনার স্ত্রীর একটা সম্পর্ক একসময় ছিলো। সেটা বিয়ের আগে। এই সম্পর্ক স্বভাবতই কুমকুমের বাবা-মা মেনে নিতে পারেননি। কুমকুমের বিয়ে আপনার সাথে ঠিক করা হয়। বাবা-মায়ের চাপে আপনাকে কুমকুম বিয়ে করেছে। কিন্তু বিয়ের পর কুমকুম আর দশটা বাঙ্গালী মেয়ের মতৈ কাজ করেছে। স্বামীর প্রতি সে বিশ্বস্ত থেকেছে। সামাদ সাহেবকে সে ভুলে যাবার চেষ্টা করেছে। তার সাথে কোন যোগাযোগ সে করেনি। সামাদ সাহেব কিন্তু চেষ্টা করেছিলেন। ভালোবাসা কি এতো দ্রুত ছেড়ে দেয়া যায়? যায়না। কিন্তু কুমকুম তাতে কোন সাড়া দেয়নি। শেষ পর্যন্ত সামাদ সাহেবও পিছিয়ে যান। ”
    নিশিতবাবু চুপ করে কিছুক্ষন রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রহমান সাহেবের এক চোখ খোলা। তাতে পলক পড়ছেনা।
    “রহমান সাহেব, আপনি আমার কথা শুনছেন তো?”
    “বলুন, সমস্যা নেই। আর একই ভুল বারবার করার কোন অর্থ নেই। আমরা রহমান সাহেব নই।”
    “আচ্ছা। বাকীটা শুনুন। প্রতিটি মেয়ের ভেতরেই মা হবার তীব্র বাসনা থাকে। কুমকুমও সেই নিয়মের বাইরে নয়। একসময় আপনারা দুজনে মিলে সেই বাসনা মেটানোর চেষ্টা করলেন। হলোনা কিছুই। ডাক্তারী পরীক্ষায় ধরা পড়লো সমস্যা আপনার। কুমকুমের না। এই বিষয়টা কুমকুম মেনে নিতে পারেনি। জানেনই তো আপনার স্ত্রী একজন আবেগপ্রবন মানুষ। সে তখন বাপের বাড়ী চলে যায়। সামাদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে। কুমকুমের ইচ্ছে ছিলো আপনাকে ডিভোর্স করে সামাদ সাহেবকে বিয়ে করার। পুরো বিষয়টি অবশ্য সামাদ সাহেব মেনে নিতে পারেননি। সামাদ সাহেবের দৃষ্টিতে ভালোবাসার সংজ্ঞাটি অনেক বিশাল। দীর্ঘদিন পর এমন একজন মানুষের সাথে কথা হলো। যাই হোক, এই সময়টিতে আপনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। আপনার ভালোবাসার এই রুপটা কুমকুমকে বোঝায় সামাদ সাহেব। কুমকুম আপনার কাছেই ফিরে আসে। অবশ্য এই তথ্য আপনি অনেক পরে জেনেছেন। কুমকুমই হয়তো আপনাকে বলেছে। তখন আপনার মনে হয়েছে সামাদ সাহেব অনেক মহ্‌ৎ একজন মানুষ। কতটা মহ্‌ৎ তা বোধহয় আপনি বুঝতে পারেননি। এই ধরনের মহত্ব দেখাতে মহত্বের পরিমানটি সত্যি সত্যি অনেক বেশী হতে হয়। এই মহত্ব একসময় আপনার কাছে কুমকুমের চেহারায় দেখা দিলো। সে আপনার স্ত্রী। আপনার আশেপাশেই থাকে। তার মানে সামাদ সাহেবের মহত্ব আপনার আশেপাশেই থাকে। আপনার ভেতর তখন তৈরী হলো একধরনের হীনমন্যতা। সামাদ সাহেব একসময় আপনার অফিসে আপনারই অধীনে কাজ করতে আসেন। তখন আপনি নিয়মিত তাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেন। সামাদ সাহেবকে আপনি মহত্বের বেদী থেকে নামিয়ে সাধারন মানুষ প্রমান করতে চেয়েছেন। সুযোগ যখন পেয়েছেন তখন তা হাতছাড়া করেননি। তার কাজের জন্য তাকে পুলিশে দিয়েছেন। সামাদ সাহেব নেমে এলো সাধারন মানুষের কাতারে। কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। ”
    “কিসের সমস্যা নিশিতবাবু?”
    “সমস্যা হলো একটা মানুষের চেতনার বিভিন্ন অংশ থাকে। আপনার চেতনার একটা অংশ সামাদ সাহেবের কাছে অসীম কৃতজ্ঞ তার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবার জন্য। আবার আপনারই চেতনার একটা অংশ তা সহ্য করতে পারেনি। সামাদ সাহেবকে সে প্রমান করেছে সাধারন মানুষ হিসেবে। এই বিষয়টা আবার আপনার সেই কৃতজ্ঞ অংশটুকু মেনে নিতে পারেনি। এই অংশটিরই ছিলো অপরাধবোধ। আবার সামাদ সাহেবের পরিণতিতে সে নিজেকে ভাবা শুরু করলো অকৃতজ্ঞ। অপরাধবোধের ছাইচাপা আগুন আর অকৃতজ্ঞতার ছায়া, এই দুই মিলিয়ে সেই অংশটি সিদ্ধান্ত নিলো শাস্তি দেবার। সে কাকের অবয়ব নিলো। রহমান সাহেব, আমার ব্যাখ্যা কি আপনার পছন্দ হচ্ছে?”
    “আমাদের পছন্দ অপছন্দে কিছু যায় আসেনা। তবে আপনার কথা শুনতে ভালো লাগছে। সবকিছু কেমন পাজলের মতো মিলিয়ে ফেলছেন।”
    “আমার কথা শেষ হয়নি। আপনার স্ত্রীর মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য দুটো দরিদ্র পরিবার থেকে দুটো বাচ্চা আপনি পালক এনেছেন। সেইসব পরিবারের কেউ যাতে বাড়িতে ঢুকতে না পারে তার ব্যাবস্থাও আপনি করেছেন। তাদের নিয়মিত টাকা পাঠানো হতো। সারাদিন বাড়ির গেইটে দাড়োয়ান আর রাতে বাড়ির কম্পাউন্ডে ছেড়ে দেয়া হতো কুকুর। বাড়ি পাহারার কাজটি করেছে আপনার চেতনার অকৃতজ্ঞ অংশটি। কিন্তু কৃতজ্ঞ অংশটি দরিদ্র বাবা-মায়ের দিকটি ঠিকই দেখেছে। পুরো বিষয়টি তার কাছে মনে হয়েছে অন্যায়। কাক যখন কোকিলের বাচ্চা বড় করে তখন কোকিল দূর থেকে বিষয়টি খেয়াল করে। আপনার বাচ্চাদের আসল বাবা-মায়েরাও যে তাদের সন্তানদের দূর থেকে দেখে যায় তা বোধহয় আপনার জানা আছে। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনার নিজেকে কাক মনে করার কারন কি?”
    “নিশিতবাবু, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?”
    “না, আর অল্পই আছে। এতো অস্থির হচ্ছেন কেন রহমান সাহেব? অস্থির হবার কিছু নেই।”
    “নিশিতবাবু, আপনি এক কাজ করুন। বারান্দায় গিয়ে বাইরে কি অবস্থা দেখে আসুন।”
    নিশিতবাবু নির্বিকারভাবে উঠে বাইরে গেলেন। এ জাতীয় রোগীদের মনে বিশ্বাস স্থাপনের জন্যে মাঝেমধ্যে তাদের কথা মতো কাজ করতে হয়। বাইরে এসে তিনি খুব অবাক হলেন। ক্লিনিকের চারপাশে সবজায়গায় শুধু কাক আর কাক। সব চুপচাপ বসে আছে। এতো কাক কেন আশেপাশে? একসাথে কি বেশ কিছু কাক মারা গেছে? নইলে তো একজায়গায় এতো কাক বসে থাকার কথা না। এর চুপ করেই বা বসে আছে কেন? সবার মধ্যে কেমন নিশ্চল ধ্যানী ভাব। কাকেরা কি ধ্যান করে? কে জানে?
    নিশিতবাবুর খুব কাছাকাছি একটা কাক বসে আছে। সে অবশ্য চুপ করে বসে নেই। মাথা নাড়ছে এদিক ওদিক। কাকটার চোখ নিশিতবাবুর দিকেই। তিনিও কিছুক্ষন কাকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কি অদ্ভূত বিষয়! কাকের গলায় সাদা ফুটকি। কাকের গলায় এরকম দাগ থাকে নাকি? কখনো চোখে পড়েনি তো!
    রুমের ভেতরে ঢুকলেন নিশিতবাবু। রহমান সাহেব বিছানার উপর দ এর মতো হাঁটু ভেঙ্গে বসে আছেন। হাত দুটো দুপাশে দিয়ে উড়ার মতো ভঙ্গি। মুখ অদ্ভুত উঙ্কÄল। দৃশ্যটা নিশিতবাবুর কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো। তিনি বিছানার পাশের চেয়ারে বসলেন।
    “কি দেখলেন নিশিতবাবু?”
    “তেমন কিছু না। অনেক কাক দেখলাম।”
    “অবাক হননি?”
    “অবাক হবার কিছু নেই। আশেপাশে কাকটাক মরেছে বোধহয়।”
    “আমরা কিন্তু জানতাম বাইরে আপনি কি দেখবেন।”
    “বাইরে অনেক কাক, একথা জানতে কাক হবার প্রয়োজন দেখিনা। আপনি আগেই হয়তো কাকেদের ডাকাডাকি শুনেছেন। তাই ধারনা করেছেন বাইরে অনেক কাক।”
    “নিশিতবাবু, কাকগুলো কি ডাকাডাকি করছে?”
    “না। এই বিষয়টা অদ্ভুত।”
    “বাইরের এই কাকেদের চেতনা সংযুক্ত অবস্থায় আছে। তাদের এখন আলাদা কোন চেতনা নেই। সংযুক্ত চেতনা এখন আপনার সাথে কথা বলছে। তাই তারা চুপ। নড়াচড়া বন্ধ। ”
    “আপনার ব্যাখ্যা সুন্দর। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু বিষয়টা অসম্ভব, তাই বিশ্বাস করতে পারছিনা। ”
    “জানতাম আপনি বিশ্বাস করবেন না। আপনার বিশ্বাসের জন্যে একটা ব্যাবস্থা নেয়া হবে। আমরা রহমান সাহেবকে ছেড়ে খুব অল্প সময়ের জন্যে আপনার চেতনা দখল করবো। যদি সহ্য করতে পারেন তাহলে এই স্মৃতি টুকু থাকবে, নইলে আমরাই মুছে দেবো। ”
    “মানুষের স্মৃতি মোছা যায়না রহমান সাহেব।”
    “ভুল বললেন নিশিতবাবু। মানুষের স্মৃতিও মোছে। আপনারা একে রোগ হিসেবে আলাদা নামও দিয়েছেন। এমনেশিয়া। তাইনা?”
    “হ্যাঁ ঠিক। ওটা রোগ। স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে এই ঘটনা সাধারনত ঘটেনা। এর জন্য মস্তিষ্কের নার্ভ সেলের উপর তীব্র চাপের প্রয়োজন হয়।”
    “আপনাকে সেই চাপ দেয়া হবে যদি আপনার সহ্য না হয়।”
    “আচ্ছা।”
    “আপনার চেতনা দখলে শক্তির প্রয়োজন বেশী। কারন আপনার চেতনায় ঈর্ষা, হিংসা , এই অনুভূতিগুলো কম। সংযুক্ত চেতনার শক্তি বাড়ানোর জন্যে কাক বেশি প্রয়োজন। তাই আশেপাশে প্রচুর কাক এসেছে। রহমান সাহেবের চেতনা দখলে এতো শক্তির প্রয়োজন হয়নি। ওর চেতনা অনেক দূর্বল। আপনি কি বুঝতে পারছেন নিশিতবাবু?”
    “পারছি, কিন্তু বিশ্বাস করছিনা। অবাস্তব জিনিষে বিশ্বাস করার কোন ইচ্ছে আমার নেই।”
    “বিশ্বাস করবেন। এক্ষুনি করবেন। কাহ কাহ কাহ...।”
    শব্দগুলো নিশিতবাবুর কাছে কেমন অবাস্তব অবাস্তব মনে হলো। এই বিচ্ছিরি শব্দগুলো কিছুতেই এই পৃথিবীর হতে পারেনা। হঠাৎ করেই নিশিতবাবু তীব্র ভয়ে কুঁকড়ে গেলেন। কিসের এই ভয় তা তিনি জানেন না। তার ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বসা থেকে তিনি উঠতে পারছেন না।
    কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই নিশিতবাবুর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো। এই অন্ধকার খুব অল্প সময়ের। অন্ধকার ভরে উঠলো আলোয়। নিশিতবাবু দেখলেন, তিনি অনেক উঁচু থেকে নিচে নেমে আসছেন। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মাটিতে একটা বাচ্চা ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। ছেলেটার হাতে বিস্কিট। অনেকদিন টাটকা বিস্কিট খাওয়া হয়না। তিনি ছোঁ মেরে বিস্কিটটা বাচ্চাটার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়ে সামনের গাছের ডালে বসলেন। বাচ্চাটা অবাক হয় তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারায় একই সাথে বিস্কিট হারানোর বেদনা এবং যে কেড়ে নিয়ে গেছে তার প্রতি ঘৃণা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে।
    নিশিতবাবু জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। মেঝেতে পড়ার আগে তার মাথা বিছানার কোনায় বাজে ভাবে ঠুকে গেলো।
    হঠাৎ রহমান সাহেব আবিস্কার করলেন তিনি বিছানার উপর বসে আছেন। হাত দুটো দুপাশে। আরে, হাত দুটো এরকম দুপাশে দেয়া কেন? ছেলেবেলায় এই ভঙ্গিতে পাখির মতো ওড়ার চেষ্টা করতেন। এই বয়সে এইরকম করার কারন কি? এতো শব্দ কোথা থেকে আসছে? ওমা, মেঝেতে কে পড়ে আছে? এতো রক্ত কেন মেঝেতে? কে এই লোক? এটা কোন জায়গা? কুমকুম কোথায়?
    রহমান সাহেব জোরে জোরে ডাকলেন, “কুমকুম, কুমকুম...”
    কুমকুম রুমের বাইরেই বসা ছিলো। চিৎকার শুনে সে ভেতরে ঢুকলো। মেঝের উপর নিশিতবাবুকে পড়া দেখে সে অবাক হয়ে গেলো। মেঝেতে এতো রক্ত কেন?
    নিশিতবাবুকে ঐ ক্লিনিকেই ভর্তি করা হলো। টানা তিনদিন তিনি সংজ্ঞাহীন রইলেন।

    ৩২

    নিশিতবাবু ক্লিনিকে ভর্তি হবার পর রহমান সাহেবের অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে গেলো। বেসিরভাগ সময় তিনি বসে থাকেন। ক্লিনিক থেকে একদিন পর তাকে নেয়া হলো মানসিক হাসপাতালে। সেখানে নানারকম চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা হলো। তাতে শরীর দূর্বল হয়ে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছু হলোনা।
    দূর্বল শরীর নিয়ে রহমান সাহেব জানালার গ্রীল ধরে ঝুলে থাকেন। কিছুক্ষন পর পর প্রচন্ড জোরে কা কা শব্দ করেন। হাসপাতালের চারপাশে তখন প্রচুর কাক থাকে। এরা বসে থাকে চুপচাপ। মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্যে রহমান সাহেবের অবস্থা স্বাভাবিক হয়। তিনি তখন স্বাভাবিক মানুষের মতো চিৎকার করেন। সেই চিৎকারে কারও কোন ভাবান্তর হয়না। মানসিক রোগীতো চিৎকার করবেই। সেই চিৎকারে গা করলে চলেনা।
    হাসপাতালে দ্বিতীয় রাতে একটা ঘটনা ঘটলো। রহমান সাহেব তখন প্রায় স্বাভাবিক মানুষ। শুধু ওষুধের হালকা কেমন একটা ঘোর লাগা ভাব আছে। একটা অশরীরি গলা তার সাথে কথা বলা শুরু করলো।
    “কেমন আছেন রহমান সাহেব?”
    “কে? কে কথা বলে?”
    “আমরা কাক রহমান সাহেব। আমাদের আলাদা কোন নাম নেই। কাক বলেই আমাদের ডাকতে পারেন।”
    “আপনারা কোথায়? দেখতে পাচ্ছিনা কেন?”
    “আমরা আছি আপনার আশেপাশেই। দেখতে পাওয়াটা কোন জরুরী বিষয় না। কথা তো শুনতে পাচ্ছেন।”
    “তাও...।”
    “ফোনে যখন কথা বলেন তখন তো বক্তার চেহারা দেখা যায়না। তাতে কি কোন সমস্যা হয়? ”
    “তা অবশ্য ঠিক। আপনি কি চান?”
    “তেমন কিছুই চাইনা। আপনি কেমন আছেন?”
    “ভালোনা। একদম ভালোনা। আমি যে স্বাভাবিক মানুষ তা এরা বিশ্বাসই করতে চায়না। আমাকে ভাবে পাগল। আচ্ছা বলুনতো, আমি কি পাগল? ”
    “নাতো, আপনি কেন পাগল হতে যাবেন?”
    “তাও এরা আমাকে আটকে রেখেছে।“
    “কেমন লাগছে রহমান সাহেব?”
    “যন্ত্রনারে ভাই। খুব যন্ত্রনায় আছি।”
    “মুক্তি চান?”
    “অবশ্যই চাই।”
    “আপনার রুমের দরজা খোলা। দরজা খোলার ব্যাবস্থা আমরাই করেছি। আপনি বেরিয়ে যান। বেরিয়ে ডানে সিঁড়ি পাবেন। সোজা উপরে উঠে যাবেন।”
    “কেন? উপরে কেন?”
    “আপনি যান। গেলেই বলবো।”
    রহমান সাহেব দরজার কাছে ছুটে গেলেন। আশ্চর্য্য তো! দরজা আসলেই খোলা। দরজা ধরে কতো টানাটানি, কতো ঝুলোঝুলি। দরজা খোলেনা। আর এখন দরজা খোলা। রহমান সাহেব দরজা খুলে এদিক ওদিক দেখে নিলেন। আশেপাশে কেউ নেই। করিডর ফাঁকা। সিঁড়ি বেয়ে রহমান সাহেব সোজা উপরে উঠে গেলেন।
    “এবার রহমান সাহেব, ছাদের দরজা খুলুন।”
    “দরজায়তো তালা দেয়া। খুলবে কি করে?”
    “সমস্যা নেই। তালা ঠিক মতো লাগেনা। তালা ধরে জোরে টান দিন। খুলে যাবে।”
    রহমান সাহেব তালা ধরে টান দিলেন। তালা খুলে এলো। এরপর তিনি সোজা চলে গেলেন ছাদে। আকাশ পরিস্কার। আজ পূর্ণিমা। বিশাল এক চাঁদ আকাশে। আকাশ ভরা তারা। রহমান সাহেব দীর্ঘক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
    “আকাশ কেমন লাগে রহমান সাহেব?”
    “আকাশ? আকাশ আমার খুব পছন্দের।”
    “আকাশে উড়বেন? উড়তে আরো ভালো লাগবে। আকাশ দেখে যতো আনন্দ, উড়তে তার চেয়ে আনন্দ বেশী।”
    “ওড়া যাবে?”
    “কেন যাবেনা? অবশ্যই যাবে। ছাদের দেয়ালে উঠে যান। আপনাকে আমরা উড়তে সাহায্য করছি।”
    রহমান সাহেব ছাদের দেয়ালে উঠে দাঁড়ালেন। অন্য কোন ভাবনা তার মাথায় নেই। ছেলেবেলায় কতো পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে হয়েছে। কত শখ ছিলো পাখির মতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যাবেন।
    “এবার রহমান সাহেব, হাত দুটো দুপাশে পাখার মতো ছড়িয়ে দিন। ঝাপটাতে থাকুন। তারপর ছোট্ট একটা লাফ দিন। আপনি উড়তে থাকবেন।”
    ঠিক তাই করলেন রহমান সাহেব। আরে তাইতো ! ওড়া যাচ্ছে তো! পৃথিবী কি সুন্দর! অদ্ভুত সুন্দর!
    পাঁচ তলার ছাদ থেকে রহমান সাহেব চোখের পলকে শক্ত, বাঁধানো কম্পাউন্ডে আছড়ে পরলেন। মাটিতে আছড়ে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তার কুমকুমের কথা মনে পড়লো। কেমন আছে মেয়েটা? ভালো আছে তো? ইস ! ওকে সাথে নিয়ে যদি ওড়া যেতো!
    আশপাশ থেকে অনেক ডানা ঝটপটানোর শব্দ পাওয়া গেলো। এলাকা ছেড়ে উড়ে গেলো কয়েকশ কাক। তাদের আর ওখানে থাকার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শেষ।

    ৩৩

    চতুর্থ দিন বিকেলে নিশিতবাবুর জ্ঞান ফিরলো। পরের দিন বিকেলে তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে নেয়া হলো। তার অবস্থা এখন অনেক ভালো। কুমকুম বিকেল বেলায় নিশিতবাবুকে দেখতে গেলো।
    “চাচা, ভালো আছেন?”
    “আছি, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
    “আমি ভালো আছি চাচা। আপনি বোধহয় আমাকে চিনতে পারেননি। আমি কুমকুম। আপনি আমার স্বামীর চিকিৎসা করছিলেন।“
    “হুমম। আচ্ছা।“
    “আপনার এখনো কিছু মনে পড়েনি চাচা, তাইনা?”
    “ঠিক ধরেছেন। আমার কিছুই মনে পড়ছেনা। Iamsorry. আপনার স্বামী কেমন আছেন?”
    “ও আর নেই চাচা। গত পরশু রাতে ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে।” কথাটা বলেই কুমকুম কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
    যে মানুষটিকে মনে নেই, তার মৃত্যুতেও নিশিতবাবুর হৃদয় ভারাক্রান্ত হলো।অসান্তনা দেবার কোন ভাষা তার জানা নেই। নিশিতবাবু কুমকুমের মাথায় হাত রেখে মমতা মাখানো গলায় বললেন, শান্ত হন মা, শান্ত হন।
    এরও দুদিন পর নিশিতবাবু ক্লিনিক থেকে ছাড়া পেলেন। হিসেব অনুযায়ী তিনি এক সপ্তাহ কাটিয়েছেন ক্লিনিকে। এয়াম্বুলেন্স দিয়ে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হলো। বাড়ির সবকিছুতে কেমন ধূলো জমেছে। মাত্র এক সপ্তাহে সময় এতো দাগ কাটে? সময় যে কি বিচিত্র জিনিষ তা যদি বোঝা যেতো! বাড়িতে ঢুকেই নিশিতবাবুর খুব ক্লান্ত লাগলো। তিনি সোজা বিছানায় চলে গেলেন। ধূলো জমেছে বিছানাতেও। ধ্যাত্তেরি! তিনি ধূলো সহ বিছানাতেই শুয়ে পরলেন। বিছানার পাশেই ছোট্ট টুলের উপর একটা ফাইল খোলা। কিসের ফাইল? ফাইলের উপর বিশাল একটা কালো পালক। কিসের পালক? এলো কোত্থেকে? নিশিতবাবু ফাইলটা হাতে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলেন।
    আব্দুর রহমান নামের একজনের ফাইল। ইনি কি তার রোগী ছিলেন? এই রোগী কবে দেখা হয়েছে? ফাইলের শেষের ব্যাখ্যাটা তার কেন যেন পছন্দ হচ্ছেনা। এই ব্যাখ্যা কার দেয়া? হাতের লেখাটা তারই। তার মানে ব্যাখ্যাটা তারই দেয়া। নাহ ব্যাখ্যাটা আরো ভালো হতে পারতো। এই আব্দুর রহমান সাহেব কবে এসেছিলেন তার কাছে? কি যেন নাম মেয়েটার? ও আচ্ছা কুমকুম। আব্দুর রহমান সাহেবই কি কুমকুমের স্বামী? ধুত্তোরী, কিছুই তো মনে নেই। মনে নেই কেন? বয়সের সাথে সাথে কি স্মৃতিটাও ক্ষয়ে যাচ্ছে?
    “নিশিতবাবু, ব্যাখ্যাটা কি আপনার পছন্দ হয়েছে?”
    “নাহ, ব্যাখ্যাটা অন্যভাবেও হতে পারতো।” কথাটা বলেই নিশিতবাবু চমকে উঠলেন। প্রশ্ন কে করলো? বাড়ীতে প্রশ্ন করার মতো কেউ তো নেই। কিন্তু প্রশ্নটা তিনি পরিস্কার শুনেছেন। নিশিতবাবু আশেপাশে দেখলেন। কেউ নেই। কারও থাকার কথাও না। বিড়াল অনামিকাকেও দেখা যাচ্ছেনা। শেষে নিশিতবাবুর চোখ পড়লো জানালার গ্রীলে। সেখানে বড়সড় একটা কাক বসে আছে। কাকটার দিকে নিশিতবাবু অনেকক্ষন তাকিয়ে রইলেন। কাকটার গলায় সাদা ফুটকি। হঠাৎ কাকটাকে তার পরিচিত মনে হলো। ধুত্তরি! কাক আবার পরিচিত হবে কেমন করে? ক্লান্ত শরীরে উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় আসছে।
    নিশিতবাবু উঠে জানালা বন্ধ করতে গেলেন। কাকটা উড়ে গেলো। নিশিতবাবু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বিদ্যুতের তারে শত শত কাক বসে আছে। সব স্থির, চুপচাপ। দৃশ্যটি নিশিতবাবুর কাছে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। খুবই পরিচিত।

    সমাপ্ত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ১৩৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন