এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০০৬

  • এলোমেলো আশ্বিনের খড়

    সঙ্গীতা ঘোষদস্তিদার
    ইস্পেশাল | পুজো ২০০৬ | ০১ অক্টোবর ২০০৬ | ৬৭০ বার পঠিত
  • স্কুলজীবনে পুজোর সময় বেশি মজা হতো ফাংশান আর তার রিহার্সালে। সারা বছর তার জন্য পথ চেয়ে থাকতাম। সেবার আমার ক্লাস সেভেন। পুজোর ফাংশানের রিহাসালে ওকে প্রথম দেখি। পাড়ায় নতুন এসেছে তখন। আমরা সেক্টর এ,ওরা সেক্টর বি। ও ক্লাস ইলেভেন,শহরের নামকরা মিশনারী স্কুলে। ফাংশানটা সে বছর কেন যেন একটু বেশি জমজমাট। আমরা রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য, ওরা সুকুমার রায়ের ঝালাপালা। আমি বয়কাট, স্কার্ট-টপ, ও চশমা, জিন্স।

    একটা বাড়ির বড় একটা হলঘরে রিহার্সাল হতো।একদিকে আমরা আর ঐ প্রান্তে ওরা।আগে নৃত্যনাট্য।আমি পাঠে আর গানে।হয়ে গেলে বাড়ি চলে যাই,পড়তে বসি।পরে নাটকের মহড়া কোনোদিনই দেখা হয়ে ওঠে না মায়ের ভয়ে।ওরা কিন্তু চলে আসে অনেক আগে।

    আমি তখন মুখচোরা,বাইরে খুব স্মার্ট,ভেতরে রামক্যাবলা।প্রেম-ভালোবাসা বই পড়ে,টিভি দেখে ভালই বুঝি। কিন্তু এসব যে আমার জীবনে কখনও ঘটতে পারে,তা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।ও মা,রোজই দেখি একটা ছেলে,দিব্যি চলনসই ,রিহার্সালে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।বন্ধুদের সাথে কথা বলছে,গল্প করছে,হাসছে,চোখ আমার দিকে।একি জ্বালা!প্রথম প্রথম ভাবছিলাম জামাকাপড়,চুল কোথাও কোন গোলমাল ঘটিয়েছি বোধহয়।কিন্তু রোজরোজ ভুলভাল হবে?আরো আছে।আমাদের তিন-চারটে বাড়ি পরে থাকে যে রনিদা,ও তার ক্লাসমেট।অতএব,কয়েকদিন পরপর বা রোজ আমাদের বাড়ির দিকে চলে এলেই ওকে আটকাবে কে?

    তাহলে?আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না।আমি বিশ্বাস করতে ভয় পাই।একলা থাকার সময় এই সব মনে পড়ে,গা শিরশির করে। তুলির সাথে নিজের তুলনা করি।ওকে পরীর মত দেখতে।কেমন দেখাচ্ছে,সে ব্যাপারেও নজর আছে।চোখের ওপরে একটু ভেসলিন লাগায় একদিন আমার সামনে।সারাক্ষণ চিকচিক করে ওর চোখের পাতা।আমিও লাগালাম একটু বাড়ি এসে,মাকে লুকিয়ে।তুলিকে ছেড়ে কারো কি করে আমাকে ভালো লাগবে?কি সুন্দর নাচে ও হাসিহাসি মুখে,রেশমের মত চুল দুলিয়ে। আর মুখে তো কথার খই ফুটছে।ঠিক কথার ঠিক উত্তর সবসময় তৈরী।আমি তো ছেলে হলে কবে ওর প্রেমে পড়ে যেতাম।

    রনিদা খুব গুডি গুডি ছেলে,মুখের দিকে তাকাতো না আগে।এখন মাঝে মাঝে আমায় দেখে হাসি চাপতে পারে না,'সব জেনে গেছি কিন্তু' গোছের মুচকি হাসে।আমি 'ওর বন্ধুর দিকে আর তাকাবো না,আর তাকাবো না,আর তাকাবো না' জপতে জপতে আবার তাকিয়ে ফেলি আলোজ্বলা চোখদুটোয়।দেখি হাসছে দু চোখ।'ধুত্তোর' বলে একটু আগে আগে চলে যাই তুলির বাড়ি।মুগ্ধ চোখে দেখি ওর তৈরী হওয়া।আস্তে আস্তে আমিও ফিটফাট থাকতে শুরু করেছি।আয়নার সামনে আমার শরীর কি মন্ত্রবলে সুগন্ধি হয়ে যায়।আমি কার ছোঁয়ায় যেন ডানা পাই-তুলিকে ছাড়িয়ে আমার ছায়া বাড়ছে,বাড়ছে।আমি খিলখিল করে হাসছি।আমার কেমন নেশা লেগে যাচ্ছে।চোখে কি মায়া আমার,হাসিতে ম্যাজিক।আমার মতো আর কে আছে?

    আমার বোন তখন ক্লাস টু বোধহয়।ওর খুব ভাব বড়ো ছেলেদের সাথে।ওরা ওর গাল টেপে আর পাকা পাকা কথার জন্য ওকে পিসিমা বলে ডাকে।বোনকে দেখি ওদের সাথে খুব কথা বলে।বাড়িতে ওকে খুব জেরা করি কে কি বলেছে জানার জন্য।একদিন কে যেন আমাকে দিয়ে তুলিকে বলিয়ে নেয় বিকেলে হাঁটতে যাবার কথা,তুলিও রাজী হয়ে গেলো।ছুটির দিন সকালে রিহার্সাল,আর বিকেলে আধঘন্টা হাউসিংএর মুল রাস্তায় যেন অমনযোগে হাঁটা।তখনও তো বার চারেক দেখা হবেই।

    পুজো এসে যায় হৈ হৈ করে।মন খারাপ লাগে।এই প্রথম পুজোয় মন খারাপ লাগা।আসলে দেখতে দেখতে চার দিন চলে যাবে।আর একাদশীতে ফাংশান।সব যেন শেষ হয়ে যাবে।অঞ্জলি দিতে গিয়ে কি চাইলাম মা দুগ্গার কাছে কে জানে!একটু দুরে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যে দাঁড়িয়ে আছে,মন তো তার দিকে।

    ফাংশানের দিন মা একটা সিল্কের শাড়ী পড়িয়ে দিলো।আমায় একদম এয়ারহোস্টেস-এর মতো লাগছিলো।ফাংশান ভালই উৎরে গেলো।তারপর একদিন রাজীবদাদের বাড়ি বিজয়া করতে গিয়ে দেখি সব মুর্তিমানরা হাজির।সেখানেই শুনলাম আমাদের একদিন খাওয়াদাওয়া আর সিনেমা দেখানোর ব্যাবস্থা করেছে ক্লাবের বড়োরা। কি সিনেমা তাই নিয়ে আলোচনা চললো খানিক।আমি ভেবে দেখলাম আমি যে কটা সিনেমার নাম জানি তাতে চুপচাপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।ও বাবা!সে ছেলে দেখি আলোচনায় নেতা হয়ে বসলো।ঝরঝর করে কতো যে ইংরাজী সিনেমার নাম বললো।আর তাতে আমার বুক গর্বে ফুলে উঠলো কেন তাই বা কে বলবে!শেষমেশ নির্ধারিত দিনে গিয়ে দেখি ঝবন ঔভধ,ভালোবাসা ভালোবাসা আর খামোশ ঠিক হয়েছে।কে বেছেছে জানি না অবশ্য।রাজীবদা কিছুতেই খামোশ দেখতে দেবে না।বলে ভয় পাবি।অনেক লড়াইএর পরে দেখতে পেলাম।একটুও কই ভয় পেলাম নাতো।দিব্যি টানটান থ্রিলার।

    সব পুজো শেষ প্রায়।একসাথে রিহার্সাল,ফাংশান,খাওয়াদাওয়া এতো কিছু হলো,কিন্তু আমরা দুটিতে কেবল চোখে চোখে চাওয়া ছাড়া এগোতে পারি কই?

    আবার কালীপুজোয় কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হলো।কালীপুজোয় ছোটো ঝিলে প্রদীপ ভাসানো হবে কলার ভেলায়।সবাই মিলে ক্লাব থেকে প্রদীপ,দেশলাই,মোমবাতি আর কলার ভেলা নিয়ে এলাম।চললো প্রদীপ ভাসানো।ঝিলের জলে শয়ে শয়ে প্রদীপের আলো পড়ে অন্ধকার রাতকে যেন ঝলমলে করে তুললো।তারপর হঠাৎ সে এগিয়ে এলো আমার দিকে।দেখলাম ওর প্রদীপ নিভে গেছে।কিছু বললো না।আমার প্রদীপ থেকে নিজের প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে চলে গেলো।পাশাপাশি কিন্তু বেশ খানিকটা দূরে আমরা একসাথে যে যার প্রদীপ ভাসালাম।ভেসে গেলো প্রদীপ।সাথে নিয়ে আরো অনেক কিছু।একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি প্রদীপদুটোর দিকে।দুজনেই।যেন জীবনমরণ সব কিছু নির্ভর করছে ওদের ওপর।প্রদীপদুটো সমান্তরাল রেখায় চললো খানিক,তারপর একটা প্রদীপ হাওয়ার খুনসুটিতে, ঢেউয়ের দোলায়,কি যেন ছুতোনাতায় অন্যটার থেকে সরে গেলো অনেকটা দূরে,একদম অন্যদিকে।আর কাছে এলো না কিছুতেই।

    সেদিন কি বুঝে যে দু'চোখ ঝাপসা হয়ে এলো,কেন দৌড়ে বাড়ি এসে বাথরুমে কল খুলে খানিক কেঁদে নিলাম আর কি সংস্কারবশত:ই বা একে কোন গুঢ় সংকেত মেনে বাকি সব ভুলে পড়াশোনায় প্রচন্ড মনযোগী হয়ে পড়লাম,তার উত্তর খুঁজি এখনও।অঙ্কটা মেলাতে পারি নি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০০৬ | ৬৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন