আইওয়ার ছোট্ট গাঁ নিউ লিবার্টিতে সকাল হয়েছে। সাড়ে সাতটা বাজে। শীত সবে বিদায় নিয়েছে। মে মাসের শেষদিক। খাতায় কলমে আজ প্রথম বসন্ত - ফার্স্ট ডে অফ স্প্রিং। কিন্তু মিডওয়েস্টের এই গন্ডগ্রামের ওপর ঋতুরাজ এখনো কৃপাদৃষ্টি দেননি। বৃষ্টিভেজা, কনকনে ঠান্ডা সকাল। ভালো করে আলো ফোটেনি।
এ গাঁ চাষীদের গাঁ। খামার বাড়ীর সামনে জটলা করছে তাদেরই কয়েকজন। নীল, ধূসর আর সাদা রঙের স্ট্রাইপ ডেনিম প্যান্ট আর জ্যাকেট। লাল, সবুজ টুপি।
"চাষের কাজ তো এখনো শুরুই করা গেল না। নামেই বসন্ত। মাটি তো জমে বরফ এখনো। কী যে হবে!"
"সেই চৌষট্টি সালে এমনটা দেখেছিলুম। তখন আমি কত ছোট, তাও মনে আছে। কী ঠান্ডা, কী ঠান্ডা! পর পর চার রাত্তির খড়ের গাদায় আগুন জ্বালিয়েছিল বাবা।"
"হ্যাঁ রে জর্জখুড়ো কেমন আছে? খোঁজ নিয়েছিস?"
"অসুখটাই খুড়োকে পেড়ে ফেলেছে। কালকেও কাশছিল খুব। কিন্তু ওষুধ খাবে না।"
"অ্যালিস আন্টির হয়েছে জ্বালা। খুড়োকে নিয়ে নাজেহাল। তার ওপর চাষের কাজ আছে। ঠান্ডা একটু কমলেই তো জমিতে ট্র্যাক্টর দিতে হবে।"
"গতবছরও বুড়োবুড়ি একসঙ্গে ফার্মে কাজ করেছে। ভুট্টা আর জই (ওটস) লাগিয়েছে। আর এবছরেই..."
"অ্যালিস আন্টির সঙ্গে দেখা হলো সেদিন, চার্চে। একাই এসেছে।"
"দু'জনে মিলেই তো যেত এতদিন। আহারে! জর্জখুড়ো বাড়ি বসার লোক নয়।"
জর্জ মিলার সত্যিই বাড়ি বসার লোক নন। ভোরেই ওঠেন। ছোটবেলার অভ্যেস। বাবার আমল থেকে।
আজও উঠেছেন। রান্নাঘরে গিয়ে কফিমেকারে জল চাপিয়েছেন। চারদিকে অন্যমনস্ক চোখ বোলান। নীল-সাদা চেক পর্দা, বাদামী কাঠের সেন্টার আইল্যান্ড। একেই বলে কান্ট্রি চার্ম। তাঁর আর অ্যালিসের ভালোবাসার নীড়।
বাবার আমলে এই রান্নাঘরটাই ছিল পুরো বাড়ি। সে কত্তদিনের কথা। ধোঁয়া ওঠা কফি কাপে ঢালতে ঢালতে জর্জ ভাবেন। তিনি আর অ্যালিস দুজনে মিলে বাড়িয়েছেন। একটা সামার পর্চ, কিচেনে আইল্যান্ড, একটা ওয়াশার-ড্রায়ার। দুজনেই খুব পরিশ্রমী ছিলেন। এখন শরীরের শক্তি কমছে।
আজ কেন কে জানে বড্ড মনে পড়ছে বাবার কথা। জর্জের জন্ম এই নতুন দেশে, আমেরিকায়। কিন্তু বাবা আডল্ফ এসেছিলেন জার্মানি থেকে। অনেকবার সে গল্প করেছেন। চোদ্দ বছর বয়েস তখন। উনিশশো সাল, বিশ শতকের সবে শুরু। দুটি সঙ্গীর সঙ্গে পাড়ি দিলেন আটলান্টিক। লম্বা পথ পাড়ি, জাহাজেই দুই সঙ্গী অসুস্থ হয়ে পড়লো। নিউ ইয়র্কে জাহাজ ভেড়ার পর আডল্ফ আর তাদের কোনোদিন দেখেন নি।
এলিস আইল্যান্ডের ইমিগ্রেশন অফিস আডল্ফকে ট্রেনে তুলে দিল। আইওয়াতে অনেক জার্মান সেটলার। তারাই আডল্ফকে চাষের জমিজমার ব্যবস্থা করে দিলেন। শুরু হলো মিলার বংশধারা। আমেরিকার মাটিতে।
চোখের ওপর ভাসছে সেই থ্যাংক্সগিভিংয়ের ডিনার। এই তো কিছুবছর আগেই। এই রান্নাঘরেই। আডল্ফ এসেছিলেন ছেলের বাড়িতে। পরদিন সকালে সবাই একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট টেবিলে। খানিক পরে মেয়েরা উঠে গেল রান্নাঘরে। বাসন ধুচ্ছে, নিজেদের মধ্যে জার্মানে কথা চলছে। তখনো ডিশওয়াশার আসেনি। সেই বাবার সঙ্গে শেষ সময় কাটানো। তারপর আর কেউ ছিল না যার সঙ্গে জর্জ জার্মান বলতে পারেন। অ্যালিস আইরিশ পরিবারের মেয়ে। ওর পূর্বপুরুষরা এসেছিল আয়ারল্যান্ড থেকে। ইংরেজীই মাতৃভাষা। জার্মান বুঝতো না ও।
অ্যালিস উঠে এসেছেন। কফি নিলেন। তাঁরও পায়ের জোর কমেছে। এখন আর অত খাটতে পারেন না।
"বাবার সঙ্গে শেষ থ্যাংক্সগিভিংয়ের কথা মনে আছে অ্যালিস?"
অ্যালিস জর্জকে বোঝেন। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি একসঙ্গে পথ চলা। কোঁচকানো হাতে হাত রাখেন।
"আমার সঙ্গে তো সেবারই প্রথম দেখা।"
"তা ঠিক। তুমি ক্ষেতে কাজ করতে এসেছিলে, কন্ট্রাক্টে। তখন কী ভয়াবহ মন্দার সময়! এখনো ভাবলে শিউরে উঠি।"
অ্যালিস মাথা রাখেন জর্জের কাঁধে। গ্রেট ডিপ্রেশন দেখেছেন তাঁরা। কী না করতে হয়েছিল সেসময় বেঁচে থাকার জন্যে। হাতে পয়সা নেই। চাষের ক্ষেতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমই সম্বল। সেই দুঃসময়ের পরে পরেই জর্জের সঙ্গে ঘর বাঁধা। ছেলেমেয়ের কাছেও করেছেন এ গল্প। ওরা কি বুঝতে পেরেছে সেই সময়টাকে? কে জানে।
"বাইরে আজও বড্ড ঠান্ডা। এবার বসন্তের চাষের যে কী হবে।" অ্যালিসের গলায় সামান্য দুশ্চিন্তা।
এই সেদিনও হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন। গতবছরেও বুনেছেন আশি একর ভুট্টা, পয়ঁত্রিশ একর জই। আরো পয়ঁত্রিশ একরে শুধুই ঘাস। গরুবাছুরের খাবার।
ট্র্যাক্টর এসে চাষের কাজে বিপ্লব এনে দিল। একরের পরে একর ট্র্যাক্টর চালিয়ে তিনি আর জর্জ চাষের কাজ করেছেন। উর্বর কালো মাটিতে ফসল ফলফলিয়ে বাড়ে। একশো বছর ধরে চাষ করার পরেও এক ফুটেরও বেশি গভীর কালো মাটি। দুজনে মিলে কখনো কখনো দিনে আঠারো ঘন্টা পরিশ্রম করে সে মাটিতে সোনা ফলিয়েছেন। ঘুমের সময়টুকুই শুধু বাদ থাকতো।
এবছর বড্ড মনে পড়ছে ছেলেমেয়েদের কথা। জোয়ানা বড়। উইলিয়াম ছোট। জর্জের খুব ইচ্ছে ছিল ক্ষেতখামারগুলো উইলিয়াম বুঝে নিক, দেখাশোনা করুক। তাঁরা আর কদ্দিন।
কিন্তু উইলিয়াম শহরের টান এড়াতে পারলো না। আইওয়ার ফসলের ক্ষেতে সে স্বচ্ছন্দ হল না। ঘরে ঘরে আজ একই কাহিনী। নতুন প্রজন্ম পাড়ি দিচ্ছে শহরে। শহর এসে গিলে নিচ্ছে গ্রাম। গ্রামীণ আমেরিকা পিছু হটছে। জর্জের পাড়ার হাইস্কুলটা এখন আর এগ্রিকালচার পড়ায় না।
কালও জোয়ানা ফোন করেছিল। বাবার অসুখের কথা শুনেছে। তারপর থেকে রোজই খবর নেয়। মায়ের সঙ্গেই কথা।
কফি শেষ করেও আজ দুজনে ব্রেকফাস্ট টেবিলেই বসে আছেন। গত বছরেও এমনটি ভাবা যেত না।
"জোয়ানা একবার তোমায় দেখতে আসতে চায়।" মৃদু আওয়াজ অ্যালিসের।
বিদ্যুতের আঘাতে জর্জ কি একবার কেঁপে উঠলেন?
"না।"
অ্যালিস নিঃশ্বাস ফেলেন একটা। টেবিল ছেড়ে ওঠেন। পর্চটা অন্যদিন আলোয় ভাসে। আজ মেঘলা। অ্যালিসের বুকের মধ্যে মেঘ ছড়িয়ে যায়। সেই কতবছর হল মেয়েটা চলে গেল। আর এলো না। ভিক্টর ছেলেটা বড্ড ভালো। একই সঙ্গে ওরা কলেজে এগ্রিকালচারে মেজর করেছে। কিন্তু চামড়ার রঙে কত কিছুই যে এসে যায়! ভিক্টরের পূর্বপুরুষ এসেছিলো নাইজেরিয়া থেকে। কালো আফ্রিকান।
জাহাজ-বোঝাই করে ওদের আনা হয়েছিল নতুন এই দেশের দিগন্তজোড়া ক্ষেতে কাজ করতে। ভুট্টার ক্ষেত, তুলোর ক্ষেত। চাষের কাজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। ক্ষেতমালিক কিনে নিলো কালো মানুষ। মানুষ হল দাস। তার জীবনের ওপর অন্যের অধিকার। মানুষ বিক্রি করা চলে, কিনে নেওয়া চলে, কথা না শুনলে তাদের মেরেও ফেলা চলে।
তারপর তো দুশো বছরের একটানা দাসত্বের ইতিহাস। অপেক্ষা, কবে আঙ্কল টম'স কেবিনের চাবুক এসে পড়বে দুনিয়ার যত সুস্থবুদ্ধির মানুষের মুখে। কবে একজন মার্টিন লুথার কিং এসে মুক্তির দরজা খুলবেন।
কিন্তু মুক্তি কাকে বলে? আজ দাসত্ব নেই ঠিকই, কিন্তু সাদা আর কালো চামড়ায় আসমান-জমিন তফাৎ রয়েই গেছে। বিশেষ করে এই মিডওয়েস্টের দিগন্ত-ব্যাপী আলু, ভুট্টা আর ঘাসের ক্ষেতে সাদা আর কালো কখনোই মেলে না। ওরা সমাজে অচল।
তাই জর্জ মেনে নিতে পারলেন না। আজন্ম-লালিত সংস্কার। মেয়ে ওর সঙ্গে কখনোই ভাল থাকতে পারে না। ওদের সমাজ আলাদা, পরিবার আলাদা।
অ্যালিসের এখনো মনে আছে সে দিনটার কথা। জোয়ানা দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। বেশি কথার মেয়ে সে কোনোদিনই নয়। কিন্তু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সে আর ভিক্টর বিয়ে করতে চলেছে।
সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ।
জর্জ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
"তুই, তুই শেষে, একটা কালো ছেলে, ছি ছি ছি। মিলারদের মেয়ে তুই। জানিস না তোর বংশমর্যাদা? এমনভাবে মুখ ডোবালি? আমাদের কোনোকুলে কোত্থাও এমন হয় নি।"
"কোনোদিন হয়নি বলে কি আজও হবে না ড্যাড?"
জর্জ ফেটে পড়েছিলেন, "এখানে নয়, আমার চোখের সামনে নয়। বর্ণসঙ্কর আমি মানি না। দূর হয়ে যাও। নিজের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করতে চাও তো করো। আমার দরজা বন্ধ হয়ে গেল জেনো।"
পড়শীরাও তখন জনে জনে এসে কত কথা বলে গেছে। অ্যালিস চুপ করে থেকেছেন। অযথা শক্তিক্ষয়। জর্জকেও তো তিনি বোঝাতে পারেননি।
জোয়ানা কলেজ থেকে বেরিয়ে চাকরি নিল, অ্যাপার্টমেন্ট নিল। ভিক্টরের সঙ্গে সংসার পাতলো। ওদের মেয়ের ছবি দেখেছেন অ্যালিস। গ্লোরিয়া। চিকন শ্যাম গায়ের রং। একমাথা কালো কোঁকড়া চুল।
জর্জ দেখেননি, দেখতে চাননি। মুখ ফিরিয়ে থেকেছেন। ভয় পেয়েছেন, দেখলেই যদি বুকে নিতে ইচ্ছে করে? যদি ভেঙে যায় এতদিনের বাঁধ?
জোয়ানা চলে যাওয়ার পর উইলিয়ামকে আঁকড়ে ধরেছিলেন জর্জ। খুব আশা ছিল ছেলেটা চাষের জমির দায়িত্ব নেবে, খামার বাড়ি দেখেশুনে রাখবে। হল না।
পর্চের কাচের দেওয়াল ভেদ করে দূরে দেখা যায় চাষের জমি। কুয়াশা জমে আছে মাটির ওপর।
জর্জ টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েন। ড্রেস-আপ করে আজ একবার চার্চে যাবেন। অনেকগুলো রবিবার যেতে পারেন নি।
দিন যায়। জুন মাস এসে গেল। আস্তে আস্তে দিন বাড়ছে। রোদের কুসুম কুসুম উত্তাপে মাটির জমাটবাঁধা বুক নরম হচ্ছে। ট্র্যাক্টর নিয়ে পড়শীরা নেমে পড়েছে যে যার ক্ষেতে। এমনিতেই এবার চাষের কাজ শুরু হচ্ছে দেরিতে। তাই সকলেরই তাড়া। শুধু মিলারদের জমি পড়ে আছে ধু-ধু মাঠ হয়ে। অকর্ষিত।
জর্জের বুকে কফ বসেছে। ডাক্তার বলেছে বেডরেস্ট। যে কোনোদিন নিউমোনিয়া ধরে নিতে পারে। তাঁকে একা বাড়িতে রেখে বেরোনো যায় না। তাই মিলারদের ট্র্যাক্টর শব্দহীন পড়ে থাকে ছাউনিতে।
বিছানা থেকে জর্জ চেয়ে থাকেন তাঁর একরের পর একর সুবিস্তৃত চাষের জমির দিকে। আগাছায় ভরে যাচ্ছে। গলায় অনুযোগ, "তুমি আজকাল আর কোনোদিকেই তাকিয়ে দেখো না।"
চিরকালের শান্তশিষ্ট অ্যালিস হঠাৎ অধৈর্য, "আমিও আর পারি না, আমার কি বয়েস হচ্ছে না? কতদিন আর সবকিছু সামলে রাখবো আমি?"
জর্জের গলা অজান্তেই চড়ে যায়, "চাষের মরশুমে জমিতে চাষ হবে না?"
"কী করে হবে? যারা পারতো, তাদের তো জীবন থেকেই বাদ দিয়ে দিয়েছো।"
"শাট আপ!"
জর্জের মুখে এমন পরুষবাণী কোনোদিন কি শুনেছেন অ্যালিস?
কেঁদে ফেলেন, "আমি চলে যাবো ওদের কাছে। থাকো তুমি তোমার মিথ্যে গায়ের রঙের বিচার নিয়ে। এখনই তো আস্তে আস্তে চাষ করার ক্ষমতা চলে যাচ্ছে। আমরা মরে গেলে কি হবে বলতে পারো ওই বিরাট জমির? এই বাড়িরই বা ভবিষ্যৎ কী?"
জর্জ হাঁপাতে থাকেন, "জাহান্নমে যাক সব। স্টেট এসে নিয়ে নিক, তাও ভাল। আমি মানতে পারবো না, পারবো না।"
উত্তেজনায় অবসন্ন জর্জ শুয়ে পড়েন বিছানায়। সব ভুলে আবার ছুটে আসেন অ্যালিস।
এভাবেই দিন কাটে। চাষের জমিতে মাথা তোলে ঘাস। মিডওয়েস্টের বিখ্যাত ঘাসের জঙ্গল, প্রেইরি। যে জঙ্গল কেটে একদিন নিজের হাতে চাষের জমির পত্তন করেছিলেন আডল্ফ। কালো মাটির উর্বরতায় মানুষসমান ঘাস লকলকিয়ে বাড়ে। জর্জ বড় অসহায় চোখে চেয়ে থাকেন, ছটফট করেন। সহ্য করতে পারেন না। যেন সন্তানের মৃত্যু দেখছেন চোখের সামনে। চাষীর কাছে জমি সন্তানসম।
আজ কয়েকদিন ধরে জর্জ বিশেষ কথা বলছেন না। অ্যালিস উদ্বিগ্ন। তিনি দেখেছেন, মানুষটার চোখে ঘুম নেই। এপাশ ওপাশ করেন। বিছানা থেকে উঠে পাশে রাখা জগের থেকে নিয়ে জল খান।
লিভিং রুমে ফোনের পাশে রাখা ছোট্ট ফোনের ডাইরি। সেখানে গিয়ে কী যেন খোঁজেন। নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ।
সেদিন জোয়ানা ফোন করলো, "মাম ডিড ইউ কল মি?"
"না তো?" অ্যালিস অবাক হন।
"বাড়ির নম্বর থেকে একটা মিসড কল..." জোয়ানা বলতে বলতে থেমে যায়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। জোয়ানা ফোন রেখে দিল।
সেদিন সকালে জর্জকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছেন, কানে এলো ট্র্যাক্টরের আওয়াজ। চোখ পড়লো ক্ষেতের ওপরে। লম্বা ঘাসের জঙ্গল সাফ করছে দুজন। ট্র্যাক্টর চলছে পরিষ্কার ক্ষেতে। ড্রাইভারের সিটে ছ'ফুট দৈর্ঘ্যের ভিক্টর। কালো চামড়ায় আলো ঝলকাচ্ছে। কালো মাটি চিরে চিরে ট্র্যাক্টর বুনছে বীজ।
স্তুম্ভিত অ্যালিসের মুখে কথা ফোটে না। জর্জের দিকে তাকিয়ে কী বলতে যাবেন, মুখে হাত চাপা পড়লো, "ফোনটা করেই ফেললাম শেষে। ভেবে দেখলাম তুমিই ঠিক। সারাজীবন এত ভুল করেছি, সে ভুলের বোঝা আর বাড়াই কেন? বরং যাবার আগে খানিক কমিয়ে যাই।"
অ্যালিস তবুও যেন বিশ্বাস করতে পারেন না, "তুমি..."
"হ্যাঁ, আমিই। তুমি ছিলে না বাড়িতে। কত গল্প হল ভিক্টরের সঙ্গে। কী মায়াবী মন ছেলেটার। নিজে থেকেই বললো ও আর জোয়ানা চাষের জমির সব ভার নেবে। সোনা ফলাবে আবার। ছেলেটা ঠিক জোয়ানার মত পাগল, জানো? সাধে কী আর ওদের অত মিল? আমাদের এই মেয়েটা যে বরাবরই অন্যরকম। প্রকৃতির সঙ্গে ওর শিকড়ের টান। মনে আছে তোমার, ছোটবেলায় জোয়ানা মাটির সঙ্গে, গাছের সঙ্গে কথা বলতো?"
জর্জ সেভাবে কোনোদিনই তাকিয়ে দেখেননি মেয়ের দিকে। আজ কি চোখে অন্য আলো? ফিরে দেখার সময় হল? অ্যালিসের চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। বুকে ক্রস আঁকেন।
নিজের মনেই বলে চলেন জর্জ, "আমি জানি, তোমার সঙ্গে জোয়ানার রোজই কথা হয়। আমার জন্যেই ওরা এ বাড়িতে আসে না। কিন্তু দরকারমতো গ্রোসারি, ওষুধ, ব্যাংকের কাজ - এসব তো ওরাই করে। নাহলে আমরা দুজন বুড়োবুড়ি কী করে বেঁচে থাকতাম বলো?"
অ্যালিসের গলা ধরে আসে, "আমায় বলোনি তো?"
কোঁচকানো মুখে শিশুর মত দুষ্টু হাসি, "জোয়ানাকে বারণ করেছিলাম আমিই, একথা তোমায় যেন না বলে।"
অ্যালিস বোঝেন, এতদিনের বরফ-জমাট মাটি গ্রীষ্মের সূর্যের উত্তাপে গলে গলে যাচ্ছে। বুকে ভালোবাসার বীজ বোনা হয়েছে। এখন চারাগাছের অপেক্ষা, ফসলের অপেক্ষা।
জর্জ বলেন, "গ্লোরিয়া সারাদিনটা আমাদের সঙ্গেই কাটাবে। ওর বাবা মা ব্যস্ত থাকবে ক্ষেতে, চাষের কাজে। কে দেখবে বলো তো ওকে?"
"তা তো সত্যিই।"
"অ্যাপল পাই খেতে বড্ড ভালোবাসে মেয়েটা। আর ম্যাশড পট্যাটো। তুমি তো আবার এসব রান্নায় সিদ্ধহস্ত।"
অ্যালিসের চোখে জল, মুখে এক আশ্চর্য হাসি।
জর্জ লোভীর মতো তাকান। কতদিন পর অ্যালিসের মুখে এই হাসিটা দেখছেন তিনি।
পরম সন্তোষে চোখ বোজেন, "আডল্ফ মিলারের গল্প তো গ্লোরিয়া শোনেনি। পূর্বপুরুষের কথা জানা দরকার। জাৰ্মান ভাষাটাও ওকেই শিখিয়ে দেব। কতদিন হল জার্মানে কথা বলিনি। তুমি তো আর ইহজীবনে ভাষাটা শিখলে না, আমিও আর তোমায় খোশামোদ কচ্ছি না বাপু।”
জর্জের মুখে ফিচেল হাসি। তাল মিলিয়ে বাইরের দিনটাও একপলকেই রোদ-ঝকঝকে হয়ে হেসে ওঠে।
--------------------------
***পনেরোই জানুয়ারি মার্টিন লুথার কিংএর জন্মদিন। তাঁর লড়াই ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’এর পথ ধরেই আমেরিকায় কালো মানুষের সমান অধিকার এসেছিল। এ লেখা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। এটি কাল্পনিক গল্প, বিদেশের পটভূমিকায় আমারই মৌলিক লেখা, কোনো বিদেশী গল্পের ভাবানুবাদ নয়। গল্পটি বাতিঘর অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত।
অসাধারণ!
খুব ভালো লাগলো।
২০২১ শুভ হোক!
খুব ভালো
গল্পটিতে কেমন যেন অনুবাদের আভাস পাওয়া গেল। কোনো প্রচলিত কাহিনীর অনুপ্রেরণাও হতে পারে। যেমন এর আগে পয়েনসেটিয়ার গল্পটির মূল সূত্র অন্তর্জাল থেকে তুলে দিয়েছিলেন এক পাঠক। তেমন হলে সূত্র স্বীকার করা যেতে পারে।
খুব ভালো লাগলো।
@অনিন্দিতা। অনিন্দিতা কে জানাচ্ছি:- এটি অনুবাদ নয়, মৌলিক লেখা। আইওয়া ফার্মিং নিয়ে কিছু তথ্য আছে যেমন জমির মাপ, ফসল ইত্যাদি। সেগুলি সাধারণ জ্ঞান, কিছু ম্যাগাজিন থেকেই পাওয়া। যেহেতু এটি কাল্পনিক গল্প, তাই তথ্যসূত্র দেওয়া নেই।
পয়েনসেটিয়ার গল্পটি মেক্সিকোর উপকথা অবলম্বনে, আমার লেখাতেই বলা ছিল। তাতে আরো একটু কল্পনার রং চড়ানো আছে।
আপনার মতামতের জন্যে ধন্যবাদ।