"চার্লস ডিকেন্সকে আমি গ্রেট বলি, জিনিয়াস নয়।“
বিখ্যাত প্রফেসর ভ্লাদিমির নবোকভ হাত রাখলেন তাঁর সামনে রাখা লেকচার স্ট্যান্ডটির ওপর।
ক্লাসশুদ্ধ সব্বাই মন্ত্রমুগ্ধ। নবোকভ সাহিত্য গুলে খেয়েছেন। কিংবদন্তী অধ্যাপক, লেখক। ‘লোলিটা’ লেখা চলছে সেসময়। যে বই পরে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছবে। নবোকভের ক্লাস কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা মিস করে না। ইউরোপিয়ান ফিকশনের ওপর তাঁর লেকচার শোনা এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
নবোকভ এবার হলভর্তি সারি সারি মাথার দিকে চাইলেন,
"কেন বলো দেখি?"
ঠিক প্রশ্নও যেন নয়। নিজের সঙ্গে নিজেরই কথা। পড়ুয়ারা অপেক্ষায়, নবোকভ নিজেই উত্তর দেবেন। আর সে উত্তর শোনাটাই একটা অসামান্য অভিজ্ঞতা হবে।
কাণ্ড দ্যাখো, ঘরের মধ্যিখান থেকে একটি হাত উঠলো। কিছু বলতে চায়।
"বলো।" প্রফেসর অভয় দিলেন।
মার্টি গিন্সবার্গ উঠে দাঁড়িয়েছে, "’ব্লিক হাউস’ পড়ার পরও আপনি এমনটি বলবেন?"
সারা ক্লাস থ’ হয়ে গেছে। মার্টিকে সবাই চেনে। মার্টিন গিন্সবার্গ। হাসিখুশি,ফুর্তিবাজ ছেলে। চোখেমুখে কথা বলে। সারাক্ষণ সবাইকে হাসিয়ে বেড়াচ্ছে। পড়াশোনার নামগন্ধ নেই, সারাদিন গল্ফ খেলে বেড়ায়। কর্নেলের গল্ফ টিমের সে স্টার প্লেয়ার। সেই মার্টি কিনা নবোকভের মত হিমালয়ের সঙ্গে ডিকেন্স নিয়ে কথা বলছে?
এককোণে চুপ করে বসে আছে ক্লাসের টপার রুথ। রুথ বেডার। রোগা চেহারা, লাজুক, মুখচোরা। ব্রুকলিন থেকে কর্নেলে পড়তে এসেছে, স্কলারশিপ নিয়ে। অসাধারণ মেধাবিনী কিন্তু নিজেকে আড়ালে রাখতে পারলেই বাঁচে।
রুথ মন দিয়ে শুনছে মার্টি আর নবোকভের আদানপ্রদান। হঠাৎ নবোকভ শুধোলেন ডিকেন্সকে নিয়ে এক কূট প্রশ্ন। কী আশ্চর্য, মার্টি উত্তর দিয়ে দিল! নাহ, ছেলেটার মধ্যে তো বস্তু আছে? এতদিন ভাবতো নেহাতই ছ্যাবলা, সারাক্ষণ হাহা আর হিহি।
পাশ থেকে জোয়ানা খোঁচা মারলো, "কী রে, উঠবি না? ক্লাস তো শেষ? কী ভাবছিস কী?"
চমকে ওঠে রুথ। পরের ক্লাসে যেতে হবে।
এর কিছুদিন পরেই একটা ছোট্ট হাতচিঠি এসে রুথের গায়ে পড়লো। মার্টি দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। সেই পরিচিত ছ্যাবলামো।
রেগে গিয়ে চিঠিটা কুচিকুচি করতে গিয়েও থেমে গেল রুথ, মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। নবোকভের সঙ্গে ডিকেন্স আলোচনা। নাঃ, খুলে দেখাই যাক।
ব্লাইন্ড ডেটের প্রস্তাব। মার্টি লিখেছে, "খুব মিষ্টি লাগে তোমায়। জোয়ানা তোমার খুব বন্ধু। ও-ই আমায় বলেছে তোমায় চিঠি পাঠাতে। রাজি হবে তো?"
কী যেন ভাবে রুথ। তারপর ঘাড় নাড়ে। তার জীবনের প্রথম ও একমাত্র ঘাড় নাড়া।
ব্রুকলিনের এক অতি-সাধারণ নিম্নবিত্ত জ্যুইশ পরিবারের মেয়ে সে, নাথান আর সিসিলিয়ার দ্বিতীয় সন্তান। বাবার ছোটোখাটো একটা ব্যবসা। রুথ জন্ম থেকেই দেখেছে তাদের সংসারের বেহাল দশা। বাবার ব্যবসা প্রায় না-চলার মত। খাওয়া জোটে না, শীতের কাপড় নেই, চাকরি নেই, হাতে পয়সা নেই - গোটা আমেরিকা জুড়ে ভয়াবহ মন্দা। দেশের অর্ধেকেরও বেশি ব্যাংক ফেল করেছে। তিরিশের দশকের কুখ্যাত 'গ্রেট ডিপ্রেশন' এর কালো ছায়ার মধ্যে রুথের বেড়ে ওঠা।
মা সিসিলিয়া চাকরি নিল এক কাপড়ের কারখানায়। সেই রোজগারে নিজের ভাইয়ের কলেজ টিউশন জোগাতো মা। নিজে কিন্তু কলেজে গেল না। যদিও মা'র লেখাপড়ার খুব, খুব ইচ্ছে। এসব রুথ চোখের সামনে দেখেছে। কতটা স্বার্থশূন্য হলে এমনটি করা যায়, ভেবে অবাক হয়েছে।
সেটা বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। আমেরিকায় মেয়েদের জীবন ঘরেই আবর্তিত। রান্না করা, ছেলেমেয়ে সামলানো, সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি। তারপরেও নিজেকে ফিটফাট রেখে পরিবারের পুরুষটিকে একটি সুন্দর সন্ধ্যা উপহার দেওয়া। মেয়েদের লেখাপড়া বেশিদূর এগোয় না, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। । ভালো একটা বিয়ে হওয়াই তাদের স্বপ্ন।
কিন্তু সিসিলিয়া অন্য ধাতুতে গড়া। মার কাছেই রুথের পড়াশোনার দীক্ষা। নিজে কলেজে যেতে পারেনি মা, কিন্তু মেয়ের কানে অবিরত মন্ত্র দিয়ে গেছে - পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে।
সে কথা রুথ কখনো ভোলেনি। হাইস্কুলে মন দিয়ে পড়াশোনা করতো সে, ক্লাসের সেরা মেয়ে।
বাড়ির কেউই কলেজে যায় নি। রুথই প্রথম হাইস্কুল পেরিয়ে কলেজে গেল। স্কলারশিপ নিয়ে, নাহলে খরচ দেবে কে? স্কলারশিপ না পেলে লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্তু মা-ও তো রইলো না বেশিদিন? ক্যান্সারে ভুগতে ভুগতে মা চলে গেল। রুথের হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশনের ঠিক আগের দিন। সেদিন বিকেলে সেমেটারি থেকে ফিরে রুথ অনেকক্ষণ একলা বসে ছিল ইস্ট রিভারের ধারে। মনে বেজে যাচ্ছে মা-র বলা কথাগুলো। "নিজের পায়ে দাঁড়ানো খুব দরকার কিকি।"
রুথ, মা-র আদরের কিকি ফুঁপিয়ে উঠলো। আজ সব বাঁধ ভেঙে গেল কেন কে জানে।
মার্টি রুথের পিঠের ওপর আলতো হাত রাখলো। চুপচাপ শুনছিলো সে এতক্ষণ। এই লাজুক কথা-বলতে-না-চাওয়া মেয়েটার ভেতরে এতো কান্না জমে আছে?
"আমি আছি কিকি, তোমার সব যন্ত্রণা ভাগ করে নেবো। ।“
“আমার লড়াইটা যে খুব কঠিন, আমি মেয়ে, তার ওপর আমরা জ্যু। স্কুলে সবাই আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতো, ফিসফাস করতো নিজেদের মধ্যে। কতবার আমায় বুলি করেছে, জানো?” উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকে রুথ।
“তোমার নিজের শক্তিতেই সব বাধা তুমি পেরিয়ে যাবে। আমি পাশে থাকবো, চিরকাল। যদি অনুমতি দাও।"
"তুমি আমায় ডিকেন্স পড়ে শুনিয়ো, আমি তোমায় তলস্তয় শোনাবো।" রুথের চোখে জল কিন্তু মুখে হাসি।
উনিশশো চুয়ান্ন সালে কর্নেল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলো রুথ বেডার আর মার্টিন গিন্সবার্গ। রুথই ক্লাসের সেরা, টপার। মার্টি স্বভাবসিদ্ধ ছ্যাবলামিতে বলে বলে বেড়ালো, "আরে আমি নেহাত দয়া করে রুথকে টপ পজিশনটা ছেড়ে দিলাম তাই, নাহলে আমি থাকতে ওর সাধ্যি ছিল ফার্স্ট হবার?"
রুথ রেগে গিয়ে ঘুঁষি দেখায়।
এর কয়েকদিন বাদেই গোটা কর্নেল ইউনিভার্সিটি বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে দেখলো তাদের বিয়ে। রুথ হল রুথ বেডার গিন্সবার্গ। একদিন যে নাম আমেরিকা তথা গোটা দুনিয়ায় কিংবদন্তী হয়ে যাবে। রক্ষণশীল আমেরিকায়, মেয়েদের এক-চুল-জায়গা-না-ছাড়া আমেরিকায় ছিনিয়ে নেবে প্রতিষ্ঠা। পুরুষপ্রধান আইনের পেশায় একের পর এক সাফল্যের পালক গুঁজবে নিজের ছোট্ট বান-খোঁপাটিতে। সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় মহিলা জাজ। বেঞ্চে দীর্ঘ সাতাশ বছর ধরে একের পর এক ঐতিহাসিক রায়। বেতনবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে, মানুষের সমান অধিকারকে মর্যাদা দিয়ে। রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব মীমাংসা। রক্ষণশীলতার আগল ভেঙে দিয়ে সে সারা দেশের উদারচেতা মানুষের নয়নের মণি হবে। লড়াকু রুথ বেডার গিন্সবার্গ - The Notorious RBG.
বিয়ের পর মার্টি কানে কানে বলেছিল কী দেখে সে প্রেমে পড়েছিল। মেধা, বুদ্ধিবৃত্তি। অনন্যা মেয়েটির প্রতি তার ভালোবাসায় মিশে আছে শ্রদ্ধা। রুথ তো লজ্জায় লাল। ইস, কী যে বলে মার্টি!
অনেক পরে রুথ বেডার গিন্সবার্গ মিডিয়াকে বলেছিলেন, “মার্টিই আমার জীবনের একমাত্র পুরুষ যে আমার মাথার মধ্যে থাকা ধূসর বস্তুটির কদর করেছিল।“ “He was the only boy I ever knew.…who cared that I had a brain.”
ফোর্ট সিল, ওকলাহোমায় সংসার পাতলো দুজনে। দিনকয়েকের মধ্যেই মার্টির উপলব্ধি, "এঃ, তোমার রান্না তো মুখে দেওয়া যাচ্ছেনা গো কিকি। কী খারাপ রান্না! সরো দেখি তুমি, আমি রাঁধছি।"
এবং দেখা গেল মার্টির রান্নার হাতটি সত্যিই ভালো। অতঃপর সেই নিয়মই চালু হল। রান্নাঘর বরাবরই মার্টির দায়িত্বে। মার্টি নিত্য নতুন খাবারদাবার বানাতে ভালোবাসে, রান্না করাটা তার নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা তাদের বাবার রান্নার ভক্ত। একসময় তাদের মা-কে রান্নাঘর থেকে চিরস্থায়ী নির্বাসন দিয়ে দিল। মায়ের নয়, বাবার রান্নাঘর - রক্ষণশীল, পিতৃতান্ত্রিক আমেরিকান সমাজে যা অকল্পনীয়। আজও কি আমরা ভাবতে পারি?
তবে এ সব তো পরের কথা। তারও আগে হারভার্ড ল' স্কুল। দুজনে ঠিক করেছিল যে পেশাই তারা বেছে নিক না কেন, দুজনে একসঙ্গে কাজ করবে। তাই ল' স্কুলে ভর্তি হওয়া। তখন প্রথম সন্তানটি সবে এসেছে। জেন। দু'মাস বয়েস। রুথ ঠিক করলো সে শুরু করবে পরের বছর। জেন তখন একটু বড়ও হয়ে যাবে। বাচ্চা সামলে সে ঠিক পড়াশুনো চালিয়ে নেবে।
কিন্তু আসল সমস্যা হলো সে মেয়ে। মেয়েরা আবার আইন নিয়ে পড়বে কী? অতএব হার্ভার্ড ল-স্কুলে সে মাইনরিটি। পাঁচশজনেরও বেশি পুরুষের সঙ্গে ক্লাস করে তারা নয়টি মেয়ে। ক্লাসে প্রফেসর করুণার চোখে তাকান। সহপাঠীরা বিরক্তিভরা নয়নে তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু ক্লাসে আবার রুথ-ই টপার। প্রতিটি পরীক্ষায় অনায়াসে শীর্ষস্থান। চোখধাঁধানো রেজাল্ট, হীরক-খচিত গ্রেডকার্ড। এবং হার্ভার্ড ল রিভিউ-তে সম্মানের আসন।
এমন একজন উজ্জ্বল মেয়ে ক্লাসে থাকলে প্রফেসরদের অস্বস্তি বাড়ে। গেলাও যায় না আবার ফেলাও যায় না যে! এরপরেও রাগ হবে না? কোথাকার একটা রোগাপ্যাংলা জ্যুইশ মেয়ে এসে পুরুষজাতকে দশ-গোল দিয়ে যাচ্ছে?
এ হলো সেই সময়ের কথা যখন মেয়ে হয়ে ল' স্কুলে পড়তে গেলে ছেলেদের থেকে তিনগুণ ভালো হতে হ’ত। রুথের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। অনায়াসে সে পরীক্ষায় সবাইকে টপকে যায়।
বেশ চলছিল সব। কিন্তু অলক্ষ্যে কেউ বোধহয় হাসলেন। মার্টি-র ক্যান্সার ধরা পড়লো।
সে রাতে বহু বহু বছর পর মা এলো স্বপ্নে। দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভোগা মা। শরীরটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। যে মাকে জড়িয়ে তার বেড়ে ওঠা। যে মা তার কানে অনবরত স্বাবলম্বী হবার মন্ত্র দিয়ে গেছে।
চমকে জেগে ওঠে রুথ। স্বাবলম্বী কথাটার মানে কী? নিজের পায়ে দাঁড়ানো। ঠিকই তো, নিজের পায়েই দাঁড়িয়ে থেকে অন্যের অবলম্বন হতে হবে তাকে। কোথ্থেকে এক বিপুল শক্তির জোয়ার আসে। ছোটোখাটো মেয়েটার দিন চলে এক নতুন ছন্দে। মার্টি-র চিকিৎসা চলছে - সার্জারি, রেডিয়েশন। ডাক্তার আশাবাদী। সেও আশায় বুক বাঁধে। ছোট্ট জেনকে দেখাশোনা, নিজের ক্লাস, আর তার সঙ্গে মার্টির নোটসগুলোও টাইপ করে রাখা - সবই একা হাসিমুখে সামলায়।।
দৈনন্দিন রুটিনে ঘুম বাদ। সময় কোথায়? মার্টিকে খাওয়াতে হয় বেশি রাতে। দিনের বেলায় মার্টি যায় রেডিয়েশন নিতে। ফিরে আসে যখন, তার মুখের দিকে তাকানো যায় না। এতটাই অসুস্থ। মাঝরাত পর্যন্ত ঘুমোয় মার্টি। তার দিনের খাবার একমাত্র সময় হলো রাত বারোটা থেকে একটা। খাওয়া শেষ হলে মার্টি তার সিনিয়র ক্লাস পেপারের ডিকটেশন দেয়। রুথ টাইপ করে। মার্টি ঘুমোতে গেলে তারপর সে নিজের বইগুলো তাক থেকে নামায়। পরেরদিনের ক্লাসের প্রস্তুতি। দিনের পর দিন চলে রুথের অমানুষিক পরিশ্রম।
লড়াইয়ে অবশেষে জিত। মার্টি সেরে উঠেছে। হারভার্ডে তার পড়াশোনা শেষ। কিন্তু রুথের ডিগ্রি তখনো বাকি। হাৰ্ভাৰ্ড তাকে আইনের ডিগ্রি দেবে না। যদিও এই হাৰ্ভাৰ্ডই পরে তাকে সাম্মানিক ডিগ্রি দিয়ে ধন্য হবে। র্যাডক্লিফ মেডেল দেবে সমাজকে পাল্টে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা।
মার্টি সহজেই নিউ ইয়র্কে একটা ল' ফার্মে চাকরি পেল। রুথ এলো তার সঙ্গে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ডিগ্রি শেষ করলো। আবার সম্মানের আসন - এবার কলম্বিয়া ল রিভিউ-তে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রুথ-ই প্রথম দু-দুটো ল' রিভিউতে জায়গা করে নিয়েছিল।
কিন্তু যতই ভালো রেজাল্ট হোক না কেন, রুথ মেয়ে। কোনো ল' ফার্ম তাকে নেবে না। ভাবটা এই – ‘ল' ফার্মের মতো সিরিয়াস কাজে মেয়ে? হুঁহ, বাচ্চাকাচ্চা, সংসার নিয়েই ওদের সময় যাবে।’
বারোটা ল' ফার্মে সে ইন্টারভিউ দিয়েছিল। কেউ তাকে নেয় নি। রুথ বেডার গিন্সবার্গ, ল' স্কুলের টপার, দু-দুটো অভিজাত কলেজের ল' রিভিউতে অনায়াসে জায়গা করে নিয়ে যে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে রেকর্ড গড়ে ফেলেছে - ল' ফার্মে তার চাকরি জুটলো না।
হার্ভার্ডের প্রফেসর রেকমেন্ড করে দিলেন সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস ফ্রাঙ্কফুর্টারএর কাছে।
"ও বাবা, আমার চেম্বারে মহিলা?" ফ্রাঙ্কফুর্টার অস্বস্তিতে পিছিয়ে গেলেন।
ততদিনে রুথ লড়তে অভ্যস্ত। শুধু মেয়ে বলেই সবকিছু লড়েই ছিনিয়ে নিতে হবে। এই তো জীবন।
শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। মার্টি উৎসাহ দিল, "শিক্ষক হিসেবেও তুমি সেরা হবে। আইনের কত জ্ঞান তোমার! ছাত্রছাত্রীদের সৌভাগ্য তোমার মত একজন শিক্ষক পাবে।"
বহু বছর পর চাকরি খোঁজার গল্প করতে গিয়ে রুথ বলেছিলো, "আমার তিন-তিনটে ডিসকোয়ালিফিকেশন ছিল। এক - আমি মেয়ে, দুই - আমি জ্যুইশ, তিন - আমি মা, আমার একটা বাচ্চা মেয়ে আছে। কোনো ল' ফার্ম আমায় চাকরি দেয় নি।"
শুধু মার্টি সবসময় পাশে থেকেছে। উৎসাহ জুগিয়েছে, ভেঙে পড়তে দেয় নি।
সংসারে তারা একে অন্যের পরিপূরক। মার্টি যখন নিউ ইয়র্কের ল' ফার্মের পার্টনার হবার চেষ্টা করছে, রুথ বাড়ি সামলাচ্ছে। আবার রুথ যখন গুরুত্বপূর্ণ ACLU Women's Rights Project শুরু করলো, তখন মার্টিই সংসার দেখছে। সানন্দে সে ঘরের কাজ করছে, বাচ্চাদের সব দায়িত্ব নিচ্ছে, রুথকে এগিয়ে দিচ্ছে তার কর্মক্ষেত্রে। আজকের যুগেও মনে হয় এ যেন রূপকথার গল্প। মেয়েদের ঘরে-বাইরে কাজ, এটাই তো নিয়ম। যতই গুরুত্বপূর্ণ পেশায় থাকো না কেন, তুমি মেয়ে, সংসার তো সামলাতেই হবে! মার্টি গিন্সবার্গ দেখিয়েছিল, সত্যিকারের দায়িত্ব ভাগ করা কাকে বলে।
দীর্ঘ আইনের পেশায় দুজনেরই মাথায় কৃতিত্বের পালক, তবে রুথের পালকের সংখ্যা বেশি। মার্টি তা নিয়ে বন্ধুবান্ধব-পরিচিত মহলে গর্ব করে বেড়ায়।
উনিশশো আশিতে রুথ রাজধানীর ফেডারেল কোর্ট অফ আপিলে জাজ হল। তার দশ বছর পর রুথের নাম উঠে এলো সুপ্রিম কোর্টের জাজ হিসেবে। মার্টি দিনরাত এক করে ক্যাম্পেন করলো। তার সুফলও ফললো। সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় মহিলা বিচারপতি নির্বাচিত হল রুথ বেডার গিন্সবার্গ। ইতিহাস বলে, আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টের পুরুষশাসিত অচলায়তন এখনো পর্যন্ত মোটে চারজন মেয়ে ভাঙতে পেরেছেন। রুথ তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র।
সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় মহিলা বিচারপতিটি এরপর ইতিহাস গড়ে ফেললো। এলো এক রূপকথার সময়। দীর্ঘ সাতাশ বছর সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চে অত্যুজ্জ্বল রুথ বেডার গিন্সবার্গ। সে নিজে বরাবর বৈষম্যের শিকার। কিন্তু সবসময় ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনাসামনি লড়েছে। বৈষম্যকে হার মানিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে নিজের প্রাপ্য। লক্ষকোটি মানুষের সে প্রেরণা।
রুথের নিজের ভাষায়, "লোকে দেখুক সুপ্রিম কোর্ট শুধু পুরুষদের জায়গা নয়। এই যে, এই মেয়েটা সেখানে জাঁকিয়ে বসে আছে। ”
তরুণ-তরুণীদের রোল মডেল সে। তার কালো ফ্রেমের চশমা, ছোট্ট বান খোঁপা আর লেসের কলারওলা জ্যাকেটে সে জনপ্রিয় ফ্যাশন আইকন। রুথ বেডার গিন্সবার্গ। ভোটাধিকার নিয়ে তার জ্বালাময়ী ওপিনিয়ন বিখ্যাত হয়ে গেল সারা দেশে। লোকে আদর করে নাম দিলো, "The Notorious R.B.G." সত্যিই তো, কখনোই চুপ থাকে না সে। তাকে notorious বলবে না তো বলবে কাকে?
দীর্ঘ ছাপ্পান্ন বছরের সঙ্গী মার্টিকে একসময় বিদায় দিতে হল। ক্যান্সার হাসপাতালে যাবার আগে মার্টি ছোট্ট একটা চিঠি লিখেছিল। "রুথ, তোমাকেই সারাজীবন সবটুকু ভালোবেসেছি। সেই যেদিন কর্নেলে তোমায় দেখেছিলাম, সেদিন থেকেই। একটুখানি ভালোবাসা শুধু রেখেছি বাকীদের জন্যে।"
“My dearest Ruth, you are the only person I have loved in my life. Setting aside a bit parents and kids, and their kids. And I have admired and loved you almost since the day we met at Cornell some 56 years ago."
দুহাজার দশ সালের এক সকালে হাসপাতাল থেকে মার্টিকে ছেড়ে দিল। তাদের আর কিছু করার নেই। জিনিসপত্র গুছিয়ে রুথ তাকে বাড়িতে নিয়ে এল। তার প্রিন্স চার্মিং। রুথ তার জীবনে এই একটি পুরুষেরই প্রেমে পড়েছিল যে বহিরঙ্গের চেহারা ছাড়িয়ে তার মননের কাছে পৌঁছেছিল।
আর চিরকালের ফাজিল মার্টি তার বন্ধুদের কাছে বরাবর বলে বেড়িয়েছে, "আমাদের এতোবছরের বিয়ের সিক্রেটটা কী জানো? কিকি আমায় কক্ষণো রান্নাঘর নিয়ে উপদেশ দেয়নি । আর আমি ওকে কক্ষণো আইন নিয়ে উপদেশ দিইনি।"
একেই তো বলে রূপকথার দাম্পত্য!
ছাপ্পান্ন বছরের বিবাহবার্ষিকীতে সুন্দর করে টেবিল সাজালো রুথ। মার্টিকে ভরে দিল ভালোবাসায়। তার চারদিন পর মার্টি চলে গেল। পরের দিন রুথ সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চে হাজির, একটা ওপিনিয়ন পড়বার জন্যে। লোকের প্রশ্নের উত্তরে একটাই জবাব, "মার্টি এমনটাই চেয়েছিল।"
ক্যান্সারে জর্জরিত রুথ নিজেও চলে গেলেন এই সেদিন, সেপ্টেম্বরের আঠেরো তারিখে। এক সন্ধ্যায় খবরটা শুনে কেঁদে উঠল সারা দুনিয়া।
মার্টি গিন্সবার্গ না থাকলেও আমেরিকা নিশ্চয়ই কর্মক্ষেত্রে RBGকে পেত, কিন্তু রুথ পেতেন না তাঁর রূপকথা-সম সংসারটি। ঘরে-বাইরে এমন পরিপূর্ণ হত না তাঁর জীবন। মার্টি নিজেকে গর্বের সঙ্গে ফেমিনিস্ট বলতেন। শুধু বলাই নয়, কাজেও করে দেখিয়েছেন। চিরকাল রুথের পাশে হেঁটেছেন, ভাগ করে নিয়েছেন দায়িত্ব। ভালোবাসায় ভরে রেখেছেন তাঁর প্রথম ও একমাত্র প্রেমকে।
রুথ বেডার গিন্সবার্গের সময় থেকে মেয়েরা বহু পথ পেরিয়েছে। আজকের যুগে তারা কী না করছে, সম্ভব-অসম্ভব সবরকমের পেশায় তারা চূড়ান্ত সফল। তাদের লড়াইটা বরাবরই শক্ত। কেউ এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়ে না। সে লড়াই নিজেকেই লড়তে হয়। রুথও তাই লড়েছিলেন। কিন্তু ঘরে ফেরার পর তাঁর সবকিছু ভাগ করে নেওয়ার জন্যে একজন মার্টি গিন্সবার্গ অপেক্ষা করতেন। সার্থক হয়ে উঠতো সব সাফল্য, জুড়িয়ে যেত সব ব্যর্থতা। ক'টা মেয়ের এমন সৌভাগ্য হয়?
"দুনিয়ার প্রত্যেকটি মেয়ে যেন তার মার্টি গিন্সবার্গকে খুঁজে পায়।" রুথেরই কথা। "May every woman find her Marty Ginsburg."
আমরাও তো তাই বলি, 'রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা,এমন কেন সত্যি হয় না আহা!' সব মেয়ের জীবন এমন ভালোবাসার পরশ পেয়ে ধন্য হোক।
-----------------------------------------
**In memory of Ruth Bader Ginsburg, the pioneer of gender equlaity, who passed away on Sep 18, 2020.
**'গুটিপোকার সুতো' সাহিত্য সংখ্যায় প্রকাশিত।
'The Notorious R.B.G'
- খুবই ভাল লাগল এই লেখা