রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি আমাদের সময়কার একজন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক ব’লে মনে করি। এর কারণ একাধিক, অল্প জায়গার মধ্যে বোঝানো দুষ্কর, অন্তত আমার মতো অপটু রসিকের পক্ষে। নিজের সুবিধের জন্যে শুরু করি সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রসঙ্গ দিয়ে। সতীনাথ যে বাংলা সাহিত্যের একজন বড়ো লেখক ছিলেন, সে বিষয়ে আজ বাঙালির সন্দেহ কম। সতীনাথ ছিলেন কংগ্রেস কর্মী, রাঘব ছিলেন মার্কসবাদী। অন্তত উত্তর-মার্কসবাদী তো বটেই। রাজনৈতিক বর্গ দিয়ে রাঘবের সাহিত্যবিচার সম্ভব নয়—কমলকুমার মজুমদারের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং মহাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে তাঁর সংশয় তেমন সাক্ষ্যই দিচ্ছে। রাজনৈতিক গোষ্ঠীপরিচয়ের কথা হচ্ছে না, অনচ্ছ গদ্যের প্রবণতার কথা হচ্ছে। ‘আন্ধাইর রাত কাটে। চাকা চাকা করে। রাতের বুদ্বুদ ফাটিয়ে বেলেঘাটায় ভোর আসে ইনফর্মারের ছোঁকছোঁক চোখ ষড়যন্ত্রের আদিম অন্ধকার বুকের মধ্যে ছিপিয়ে।’ কমলকুমার যদি ভাষাতে অপরিচয়ের ব্যবধান সৃষ্টির এক দৃষ্টান্ত হ’ন, সতীনাথ রাজনৈতিক উপন্যাসের বহুস্বর সৃষ্টির এক দৃষ্টান্ত। সুতরাং রাঘবের কথা বলতে বসে অল্প হ’লেও সতীনাথের আলোচনা অবান্তর হবে না ব’লেই মনে হয়।
গত শতাব্দীর চারের দশকের থেকে আটের দশক পর্যন্ত এপার-বাংলায় যে-কয়েকটি মহৎ রাজনৈতিক উপন্যাস লেখা হয়েছে তাদের মধ্যে অসীম গুরুত্বের দুটি বই হ’ল সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ এবং রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কমুনিস’। ‘জাগরী’ ছিল সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম উপন্যাস, আর ‘কমুনিস’ রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘জাগরী’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে, স্বাধীনতার এক বছর আগে, এবং তার কাহিনির নেপথ্যে ছিল চার বছর আগেকার বিয়াল্লিশের সহিংস স্বাধীনতার লড়াই। ‘কমুনিস’ প্রথম বেরোয় ১৯৭৫ সালে, জরুরি অবস্থার জারির বছরটিতে, নকশালপন্থী শহর-গেরিলা হিসেবে লেখকের গ্রেফতারের পাঁচ বছর পরে, এবং তিন বছর জেল খাটার অন্তে। কারাগারে কংগ্রেস কর্মী সতীনাথকেও যেতে হয়েছিল—ভাগলপুর জেলে তাঁকে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে প্রায় চার বছর কাটাতে হয় দু-দফায়। ‘জাগরী’র ঘটনাকাল কারাগারে চরম প্রতীক্ষার একটি রাত। কিন্তু স্মৃতির প্রতিসরণ এবং চার মুখ্য চরিত্রের স্বগতচিন্তা বিস্তৃত করে তোলে তার আখ্যানপট, ব্যাপ্ত স্থানকালে বিচরণ করে কাহিনি। ‘কমুনিস’ সংকীর্ণ বিচারে কারাজীবন-কেন্দ্রিক নয়, যদিও সেখানেও ফাঁড়ি ও জেলখানার উপস্থিতি বিনিদ্র প্রহরায় নিয়োজিত রাষ্ট্রব্যবস্থার মতোই সর্বত্র সদাপ্রবিষ্ট। দুটি উপন্যাস জুড়ে রয়েছে লেখকের নিজ নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা। গূঢ়তর মিল কিন্তু আছে অন্য জায়গায়। দুটি কাহিনিতেই স্মৃতি ও অন্তর্গত স্বগতকথনের মধ্যে রয়েছে চেতনাপ্রবাহের বাহ্য নির্মাণের চাইতেও আরও অস্বস্তিকর কিছু। ভাষার বিক্ষেপের মধ্যে ধরা আছে সেই অস্বস্তি। অস্বস্তি কথক বা বিপন্ন দিশেহারা চরিত্রগুলির যত না, তার চাইতে ঢের বেশি প্রতিটি উদ্দিষ্ট তথা নিরুদ্দিষ্ট পাঠকের। এমন বিক্ষত, কখনও-বা বিমূঢ়, পাঠ-অভিজ্ঞতা ও আত্মদীর্ণ জিজ্ঞাসা হল খাঁটি রাজনৈতিক উপন্যাসের জন্মদাগ—এ কথা বলা সাহিত্যবিচারের অবসন্ন শব্দগুচ্ছের অলস প্রয়োগ। যে কথা রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ ও ‘চার অধ্যায়’ সম্পর্কে খাটে, আবার তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা’ কিংবা সতীনাথের ‘জাগরী’ সম্পর্কে সমান প্রাসঙ্গিক, যে কথা দীপেন্দ্রনাথের ‘শোকমিছিল’ কিংবা সমরেশের ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ সম্পর্কে বলা চলে, আবার শৈবাল মিত্রের ‘অগ্রবাহিনী’ কিংবা নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ উপন্যাসের ক্ষেত্রে অবান্তর নয়, সে কথা বলা নিরর্থক, হয়তো-বা অস্বস্তিটি এড়ানোর ফিকির। মননের এমন জড়তা প্রতিহত করাই নির্মম রাজনৈতিক উপন্যাসের স্বধর্ম। সপ্রশ্ন পাঠক সেখানে যুক্তি-প্রতিযুক্তির আগে থাকতে তৈরি কোনও উত্তর পান না, পান না সহজ সমন্বয়ের আরাম। রাজনৈতিক উপন্যাস, নৈতিক প্রতর্কের আলোচনার মতোই, খাড়া করে এক দুস্তর ভাষার বাধা, সুগম অর্থোদ্ধারের পথে এক কাঁটাতার। চেনা শত্রুকে চেনা ছকে শায়েস্তা করার কাহিনি চেনা ভাষায় পড়ে যাঁরা সুখ পান, মতাদর্শকে পালাবার সুড়ঙ্গ হিসেবে যাঁরা ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, নিজের বিভ্রান্তির দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকতে স্লোগানসর্বস্ব গল্পের আশ্রয় খোঁজেন যাঁরা, সতীনাথ ভাদুড়ী ও রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় পড়তে তাঁদের আগ্রহ হওয়ার কথা নয়।
সতীনাথের গল্পে দুই ভাইয়ের গল্পে একজন ফাঁসির সাজার জন্যে প্রহর গুনতে থাকা কংগ্রেসের সমাজবাদী অংশের কর্মী, অন্যজন মার্কসবাদী, এবং একই জেলে বন্দি তাদের বাবা নির্ভেজাল গান্ধিবাদী। সতীনাথ নিজেও কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন সোশালিস্ট পার্টিতে ১৯৪৮ সালে, ‘জাগরী’ বেরোবার বছর তিনেক পরে। সংশয় রয়েছে ‘কমুনিস’ উপন্যাসের রাজনৈতিক পন্থা নিয়েও। উত্তর পান না পান, প্রশ্নগুলি আদতে প্রাঞ্জল আকারে যুবক গেরিলাদের রাগী অবিন্যস্ত চেতনায় স্পষ্টভাবে প্রকট হোক না হোক, রাঘবের উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র গোরা নিরন্তর সংশয়ে বিদ্ধ হয়েছে নকশালপন্থী আন্দোলনে খতম-পন্থার নেতাদের প্রভুত্ববাদ ও অপরিণামদর্শিতার নমুনা দেখে, মজুরদের আন্দোলনের রণকৌশলের সঙ্গে শহর-গেরিলাদের শ্রেণিসন্ত্রাসের গরমিল লক্ষ করে, তার রোজকার মাশুলের খুনে সাক্ষ্যে। ‘জাগরী’ চারজন এক পরিবারের কারা-কাহিনি: তাদের প্রত্যেকের পথ আলাদা, বিশ্বাস আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন, অথচ একই শ্রেণি ও সামাজিক পটভূমি তাদের দুঃসহ এক দূরত্বে বেঁধে রাখে, একই উদ্যানের নিঃসঙ্গ বৃক্ষরাজির মতো। রাঘবের উপন্যাসে মুখ্য চরিত্র গোরা বেলেঘাটার বস্তিতে আলাদা আলাদা জাতের, আলাদা আলাদা ভাষার, কর্মী ও মজুরদের মধ্যে এক শ্রেণিগত সংহতির প্রতিশ্রুতি দেখতে পায়, তাদের সুখেদুঃখে তার নিজের কমুনিস্ট শরিকি অধিকার খোঁজে এক ন্যায়ভিত্তিক সমাজের যৌথ স্বপ্নের মধ্যে। বেলেঘাটার বস্তি আর কারখানার সর্পিল গলিঘুঁজি এই জায়মান সামাজিক শরীরের ঐক্যের ছবি হয়ে ওঠে রাঘবের দেহঘন বাংলা-ভোজপুরী-ওড়িয়া মিশ্র বুলিতে, টাঙ্গি-আঁকড়ার মতো নিপীড়নের অমার্জিত হাতিয়ারের মতো শব্দ ঠেলে তাঁর গদ্য পাঁক আর রেললাইন ধরে ফেরারি আততায়ীর পায়ে-পায়ে হোঁচট খেতে খেতে এগোতে থাকে। লোহার গরাদ, তালা, ঘড়ি, চরকা, যুদ্ধের বাজারে জেলের যৎসামান্য তেল ও তৈজসপত্র, রাজনৈতিক শিবির অনুযায়ী কয়েদিদের ছোটো দল-উপদলের মার্কা—এগুলি ‘জাগরী’ উপন্যাসের এক-একটি প্রতীকী ফলক। ‘কমুনিস’-এ সেসবের জায়গা নেয় বেলেঘাটা-তপসিয়ার কারখানার সামনের পোস্টে ঝুলতে থাকা মলিন ঝান্ডা, ওয়ালিং-এর ‘টেনসিল’, মজুরদের ঝুপড়িতে বেহায়া রসুই-গোসল, কলকাতার জঞ্জালের শেষ ঠিকানা ধাপাপট্টি আর বেলেঘাটার পচাখাল, ছাল-ওঠা রাস্তার ওপর খড়ি-ওঠা পায়ের চোরাপথে হেঁটে চলার শব্দ, রেললাইন, মালগাড়ি, পুলিশ ভ্যানের হেডলাইট আর ব্রেকের শাসানি, আক্রান্তের পকেটে অসহায় ‘ওয়ান-শটার’, গেরিলা আস্তানায় অন্ধকারে জ্বলতে থাকা বিড়ি, মোমবাতি, জোড়া-জোড়া বিনিদ্র চোখ।
সংঘের শৃঙ্খলা আর কমরেডদের স্মৃতি-স্বপ্নের প্রতি দুর্মর ভালোবাসা—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে গোরার চিত্তবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তির মধ্যে পদে পদে লাগে সংঘাত। পুলিশের বুটের সদম্ভ লাথ খেয়ে আর ছ-ঘরার ‘ক্যাপসুল’ বুকে নিয়ে নির্ভীক কমরেডের মৃত্যুর বদলা হিসেবে ‘বেলিয়াহাট্টা বন্ধ্’ না অ্যাক্শান স্কোয়াড লাগিয়ে পুলিশ খতম—কোন পথটা ঠিক? ‘সোনা তো বদলার জন্যে লড়েনি, ও লড়েছিল সাচ্চা আজাদির জন্যে।’ এমন তর্ক প্রায়ই ফেনিয়ে ওঠে গোরার বিড়ম্বিত মনে, অসতর্ক জিভের ডগায়। ‘তোর সংগ্রামে মানুষের অস্তিত্ব নেই।’ ‘নাহ্ সন্ত্রাসবাদে কোনও কমিউনিস্টের আস্থা থাকে না।’ ‘হয়তো ওর বোঝার ভেতর ফাঁক-ফোকর ছিল। তা ছাড়া, এ এক সূক্ষ্ম শিল্প, নিজের বুঝ আর একজনের কাছে চালান দেওয়া।’ ‘গোরার কেস আরও জটিল (এবার নিজের মনটাকে কাটাছেঁড়া করতে লাগল)। আরও গহেরা।’ সত্যি-মিথ্যে ঠিক-ভুল জরিপ করার আগেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সাঁড়াশি হামলায়, হাজতে-জেলে পাশব নিষ্পেষণে বন্ধ হয়ে যায় নিষ্ক্রমণের সব রাস্তা, ত্রস্ত কোণঠাসা জনবিচ্ছিন্ন গেরিলাদের নেতৃত্বের কাছে এসব প্রশ্ন হয়ে পড়ে অমার্জনীয় ‘শোধনবাদ’ অন্যথা ‘সিপিএমের যুক্তি’, জন্মভূমিকে বাসযোগ্য করার সংরাগকে দেগে দেওয়া হয় পেটি-বুর্জোয়া চিত্তবিলাস ব’লে।
‘জাগরী’ উপন্যাসে রাষ্ট্রের ক্ষমতাতন্ত্রের বিরোধিতার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিল সমাজ-শরীরের সম্বন্ধ—রাজনৈতিক লাইন নিয়ে সপ্রশ্ন দ্বন্দ্বের সঙ্গে অচ্ছেদ্য ছিল জাতপাত, পারিবারিক বিপর্যয় ও বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কালোবাজারি ও ভুখমারি। এই সম্পর্ক তাড়িত করে চারজন কথকের ভাষা, স্মৃতির স্থিতিগতি। স্বগতকথনের মধ্যে দিয়ে সংগঠিত হয় এক দ্বান্দ্বিক সংলাপ, ইতিহাসের আত্মবিনির্মিতি। জেলখানায় শরীরের ভাষার সঙ্গে কথকের চিন্তার ভাষাকে আলাদা করা যায় না আর। পাঠ্যবস্তুর মধ্যে হারায় না ইতিহাস, পাথুরে ইতিহাসকে ব্যক্তির স্মৃতির মারফত নতুন ক’রে পাঠককে অন্যায়ের দুরপনেয় সাক্ষ্যের কথা ভাবতে বাধ্য করে, ভাবতে বাধ্য করে তার নিজের মনন ও কর্মের দায়ের কথা। আত্ম-সর্জনের এমন অধিকার দেয় রাজনৈতিক সাহিত্য; কেবলমাত্র সাহিত্যের এই ভঙ্গুর সৌধেই শহিদের আত্মবিসর্জন অব্যর্থ থেকে যায়। রাঘবের চিন্তাতেও পাঠ্যবস্তুর ঘর-বাহির অবিভাজ্য, অবিভাজ্য ১৯৬৮-র সংক্ষুব্ধ পৃথিবী এবং বেলিয়াহাট্টার অর্ধশিক্ষিত আধপেটা রুগ্ন মজুরদের জেদ ও সোহাগের দুনিয়া। ‘কমুনিস’ উপন্যাসের গদ্য রাজনৈতিক পাঠের পরিভাষার সীমা টেনে দেয় বার বার, রচনা করে তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতার মধ্যে এক সংশয়ী ব্যবধান।
শহিদ ভুল পথে যায়, আন্দোলন ব্যর্থ হয়, রণকৌশল বদলায়। কিন্তু অন্যায় প্রতিহত করার প্রতিটি চেষ্টা ভাষাকে নতুন ইন্ধন জুগিয়ে যায়, নতুন ব্যাখ্যার, নতুন ব্যাখ্যা আদায়ের সংকল্পে ব্যহত করে চিন্তার অভ্যাস, পাঠের অভ্যাস। এ হেন ‘অটো-ক্রিটিক’ ছাড়া, সংশয় বিনা, নিঃসংশয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনও নতুন তাৎপর্য থাকে না—না সাহিত্যের পাঠে, না ইতিহাসের পাঠে।
ইতিহাস সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে যে প্রশ্ন পাঠক তার ঐতিহাসিক স্থানকাল থেকে তাকে করতে পারে। ইতিহাসের সত্য ঠিক কী তবে? রাজনীতির সত্যই বা কী? কোনও সার্বভৌম নিরঙ্কুশ সত্য না-ই বা থাকল, নিয়ন্ত্রক ধারণা হিসেবে সত্যকে অস্বীকার করলে ইতিহাস-রাজনীতিকে অস্বীকার করতে হয়, সত্যযুগের উত্তরপর্বের—অর্থাৎ ‘পোস্ট-ট্রুথ’-এর জমানার—বিকারকে ধ্রুব নিয়তি ব’লে মানতে হয়, খুন করতে হয় যৌথ সাংস্কৃতিক স্মৃতির অস্তিত্বকে। ‘ওয়ান মাস্ট নেভার ডাল দ্য শিয়ার ফোর্স অফ হোয়াট হ্যাপেন্ড, দ্য শিয়ার ফোর্স অফ দি ইভেন্টস।’ ১৯৮৮ সালে তাঁর সম্মানে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় বলেছিলেন ফরাসি দার্শনিক পোল রিক্যর। এর পরেই তিনি পাড়েন ইহুদিনিধনের প্রসঙ্গ, মানুষের সাম্প্রতিক ইতিহাসে যা একটি নেতিবাচক অর্থে মৌল ঘটনা, ইংরেজি তরজমায় ‘এ নেগেটিভ ফাউন্ডেশনাল ইভেন্ট’। জানতে হবে কী ঘটেছিল, কেমন এমন ঘটেছিল, এর বিহিত কী। মনে রাখতে হবে ‘তাহাদের কথা’। সতীনাথের উপন্যাসের মতোই ‘কমুনিস’ এই মৌলিক প্রশ্নে দীর্ণ, আলোড়িত। অথচ তাজা প্রাণগুলি সেই ফুরসত পেল কোথায়? কেবল হঠকারিতার কথা ব’লে আমরা, আম পাঠকেরা, নিজেদের দায় কতটা এড়াতে পারি? ঈশ্বর সদয় হয়ে আমাদের বিস্মরণশক্তি দিয়েছিলেন হয়তো, ঈশ্বরের প্রবল প্রতিস্পর্ধী রাঘব কিন্তু আমাদের তা দে’ন নি। ‘কেন? কেন ও সব জানল না? রাজনৈতিক পরিভাষার খোলস খান খান করে ভেঙে কেন ও সত্যটা আবিষ্কার করতে পারল না?’ গোরা ভাবছে পুলিশের হাতে অকালমৃত কমরেড সোনার কথা। কিন্তু এই সত্যটা আবিষ্কারের দায় কতটা নিয়েছি আমরা, আমরা যারা নকশাল নিধনের সাফাই উগরে দিয়ে হালকা হই বা বিংশ শতাব্দীর ষাট-সত্তরের ‘পথভ্রষ্ট’ তরুণদের জন্যে শখের শোক করে থাকি। অভ্রান্ত সত্যের দেখা না পেলেও সমাজ-সংসারের ভ্রান্তির মূলের সন্ধান খোলা চোখে করতে চেয়েছি আমাদের মধ্যে কতজন?
এই দেখতে চাওয়া, জানতে চাওয়ার সাহস চারিয়ে দিতে হবে উপন্যাসের গদ্যে, অস্বস্তিকর ভাষার শরীরে। তবেই পাঠ হয়ে উঠবে সত্যিকারের সন্ধান, নিজের অভ্যস্ত বুঝ চলবে হোঁচট খেতে খেতে অনির্দেশ্য সমুখপানে। ‘দুশমনের অত্যাচারে দমছি না, কিন্তু যে যন্তরটা দিয়ে তামাম জনতাকে দাবিয়ে রাখে তার নাট-বল্টু-ইস্ক্রুপ সব দেখে চিনে নিচ্ছি ... পরীক্ষা দিচ্ছি ... ইনতেহার, সহ্যের আর মনের তাকতের।’ এখানে রাঘবের উপন্যাস সতীনাথের সমধর্মী, যতই তাঁর প্রথম উপন্যাসে কমলকুমারের শৈলীর রেশ দেখা যাক না কেন।
সতীনাথ ভাদুড়ীর সঙ্গে রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন ভাবে তুলনা, রাজনৈতিক পটভূমির এমন সুগভীর বিশ্লেষণ আর ভাষার তাৎপর্য নিয়ে এমন চুলচেরা ব্যাখ্যায় সমৃদ্ধ হলাম। এ ভাবে তো আগে ভেবেই দেখিনি।