গান বস্তুটা ছোটো বেলা থেকেই চঞ্চল হজম করতে পারত না। সুর, তাল, লয় এসবের কাছ থেকে সে বহুদুরে থাকার চেষ্টা করত। স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার সময়েও তার তাল ভুল হত। সকলের গলা যেত একদিকে, আর চঞ্চলের অন্যদিকে। বড় ক্লাসে ওঠার পরে সে শুধু ঠোঁট নাড়াতো। গলা থেকে কোনও আওয়াজ বের হতো না।
‘যে গান ভালবাসেনা, সে নাকি মানুষ খুন করতে পারে’- একথাটা অবশ্য চঞ্চলের ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়। কারন চঞ্চল খুবই সংবেদনশীল ছেলে। সে ছাত্র জীবন থেকেই ধনী গরীবের অসাম্য, সাম্যবাদ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে কয়েকটি মুষ্টিমেয় দেশের শোষন, এইসব নিয়ে সিরিয়াস চিন্তা ভাবনা করে। তার বাবা নামকরা ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও নিজের পোষাক পরিচ্ছদ, খাওয়া দাওয়া, আচার ব্যবহারে অত্যন্ত সাধারণ ভাবে থাকতে চায়। খাতার পেছন দিকের পৃষ্ঠায় কবিতা লেখে। সেসব কবিতায় রোম্যান্টিক বিপ্লবের জয় জয়কার। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ থেকে শঙ্খ ঘোষের অনেক কবিতাই মুখস্থ বলতে পারে। কিন্তু সে গান শোনে না।
সে রবীন্দ্রসংগীত শোনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম গান শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বর্ণ যুগের আধুনিক গান শোনার চেষ্টা করেছে, বড্ড ন্যাকা ন্যাকা মনে হয়েছে। বাংলা ব্যান্ডের গান শোনার চেষ্টা করেছে। বাজনার আওয়াজে তার মাথা ধরে গেছে।
চঞ্চলের ভাল লাগার বিষয় ছিল দুটি। ফুটবল আর ফিজিক্স। তার চেহারা বড় সড়। পাড়ার কাদা মাঠে সে যখন বল নিয়ে দুদ্দাড় করে ছুটত তখন ভয়ের চোটে কেউ তাকে আটকাত না। একেকটা ম্যাচে সে একাই কুড়ি বাইশটা করে গোল দিত। সে যে দলে খেলত তাদের জয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। তবে পাড়ার মাঠ ছাড়া আর কোথাও তার প্রতিভা দেখানোর সুযোগ সে পায়নি। আর ফিজিক্সের অঙ্ক নিয়ে সে যে কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে তার হিসাব নেই। ইলেভেন টুয়েলভে পড়ার সময় পরবর্তী কালে ফিজিক্স ছাড়া আর কোনো কিছু নিয়ে পড়ার কথা সে ভাবতে পারত না।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। কত ছেলে মেয়ে একাধিক বার প্রস্তুতি নিয়েও জয়েন্ট এন্ট্রান্সে চান্স পায়না। অথচ চঞ্চল বিশেষ প্রস্তুতি ছাড়াই জয়েন্ট এন্ট্রান্সে মেডিকেলে দ্বিতীয় হল। এবং এরপর যা হয়। সে ডাক্তারি পড়তে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হল। তার জীবনের প্রধান দুটি ভালবাসা তার কাছ থেকে বিদায় নিল। প্রথম বছরটা তার এই দুঃখেই কেটে গেল। এবং বছর শেষের ফাইনাল পরীক্ষায় অ্যানাটমিতে ফেল করার পর তার ঘোর কাটল।
অ্যানাটমি সাপ্লিমেন্টারী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ে তার জীবনে একটা ঘটনা ঘটল। কবিতা লেখা, দেওয়াল পত্রিকা করার সূত্রে তার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিল। সে তাকে ধরে বেঁধে একদিন একটা ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে গেল। মোবাইল, ল্যাপটপের আগের যুগে পাড়ায় পাড়ায় অনেক সাংস্কৃতিক চক্র থাকত। তাদের সদস্যরা কেউ গান করত। কেউ আবৃত্তি করত। কেউ স্বরচিত কবিতা বা গল্প পাঠ করত।
এটিও তেমন এক সাংস্কৃতিক চক্র। অন্যদের সাথে এটির পার্থক্য হল এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন মনীষীদের জন্মদিন অথবা মৃত্যুদিন পালন করে। সমাজে তাদের অবদান নিয়ে আলোচনা হয়। তাছাড়াও সদস্যরা গান, আবৃত্তি, স্বরচিত রচনা পাঠ করে।
আজকের অনুষ্ঠান ছিল শহিদ ক্ষুদিরামের মৃত্যুদিন স্মরণ করে। অনুষ্ঠানটি চঞ্চলের খুবই একঘেঁয়ে লাগছিল। সে উঠে যাওয়ার আছিলা খুঁজছিল। সেই সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একটি মেয়ে গান শুরু করল। বয়েসে সে চঞ্চলের থেকে বছর তিনেকের বড়ই হবে। গায়ের রঙ কালো। অত্যন্ত সাধারণ চেহারা। কিন্তু সে গান শুরু করার পরে মনে হল যেন একটা ম্যাজিক ঘটছে।
অত্যন্ত চেনা একটি গান। ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্গুনিয়ে...’ কিন্তু চঞ্চল সম্পুর্ণ অন্য জগতে চলে গেল। একই সাথে একটা অদ্ভুত কষ্ট, অদ্ভুত আনন্দ তাকে ঘিরে ফেলল। আশ্চর্য মনখারাপ আর ভালোলাগা। চঞ্চল যেন উত্তাল ঢেউয়ের উপর একটা ছোট্ট নৌকায় ভাসছে। তার গন্তব্য ঠিক নেই। কিন্তু প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকাটাও বড্ড সুন্দর।
গান শেষ হল। চঞ্চল কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না। একজন হেডমিস্ট্রেসের মত দেখতে বয়স্ক মহিলা বললেন, ‘পঞ্চমী, আজকের অনুষ্ঠানের সাথে সঙ্গতি রেখে কোনও দেশাত্মবোধক গান করতে পারতিস। গান নির্বাচনের ক্ষেত্রে তোর একটু যত্নবান হওয়া উচিৎ।’
আরেকটি ছেলে তেড়েফুঁড়ে গান শুরু করল ‘দূর্গম গিরি কান্তার মরু...’। চঞ্চলের কানে কিছুই ঢুকছিল না। জীবনে প্রথমবার সে ভালবাসা অনুভব করতে পারছিল। তার বন্ধুটিও কিছু অনুমান করেছিল। সে বারবার জিজ্ঞাসা করছিল, ‘কিরে কি হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘তুই অনুষ্ঠানের মধ্যে হঠাৎ থম মেরে গেলি কেন?’
‘শোন না, ওই যে গান গাইল না... ঘরেতে ভ্রমর এল... পঞ্চমী... ওর সাথে আলাপ করিয়ে দিবি?’
বন্ধুটি অবাক হল। বলল, ‘পঞ্চমীদির সাথে আলাপ করবি! সে করিয়ে দেওয়া যাবে। আমাদের পাশের পাড়াতেই থাকে।’
কিছুদিনের মধ্যেই চঞ্চল আর পঞ্চমীকে একসাথে বিভিন্ন জায়গায় দেখা যেতে লাগল। চঞ্চল প্রথমেই পঞ্চমীকে জানিয়েছিল, সে তাকে নাম ধরেই ডাকবে, দিদি টিদি বলবে না।
কালো মেয়ের কাজল কালো চোখ দুটি কৌতুকে ঝিকমিকিয়ে উঠেছিল। পঞ্চমী বলেছিল, ‘আমিও তাহলে তোকে নাম ধরে ডাকব আর তুই তোকারি করব।’
‘সে তোমার যা ইচ্ছে।’
কিছুদিনের মধ্যেই চঞ্চল গান ছাড়াও পঞ্চমীর মধ্যে আর একটা ভালো লাগার জিনিস আবিষ্কার করল। ঠোঁট চেপে তার হাসি। সেই হাসি দেখলেই চঞ্চলের দম বন্ধ হয়ে যেত। উনিশ বছরের চঞ্চল প্রথমবার কোনো মেয়ের প্রেমে ভেসে গেল।
সে নিয়মিত সাংস্কৃতিক চক্রটির অনুষ্ঠানে যেতে শুরু করল। অসীম ধৈর্য্য নিয়ে সে বিভিন্ন মনীষীদের উপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনত। হাসি হাসি মুখ করে বিভিন্ন অ্যামেচার শিল্পীদের বেসুরো গান আর আবৃত্তি শুনত। আর দম বন্ধ করে অপেক্ষা করত পঞ্চমীর গা্নের জন্য।
সে পঞ্চমীদের বাড়িতেও গেল। পঞ্চমীর মা মারা গেছেন তার ছোটোবেলাতেই। বাবা সুশান্তবাবু গ্রুপ থিয়েটারে নাটক করেন। চঞ্চল তার সাথে রীতিমত উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র এদের নিয়ে আলোচনা জুড়ে দিল। অবশ্য এর জন্য সে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। পঞ্চমীর বাবা নাটক করেন শোনার পর থেকেই সে কলেজ স্ট্রীট থেকে বাংলা থিয়েটারের উপর বই কিনে কিছু সিরিয়াস আলোচনা পড়ে ফেলেছিল। সুশান্তবাবু প্রেশার, সুগার এবং হার্টের নানান সমস্যায় ভুগছেন। সবে ডাক্তারির দ্বিতীয় বর্ষে ওঠা চঞ্চল সেসব রোগ নিয়েও বিশেষজ্ঞের মত তার মতামত জানাল।
দ্বিতীয় বছরটা চঞ্চল মোটামুটি একটা ঘোরের মধ্যেই কাটাল। এবং অ্যানাটমির সাপ্লিমেন্টারী পরীক্ষায় কোনোরকমে পাশ করলেও প্যাথলজিতে আ্টকে গেল।
মেধাবী ছাত্র চঞ্চলকে এভাবে বছর বছর ফেল করতে দেখে তার বাবা চিন্তিত হলেন। তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ চিকিৎসক। ফলে রোগ নির্নয় করতে ভুল করলেন না। তিনি রাগা রাগী করলেন না। পঞ্চমীদের বাড়িতে গিয়ে শাসিয়ে এলেন না। শুধু মেডিকেল কলেজের হোস্টেল সুপারের সাথে আলোচনা করে মেন হোস্টেলে চঞ্চলের জন্য একটি বেডের বন্দবস্ত করলেন। নিজে গাড়ি করে বিছানা পত্তর আর বই খাতা সমেত চঞ্চলকে হোস্টেলে রেখে এলেন।
হোস্টেলে আসার পর চঞ্চল রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়ল। এক অতি বামপন্থী দলের হয়ে তাকে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ক্লাসে ডায়াসিং করতে দেখা গেল। কলেজ ভোটের আগে মেডিকেল কলেজের অলিতে গলিতে পোস্টার লাগাল। নিজে ভোটে দাঁড়াল এবং সবাইকে অবাক করে সংগঠিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিকে হারিয়ে ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচিত হল। তখন সবে মোবাইল এসেছে। ইন কামিং কলেও পয়সা লাগত। চঞ্চল আর পঞ্চমী কারোরই মোবাইল ছিল না। পঞ্চমীদের বাড়িতে ফোনও ছিল না। ফলে দুজনের মধ্যে যোগাযোগ ক্রমশ কমতে কমতে এক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিছিন্ন হয়ে গেল।
চঞ্চল ডাক্তারি পাশ করে সরকারি চাকরি নিয়ে পুরুলিয়ার এক গ্রামীণ হাসপাতালে চলে গেল। চারবছর চাকরি করার পর মেডিকেল কলেজেই এম ডি করার সুযোগ পেল। আবার বাড়ি ফিরে আসল। বিয়ে করল। তার স্ত্রী কাছাকাছিই একটি হাই স্কুলের শিক্ষিকা। বছর দুয়েকের মধ্যে তাদের একটি মেয়েও হল।
মেডিসিনে এম ডি করার পর চঞ্চল বাড়ির কাছাকাছি একটি সাব ডিভিশান হাসপাতালে পোস্টিং পেল। সে চাকরির সাথে সাথে প্রাইভেট প্রাকটিসও শুরু করল।
প্রাকটিস শুরু করার পর চঞ্চল বুঝতে পারল সত্যিকারের ভালো ডাক্তারের কত অভাব। কিছু তথাকথিত নামকরা ডাক্তাদের প্রেসক্রিপশান দেখে সে তাজ্জব হয়ে গেল। একগাদা দামি দামি অপ্রয়োজনীয় ওষুধ এবং তার থেকেও বেশী অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা। চঞ্চল তার ক্লিনিক্যাল নলেজের উপর ভিত্তি করে নুন্যতম পরীক্ষা নিরীক্ষা ও নুন্যতম ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা শুরু করল। যার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তার চেম্বারে ভিড় উপচে পড়ল।
সেই ভিড়ে রোগী ছাড়াও আরও কিছু মানুষ আসতে শুরু করল। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি এবং বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির লোকজন। প্রথম প্রথম হাতে গোনা কয়েকজন। চঞ্চল তাদের বিশেষ পাত্তা দিত না। কিন্তু লোক গুলির অসীম ধৈর্য্য। কিছুতেই তাদের মুখের হাসি মেলায়না। প্রত্যেকের কথা শুনলেই মনে হয় চঞ্চলের জন্য তারা জীবন দিতে প্রস্তুত। আস্তে আস্তে এধরণের লোকের সংখ্যা বাড়তে লাগল।
চঞ্চল ধীরে ধীরে কমিশন আর পার্সেন্টেজের অঙ্ক শিখে যাচ্ছিল। প্রথম প্রথম যে অস্বস্তি হচ্ছিল, আস্তে আস্তে সেটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। এই ভাবে কিছুদিন চললে তার সাথে যে তথাকথিত নামকরা ডাক্তারদের বিশেষ পার্থক্য থাকবে না সেটা চঞ্চল বুঝতে চাইছিল না।
এক সন্ধ্যেতে চঞ্চল দ্রূত রোগী দেখছিল। রোগী দেখা শেষ করে এক জায়গায় যেতে হবে। বারাসতের এক রেস্টুরেন্টে নামী ওষুধ কোম্পানীর সেমিনার আছে। নামেই সেমিনার। এগুলো আসলে ডাক্তারদের মদ খাওয়ার আর পরনিন্দা করার আড্ডা। চঞ্চল খুব বেশী মদ্যপান করে না। সীমা রেখেই খায়।
আজকে যেন বেশী ভিড় হয়েছে। একের পর এক রোগী চেম্বারে ঢুকছে। চঞ্চল তাড়াতাড়ি দেখতে শুরু করেছে। অথচ রাত নটার সময়েও শেষ করতে পারেনি। চঞ্চল তার অ্যাসিস্টান্টকে জিজ্ঞাসা করল ‘বাইরে আর কজন আছে?’
‘একজন মহিলা আছেন ডাক্তারবাবু। বেশ কিছুক্ষণ এসেছেন।বলছেন সবার শেষে দেখাবেন।’
শেষ মহিলা ঢুকলেন। তাকে দেখে চঞ্চল চমকে উঠল, ‘একি... পঞ্চমীদি?’
‘দিদি কেন? শুধু পঞ্চমী বল।’
‘কেমন আছ? কি হয়েছে?’
‘আমি নই, বাবা খুব অসুস্থ। মাঝে মাঝেই শ্বাস কষ্ট হয়। সেটারই বাড়াবাড়ি হয়েছে। একবার আমার সাথে যেতে পারবি রে চঞ্চল?’
‘এখন আমার পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।মানে .. ইয়ে আমার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।’
‘তাহলে কাজ সেরে আয়। আমি অপেক্ষা করব।’
চঞ্চল দ্রূত চিন্তা করল, কিছুতেই পঞ্চমীর বাড়ি আজ যাওয়া যাবে না। ফেরার পর তার মুখে মদের গন্ধ থাকবে। মদ খেয়ে প্রাক্তন প্রেমিকার অসুস্থ বাবাকে দেখতে যাওয়া উচিৎ হবে না।
‘আজকে কিছুতেই যেতে পারব না পঞ্চমী। হাসপাতালে নাইট ডিউটি আছে।’ চঞ্চল বেমালুম মিথ্যে কথা বলে দিল। ‘ঐ দেখনা সুপার হাসপাতাল থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।’ ওষুধের কোম্পানির পাঠানো গাড়িটাকে দেখালো চঞ্চল। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের নাইট ডিউটিতে যাওয়ার জন্য যে কোনো গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা নেই পঞ্চমীর জানার কথা নয়।
‘তাহলে কি করব? বাবার অবস্থা খুব সিরিয়াস। এতদিন তোর কাছে আসতে কেমন বাধো বাধো লেগেছে। আজ একেবারে নিরুপায় হয়ে এসেছি।’
‘খুব খারাপ অবস্থা হলে কাকুকে কোথাও অ্যাডমিট করে দাও। কোনো নার্সিংহোমে..’
‘তুই তো আমাদের আর্থিক অবস্থার কথা সবই জানিস। নার্সিংহোমের খরচ চালানোর ক্ষমতা আমার নেই।’
‘তাহলে সোজা বারাসত হাসপাতালে নিয়ে যাও।’ নির্বিকার মুখে বলল চঞ্চল।
‘অনেক বারই নিয়ে গেছি। ওখানে একটু ভাল হলেই ছুটি দিয়ে দেয়। বাড়িতে এসে দুদিন বাদে আবার একই অবস্থা। তুই যদি একবার দেখতিস। এ অঞ্চলে তোর এত নামডাক। সবাই বলে গরিবের ডাক্তার।’
‘গরিবের ডাক্তার’ কথাটা শুনে গর্বের বদলে চঞ্চলের একটু রাগই হল। তাছাড়া দেরী হয়ে যাচ্ছে। এই সেমিনার গুলিই তো তার ক্লান্তিকর জীবনের অক্সিজেন। সে বলল, ‘গরিব বড়লোকের আলাদা ডাক্তার হয় না। যে ভাল ডাক্তার সে গরিবের কাছেও ভাল, বড়লোকের কাছেও ভাল। আমি আজ কিছুতেই যেতে পারব না। কাল সকাল ন’টা নাগাদ যেতে পারি।’
সেমিনারে এসে হার্ড ড্রিংকসের গ্লাস হাতে চঞ্চল স্বাভাবিক হতে পারছিল না। তার বার বার মনে হচ্ছিল কি একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। দু একজন সিনিয়ার ডাক্তার এর মধ্যে আকন্ঠ মদ্যপান করে মাতলামি শুরু করেছেন। তার মধ্যে একজন চঞ্চলদের হাসপাতালের ডাক্তার। শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি দুমাস ছুটিতে আছেন। চঞ্চলের কাছে হাতে নাতে ধরা পড়েও তাঁর বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। বরঞ্চ তিনি চঞ্চলের কাছে কিছুক্ষণ সুপারের নামে গালিগালাজ করলেন।
চঞ্চলের একেবারেই ভাল লাগছিল না। সে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইছিল। পঞ্চমীর মুখের যে হাসি তাকে পাগল করে দিত, সেই হাসি সে একবারের জন্যও আজকে দেখতে পায়নি। পঞ্চমীর কি বিয়ে হয়ে গেছে। তার বয়স এখন তেত্রিশ। তার মানে পঞ্চমীর বয়স ছত্রিশ। বিয়ে হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ সে পঞ্চমীর শরীরে বিবাহিত রমনীর কোনও চিহ্ন দেখেনি। চঞ্চলের মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা করছিল। সে দ্রুত চুমুকে হাতের গ্লাস শেষ করল। অ্যালকোহল রক্তে মিশে যদি তাকে স্বাভাবিক করতে পারে।
বাড়ি ফিরে সে ঘুমন্ত স্ত্রী আর কন্যার পাশে শুয়ে পড়ল। সারারাত ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হল। ভোরের আলো ফুটতেই সে স্কুটার নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। তার বুকের মধ্যে কাঁপছিল। আজ থেকে প্রায় তেরো বছর আগে পঞ্চমীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময়েও তার বুক এইভাবেই কাঁপত। সময় সব অনুভূতি কেড়ে নিতে পারে না।
পঞ্চমীদের একতলা ছোট বাড়িটার সামনে পৌঁছে সে অবাক হয়ে গেল। এত লোক! সে যতদূর জানত পঞ্চমীদের আত্মীয় স্বজন তেমন নেই। সেই সময় বহুযুগের ওপার থেকে কানে এল এক অত্যন্ত পরিচিত কন্ঠস্বর। যে কন্ঠস্বর চঞ্চলকে বহুবার অন্য পৃথিবীতে নিয়ে গেছে। স্কুটারটা রাস্তার এক পাশে দাঁড় করে সে এগিয়ে গেল। সাদা চাদরে ঢাকা সুশান্তবাবুর দেহ। তার সামনে বসে পঞ্চমী গান করছে... ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে/ বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে’।
চঞ্চলের সমস্ত শরীর কাঁপছিল। সে ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু এই ভুল শোধরানোর ক্ষমতা তার নেই। স্কুটার চালিয়ে সে দ্রুত পালাতে চাইছিল। কিন্তু তাকে তাড়া করে আসছিল এক আকুল কান্না ... ‘গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে/ তাঁহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে’।
ডাক্তার বাবু, আরও গল্পের আশায়। ধন্যবাদ ।
ভাল লাগল ।
চেনা নষ্ট মানুষের গল্প, শক্তিশালী কলম।
অসাধারণ লাগলো। এক নিদারুণ অথচ বাস্তব অবক্ষয়ের চিত্র। আপনার দৈনন্দিন লেখাগুলি র মতই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে হল। এমন আরও লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
বেশ ভালোই লাগলো।
বাস্তবের গল্প না গল্পের বাস্তবতা । বর্তমানে তথাকথিত নামী ডাক্তারদের বাস্তব জীবন তুলে ধরেছেন । তারা আপনার উপর খুব একটা প্রসন্ন হবে বলে মনে হয় না । লেখাটা আপনার অন্যান্য লেখাগুলির মতো খুব ভালো হয়েছে । পরের গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
একদম শেষে গানের লাইন দুটো তোর গল্পটাকে সার্থক নামা করেছে। এক টুকরো মাংস আর মন খারাপ হয়ে গেল। বেশ ভালো লিখেছিস। তবে ভাই প্রেমের বলগুলো আরেকটু soft hand এ খেলতে হবে।
বেশ ভালো লাগলো। চঞ্চলকে চেনা চেনা লাগলো!
মোটেই ভালো হয়নি। না ভাষা না গল্প না আঙ্গিক। ডাক্তারবাবুর থেকে আরো ভালো লেখা আশা করি বিশষত করোনার দিনগুলি সিরিজের pare
নুতন লেখকের লেখা হলে বলতাম, লিখতে থাকুন, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আপনার এত ভালো লেখা পড়া আছে যে এই লেখার জন্য সেটা বলার কোন জায়গাই নেই। আমার বরং যেটা মনে হয়েছে, এই লেখাটিকে মূলসুতো করে একটি উপন্যাসের মালা গাঁথলে কেমন হয়?
এই গল্পের মূলচরিত্র চঞ্চল এর জীবনের কাহিনী অত্যন্ত বাস্তব...নায়কোচিত কৃত্রিম নাটকীয় জীবনপঞ্জি দেখা যায় নি।
এই গল্পে সাবলীলভাবে প্রিয় লেখক যা তুলে ধরলেন...বর্তমান সমাজের সামগ্রিক অবক্ষয়ের প্রভাব এত গভীর... যে প্রথাগত শিক্ষার পরেও একজন মানুষ... তা তিনি যে মহৎ পেশায় থাকুন না কেন..এই অবক্ষয়ের স্রোতে গাভাসানোর মানসিকতা তার নৈতিক ও সামাজিক চেতনাকে মসীলিপ্ত করে।
তবে চঞ্চলের অতীত জীবনের ব্যতিক্রমী মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, নৈতিকতার চর্চা তার মধ্যে যে সামাজিক সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল....যা তাকে অনেক ভুলের মধ্যেও তাকে দেয় অনুশোচনা.... লজ্জাবোধ, সেটাইঅদূর ভবিষ্যতে তাকে মানুষের মতো নূতন মানুষ হতে সাহায্য করবে।
ভালো গল্প। বাস্তবানুগ, কারণ এমনটিই হওয়ার কথা। তাই শেষের মোচড়টি প্রত্যাশিত। তবে গল্পটি আরও একটু বিস্তৃতি (পাত্র পাত্রীর পরিবেশ, পরিস্থিতি, মানসিক অবস্থা ইত্যাদি) দাবি করে মনে হয়। হয়তো সময়াভাব সেই সুযোগ দেয় নি। আশা করি মুদ্রিত রূপে এই কমতি পূরণ হবে। তবু এমন একটি সংবেদী রচনার জন্য অভিনন্দন জানাতেই হয়।
সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ মতামত জানানোর জন্য।
অসামান্য লাগলো জানেন! খুব সাধারণ আকছার জানা ঘটনাই তো, কিন্তু তাতে শৈলী ঝরে পড়ছে। আমার ভিতরে এখনও বাজছে, বেজে চলবে জানি - আপনার শব্দ গুলো। আপনার জন্যে ও বাজুক আমার ধার করা রবীন্দ্রনাথই ফের -
আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে আসিল নাবিয়া!
ভুবন মিলে যায় সুরের রণনে,
গানের বেদনায় যাই যে হারায়ে ....
আরো বেশি আশা ছিল।সময়ের অভাব নিশ্চয়। যেন উপন্যাসের সার সংক্ষেপ পড়লাম।