অংশুমান দাসের টুকরো টাকরা শান্তিনিকেতন নামে একটা বই হাতে এল, পড়লাম। লেখক আশি-নব্বই এর দশকে ছাত্র ছিলেন শ্রীনিকেতনে, বিশ্বভারতীতে। লেখাটি সাবলীল, কিন্তু খুব অভিনব তা নয়। আমি যেহেতু কিছুদিন আগে পর্যন্তও প্রায় প্রতি সপ্তাহে শান্তিনিকেতন যেতাম, অনেক জায়গা তাই চেনা লাগছিল; মিলিয়ে নিচ্ছিলাম এখনকার ল্যান্ডস্কেপের সাথে, কিছু মিলছিল, কিছু মিলছিল না। কিন্তু যে অংশটা আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করল এবং কিছুটা ভাবালো সেটা হল অংশুমানদের নাটকের দলের কথা, যার নাম ছিল সাঁকো। এটা ভাবালো কারণ আমাদের যৌবনে আমরা অনেকেই অনেক সঙ্ঘে ঢুকেছি যার বেশীর ভাগই ভেঙ্গে গেছে কয়েক দশকে (এমনকি কয়েক বছরেও)। কখনও সেটা লিটল ম্যাগাজিন, কখনও নাটকের দল, কখনো রাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু ঠিক কেন এই সঙ্ঘগমণ তা নিয়ে ভেবেছি অনেক। আপাতদৃষ্টিতে (এবং প্রস্তাবনায়) সঙ্ঘ সঠিক কবিতা, নাটক, বা মানবমুক্তির সঠিক পথের প্রতিশ্রুতি দেয়। যখন কেউ মেলে অন্যদের সাথে সেও নিশ্চয়ই বিশ্বাস করে সঠিক পথ এদিকেই। যদিও কিছুদিনের মধ্যে প্রায় সবাই বুঝতে শুরু করে সঠিক পথ এক আশ্চর্য মরিচীকা, দিগন্তরেখার মত যা শুধুই দূর থেকে দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না। তাহলে কি সঠিক পথের এই মরিচীকার আড়ালে অন্য কিছু থাকে? সেই অন্যকিছু কি আসলে যূথবদ্ধতার স্বপ্ন যা সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে ক্রমবিলীয়মান? অংশুমান তাঁদের নাটকের দলের যে যাপনের কথা, হাতে হাত রেখে বেঁচে থাকার যে কথা লিখেছেন তাতে আমি সঠিক নাটকের সন্ধান ছাড়িয়ে সেই যূথবদ্ধতার যাপন চিহ্ন দেখছিলাম। এই যাপনচিহ্ন আমি দেখেছি আমার দেখা নব্বই ও তার পরের স্বপ্নসন্ধানী রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে, লিটল ম্যাগাজিনে, নাটকের দলের মধ্যে। যূথবদ্ধ যাপনের টান আমি ব্যক্তিগতভাবে পাই নি কোনদিন, কিন্তু অনেক অনেক মানুষকে পেতে দেখেছি বা পড়েছি ষাট, সত্তরের লেখায়। কৃত্তিবাস, হাংরি কবিকুল -- আজকাল মনে হয় -- এই যূথবদ্ধতার টানেই মজেছিলেন কাব্যদর্শনের আদর্শের থেকেও যা অনেক শক্ত করে আমাদের বেঁধে রাখে। এই যৌথতার আকর্ষণ হয়তো আমাদের আদিম পূর্বপুরুষের জিনেই প্রোথিত ছিল, যা হয়ত যূথবদ্ধতার দিকে অমোঘ হাতছানি দেয়। কিন্তু শুধু জিন নয়, অংশুমানের লেখা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের সমাজ অনেক বেশী করে এই যৌথতাকে ধারণ করতে পারত, যা দু হাজারের পরের পৃথিবীতে আর সম্ভব নয়। প্রযুক্তি আরো বেশী বেশী করে একক যাপনকে সহনীয় করে তুলছে। বিলীয়মান যৌথযাপন নিয়ে আমার কোন আপশোষ নেই, একক বা যৌথযাপনের মধ্যে এ ভাল আর ও খারাপ এরকম কোন বিশ্বাসও নেই। আমি দেখি -- সাক্ষী বড়িলালের মত, দেখি আর বুঝি। বুঝি যে প্রযুক্তি পালটে দিচ্ছে আমাদের -- প্রতিদিন, পালটে যাচ্ছে যাপন আর যূথবদ্ধতার অমোঘ আকর্ষণ। সোশ্যাল মিডিয়া, অন্তত আমার বিচারে এই যৌথ যাপন থেকে অনেক দূরে, ঠিক বিপরীত। সোশ্যাল মিডিয়া আসলে অহং এর উদযাপন, নিজের প্রতিচ্ছবি ছুঁড়ে দেওয়া পৃথিবীর মুখে।
এই ভাবনার সূত্র ধরেই মনে হয় আগেও কি যূথবদ্ধতার স্বপ্ন আদৌ ছিল? নাকি তাও আসলে অহং উদযাপণেরই প্রয়াস যা পরিস্থিতির প্রয়োজনে যূথবদ্ধতার হাত ধরেছিল? কিছু বছর আগেও, মানে আমাদের ছাত্রজীবনে, নব্বইয়ের শেষদিকে রবীন্দ্রসদন চত্বরে, বিকেল সন্ধের ভিড়ে জমা হতেন কবি-লেখকরা। এঁরা প্রায় সবাই লিটল ম্যাগাজিন বের করতেন, একে অপরের কবিতা পড়তেন, ছাপতেন। আমি এঁদের কাউকেই ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম না। কিন্তু এই যে দল এবং তার বসে থাকা, সন্ধের রবীন্দ্রসদনে উপেক্ষা করা অসম্ভব ছিল। এই দল কী এখনও বসে? আমার ওই অঞ্চলে যাতায়াত খুব বেশী নেই আর। তবে ইদানীংকালে যে গেছি কয়েকবার সেভাবে কোন বড় দল চোখে পড়ে নি। তার কারণটা বোঝা খুব কঠিন নয়। এখন এধরণের অনেক আড্ডাই বসে ফেসবুকে, সেখানেই লেখার আদান-প্রদান হয়। আদান-প্রদান হয়ত আগের মতই আছে, কিন্তু তা সরে এসেছে ভার্চুয়ালের পরিসরে যেখানে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিমানুষ। আমার আজকাল মনে হয় যূথবদ্ধতায় মানুষের যে যোগদান, তা কিন্তু অনেকটাই বাকিদের থেকে একধরণের স্বীকৃতি পাওয়ার ইচ্ছে সঞ্জাত। এখন আর সেই দায় আর নেই। দলহীন এই পৃথিবীতে এখন অনেক অনেক বিচ্ছিন্ন মানুষ সামাজিক মাধ্যমে লাইক-শেয়ার ইত্যাদির মাধ্যমে সেই স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। আগে ব্যক্তি যখন দলে মিশত, তখন প্রাথমিক স্বীকৃতি আসত দলের। ব্যক্তি সদস্য সেই স্বীকৃতির পরোক্ষ ভাগ পেত। এখন কিন্তু স্বীকৃতি আসছে ব্যক্তিরই নামে। কারণ আগে বৃহত্তর সমাজের কাছে পৌঁছনর জন্য যে ব্যয় বহন করতে হত সেই ব্যয় একা কারো পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। মানে ধরুন কোন পত্রিকা প্রকাশ, কবি সন্মেলনের আয়োজন বা নাটক করা এর কোনটাই ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখন প্রযুক্তি এসে এই ব্যয়টাই কমিয়ে দিয়েছে। নিজের কবিতা অন্যকে শোনানোর জন্য আর পাঁচজন কবিকে জোগাড় করে কবি সন্মেলনের প্রয়োজন নেই আর। ফেসবুক লাইভে নিজে নিজেই সেটা করা সম্ভব। তাই মনে হয় যেটাকে সত্তরের দশকে যুথবদ্ধতার টান বলে মনে হয়েছিল, সেটাও হয়ত আসলে নিজের অহং উদযাপনেরই টান, অন্য কিছু নয়। তখন প্রযুক্তির কারণে এই উদযাপণের ব্যয় ছিল বেশী, তাই লোকে আরো আরো বেঁধে বেঁধে থাকার প্রয়াস নিত। এখন এই ব্যয় এসেছে কমে, তাই যৌথতাও ভেঙ্গে যাচ্ছে। এটাই কালের নিয়ম যেখানে প্রযুক্তি এসে পুরোন মূল্যবোধ ভেঙ্গে দেয়, নতুন মূল্যবোধ তৈরি করে। যেমন একসময় ছাপাখানা এসে জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতিকে পালটে দিয়েছিল, আবার ইন্টারনেট এসে তা আরও পালটে গেল। এ নিয়ে আমার কোন দুঃখবোধ নেই। শুধু মনে হল, টুকরো টাকরা শান্তিনিকেতনের মত কোন লেখা আজকের কোন ছাত্র বা ছাত্রী আজ থেকে কুড়ি তিরিশ বছর পরে লিখবেন না বোধহয়।
এখন একজন মানুষ, আর একটি ফোন, আর বিচ্ছিন্ন চারপাশ। কেউ বলে না, কেউ চলে না, কেউ শোনে না!...
#
লাইন স্পেসে ছোট ছোট প্যারায় লেখাটি প্রকাশ হলে চোখের আরাম হতো। আরও লিখুন
সামাজিক মাধ্যমে দল নেই!!