এক ছিল আজবগজব রাজ্য। রংমিলান্তি রাজ্য। সেই রাজ্যে ছিল সাত-সাতখানা গ্রাম। বেগনে গ্রাম, নীল গ্রাম, আকাশি গ্রাম, সবুজ গ্রাম, হলুদ গ্রাম, কমলা গ্রাম আর লাল গ্রাম। ভাবছ বুঝি এমনধারা নাম আবার কোন গ্রামের হয়? কোন রাজ্যেই বা আছে সেই গ্রামগুলো? জানি ভারি কৌতূহল হচ্ছে। কৌতূহল হওয়ারই কথা। না হলেই বরং অবাক কাণ্ড। তাহলে শোনো বলি।
রংমিলান্তি রাজ্যে কারা বাস করে জানো? রঙপেন্সিলরা মানে ক্রেয়নরা। বেগনে গাঁয়ে থাকে বেগুনি ক্রেয়নরা, নীল গাঁয়ে নীল, লাল গাঁয়ে লাল... বুঝতেই পারছ ক্রেয়নদের রঙেই তাদের গাঁয়েরও নাম। যখন আকাশের নীল রঙ ফিকে হয়ে আশে তখন রাজামশাই খবর পাঠান নীল গাঁয়ে। লাল গোলাপ ফোটার সময় হলে খবর যায় লাল গাঁয়ে। গাছের পাতা গজায় যখন সবুজ গাঁয়ে দৌড়য় রাজামশাইয়ের পেয়াদা।
রাজামশাইয়ে রাজমহলের পাশেই আছে বিশাল বড় একটা ক্রেয়ন বানানোর কারখানা। সেখানে একশ কারিগর রোজ রঙপেন্সিল গড়ে। সেই রঙপেন্সিল গড়ার মোম আসে রাজবাড়ির পেছনবাগের জঙ্গলের মৌচাক থেকে। মোম দিয়ে পেন্সিলের দেহ গড়া হলে তাকে পাঠানো হয় রংরেজের বাড়ি। রংরেজ কিন্তু যে সে রংরেজ নয়। সে হল গিয়ে রামধনুর দেশের কারিগর। রামধনুর সাত রঙ থেকে সে সাতটি শিশিবোতলে ভরে নিয়ে আসে রঙ। তারপর ইয়াব্বড় সাতটা জালায় জল ভরে একফোঁটা করে রামধনুর রঙ মেশায়। তাইতে যেই না টপাৎ করে ডুব দেয় রঙপেন্সিলগুলো ওমনি সেই রঙে রঙিন হয়ে যায়।
তারপর সেই রঙিন ক্রেয়নগুলোকে কারখানার কারিগররা জামায় মুড়ে, টুপি পরিয়ে, গায়ে লিখে দেয় বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল। ব্যাস! তখনই ঠিক হয়ে যায় তারা কে কোন গ্রামে বাস করবে। এবার তাদের নিয়মমত যার যেখানে রঙ করার কথা ঠিক তেমনটিই করে চলে জীবনভর। তারপর ক্ষইতে ক্ষইতে যখন এত্তটুকুনটি হয়ে যায় তখন ক্রেয়নদের ফেরৎ পাঠানো হয় রাজামশাইয়ের সেই কারখানায়। তাদের ছাঁচে ঢেলে আবার নতুন করে গড়ে তোলে কারিগররা। রংরেজের রঙের জালায় চুবে রঙিন হয়ে ফের নিজের গ্রামে নিজের কাজে ফিরে যায়।
এই নিয়মেই দিব্যি চলছিল রংমিলান্তি রাজ্য। কিন্তু হঠাৎই একদিন তাল কাটল লাল গাঁয়েতে। এক নতুন ক্রেয়ন, লালু, রাজামশাইয়ের কারখানা থেকে এসে উপস্থিত হল সেই গাঁয়ে। গাঁয়ের প্রথামত নতুন ক্রেয়ন এলেই তাকে অভ্যর্থনা করা হয়, উৎসব হয়। তারপর গাঁয়ের মোড়ল লালপ্রতাপের বাড়ির সাদা দেওয়ালে গিয়ে নিজের নামটা লিখতে হয় নতুন সদস্যকে। গলদটা ধরা পড়ল সেখানেই। লালে লালে ভরা দেওয়ালে হঠাৎই আঁচড় পড়ল নীল রঙের। কী হল কী হল? সবাই তো আশ্চর্য। মুখে বোল ফোটে না। লালু মানে নতুন ক্রেয়নটি নিজেও অবাক। সবাই চোখ বড় বড় করে চায় তার দিকে। ওই তো লাল জামা, লাল টুপি, গায়ে লেখা ‘লাল’ তাহলে আঁচড় কী করে নীল পড়ল।
উঁহু এমনটি তো হতেই পারে না। সবাই হইহই করে উঠল,
-“ওকে আরও বেশি করে রঙ করা অভ্যেস করতে হবে! লাল রঙটা নিশ্চয়ই ওর অনেকটা ভেতর দিকে রয়ে গেছে। ক্ষইতে ক্ষইতে তবে আসল রঙ ফুটবে।”
-“একশটা গোলাপে লাল রঙ করতে হবে রোজ!”
-“শুধু লাল রঙের স্বপ্ন দেখতে হবে!”
-“লাল আপেল, লাল স্ট্রবেরির রস খেতে হবে দুইবেলা!”
-“নীল আকাশের দিকে ভুলেও তাকানো চলবে না!”
এতজনের এতরকম মত শুনে তো কানমাথা ভোঁভোঁ করতে লাগল লালুর। কী করে বেচারা এখন।
লালু ক’দিন তাই করে চলল যেমনটি সবাই বলল। গোলাপে মাথা ঘষে ঘষে তো মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল। ভয়েতে চেয়েও দেখেনা গোলাপে কী রঙ হল! শুধু লাল স্ট্রবেরি আর লাল আপেল খেয়ে খেয়ে মুখ বিস্বাদ হয়ে গেল। আকাশের দিকে পাছে চেয়ে ফেলে সেই আতঙ্কে মাথা নিচু করে থাকতে থাকতে ঘাড় কনকনিয়ে গেল। হাজার কষ্ট হলেও মনে মনে আশা নিশ্চয়ই সব ঠিক হবে এবার। ক’দিন পর মোড়লের বাড়ি ফের ডাক পড়ল। দুরুদুরু বক্ষে গিয়ে সেই দেওয়ালে যেই নাম লিখতে গেল, একই কাণ্ড ঘটল। নীল বড় বড় অক্ষরে লেখা হল ‘লালু’।
এবার তো আর অপেক্ষা করা চলে না। এমন বিপদের খবর রাজামশাইকে জানাতেই হয়। রাজামশাইকে জানানোমাত্র পেয়াদা এসে নিয়ে গেল লালুকে। কী এমন কাণ্ড হল কারখানায় যে লাল জামা পরা, লাল টুপি পরা, গায়ে লাল লেখা ক্রেয়নে নীল রঙ হয়! লালুকে পাঠানো হল রংরেজের কাছে। রংরেজ চোখে চশমা এঁটে লালুকে ডাইনে বাঁয়ে ঘুরে ফিরে দেখে। একবার এদিকে দাগ টানতে বলে, একবার ওদিকে আঁচড় কাটতে বলে। কিন্তু সব জায়গাতেই লালের বদলে নীল আঁচড় পড়ে। রংরেজ তো হতবাক। এত বছর ধরে মোমের পেন্সিলে রামধনুর রঙ লাগাচ্ছে, এমনটা তো কখনও হয়নি। তাহলে কি কারিগরদের গড়তেই কিছু ভুল হয়েছে? মোমের সঙ্গে কি মিশে গেছে অন্য কিছু!
লালুর গাঁয়ের মোড়ল এল, কারিগররা এল, এলেন খোদ রাজামশাই। সবাই মিলে বলল,
-“লালুর মাথাটাই খারাপ হয়েছে!”
-“লালুর অসুখ করেছে নির্ঘাৎ, বদ্যি ডাকো!”
-“লালুকে ফের লাল রঙের জালায় চোবানো হোক!”
-“লালুকে কেটে দেখা হোক ওর ভেতরটাও নীল নাকি লাল!”
লালু কোনওমতে বলার চেষ্টা করল,
-“আচ্ছা আমার গায়ে লাল লেখা বলেই কি আমার রঙ লাল হতে হবে? যদি আমি নীল রঙেরই হই, তাতে অসুবিধেটা কোথায়?”
সবাই তো হাঁ হাঁ করে উঠল,
-“এ আবার কেমন অনাছিস্টির কথা বাপু। রংরেজ শুরুতে যাকে যে রঙে রাঙিয়েছে, যে রঙের পোশাক কারিগর পরিয়েছে, গায়ে যে রঙ লেখা আছে, সেটা আবার বদল হয় নাকি! ওসব চলবেনা। তুমি লাল! লাল! লাল!
লাল রঙ তোমায় করতেই হবে।”
-“রংরেজ ওকে ফের লাল রঙে ডোবাও!”
আদেশ দিলেন স্বয়ং রাজামশাই।
যেমন বলা তেমনি কাজ। সবাই মিলে লালুকে ফেলে দিল গিয়ে লাল রঙের জালায়। জালা থেকে উঠলে পেয়াদা তাকে নিয়ে গিয়ে সাদা দেওয়ালে দাগ কাটতে বলল। দাগ কাটতেই সবাই দেখল লালুর গায়ের নীল রঙ আর জালার লাল রঙ মিশে বেগুনি দাগ পড়ল। শিগগির ঘষে ঘসে বেগুনি রঙ শেষ করে, রংরেজ লালুকে ফের চোবালো হলুদ রঙের জালায়। এবার নীলে আর হলুদে মিলে দাগ পড়ল সবুজ! রংরেজের মাথায় হাত। রংরেজ নানা রঙের জালায় লালুকে ডোবায় আর নতুন নতুন রঙ তৈরি হতে শুরু হয়। লালু একটু একটু করে ক্ষইতে থাকে।
অবশেষে যখন আর একটুখানি অবশিষ্ট আছে তখন লালু কোনওক্রমে চিৎকার করে,
-“এবার থামো!”
সবাই চমকে দেখে দেওয়ালের দিকে। কতরকম রঙের দাগে দাগে দেওয়ালটা ভরে উঠেছে। লালু করুণ সুরে বলে,
-“রাজামশাই কেন এত রঙের বাছবিচার? যা কিছু সুন্দর সেটাকে ভালোবাসলেই তো হয়? লাল গোলাপের বদলে নীল বা হলদে গোলাপে ক্ষতি কি? নীল আকাশে মাঝে মাঝে লাল বেগুনি কমলার রঙ ধরলে মন্দ কী? গাছের পাতা সারা বছর সবুজ না থেকে যদি মাঝেসাঝে হলুদ, কমলা, লালে বদলে যায় ভালো হয় না?”
সবাই মনে মনে ভাবল তাই তো! মন্দ কী! রাজামশাই কারিগরদের বললেন তক্ষুনি লালুকে নতুন করে ছাঁচে ফেলে গড়ে আনতে। আর এবার ও নিজেই স্থির করবে রামধনুর কোন রঙে সাজবে। ওদিকে রংরেজবুড়োও বেজায় খুশি। সে রাজামশাইকে বলে,
-“রাজামশাই আমায় আরও অনেকগুলো জালা বানিয়ে দিন তো বড় বড়। আমি রঙে রঙ মিশিয়ে নতুন রঙ বানাবো! সাতটা নয় সাতশো রঙে ভরব দুনিয়াটাকে”
তারপর?
তারপর কী হল সেটা তোমাদের চারদিকের দুনিয়াটা দেখলেই বুঝতে পারবে। আর লালু? লালু তো এখন আর লাল বা নীল নেই। তার গায়ে সাতশ রঙের মেলা। লালু তাই নিজেই নিজের নাম দিয়েছে, শ্রী ঝলমলচন্দ্র রঙবাহার।
(সমাপ্ত)
ছবি: আমি
ক্যাপ্টেন নিমো অনলাইন ক্লাসে একটি গপ্পের বই পড়েছিলেন। সেইটে আমাকে শোনাচ্ছিলেন পরে এসে। এই আইডিয়াটা সেখান থেকেই এল। ☺️
ছবি কই?
গল্পটা খুব ভাল।
এলজিবিটি মুভমেন্ট নিয়ে ভালো লেখা। বড় চেহারায় অপরিণত মনের লোক শিক্ষার জন্য তো বেশই উপযোগী।