এক বনে থাকত একটা কাঠবেড়ালির ছানা। বাদামি রঙের পশমের মত লোম গায়ে, ইয়া ফুলো ফুলো ঝামরি ঝুমরি বাদামি লেজ একটা। কী বললে কাঠবেড়ালি অমন দেখতে হয়না? কাঠবেড়ালি ছোট্ট ছোট্ট সাদায় কালোয় দাগকাটা পিঠে, ধূসর রঙের হয়। হুম হয়ই তো। কাঠবেড়ালি এরকমও হয় আবার ওরকমও হয়। জঙ্গলে কতরকম পশুপাখি থাকে, সমুদ্রে কতরকম মাছ থাকে তাদের সবাইকে কি আর আমরা চিনি?
আমাদের আজকের গপ্পো এই বাদামি কাঠবেড়ালির ছানাকে নিয়েই। সে এক ভারি দুষ্টু কাঠবেড়ালি। পাইন গাছের কোটরে থাকে মা বাবার সঙ্গে। দুপুরবেলায় যেই না মা একটু দুই চোখের পাতা এক করেছে ওমনি দুষ্টু কাঠবেড়ালি কোটর থেকে এক লাফে বেরিয়ে ভোঁকাট্টা। কোথায় পালায় কাঠবেড়ালি? কোথায় আবার! এই কাছেপিঠে হেথাহোথা। কখনও যায় এ পাশের কোটরে লুকনো বাদাম খেতে, কখনও ও পাশের গাছের ঢুলঢুলুনি প্যাঁচাকে জ্বালাতন করতে, কখনও আবার গাছের গোড়ার ঝোপে লুকনো খরগোশছানাদের ডেকে ডেকে ঘুম থেকে তোলে।
সেদিন খরগোশগিন্নি খুব নালিশ করেছে কাঠবেড়ালির মায়ের কাছে এই নিয়ে। তাই আর খরগোশছানাদের জ্বালাতন না করে চুপিচুপি গাছ থেকে নেমে কাঠবেড়ালি গেল একটু দূরদিকে। এক লাফ দুই লাফ তিন লাফ গুণতে গুণতে প্রায় শতখানেক লাফ দিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে গেল। এমনিতে গুনে গুনে পঞ্চাশটা লাফের থেকে বেশি দূরে যায় না কক্ষণও। বাড়ি ফিরতে পারবে তো! একটু বুক ঢিপঢিপ করে। তারপরেই সামনে দেখে কী সুন্দর গোলাপি গোলাপি ফুলে ঢাকা গাছ। যতদূর চোখ যায় ততদূর। মাটিতে গোলাপি ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে। কাঠবেড়ালি তো মনের আনন্দে গড়াগড়ি দেয় পাপড়ির বিছানায়।
হঠাৎ একটা নীল প্রজাপতি এসে বলে কাঠবেড়ালির নাকের ডগায়। মাথা নাড়িয়ে ওড়ায় তাকে, সে ফের এসে বসে নাকে। ফের ওড়ায়, ফের এসে বসে। এতো মহাজ্বালা। লেজ দিয়ে একটা ঝাপটা মারে নাকে, প্রজাপতি তার আগেই উড়ে পালায়। কাঠবেড়ালির খামোখা নাকে লোম ঢুকে সাড়ে উনিশটা হাঁচি হয়। শেষ হাঁচিটা বেরোতে গিয়েও বেরোয়নি কিনা। হাঁচি থামতেই প্রজাপতিও এসে হাজির। এতো মহা নাছোড়বান্দা প্রজাপতি। চাদ্দিকে এতো এতো ফুল ফুটে আছে তাইতে না বসে কেন নাকে এসে বসা বাপু!
কিন্তু বারবার প্রজাপতিটা ওরকম করায় কাঠবেড়ালির একটু সন্দেহ হল এবার। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল প্রজাপতিকে তারপর প্রজাপতি যেদিকপানে উড়ল কাঠবেড়ালিও সেদিকপানে লাফ দিল। কিন্তু ধরতে পারল না। প্রজাপতি ফের উড়ল, কাঠবেড়ালি ফের লাফালো। এমনি করে বেশ অনেকদূর যাওয়ার পর প্রজাপতিটা শাঁ করে উড়ে গিয়ে বসল একটা উঁচু গাছের ডালে। কাঠবেড়ালি মনে মনে বেজায় হাসল। গাছ বাইতে সে যে কত দড় তা তো আর প্রজাপতি জানেনা।
তরতরিয়ে গাছ বেয়ে উঠে যে ডালটায় প্রজাপতি বসেছিল সেইটেয় গিয়ে দেখে, ও মা! এতো একটা রবিন পাখির বাসা। সেই বাসায় দুটো কুট্টি কুট্টি রবিন পাখির ছানা। তাদের না গজিয়েছে গায়ে লোম, না ফুটেছে চোখ। প্রজাপতিটা এসে বাসাটার গায়ে বসেছে। ছানাদুটো যেন থরথরিয়ে কাঁপছে। আহা রে! ভারি ঠাণ্ডা লেগেছে বুঝি। মুখটা হাঁ করে চিঁচিঁ করে ডাকছেও তো। তার মানে খিদেও পেয়েছে ওদের। কী মুশকিল। কাঠবেড়ালির ছানা এখন কী করে! শুধু কী তাই! নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা দুষ্টু সাপও গাছের গোড়ার গর্ত থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এতো তিনদিক দিয়ে বিপদ।
প্রজাপতিটা মনে হয় ওই জন্যই কাঠবেড়ালির ছানাকে এত ডাকাডাকি করার চেষ্টা করছিল। কী করে কী করে! ভালো করে চারদিকে তাকিয়ে দেখে যে গাছটায় পাখির বাসাটা সেটা একটা ওক গাছ। চারদিকে ডালে ডালে ধরে আছে একর্ন, ওক গাছের ফল। কাঠবেড়ালির ছানার বেজায় প্রিয় খাবার। হুম! একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। ওকনাট মানে একর্নের খোলা তো বেশ শক্তপোক্তও হয়। তাহলে...
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। একটা একটা করে একর্ন ছেঁড়ে আর ঢিপঢাপ করে ছোঁড়ে সাপটার দিকে। সাপটা খানিকক্ষণ পরেই উঁকিঝুঁকি মারা বন্ধ করে ঝটপট পালাল গাছের তলা ছেড়ে। কাঠবেড়ালির ছানা তুড়ুক লেজটি তুলে একপাক নেচে নিল। প্রজাপতিও ডানা নেড়ে একপাক উড়ে নিল। কিন্তু পাখির ছানারা এখনও চিঁচিঁ করে কেঁদেই চলেছে। কাঠবেড়ালি শিগগির একটা ফলের দাঁতে করে খোলা ভেঙে ভেতরের বীজটা চিবিয়ে নরম করে দিল পাখির ছানাদের মুখে। কয়েকবার দেওয়ার পরেই পাখির ছানাদের পেট ভরে গেল। ওই তো অতটুকুটুকু পেট।
যাকগে দুটো সমস্যার তো সমাধান হল। এবার রইল বাকি এক। ছানারা তো এখনও শীতে কাঁপছে। প্রজাপতি উড়ে এসে বসল কাঠবেড়ালির ঝামরি ঝুমরি লেজের ওপর। তাই তো! এটা মাথায় আসেনি এতক্ষণ! বাসার পাশে বসে লেজটা পাখির ছানাদের গায়ে চাপা দিল আলতো করে। তারপর কখন যেন গুটিশুটি দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল। প্রজাপতি ডানা মুড়ে এসে বসল কাঠবেড়ালির ছানার মাথার ওপর। এবারে কিন্তু তাকে আর তাড়ালো না কাঠবেড়ালি।
ঘুম ভাঙল পাখিছানার মা বাবার কিচিরমিচির ডাকে। ওরা তো প্রথমে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। বাসার পাশে কাঠবেড়ালির ছানাকে দেখে। তারপর সবটা শুনে তো কাঠবেড়ালি ছানাকে এত্ত এত্ত চুমো দিল রবিন মা। যদিও পাখির শক্ত ঠোঁটের চুমোগুলোয় একটু মাথায় ব্যথাই লাগছিল কাঠবেড়ালি ছানার তাও কিছু বলল না। ও কি আর ছোটোটি আছে! আজ কত বড় কাজ করল বল দেখি একটা।
কিন্তু মুশকিল হল এবার বাড়ি ফিরবে কী করে কাঠবেড়ালির ছানা। এতটা দূরে তো আগে কখনও আসেনি। তাই মনেই পড়ছে না কোন পথে এসেছে। এমন সময় প্রজাপতি ফের ওড়ে নাকের ডগায়। চিন্তা কী! প্রজাপতির পিছু পিছু চলল কাঠবেড়ালিছানা আর রবিন মা। রবিন বাবা রইল বাসায় ছানাদের পাহারায়।
এদিকে কাঠবেড়ালির মা ঘুম ভেঙে কোটরের বাইরে ডাক শুনে এসে দেখে রবিন মা আর কাঠবেড়ালির ছানা। প্রজাপতিকে অবশ্য দেখতে পায়নি, সে কাঠবেড়ালির লেজের আড়ালে লুকিয়েছিল। প্রথমে তো মা ভেবেছিল রবিনগিন্নি বুঝি কোনও নালিশ করতে এসেছে খরগোশগিন্নির মত। কিন্তু যখন পুরো ঘটনাটা শুনল তখন তো অবাক। সেই দুষ্টু ছানাটা নাকি এত বড় কাণ্ড করেছে একটা। ইতিউতি গাছের কোটর থেকে সব্বাই বেরিয়ে কাঠবেড়ালি ছানা আর প্রজাপতির বীরত্বের গল্প শুনে হাততালি দিল এত এত। এমনকি খরগোশগিন্নিও তার ছানাদের বলল,
-“সারা দুপুর পড়ে পড়ে না ঘুমিয়ে একটু কাঠবেড়ালিদাদার থেকে শিখতে পারিস তো কিছু, নাকি?”
(সমাপ্ত)
আজ গল্পের শেষে কটা মজার কথা বলি? বলেছিলুম না শুরুতেই এই দুনিয়ায় পশুপাখি গাছপালা যে কত্তরকমের হয় তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই শোনো তবে।
গোটা বিশ্বে কতরকম প্রজাতির কাঠবেড়ালি হয় জানো? প্রায় ২৮৫!
আরও শুনবে?
রবিন পাখিরও প্রায় ৬৫ টা প্রজাতি আছে।
শুধু পশুপাখি! গাছেরাও কতরকমের হয়! পাইন গাছের প্রায় ১২৬-টা আর ওকগাছের প্রায় ৬০০-টা প্রজাতি হয়।
এই শুনেই যদি তোমরা অবাক হও, তাহলে এবার যেটা বলব সেটা শোনার আগে বাপু একটু শক্ত হয়ে বোসো। সারা বিশ্বে প্রায় ১৭৫০০ রকমের প্রজাপতি দেখতে পাওয়া যায়! বোঝো!
তাহলেই ভেবে দেখো আমাদের এই পৃথিবীটা কতরকম আশ্চয্যিতেই না ভরে রয়েছে।
ছবি: সুকান্ত।
(তথ্যে কোথাও ভুল থাকলে ঠিক করে দিও বন্ধুরা)
বাহ, দারুন তো!
লেখায় ছবির কথা আছে, কিন্তু ছবি আসেনি দেখছি।
অপরূপ রূপকথা .
খুব ভালো লাগল। ভারী সুন্দর।