সোশাল মিডিয়ায় ব্যক্তি বা বর্গের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত/রাজনৈতিক/সামাজিক সমবেত আলোচনা/সমালোচনা অনেক সময়েই ‘খাপ বসেছে’ বলে অভিহিত হয়; খাপ পঞ্চায়তের সঙ্গে এই তুলনার কিছু তাৎপর্য আছে, ন্যায়-বিচারের যুক্তিকাঠামোর বিরুদ্ধে ‘খাপ’ শব্দটি একটি প্রতীকী উচ্চারণ, যেখানে প্রচলিত যুক্তির বিন্যাসে ন্যায় পাওয়া সম্ভব না। ‘খাপ পঞ্চায়েত’ বিষয়ে দুএক কথা আমরা সকলেই জানি, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লির গ্রামাঞ্চলে জাঠদের সমাজ-রাজনীতি ও জাতিগত দৃষ্টিভঙ্গি, চলনের আধার হল ‘খাপ পঞ্চায়েত’। যদিও রাজস্থান, পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে থাকা বৃহত্তর জাঠ জাতির মধ্যে সর্বত্রই যে খাপ পঞ্চায়েত বিরাজমান, এমনটা একদমই নয়। ‘খাপ’গুলি সম গোত্রের মধ্যে বিবাহের বিরুদ্ধে -সেরকম কিছু ঘটলে খাপের সামাজিক ক্ষমতা আছে সেই বিয়ের পাত্রপাত্রীদের ঘাড় ধরে ভাইবোনের পরিচয়ে মুচলেকা দিতে বাধ্য করার, কখনো মৃত্যুদণ্ডর বিধান দেওয়ার যাকে বলে ‘অনার কিলিং’ - জাতির সম্মান ও সংস্কৃতি রক্ষার্থে হত্যা।
খাপ পঞ্চায়েতের বিচারপদ্ধতি পিতৃতান্ত্রিক, কুৎসিত জাতিবর্ণব্যবস্থার দোষে দুষ্ট, সামন্ততান্ত্রিক দর্শনের প্রতিভূ বলে অভিযোগ ওঠে। আশ্চর্যের বিষয় হল ‘খাপ পঞ্চায়েত’-এর পরিপূর্ণ বিকাশ হয়েছে আধুনিক, স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে। খাপ পঞ্চায়েত নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে, আদালতের বাইরে তারা এই রকম বিচার সভা বসাতে পারে কিনা সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, খাপ পঞ্চায়েতের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, গণতান্ত্রিক সমাজে এরকম একটা সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকতে পারে কিনা সে প্রসঙ্গও উঠেছে। উল্টোদিকে জাঠ সমাজের প্রতিনিধিরা খাপের সমর্থনে তাদের জাতির সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যুক্তি তুলেছেন, এবং একটি ডকুমেন্ট পেশ করে মোঘল আমল থেকে খাপ পঞ্চায়েতের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ও গুরুত্বের কথা প্রমাণ করতে চেয়েছেন -এক পণ্ডিত কানহারাম রচিত একটি নামহীন পুঁথির সাহায্যে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে বহুযুগ আগে, মুহম্মদ ঘুড়ির সময়ে জাতির সম্মান রক্ষার্থে জাঠদের জোটবদ্ধ হবার লক্ষ্যে সর্বখাপ পঞ্চায়েত বসে। তারপর তৈমুর লঙের আক্রমণের বিরুদ্ধে এবং বাবর থেকে অওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধেও খাপ পঞ্চায়েতের নেতৃত্বে জাঠ বিদ্রোহের উদাহরণ দিয়েছেন। মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে যাদের এত সংগ্রাম সেই খাপের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কোন শালায়?
বলাই বাহুল্য, উপরোক্ত পুঁথিটি ভুয়ো। ঐতিহাসিক সূরজভান ভরদ্বাজ এক কথায় নস্যাৎ করে দিয়েছেন এই খাপ প্রতিরোধের গল্প, প্রথমত এই প্রতিরোধের কোনো অন্য কোনো ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ নেই, দ্বিতীয়ত আধুনিক হিন্দিতে লেখা গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছু নেই সেই পুঁথিতে, তৃতীয়ত মুঘল আমলেও জাঠেদের গ্রামাঞ্চলে সম্রাটের প্রতিনিধিদের (যেমন কানুনগো, চৌধুরি, পটেল) মাধ্যমে শাসন শৃঙ্খলার ভার ন্যস্ত ছিল, খাপ পঞ্চায়েতের মতো কোনো সামাজিক সংগঠন বা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা উপস্থিতি সেইসময় ছিল না। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে আর্য সমাজের প্রভাবে মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে ‘হিন্দু জাগরণ’-এর ধুয়ো তুলে নানা বইপত্র লেখা হতে থাকে, মারাঠা হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এইরকম লেখালেখি শুরু করেন (বাংলায় আনন্দমঠ স্মরণ করা যেতে পারে) - পণ্ডিত কানহারামের পুঁথিটি ওইরকমই কিছু হবে। সুরজভান ভরদ্বাজ আরো মন্তব্য করছেন যে অসংখ্য গোত্রে বিভক্ত জাঠদের (পশ্চিম উত্তরপ্রদেশেই আশির বেশি গোত্র আছে) জাতি পরিচয় শক্তিশালী হওয়া শুরু করে ১৯৬০-এর দশকে, চৌধুরি চরণ সিং-এর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে। বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন খাপ স্থাপিত হয়, খাপগুলি থেকে রাজনৈতিক নেতাদের জন্ম হতে থাকে। দেবীলালের হাত ধরে হরিয়ানায় খাপ শক্তিশালী হয়, জাঠ ভোট ব্যাঙ্ক ঘনীভূত হবার প্রয়োজনীয়তায়। ১৯৯৩ সালের ২৩ মার্চ, হরিয়ানার সিসনা গ্রামে লক্ষাধিক সরপঞ্চের (খাপ মেম্বারের) উপস্থিতিতে হল প্রথম সর্বখাপ সম্মেলন, উদারনীতি ও বিশ্বায়ন পরবর্তী ভারতের মাটিতে খাপ ব্যবস্থা অবয়ব পেল। কী কী সিদ্ধান্ত হল সেইখানে? পুত্রসন্তান না থাকলে তবেই মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার থাকবে, বিয়ের বারাতে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া চলবে না, ছেলে মেয়েদের একসঙ্গে স্কুল কলেজ করা যাবে না, পঞ্চায়েতে মহিলাদের ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ তুলে দিতে হবে। খাপের চাপে হরিয়ানা সরকার সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনে বদল করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেয় পরিবর্তনের জন্য!
খাপের ইতিহাস নিয়ে উপরোক্ত আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, খাপ পঞ্চায়েতের বিষয়টিকে যেভাবে মধ্যযুগীয় বর্বর বলে চিহ্নিত করা হয়, সেরকম আদপেই নয়, বরং খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা, গত পঞ্চাশ বছরে খাপ পঞ্চায়েত শক্তিশালী আকার পেয়েছে আধুনিক ভারতের মুখে চুনকালি মাখিয়ে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই, নির্বাচনকেন্দ্রিক সমীকরণের সূক্ষ্মতা মাথায় রেখেই রেখেই খাপ পঞ্চায়েত বিকশিত হয়েছে, যেমন বিকশিত হয়েছে রামজন্মভূমি কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক বিজেপির রাজনীতি। বাবরি মসজিদের মধ্যে রামালালার মূর্তির আবির্ভাবের মতই পণ্ডিত কানহারাম রচিত পুঁথি আবিষ্কৃত হল, খাপের ঐতিহাসিক ভিত্তি নির্মিত হল - পোস্টট্রুথ কথাটি উদ্ভাবনের বহু আগে থেকে ভারতের দক্ষিণপন্থীরা ইতিহাস বিকৃতিকরণের অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে।
এখন বিষয়টি হল, আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় খাপ ছাড়াও আরো নানা ধরনের রাষ্ট্র-অননুমোদিত বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল, আছেও, যেমন আদিবাসীদের নিজস্ব সামাজিক বিধান ব্যবস্থা, গ্রামের মোড়ল প্রথা, দলিতদের বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের বিধিনিষেধের ব্যবস্থা, মব লিঞ্চিং এর উদাহরণ (মুসলিম ও দলিতদের বিরুদ্ধে), বিবিধ কারণে একঘরে করার সামাজিক ঘটনা ইত্যাদি। আধুনিক, গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের প্রেক্ষিতে উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলি গোলমেলে, এই সব ক্ষেত্রে আগে থেকেই অপরাধ ও অপরাধী নির্দিষ্ট হয়ে থাকে, সংস্কৃতি - লোকাচার - ধর্মের যুক্তিই এসব ক্ষেত্রে মানদণ্ড - কোনো যুক্তিতর্ক, আত্মপক্ষ সমর্থনের অবকাশ নেই। অযৌক্তিকতার এই যুক্তিকাঠামোর বিপরীতে রাষ্ট্র-অনুমোদিত আধুনিক আদালতের বিচারের উপর ভরসা রাখে আধুনিক মানুষ।
এই সকল রাষ্ট্র-অননুমোদিত বিচারব্যবস্থার নতুন নতুন উপস্থিতি ও আধুনিক সমাজের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রবল উদ্যমে টিকে থাকা ভারতের ভিন্ন শ্রেণিগুলির সামাজিক বিরোধাভাসকেও ইঙ্গিত করে। ১৯৪৭-এর পরবর্তী নানারূপ কৃষি সংস্কার, আইন করে জমিদারি প্রথার বিলোপ সত্ত্বেও ভারতরাষ্ট্রের উৎপাদন সম্পর্কের সামন্ততান্ত্রিক চেহারাটি বদলায়নি, সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের উপর আইনি আঘাত এলে (যা আদতে উপরিকাঠামোয় আঘাত), অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে নতুন ধরনের উপরিকাঠামোর সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামন্তবাদ নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। যেমন, বিহারের তীব্র সামন্ততান্ত্রিক শিকড় যেখানে আছে সেই গ্রামাঞ্চলে আশি-নব্বই দশকে বিভিন্ন উচ্চবর্ণের সশস্ত্র বাহিনী, রণবীর সেনা, সানলাইট সেনা ইত্যাদি গড়ে ওঠে, জমির দখলদারিকে বজায় রাখতে। বুর্জোয়া আইনের মাধ্যমে জমি হাতবদল আটকাতে আইনি ব্যবস্থার নাকের ডগায় গড়ে ওঠে সামন্ততান্ত্রিক সশস্ত্র সংগঠন।
আবার খাপ প্রসঙ্গে বলা যায়, হরিয়ানা, দিল্লির গ্রামাঞ্চল ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সেইসব অংশেই খাপের বাড়াবাড়ি যেইখানে বিশ্বায়নের পরে একের পর এক রিয়েল এস্টেট গড়ে উঠেছে, জমি বিক্রির বিপুল টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে স্থানীয় কৃষিজীবী জাঠেরা। গ্লোবাল ক্যাপিটালের কাঁচা টাকা হাতে নিয়ে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রবল রক্ষাকর্তা রূপে দাপট দেখাচ্ছে খাপ। চৌধুরি চরণ সিংদের নেতৃত্বে যে সামন্ততান্ত্রিক পুনরুত্থানবাদী রাজনীতির জন্ম হয়েছিল, তা পরিপূর্ণ চেহারা পেল খাপের উত্থানের মাধ্যমে, বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়ে।
এখানে আর একটি রাষ্ট্র-অননুমোদিত বিচারব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা জরুরি যেটিও অত্যন্ত বির্তকিত, কখনো ক্যাঙ্গারু কোর্ট কখনও বিচারের প্রহসন বলে উল্লেখিত হয়, অতীতের কমিউনিস্ট/নকশাল, বর্তমানে মাওবাদীদের গণ আদালত। গণ আদালতের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল, ন্যায়বিচারের ধাপগুলি এক্ষেত্রে মানা হয় না, কোনো লিখিত ধারা নেই, পিপলস কোর্টের বিচারকরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ দিয়ে বিচার করেন, যা কোয়ালিটি অফ জাজমেন্ট ও নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ণ করে। পিপলস কোর্টের নিজস্ব দর্শনের ভিত্তিগুলি দেখে নেওয়া যাক।
সলিল চৌধুরী রচিত ১৯৪৭ সালের গান ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা’ গানটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বিচার কেন্দ্রেও বাজানো হত। গানের লিরিক মারাত্মক, মোদ্দা বক্তব্য হল ন্যায়ালয়ের সর্বোচ্চ আসনে যারা বসে আছেন তারা শাসন ও শোষণের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার দায়ে অপরাধী, তাদের সভায় আমির যারা, ফাঁসিকাঠে ঝুলবে তারা, রক্তারক্তি হবে ইত্যাদি। মোটামুটি বুর্জোয়া বিচারব্যবস্থা নিয়ে কমিউনিস্টদের লাইনেই গানটি রচিত। বুর্জোয়া ব্যবস্থা নিয়ে (বকলমে বুর্জোয়া আইন ও ন্যায়ের ধারণা নিয়ে) তারও আগে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব কী মতামত রেখেছিলেন সেগুলি খানিক দেখে নেওয়া যাক। ‘আধুনিক রাষ্ট্রের শাসকমণ্ডলী হল সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণির সাধারণ কাজকর্ম ব্যবস্থাপনার একটি কমিটি মাত্র’ – কমিউনিস্ট ইস্তেহারের ঘোষণা (পৃষ্ঠা আটাশ, ধ্রুপদি প্রকাশনা, ১৯৫৯)। কার্ল মার্ক্সের মতে, রাষ্ট্র হল শ্রেণি শাসনের অঙ্গ, এমন একটি অঙ্গ যার মাধ্যমে এক শ্রেণি অন্য শ্রেণির উপর শোষণ চালায়। রাষ্ট্রর নির্মিত শৃঙ্খলার পাঠ শ্রেণি শোষণের জায়েজ ভিত্তি স্থাপন করে ও বয়ে নিয়ে যায়i – লেনিন লিখছেন –অলংঘ্যনীয় শ্রেণি সংঘাতের রূপ হল রাষ্ট্রii। এঙ্গেলসের মতে –রাষ্ট্রকে যদি শ্রেণি বিরোধের রূপ হিসেবে গন্য করা হয়, রাষ্ট্র যদি একটি শক্তি রূপে সমাজের উপরে নিজেকে স্থাপন করে, তাহলে পরিষ্কার ভাবে এটিও বলার যে শুধু হিংসাত্মক বিপ্লব নয়, রাষ্ট্রের কলকব্জাগুলিকে ধ্বংস করা ছাড়া শোষিত শ্রেণির মুক্তি সম্ভব নয়, যে কলকব্জাগুলি শাসক শ্রেণির তৈরি এবং যে কলকব্জাগুলি সমাজের ঊর্ধ্বে, সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে মূর্ত হয়iii। এঙ্গেলসের মতকে আরও বিস্তার করছেন লেনিন – এঙ্গেলস বিশদ করছেন ক্ষমতার ধারণা যেটাকে রাষ্ট্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, এমন ক্ষমতা যার উৎসস্থল হল সমাজ কিন্তু সেই রাষ্ট্র নিজেকে সমাজের উপরে স্থাপন করে, ক্রমে ক্রমে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে। এই সর্বব্যাপী ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কি? ভরকেন্দ্র হল রাষ্ট্রের অনুমোদিত বিশেষ সশস্ত্র বাহিনী, তাদের নিয়ন্ত্রিত কারাগার ইত্যাদিiv। – শোষণের যন্ত্রটির কলকব্জা হল রাষ্ট্র নিয়োজিত বন্দুকধারী, জেল ইত্যাদির সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। লেনিনের লেখার এই অংশে ন্যায়ালয়ের উল্লেখ নেই, কিন্তু আমরা ধরে নিতে পারি পুলিশ, জেলের কাঠামোয় অবশ্যম্ভাবীরূপে আদালত ও বিচারব্যবস্থা থাকবেই। এবং এই বিচারব্যবস্থা কমিউনিস্টদের যুক্তিতে বুর্জোয়া বিচারব্যবস্থা যা আদতে শ্রেণিদমনের কলকব্জার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মার্ক্স/এঙ্গেলস/লেনিনের বিচারে সমাজের উপরে নিজেকে স্থাপন করে, মহামান্য হিসেবে প্রতিভাত হয় ও পবিত্র, প্রশ্নাতীত, সর্বোচ্চ রায়দানের ক্ষমতার অধিকারী হয়। মার্ক্স/এঙ্গেলস/লেনিনের বিচার ধারা অনুযায়ী বুর্জোয়া বিচারব্যবস্থা আদৌ নিরপেক্ষ নয়, এই ন্যায়বিচারে আস্থা রাখার অর্থ বুর্জোয়া রাষ্ট্রের শ্রেণি দমনের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাজ্ঞাপন। যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপকে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, বুর্জোয়া বিচারব্যবস্থা সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার প্রধান প্রতিষ্ঠান (ম্যানিফেস্টোতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপ বলতে গরিব মধ্যবিত্তের বাড়ি-সম্পত্তি কেড়ে নেবার কথা বলেনি, পুঁজিপতির হাতে কেন্দ্রীভূত সম্পত্তি যা বিরাট অসাম্যের জন্ম দেয় সেই সম্পত্তি বিলোপের ব্যাপারে বিষয়ে বেশ কয়েক প্যারাগ্রাফ জুড়ে লেখা আছে)।
‘ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ’ পুস্তকে পারী কমিউনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে লিখছেন ‘স্থায়ী ফৌজ, পুলিস, আমলাতন্ত্র, যাজক সম্প্রদায় ও আইন-আদালত’-এইগুলি হল ‘কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রশক্তির সর্বব্যাপী যন্ত্র’; এই কেন্দ্রিত রাষ্ট্রশক্তি মধ্যযুগে জন্মগ্রহণ করে এইযুগে বিকাশ লাভ করে (*১৮৭১ সালের কথা বলা হচ্ছে)। মূলধন ও শ্রমশক্তির মধ্যে শ্রেণিবৈরিতা যতই তীব্র হতে থাকে, রাষ্ট্রশক্তিও ততই শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখার স্বার্থে পুঁজিপতির কেন্দ্রীয় ক্ষমতা যন্ত্রের, সমগ্র সমাজকে দাসত্বনিগড়ে বাঁধবার উদ্দেশ্যে সংগঠিত এক সার্বজনিক দণ্ডের, এক শ্রেণিগত শাসন-যন্ত্রের চরিত্র পরিগ্রহ করতে থাকে…। এবং পারী কমিউনে পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রাষ্ট্রের ভ্রূণকার চেহারা দেখে চমৎকৃত হন। ‘কমিউনের প্রথম ডিক্রিই ছিল স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর বিলোপ ও সশস্ত্র জনগণ দিয়ে তার স্থান পূরণ’, কমিউনে ‘রাষ্ট্রের বড় চাকুরেদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমস্ত বিশেষ সুবিধা ও প্রতিনিধিত্ব ভাতাও দূর করা’, ‘রাষ্ট্রক্ষমতার কাজগুলি যত চালাবে সর্বজনগণ, ততই হ্রাস হয় সে ক্ষমতার প্রয়োজনীতা’ ইত্যাদি বয়ানে বিকল্প রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে অভিনন্দন জানান তিনি।
সেই পারী কমিউনও নেই, সেই মার্ক্সও নেই, কিন্তু দেড়শ বছর আগের বুর্জোয়া একনায়কত্ব জাঁকিয়ে ক্রমে ক্রমে জাঁকিয়ে বসেছে। বুর্জোয়া একনায়কত্বের অধীনস্থ ন্যায়বিচারের ধারণা এতটাই বিকশিত হয়েছে যে বুর্জোয়া একনায়কত্বর উপস্থিতি ভুলে গিয়ে শুধু ন্যায়বিচারের ধারণাটিই চোখে পড়ে, ন্যায়বিচারের কাঠামোটিই আইডিওলজির রূপ পেয়ে গেছে। আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সম্মতি নির্মাণের কলকব্জাগুলিও ভয়ঙ্কর প্রভাবশালী, প্রবল মুক্তমনা তার্কিকও বুর্জোয়া ন্যায়বিচারের অমোঘতায় আসক্ত হয়ে যান, প্রতিষ্ঠান হিসেবে ন্যায়ালয়কে মহত্তম ও অবিকল্প ভাবতে থাকেন- প্রায় ঐশ্বরিক।
কমিউনিস্টদের বুর্জোয়া বিচার ব্যবস্থা নিয়ে উপরোক্ত যুক্তিগুলি যথেষ্ট সেকেল মনে হতে পারে, আমার আপনার অপছন্দের হতে পারে, কিন্তু এটা গণ আদালতেরও যৌক্তিক কাঠামো - এক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের কাঠামোটিই সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিসরের।
অবশ্য ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বিচারকরা যে সব রায় দিচ্ছেন আজকাল, যেভাবে শাসক ও বিচারব্যবস্থা কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে হিন্দুত্বর ধারণাকে হাওয়া দিচ্ছেন তাতে আঁতকে উঠেছেন আধুনিক গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণি হিন্দু ফ্যাসিস্ট তাই বিচারালয়ের বিচার একটু গণ্ডগোলের হয়ে যাচ্ছে - এটা তো কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না! কমিউনিস্টরা অন্যভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন, পুঁজিবাদের আভ্যন্তরীণ সঙ্কটে শাসক শ্রেণির আর পুরানো শাসন পদ্ধতিতে শাসন করতে পারছে না, বুর্জোয়া একনায়কত্ব রক্ষার্থে উদারতার মুখোশ খুলতে হচ্ছে, আদালতের প্রতিটি রায় বুর্জোয়াদের একনায়কত্বর দাপট স্থূল ভাবে প্রকাশ করে দিচ্ছে। এবং এটি শুধু ভারতবর্ষের ঘটনা নয়, পৃথিবী জুড়ে দক্ষিণপন্থার উত্থান হয়েছে ও অটোক্র্যাসি কেমন ভাবে ন্যায়বিচারের উপর দখলদারি চালাচ্ছে তার বিবরণ এই উদারপন্থী পত্রিকায় পড়তে পারেন।
https://www.theguardian.com/global-development/2019/feb/28/study-warns-of-rise-in-autocratic-leaders-hijacking-laws-for-own-ends-world-justice-project-global-justice-index।
মোদ্দা বিষয় হল, পৃথিবীতে সংঘাত থাকবেই, সংঘাতের নিষ্পত্তি কোথায় হবে, কোন এজলাসে হবে তা নিশ্চিত ভাবে বলা মুশকিল। ফ্রান্সের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অ্যান্টিবডি হিসাবে পারী কমিউন এসেছিল স্বল্প সময়ের জন্য, দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে গেছিল। ভারতেও অদূর ভবিষ্যতে জেগে ওঠা জনতা বিচারপতির বিচার করবে কিনা সেটা দেখবার।
১ তা লেনিনের সরকার/রাষ্ট্র বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে জনগণের বা শ্রমিকের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল? সেটা নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ছিল ? মস্কো ট্রায়াল?
২"‘কমিউনের প্রথম ডিক্রিই ছিল স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর বিলোপ ও সশস্ত্র জনগণ দিয়ে তার স্থান পূরণ’, কমিউনে ‘রাষ্ট্রের বড় চাকুরেদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমস্ত বিশেষ সুবিধা ও প্রতিনিধিত্ব ভাতাও দূর করা’, ‘রাষ্ট্রক্ষমতার কাজগুলি যত চালাবে সর্বজনগণ, ততই হ্রাস হয় সে ক্ষমতার প্রয়োজনীতা’ ইত্যাদি বয়ানে বিকল্প রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে অভিনন্দন জানান তিনি"।
--এর মধ্যে কোনটা লেনিনের রাশিয়ায় বা মাওয়ের চীনে হয়েছে? বস্তারের মাওবাদীদের ক্যাঙ্গারু কোর্টের রায়ে আদিবাসী গরীবমানুষের পুলিশের চর সন্দেহে গলাকাটা ছেড়েই দিলাম।
৩ ভাল ভাল কথা বড় বড় বইয়ে অনেক লেখা থাকে । রামায়ণ-মহাভারতে , টেন কম্যান্ডমেন্টে , স্টেট এন্ড রেভোলুশনে। বাস্তবে?