এবারে আমরা আলোচনা করব সেইধরনের কবিতা নিয়ে যা বৃহত্তর বিশ্ব তো বটেই এমনকি ইরানের অধিকাংশ মানুষের কাছেও অপরিচিত। লিকো। এ কবিতা লিখিত নয়। ইরানে বাচিক কবিতার যে পরম্পরা রয়েছে তার অন্যতম হল লিকো। ইরানে যে দীর্ঘ ধ্রুপদি কাব্যধারা রয়েছে তা থেকে একেবারেই পৃথক এই লিকো কবিতা। পৃথক দু-অর্থে। প্রথমত লিকো ফারসি ভাষায় নয় ইরানের একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভাষায় এ কবিতা লেখা— রুদবারি। দ্বিতীয়ত সেই কবিতার উৎসের নৃতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক পরম্পরা ইরানের মূলধারার সাহিত্যের উৎসের থেকে একেবারেই আলাদা। সে অর্থে লিকো-কে অন্য বলা যেতে পারে।
দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের একটি অঞ্চলের নাম রুদবার। এই রুদবার অঞ্চলে এসে মিশেছে একাধিক সংস্কৃতি— কেরমান অঞ্চলের ফারসি সংস্কৃতি, পারস্য উপসাগর তীরবর্তী হোরমোজ়গানি সংস্কৃতির এবং পূর্বের বালুচেস্তান অঞ্চলের বালুচ সংস্কৃতি। এই অঞ্চলে যুগে যুগে এসেছেন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, আর তার ফলেই এখানে গড়ে উঠেছে এক অন্য সাংস্কৃতিক পরম্পরা যা ইরানের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে একেবারেই পৃথক।
বৃহত্তর অর্থে বলা যেতে পারে লিকো কবিতা রুদবার এবং বালুচেস্তানের বাচিক পরম্পরার অন্তর্গত। ধ্রুপদি ফারসি কবিতার থেকে লিকো এই অর্থেও পৃথক যে, একে ‘সিলেবিক’ কবিতা বলা যেতে পারে। এবং এই নিরিখে আবার রুদবারি ও বালুচি লিকোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রুদবারি লিকো চার সিলেব্লের কবিতা আর বালুচি লিকোতে সাধারণত থাকে দশ সিলেব্ল। দুই ধরনের লিকোই অবশ্য ছোটো ছোটো কবিতা, এবং যার ফলে তা পাঠকের সক্রিয় অংশগ্রহণ দাবি করে। প্রশ্ন হল, এই ধারার কবিতার নাম লিকো হল কেন? নীল ও খয়েরি রঙের এক স্থানীয় পাখির নাম থেকে। একসময় রুদবার অঞ্চলে প্রচুর পাওয়া যেত। কিন্তু অনন্ত অনাবৃষ্টির ফলে তার সংখ্যাই এখন অতি অল্প।
লিকোর ছন্দও ইরানের ধ্রুপদি কবিতার ধারা থেকে একেবারে পৃথক। ধ্রুপদি ফারসি কবিতা আসলে আরবি ছন্দ-পরম্পরা অনুসরণ করে। আর লিকোর ছন্দ-পরম্পরা ইরানে ইসলাম প্রচলিত হওয়ার আগের সময় থেকে প্রবাহিত হয়ে আসছে। দুর্ভাগ্যবশত ইরানে বাচিক কবিতার পরম্পরা প্রায় বিলীন হয়ে এসেছে। অবশিষ্ট শুধু রুদবারি লিকো, কুর্দিশ বাইত, আফগানি লন্ডে আর বালুচিলিকো পরম্পরা। এই কয়েকটি পরম্পরার কবিতাই এখনও প্রাচীন সিলেবিক কবিতার পরম্পরা বহন করে নিয়ে চলেছে।
রুদবারি লিকো সাধারণত চার শব্দের পঙ্ক্তি এবং অন্ত্যমিল দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। রুদবার অঞ্চলে অবশ্য লিকো কবিতা আরও একাধিক নামে পরিচিত—দাহু দাহু, জ়হরা, দিকান, জ়হিরুকি এবং তস্কিন। আকারে এত সংক্ষিপ্ত হওয়ার জন্যই এবং প্রাত্যহিক জীবন থেকে তা উঠে আসার কারণেই লিকোকে প্রায়শই জাপানি হাইকুর সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু হাইকুর থেকে এর বিশেষ একটি পার্থক্যের কথা বলতেই হবে। বিভিন্ন ঋতুর ছবি পাশাপাশি গেঁথে যেভাবে হাইকু তৈরি হয়, যাকে পরিভাষায় ‘কিরু’ বলা হয়ে থাকে তা কিন্তু লিকো কবিতায় একেবারেই অনুপস্থিত।
অনেক গবেষক লিকো-কে নারী পরম্পরায়ের কবিতা বলেও মনে করে থাকেন। এর কারণ সাধারণত মহিলারা ঘেচাক, চাং, নেই, শাবানি এবং দুনিলি-র মতো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে লিকো গেয়ে থাকেন। তবে কোনো বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই মরুভূমির বাতাসের ডাকের সঙ্গে মিশে রুদবারি মানুষের কণ্ঠে ভেসে আসছে লিকো, এমনটাও নেহাত বিরল নয়।
লিকো এক কঠোর জীবনচর্যার কবিতা। এতে ফুটে ওঠে মরূদ্যানের জীবন। যে জীবনে কঠোর পরিশ্রমটাই দৈনন্দিন সত্য, আর তারই মাঝে মাঝে আসে আনন্দের সংক্ষিপ্ত সময়। এ কবিতা বলে যাযাবর মানুষের সম্পর্কের কথা। বলে সারারাত ধরে মরুভূমিতে নিঃসঙ্গ উট-চালকের কথা। বলে কয়েক মুহূর্ত দেখা দেওয়ার পরেই ভীষণ বালু-ঝড়ে আবছা হয়ে যাওয়া প্রিয়তমার কথা। অতৃপ্ত ভালোবাসার কথা।
নীচে রইল লিকো কবিতার কিছু তরজমা করা উদাহরণ।
—
১।
গ্রীষ্মের সেই আগুন দুপুরে
বলোনি আমায়—এসো বসো
২।
দরজায় ঝুলছে একটা তালা
নিস্তব্ধ প্রশান্ত
আমার চারপাশ
৩।
তোমার পায়ের ছাপ ধরে চলি
মাটিতে পড়ে তোমার হাতের চুড়ি
৪।
গোরস্থানে উড়ছে পাতাকা আরেকটা
সইতে হবে কত কষ্ট আরও
৫।
তিক্ত জলের কুয়ো
ধুসর চাদর জড়ানো মেয়ে
ঘুমিয়ে রয়েছে পাশে
৬।
বসে আছি মরুর নদীর পাশে
অপেক্ষায় কালো চুলের প্রিয়তমার
কথা দিয়েছে যে সে
৭।
তোমার চাদর জড়িয়ে নিয়েছি
চলে যাব তোমাকে ছাড়াই
৮।
বালি আর ধুলো চারপাশে
এই তো রুদবার, এই আমার দেশ
৯।
দেহটাকে পাহাড়ে নিয়ে যেও
নিজের হাতে
নিজেকে জ্বালিয়েছি
১০।
সারারাত চরছে পাল
চরায় যে, কী নিঃসঙ্গ সে
১১।
তোমার বাড়ির ছায়ায়
পাতা রয়েছে খাট
আমার জীবন নাও, আমায় মুক্ত করে দাও
১২।
হুস করে চলে গেল গাড়ি
ব্রেক কষল
গ্রামের হাসপাতালের ঠিক সামনে এসে
১৩।
বাতাসে বসন্ত
পথের দলপতি আমার দুই চোখ
১৪।
খেজুরবাগানে ঝগড়া শুরু হল
তোমার আমার কাহিনি হবে বলে
১৫।
রূপসি নারীদের বাড়ি
লম্বা ওই লেবুগাছের নীচে
১৬।
আকাশে মেঘের টুকরো একটা
রূপসি প্রিয়াকে আমার
দেখা গিয়েছে পথের ধুলোয়
১৭।
কিছুই দ্যাখে না আমার দু-চোখ
আমার হাত ধরো, যাত্রা শুরু করাও
১৮।
এই ঝলমলে চাঁদনি রাতে
বিশ্বাসই করব না ঘটতে পারে এমন বিপর্যয়
১৯।
পাহাড়ে চড়ো
এবং ঘটনাটা মনে রেখো
২০।
তোমার চাদর তুমি
মাটিতে লুটিয়ে নিয়ে যাও
যাও আমায় জীবন্ত কবর দিতে দিতে