বিজান এলাহি। আজকের ফারসি সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় কবি ও সাহিত্য-তরজমাকার। জীবনের শেষ তিরিশ বছর ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। জীবৎকালে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশ করতে পারেননি বারদুয়েক চেষ্টা করেও। ২০১০ সালে প্রয়াণের পর জনসমক্ষে আসা শুরু হয়েছে তাঁর কবিতার ও তরজমার বিপুল ভাণ্ডার। লিখছেন ইরানি কবি, তরজমাকার, সাহিত্যের গবেষক ও এনসাইক্লোপিডিয়া ইরানিকার প্রাবন্ধিক মাহদি গঞ্জভি১
বিজান এলাহির জন্মদিন গেল ৭ জুলাই। তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালে। মৃত্যু ২০১০-এ। কবিতা নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা-করা এই মডার্নিস্ট কবি তাঁর মৃত্যুর পর আধুনিক ফারসি কাব্যজগতে যে স্থান পেয়েছেন তা এ পর্যন্ত নিমা ইউশিজ (১৮৯৭-১৯৬০), আহমদ শামলু (১৯২৫-২০১০) এবং ফুরুঘ ফারখজাদের (১৯৩৪-১৯৬৭) মতো হাতে গোনা কয়েকজন কবিই তাঁর আগে অধিকার করতে পেরেছেন। তবে এই কবিদের সঙ্গে এলাহির জীবনের একটা পার্থক্য এই যে, মৃত্যুর আগের তিন দশক তিনি প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে কাটিয়েছেন, এবং জীবৎকালে মাত্র দু-বার নিজের কিছু কবিতা প্রকাশের চেষ্টা করেছিলেন, দু-বারই ব্যর্থ হয়েছিলেন। ২০১০ সালে এলাহি মারা যাওয়ার পরে তাঁর কন্যা সালমা এলাহি তাঁর কবিতার বিপুল সংগ্রহ এবং তাঁর করা তরজমা প্রকাশের অনুমতি দেন। ইরানি প্রকাশক বিদগুল এ পর্যন্ত এলাহির কবিতার দুটি সংগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর প্রকাশ করেছে ইংরেজি, ফরাসি এবং আরবি ভাষার কবিতা থেকে এলাহির করা তরজমার আটটি সংগ্রহ এবং তাঁরই করা গদ্যের তরজমার একটি সংগ্রহ।
গত একদশকে ইরানের কবি ও কবিতাপ্রেমীদের নয়া প্রজন্মের কাছে পৌঁছে গিয়েছে এলাহির কবিতা। বহু পাঠক তাঁকে সম্মান করেন আধুনিক সুফি হিসেবে। আবার ইরানের বহু নবীন কবি ও সাহিত্য-তরজমাকার সহ অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন কবিতা ও তরজমার ক্ষেত্রে এলাহির মডানিস্ট অবস্থানে। তবে, আলিস তোয়াতিকালেহ্-র মতো অনেক সাহিত্য-সমালোচকই এলাহির প্রতি পাঠকদের এই নয়া আকর্ষণ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন। তাঁদের মতে এই টান আসলে আধুনিক ফারসি কবিতার অরাজনীতিকরণ এবং আধুনিক ফারসি কবিতা নিয়ে অতি-স্বদেশিয়ানারই পরিণাম। যাই হোক, বিজান এলাহির কাব্যিক পরম্পরা কী হবে তা নিয়ে এখনও বাক-বিতণ্ডা অব্যাহত এবং সে প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। এবং তাঁর সৃষ্টির একটি বড়ো অংশের এখনও কোনো তরজমা হয়নি। ইদানীংকালে তাঁর কবিতার তরজমার যে প্রচেষ্টা চলেছে তার একটি উদাহরণ রেবেকা রুথ এবং কাইওয়ান তহমসবিয়ান অনুদিত এলাহির নির্বাচিত কিছু কবিতার সংগ্রহ—High Tide of the Eyes: Poems by Bijan Elahi (New York: The Operating System, Glossarium: Unsilenced Texts & Modern Translations series, 2019)২।
ফারসি আধুনিক কবিতার বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বিজান এলাহির অবদান বুঝতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ইরানে ‘শেরনু’ (নয়া কবিতা) ও সাহিত্যিক মডার্নিজমের উত্থানের সময়কালের দিকে। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকেই আরবি, তুর্কি ও উর্দু কবিতার মতোই ইরানি কবিতাতেও চলছিল সেই সাহিত্যিক ও নান্দনিক পরীক্ষানিরীক্ষা যার লক্ষ ছিল ধ্রুপদি আঙ্গিক (যেমন গজ়ল, মসনবি, কাসিদা), পরম্পরাগত ছন্দ এবং প্রতিষ্ঠিত প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে কবিতার সম্পর্কের নয়া সংজ্ঞা নিরূপণ করা। কবিতার পরম্পরা পরম্পরাগত আঙ্গিক ও ছন্দের ঘাড়ে যে অপরিহার্য দায়িত্ব চাপিয়ে রেখেছিল,কাব্যিক ভাষাকে ও তার আঙ্গিকগত এবং শৈলীগত সম্ভাবনাগুলিকে আধুনিক করে তুলতে কবিদের যে শুধু সেগুলিকে ফেলে দিতে হচ্ছিল তাই নয়, তার পাশাপাশি কাব্যিক সম্পর্কের নয়া আঙ্গিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নয়া কথন-কৌশলও তৈরি করতে হচ্ছিল।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক নাগাদ নিমা ইউশিজ (যিনি আধুনিক ফারসি কবিতার জনক হিসেবে চিহ্নিত) নয়া লেখালিখি এবং কাব্যিক সম্পর্কের খোঁজে ভারতীয় ধ্রুপদি শৈলী-সহ মধ্যযুগীয় ফারসি সাহিত্যের দিকে নজর দিয়েছিলেন। সেইসময় বহু কবিই ধ্রুপদি ফারসি কাব্যিক আঙ্গিককে আর অপরিহার্য মনে করছিলেন না এবং নিমাকে অনুসরণ করে পরম্পরাগত ছন্দকে পরিবর্তিত ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
বহু পাঠকই মনে করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দশকগুলি—অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ৭০-এর দশক—ইরানের আধুনিক কবিতার স্বর্ণযুগ। সেসময়ে অসাধারণ বহু কবি কবিতার নান্দনিকতা নিয়ে তীব্র বিতর্ক তুলে নতুন নতুন সাহিত্যিক আন্দোলনের সৃষ্টি করেছিলেন। এই সময়কালেই আহমদ শামলু সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ মুক্ত ছন্দের কবিতার আঙ্গিক (ফারসিতে যা শেরসিপিদ নামে পরিচিত) সৃষ্টি করতে ব্যবহার করলেন মধ্যযুগীয় ফারসি গদ্য। ফুরুঘ ফারখজ়াদ ফারসি কবিতায় নারীদেহ, আকাঙ্ক্ষা এবং নারীর সার্বিক প্রতিনিধিত্বের উপেক্ষার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জারি করলেন শহুরে বাচনভঙ্গি, শব্দভাণ্ডার এবং শৈলীর মাধ্যমে। আবার সোহরাব সেপেহ্রি আধুনিক ফারসি কবিতায় নতুন করে চালু করলেন অতীন্দ্রিয়বাদ এবং তাঁর কবিতা থেকেই উত্থান হল এমন এক কাব্যিক কল্পনার যা মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে বৈরিতার সম্পর্কের কঠোর সমালোচক। গত শতকের ৭০-এর দশক নাগাদ সয়ীদ সোলতানপুর (১৯৪১-১৯৮১) এবং সয়ীদ ইউসেফের (জন্ম ১৯৪৮) মতো বহু কবি ইরানে শাহবংশের৩ রাজত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। এই কবিদের গেরিলা ও প্রতিরোধী কবিতার আঙ্গিকে দেখা গেল মার্কসবাদী প্রতীক ও শব্দভাণ্ডার, যা শাহ-বিরোধী গেরিলাদের জীবন ও আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করে এবং সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত।
আবার এই সময়কালেই একটি সংকীর্ণ পরিসরে শুরু হল নানা পরীক্ষানিরীক্ষায় ঋদ্ধ এমন একটি কাব্য-আন্দোলন যার প্রধান প্রতিনিধিরা হলেন ইয়াদোল্লা রোয়েয়ি (জন্ম ১৯৩২) এবং বিজান এলাহি। মধ্যযুগীয় ভারতীয় কবিতার শৈলীতে নিমা ইউশিজের আগ্রহে অনুপ্রাণিত হয়ে এই দুই কবি ফারসি সুফি সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন, বিশেষ করে পরমানন্দঘন সুফি উচ্চারণে, ফারসিতে যাকে বলে ‘শাথ’। তাঁরা বিশ্বসাহিত্যের বিষয়ে, বিশেষ করে ফরাসি সুররিয়ালিস্টদের সাহিত্যের বিষয়ে অবহিত ছিলেন। সেই বোধে সমৃদ্ধ হয়ে রোয়েয়ি এবং এলাহি চেষ্টা করছিলেন এমন কবিতা লিখতে, যে কবিতা শাথ-সাহিত্যে শব্দের বিবিধ অর্থের নানা অলৌকিক অনুষঙ্গ এবং তার মাধ্যমে সূক্ষ্ম, জটিল অন্তর্লীন ভাবের প্রকাশে অনুপ্রাণিত। এর ফলে এই দুই কবি ভাষার পরিচিত অর্থের অভ্যাস ঝেড়ে ফেলে চিত্রের নয়া অনুষঙ্গ গড়ে তুলতে সফল হচ্ছিলেন। রোয়েয়ির কবিতা জাগতিক হয়েও রহস্যাবৃত হয়ে থাকল। বিজান এলাহি নিজস্ব জীবনচর্যায় এবং নানা কাব্যিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ক্রমে সুফি অনুশীলনের কঠোর দাবিগুলির কাছে নিজেকে সমর্পণ করছিলেন। এর ফলেই তিনি সাহিত্যিক পরিমণ্ডল এবং জনজীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এলাহির কবিতা পড়তে পড়তে আমরা দেখি তাঁর কবিতা সূক্ষ্ম এবং গতিময় চিত্রে ভরপুর, যেগুলি শব্দ ও রূপকের পরম্পরাগত অনুষঙ্গের ওপর স্থিত হয়েও সেই অনুষঙ্গকে ওলট-পালট করে দেয়। মার্কিনি কবি এজরা পাউন্ডের চিনা কবিতার তরজমায় অনুপ্রাণিত হয়ে এলাহি বিপুল পরিমাণ ফরাসি ও ইংরেজি কবিতা ও গদ্য তরজমার কাজও করেছিলেন। জীবনের শেষাংশে তিনি মধ্যযুগীয় মহান অতীন্দ্রিয়বাদী মন সুরঅল-হল্লাজের আরবি কবিতা এবং প্রথম শিয়া ইমাম, ইমাম আলির কবিতা হিসেবে পরিচিত বহু কবিতার তরজমা করেছিলেন। এলাহির তরজমার তত্ত্ব প্রথমের দিকে ছিল তথাকথিত ‘বিশ্বস্ত তরজমা’-র প্রতি অনুগত। পরে তিনি পরীক্ষামূলক তরজমার দিকে অগ্রসর হন, যার ভিত্তি ছিল গূঢ় সুফি রূপক ব্যবহারে বিশ্বাসী তত্ত্ব এবং যে তরজমায় তরজমার প্রক্রিয়াটি ফুটে ওঠে টেক্সটটির আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণের পরিভাষায় ও ঐশ্বরিক জ্ঞান এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় স্থানান্তরণে।
আজকের পারসিক সমাজের হিংসাত্মক ও পরস্পরবিরোধী সামাজিক সম্পর্কগুলো চিত্রায়িত করার ক্ষেত্রে কবি হিসেবে আমার নিজের মনে হয়েছে শ্লেষাত্মক সুররিয়ালিজম বেশ কাজে লাগে। এবং সেই নিরিখে কবিতা ও তরজমার ক্ষেত্রে এলাহির অবস্থান, পদ্ধতি ও কৌশল ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে বেশ সাহায্য করেছে। প্রাত্যহিক জীবনের ভাষার অবনতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে শাথ-সাহিত্যের দিকে কীভাবে ফিরে দেখা যায়, এবং একটা গভীর অন্যায় সামাজিক জীবন কাটাতে বাধ্য হওয়া থেকে উঠে আসা নানা অদ্ভুত অন্তর্গত অনুভূতি কীভাবে প্রকাশ করা যায় তা শিখতে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি রোয়েয়ি এবং এলাহি-র প্রভাবে। মানে আমি বলতে চাইছি যে, নিজে কবি হিসেবে আমি এলাহির ক্রমবর্ধমান অধ্যাত্মীয় কাব্যিক পরম্পরায় একটা ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংযোগ ফিরিয়ে আনতে চাইছি।
সাহিত্যের তরজমাকার হিসেবে আমি অর্থ এবং তরজমাকারের মাধ্যমটারই সীমাবদ্ধতা নিয়ে ক্রমাগত লড়াই করতে থাকি। এবং সেই কারণেই আমি অনুপ্রেরণার জন্য এলাহির বহুবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়ে প্রায়শই নাড়াচাড়া করি। আমি এলাহির তিনটি কবিতার তরজমা এখানে দিলাম। এই তরজমায় আমি কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা চালাইনি। চেষ্টা করেছি মূলানুগ থাকতে। এই প্রচেষ্টা এলাহির আরও পরিণত তরজমা-তত্ত্বের সঙ্গে ততটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমি ইচ্ছে করেই তাঁর প্রথমদিকের আক্ষরিক তরজমার-নীতিতে নিজেকে সীমিত রেখেছি। প্রথম কবিতা (বর্ফ) ১৯৬৪ সালে তুরফা প্রকাশনার সাহিত্য-পত্রিকা জঙ্গ-ই-অদবি তুরফা-তে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় কবিতাদুটি এলাহির পরবর্তী জীবনের সুফিবাদ ও ইসলামি দর্শনে আকর্ষণের উদাহরণ। দ্বাদশ শতকের ইসলামি দার্শনিক শাহাবউদ্দিন সুহরাবর্দি মানুষের আধ্যাত্মিক মুক্তি-সংক্রান্ত যে প্রতীকী শাস্ত্র রচনা করেছিলেন, ‘অ্যাক্ল-ই-সুর্খ’ তৃতীয় কবিতার ‘সুর্খ অ্যাক্ল’ (লালপ্রজ্ঞান) নামটি তার প্রতি ইঙ্গিত করে। সুহরাবর্দি ‘School of Illuminationism’-এর প্রবর্তক ছিলেন।