ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রেণিচেতনাযুক্ত ধারার উদ্ভব ও বিকাশের নেপথ্যে থাকা সংগ্রামীদের মধ্যে ভগৎ সিং একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ‘ভগৎ সিং: শহিদ-এ-আজম’ বইটির লেখক তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায় খুবই সহজভাবে ভগৎ সিংয়ের জীবনের পর্যায়গুলি ব্যাখ্যা করেছেন। মূলত সাতটি অধ্যায়ে ভগৎ সিং-এর সমগ্র কর্মকাণ্ডকে বিন্যস্ত করা হয়েছে। শহিদের চরম আত্মদানের জন্য তিনি স্মরণীয়। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার দ্রুত ও বিস্ময়কর ক্রমবিকাশে ও পরিণতিমুখিনতার জন্যও। আজ একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের দোরগোড়ায় পৌঁছে ভারতে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নয়াহিন্দুত্ববাদীদের দাপটে ইতিহাস থেকে আরম্ভ করে গৃহস্থের খাদ্যতালিকা পর্যন্ত ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা চলছে ভগৎ সিংকে হিন্দু বীর হিসেবে প্রতিপন্ন করে তাঁর আত্মদানকে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি রূপে স্থাপনের। সযত্নে চাপা দেওয়া হচ্ছে তাঁর ‘কেন আমি নাস্তিক’ প্রবন্ধ। অনুল্লিখিত থাকছে তাঁর আরও দুটি লেখা—‘ধর্ম এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ আর ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও তার প্রতিকার’। আজকের জাতপাতের উৎপাত, ধর্মীয় হানাহানি-ক্লিষ্ট ভারতে ভগৎ সিংকে নিয়ে নতুনভাবে চর্চা করা খুবই প্রয়োজন। নিঃসন্দেহে এই বইটি সেই আলোচনায় একটি জরুরি সংযোজন।
আলেঁ বাদিউ থেকে ওক্তাভিও পাজ; সিগমুন্ড ফ্রয়েড থেকে ইতালো ক্যালভিনো; হার্বার্ট রিড থেকে অঁতোনা আর্তো হয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল। ‘স্ট্রবেরি জংশন’ বইটিতে উজ্জ্বল বন্দোপাধ্যায় তরজমা করেছেন এমনই দিকপাল সাতজন চিন্তকের বিভিন্ন প্রবন্ধ। আলেঁ বাদিউয়ের প্রবন্ধ সংকলন ‘দ্য এজ অফ দ্য পোয়েট্স অ্যান্ড আদার রাইটিংস’ থেকে নেওয়া হয়েছে ‘কবিতা ও সাম্যবাদ’ প্রবন্ধটি। তিনটি প্রেক্ষিতে চিত্রপরিচালক বুনুয়েলকে নিয়ে আলোচনা করেছেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক ওক্তাভিও পাজ। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী ও বিতর্কিত ভাবুক সিগমুন্ড ফ্রয়েডে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিম্স’ থেকে নেওয়া হয়েছে একটি প্রবন্ধ। আধুনিক ইতালীয় সাহিত্যের অন্যতম স্রষ্টা ইতালো ক্যালভিনো। ‘দর্শন ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে তাঁর চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। যুদ্ধপরবর্তী ইউরোপের একজন র্যাডিক্যাল নেতা এবং প্রতিস্পর্ধী চিন্তক হার্বার্ট রিড ‘পর্নোগ্রাফি’ প্রবন্ধে সেবিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণগুলি আলোচনা করেছেন। ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’-র জনক অঁতোনা আর্তোর লক্ষ্য ছিল দর্শকদের স্বাভাবিক অবস্থান থেকে সরিয়ে নিষ্ঠুরতার সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে দেওয়া। সমালোচক জর্জ ল্যব্রেত-কে লেখা তাঁর একটি চিঠির খসড়ার অনুবাদ লিপিবদ্ধ হয়েছে। বিশৃঙ্খলার ফাঁদে জড়িয়ে পড়া একজন প্রতিভাবান কবির অবসাদগ্রস্ত জীবনের সঙ্গে সান্নিধ্য খুঁজে পেয়েছিলেন আর্তো। এই চিঠির খসড়াটি তারই সাক্ষী। শেষ প্রবন্ধটি নৈরাজ্যবাদের ব্যুৎপত্তি এবং রুশ নৈরাজ্যবাদী বাকুনিনকে নিয়ে। আললোনা করেছেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ও তার্কিক বার্ট্রান্ড রাসেল। সব মিলিয়ে, একাধারে মার্কসবাদ, মনস্তত্ত্ব থেকে শুরু করে কবিতার সম্ভাবনা অথবা সিনেমার অন্তর্ঘাত বহু কিছুই এসেছে এই দুমলাটের মধ্যে।
সুপ্রকাশ প্রকাশনীর উদ্যোগে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে আঞ্চলিক সংস্কৃতিচর্চার গ্রন্থমালা সিরিজ।‘শিলাবতী উপত্যকার লোকায়ত প্রত্নজীবন’ বইটি এই তালিকায় নবতম সংযোজন। বইটির লেখক রামামৃত সিংহ মহাপাত্র এই গ্রন্থে আলোচনা করেছেন শিলাবতী নদী এবং তার বিস্তীর্ণ উপত্যকা জুড়ে গড়ে ওঠা নদীমাতৃক সভ্যতার লোকায়ত প্রত্নজীবন। প্রাঞ্জলভাবে আলোচনা। ভৌগোলিক ভাবে এই নদী পুরুলিয়া জেলায় উৎপত্তি লাভ করে বাঁকুড়া জেলা হয়ে প্রবেশ করেছে মেদিনীপুরে, তারপর গড়বেতা পেরিয়ে ঘাটালের কিছু আগে মিলিত হয়েছে দ্বারকেশ্বর নদীর সাথে। গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র গনগনি এই নদীর গতিপথেই অবস্থিত। শিলাবতী নদীউপত্যকার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নপ্রমাণগুলি উপস্থাপিত করে লেখক এই অঞ্চলের ভূমিজ মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরেছেন। বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবী এই উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। সাধারণত এইসমস্ত দেবদেবীর কোনো মূর্তি নেই। সর্বত্রই তাঁরা পূজা পান পোড়ামাটির হাতি বা ঘোড়ার প্রতীকে, পাথরখণ্ডে কিংবা মাটির ঢেলায়। এরকম বেশ কিছু দেবদেবীর ছবি এ বইয়ের শেষে দেওয়া আছে। শিলাবতী উপত্যকায় প্রাপ্ত জৈনধর্মের নিদর্শনগুলিও আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বইয়ের অধ্যায়গুলি খুব দীর্ঘ নয়। সব মিলিয়ে বিষয়বৈচিত্র্যে অভিনব এ বই শেষ পর্যন্ত পাঠকের কৌতূহল জিইয়ে রাখে।
গত শতাব্দীর সাতের দশকের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসে রাজনীতি এসেছে এক ভিন্ন আঙ্গিকে। ‘মাধবীলতা’ খেটে-খাওয়া মানুষের গল্প নিয়ে তৈরি এক আখ্যান। দেড়শো বিঘে জমির মালিক রুহিতাস্য নস্করের দাদাগিরিতে তিতিবিরক্ত মাধবীলতা গ্রামের মানুষ। গ্রামেরই মেয়ে চিত্রা অল্প বয়সে বিধবা হয়ে শহরের বড়ো উকিল কেশবের সঙ্গে এক অন্য ভালোবাসায় বাঁচে। মানিক, তারকের মতো ছেলেরা ভাগ্যের সন্ধানে এসে পৌঁছোয় শহর কলকাতায়। উদাসী স্বভাবের কথকতা করা হারানও সময়ের ফেরে হয়ে যায় খুনের ষড়যন্ত্রী। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও শ্রীনাথের সঙ্গে লক্ষ্মীবউদির প্রেমের পরিণতি ঘটে করুণভাবে। খিদিরপুর ডকে দুটো খুনের অপরাধে পালিয়ে বেড়ানো তারক আশ্রয় নেয় চরশম্ভু শ্মশানে। অন্যদিকে মালতি ক্রমশ তারকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এক উদ্দাম শরীরী প্রেমের সম্পর্কে। গ্রামকে ভালোবেসে ফিরে আসে সুধীর, নিরূপদ্রবে শালতি বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। তবু একদিন প্রতিবাদ হয়। মাধবীলতা গ্রামে তার প্রতিফলন ঘটে, অন্যরকম ভাবে। ভাগ্যের ফেরে হঠাৎই মারা যায় রুহিতাস্য নস্কর। বন্যায় মাঠের ধান হেজে মজে গেলেও মাধবীলতা গ্রামে নবান্ন আসে উৎসব হয়ে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত উঠে দাঁড়ায় তারক, শ্রীনাথ, হারান, সুবলের মা-সহ গোটা মাধবীলতা। শুধু একটা গ্রামের নাম নয়, মাধবীলতা হয়ে ওঠে এক বিশ্বাসের নাম।
নয়ের দশকের কবি রাজীব সিংহের লেখা সাতটি প্রবন্ধের সংকলন—অবদমনের সাহিত্য, সাহিত্যের অবদমন। সাহিত্যে তথা কবিতায় অন্তর্নিহিত থাকা শূন্যতা আবার উপন্যাস বা গল্পে তৈরি হওয়া একধরনের কুহক যা পাঠককে যুগপৎ উৎসুক ও কৌতূহলী করে তোলে; শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, অরুণেশ ঘোষ প্রমুখ কবির কবিতা প্রসঙ্গে আলোচনায় এই বিষয়গুলির সন্ধান করেছেন লেখক। নবনীতা দেব সেনের প্রথম উপন্যাসের সূত্রে আসে বর্জন বা এলিয়েনেশন, যা নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর উপন্যাস হারবার্ট-এ হাতিয়ার করেন। আবার কলকাতায় কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের আসা এবং তৎকালীন সময়ে নতুন ধারার কাব্য আন্দোলনের সূত্রে এসেছে মলয় রায়চৌধুরী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়দের কথা। প্রচলিত রীতি অস্বীকার করে নতুন পথের সন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা একধরনের নির্জনতার শরিক হয়ে পড়েন। সাম্প্রতিক সময়ের নারীরাও কবিতা লিখেছেন যে-কোনো ধরনের অবদমনের বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে কবিতা সিংহ-সংযুক্তা-মল্লিকা থেকে শুরু করে যশোধরা-তানিয়া-বেবী-সহ বেশ কিছু কবির লেখা কবিতা উদ্ধৃত করে এইসময়ের এক অদ্ভুত টানাপোড়েনকে চিহ্নিত করেছেন প্রাবন্ধিক। এই বইয়ের সাতটি প্রবন্ধে রাজীব সাহিত্যের নানা অবদমিত দিকগুলি আলোচনার মাধ্যমে উসকে দিতে চেয়েছেন এক চিরকালীন বিতর্ক।